আমরা যারা পরজন্মে বিশ্বাস করি আমাদের জীবনকে দেখার ধরণ আর যাঁরা মনে করেন একটাই জীবন, যাপনের বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা মূল পার্থক্য হলো সংরক্ষণ এবং সর্বভুখের মধ্যে যে পার্থক্য - তাই। আমাদের বোধে আত্মাই প্রাধান আর শরীর তাঁর একটি বাহন মাত্র আর উল্টোদিকে শরীরই প্ৰধান, soul incidental, যাকে মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যেহেতু সামাজিক বিশ্বাসের সাথে অর্থনীতি সরাসরি জড়িত, তাই যে সমাজ পরজন্মে বিশ্বাসী তার ভোগস্পৃহা আর যে সমাজ শরীরভিত্তিক individualismএ বিশ্বাসী, তার ভোগস্পৃহা এক হতে পারে না। এই যে দুই চিন্তাধারার মধ্যে gap, এটা ভারতের সনাতন সংস্কৃতির অনুসারী মূলত গ্রাম্য নাগরিক এবং Western consumerism এর শিকার শহুরে এবং আধা-শহুরে নাগরিকদের মধ্যে দিনকেদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ভারত কোন রাস্তায় হাঁটবে সেই নির্ণয় এবার তাকে নিতেই হবে। হয় আমরা স্বধর্মরক্ষার্থে কাজ করবো নয় কেবল শরীররূপী 'আমার' ফুর্তির জন্য কাজ করবো, আর এই দুই approach এর ফল সম্পূর্ণভাবে আলাদা হতে বাধ্য।
যে ভাবধারা rank consumerismএর জন্ম দেয়, সেই ভাবধারাই জন্মের হার কমাতে কমাতে জাপান বা স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলিকে বিলুপ্তির দিকেও ঠেলে দেয়। আবার এই ভাবধারাই অন্য এক রূপে one child policy রূপে একনায়কতন্ত্রের অভিশাপ হয়ে চিনের মতন দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দেয়, যেখানে একজন যুবকের ওপর এক জোড়া বাবা মা এবং দুই জোড়া দাদু দিদা ভরণপোষণের জন্য নির্ভর করতে বাধ্য হন। আমাদের দেশেও শহুরে শিক্ষিত elite সেই দিকেই এগোচ্ছেন আর তাঁদের দেখাদেখি একদিকে যেমন গ্রামের দিকেও বাচ্চার জন্মহার প্রতিনিয়ত কমছে, তেমন অন্যদিকে দেশে longivity বেড়ে যাওয়ায় ফলে আর ষাট সত্তর বছরের মধ্যে আমাদের সমাজের দশাও আজ থেকে ত্রিশ বছর পরের চিনের মতন বৃদ্ধপ্রধান হয়ে যাবে।
আমাদের একটাই জীবন, ফলে যা কিছু উপভোগ করার তা এই একটাই জীবনে সেরে ফেলতে হবে। যে যে কারণে আমাদের lifestyleকে compromise করতে হতে পারে, তা সে গার্হস্থ্য জীবন শুরু করার বয়স হোক, বিয়ের পর সন্তান ধরণের বয়স হোক, সন্তানের সংখ্যা হোক, একান্নবর্তী পরিবারে মানিয়ে চলাকে অস্বীকার করা হোক, মানুষকে সাহায্য করা হোক, সামাজিক কাজে সময় ব্যয় করা হোক বা মা হিসেবে যথাযতভাবে নারীর ভূমিকাপালনই হোক, সেসব কি আর আমরা করতে ইচ্ছুক? আমার মনে আছে আমাদের যখন প্রথম সন্তান এলো আমার স্ত্রীর কাছে option ছিল একজন আয়ার কাছে সন্তানকে গচ্ছিত রেখে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তিনি তা করেননি। সেই যে তিনি নিজের আর্থিক আত্মনির্ভরতাকে তাকে তুলে রেখে মায়ের ভূমিকা পালন করতে নামলেন, সোজা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রাইমারি স্কুলে না যাওয়া পর্য্যন্ত আর চাকরিতে ফিরে গেলেন না। তাতে ওঁর seniority loss তো হলোই, বিস্তর আর্থিক ক্ষতিও হলো কিন্তু তাঁর কাছে মাতৃত্বের দায়িত্বপালন priority ছিল। তাঁর সেই ত্যাগের ফল আজ সুস্পষ্ট - যাঁরা আমাদের দুই পুত্রকে জানেন তাঁরা বুঝতে পারবেন।
মূল বিষয় হলো এই পাকা বিশ্বাস যে আমাদের কখনোই ধর্মপথ থেকে সরলে চলবে না। সনাতন সংস্কৃতিতে সংসারে যে চারটি আশ্রম আছে, তার প্রত্যেকটির নিজস্ব ধর্ম আছে এবং আমাদের যদি আখেরে কোনো এক জন্মে মোক্ষলাভ করতে হয় তাহলে প্রতিটি আশ্রমে ধর্মত আমাদের যা ভূমিকা, তা পালন করতেই হবে। আমাদের তো আর একটা জন্ম নয় যে লালায়িত হয়ে আমরা ধর্মভ্রষ্ট হলাম তবু তার কর্মফল পরের জন্মে আর আমাদের ভুগতে হবে না - ভুগতেই হবে। সন্তান হলে তার পেছনে খরচ বাড়বেই, তাকে সময়ও দিতে হবে - দুটোই বাপ-মায়ের ভাগ থেকে যাবে কিন্তু এটাই গৃহস্থ হিসেবে আমাদের কর্তব্য। এটা না হলে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের পুনর্বার জন্ম দেওয়ারও কেউ থাকবে না। কেন আবার জন্মাতে হবে? কারণ আমাদের জীবনের লক্ষ্য ক্যাবারে দেখে হাততালি দেওয়া নয়, জীবনের লক্ষ্য হলো স্বরূপদর্শন। একমাত্র সেটি হলেই এই জন্ম মৃত্যুর cycle থেকে আমরা চিরতরে মুক্তি পাবো।
মাঝেমাঝেই আক্ষেপ শুনি যে আমাদের দেশেই একশ্রেণীর মানুষ পিলপিল করে বাড়ছে, না আছে তাদের পরিবার প্রতিপালন করার সামর্থ, না আছে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার ভাবনা আর না আছে পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিবোধ। নেহাত পাশবিক নিয়মে এবং অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভর করে তারা সংখ্যায় বেড়ে চলেছে, একমাত্র destructive ছাড়া বেশিরভাগই সমাজে কোনো সদর্থক ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। এইখানে ধর্মবোধহীনতা এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতি জড়িয়ে পড়ে। ব্রহ্মচর্য শেষ না করে, উপার্জনক্ষম না হয়ে, গার্হস্থ্য জীবনের দায়িত্ব নেওয়া চরম অধর্ম। আর নিজের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের দুটি কচি হাতকে বড়দের গ্রাচ্ছাসাধনের স্বার্থে ব্যবহার করা হলো মহাপাপ। ভারতীয় পরম্পরায় গরিব কৃষকের ছেলেমেয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও গ্রামের পাঠশালায় পন্ডিত মশাইয়ের কাছে পড়তে যেত, বাপ যত গরিবই হোক সন্তানকে অর্থের বিনিময়ে child labour হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারতেন না। এই খেতে দেওয়ার ক্ষমতা নেই কিন্তু ফৌজ খাড়া হয়ে যাচ্ছে - এ সনাতন সংস্কৃতি নয়, পরজন্মহীনতার বেপরোয়া মনোভাব থেকে উদ্ভূত এক অধর্ম। এর প্রতিকার এবং productive population growthকে encourage করার উপায় ভারতকে খুঁজে বের করতেই হবে।
No comments:
Post a Comment