Wednesday, February 16, 2022

শ্রীরামকৃষ্ণের কুকুর

স্বামী ধর্মেশানন্দজীর স্মৃতিচারণায় দেখছি রামকৃষ্ণ মিশনের দ্বিতীয় সঙ্ঘাধ্যক্ষ পরম পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজ ভাবের ঘোরে নিজেকে ঠাকুরের কুকুর বলে বর্ণনা করছেন। ওনাকে ইংরেজিতে পূজ্যপাদ মহারাজ বলছেন, "I am Thakur's dog, my Master's dog....Lying at my Master's door, I safeguard his wealth and his Monastic Order." মহারাজ বলছেন তাঁর কাজ হচ্ছে ঠাকুরের ধনসম্পত্তি আর ঠাকুরের সঙ্ঘকে রক্ষা করা। এই কথাগুলো খুবই গভীর। উনি যখন সঙ্ঘাধ্যক্ষ, তখন সঙ্ঘের ভার অবশ্যই তাঁর ওপরে, এবং তিনিই সশরীরে ঠাকুরের প্রতিনিধি, তাঁর মধ্যেই ঠাকুরের সাক্ষাৎ প্রকাশ। কিন্তু অন্য বিষয়টি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ঠাকুর তো ফকির মানুষ, ওঁর আবার জাগতিক সম্পত্তি কোথায়? আর তাঁর যিনি সাক্ষাৎ সন্তান, তাঁরই নিজের হাতে গড়া প্রিয় পার্ষদ, যিনি নিজে একজন আত্মবোধসম্পন্ন সর্বত্যাগী ঈশ্বরকোটির সন্ন্যাসী - তিনি কি আর রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পত্তি আগলে রাখার মতন বৈষয়িক কথা বলবেন?


এখানে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য - কুকুর আর সম্পত্তি। কুকুর কেন? কারণ মালিক তাকে খেদিয়ে দিতে চাইলেও সে কখনো মালিককে ছেড়ে যায়না, তাঁর দোরগোড়াতেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। আমেরিকায় কত দেখেছি, মালিক হয়তো বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেছেন বা স্বামী স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়ে ঘর ভেঙে গেছে, অমানুষের মতন পোষ্য কুকুরটিকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তারা যে যার মতন অন্যত্র চলে গেছেন, কুকুরটি কিন্ত অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় ওই বাড়ির কাছেই সারাদিনরাত বসে আছে, এই আশায় যে প্রভু কোনোদিন হয়তো ফিরে আসবেন। লোমে জট পড়ে গেছে, গায়ে পোকা হয়ে গেছে, তবু সে নড়বে না, যাকে বলে একেবারে শবরীর প্রতীক্ষা। এই যে প্রভুর প্রতি বিশ্বাস, এই নির্ভরতা, এই অসীম ভালোবাসা আর এই প্রত্যয়, এটাই একজন ভক্তের আসল চিহ্ন। পোষ্য কুকুরের ভাব হলো complete surrender, dedication and loyalty, সম্পুর্ন আত্মসমর্পণ, আত্মোৎসর্গ আর আনুগত্য, যেখানে ভক্তি দিয়ে, সেবা দিয়ে, প্রভুর ভালোবাসা জিতে নেওয়ার প্রয়াসটাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই ভাবটাই নারদীয় ভক্তির ভাব, যা রবীন্দ্রনাথের গানে বড় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে:

নাই বা ডাক, রইব তোমার দ্বারে;

মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে।

বসব তোমার পথের ধুলার 'পরে

এড়িয়ে আমায় চলবে কেমন করে?


এবার ঠাকুরের সম্পত্তির কথা। ওমনি তো গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডের উনিই কর্তা কিন্তু অবতাররূপে জীবের কাছে ওঁর গচ্ছিত সম্পত্তি হলো জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক আর বৈরাগ্য, অর্থাৎ knowledge, devotion, discrimination and renunciation. উনি এই সম্পত্তিই সশরীরে নিজের ক্ষেত্রে বেছে বেছে আর শ্রীশ্রীমায়ের মাধ্যমে অকাতরে বিলোতে এসেছিলেন, এবং এত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া স্বত্তেও তা এখনো যেমন কে তেমন অক্ষুন্ন আছে, দৈবী ঐশ্বর্যের একটুও ঘাটতি হয়নি। এই সম্পত্তি হলো শাশ্বত, নিত্য বা সত্য - এ হলো আত্মা আর পরমাত্মার মধ্যে যোগাযোগের সনাতন বিদ্যা, যা যুগে যুগে অবতারেরা বিলোতে আসেন। উপনিষদ বলছেন, 

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

অর্থাৎ, পরব্রহ্ম পূর্ণ, নামরূপ ব্রহ্মও পূর্ণ; পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্গত হন; পূর্ণের পূর্ণত্ব বিদ্যার সাহায্যে গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্মই) অবশিষ্ট থাকেন। 

নিশ্চয় স্বরণে থাকবে যে একদিন সন্ধ্যায় দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিনীর কাছে সদ্যপিতৃহারা, প্রচন্ড অর্থকষ্টে জর্জরিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত জাগতিক স্বস্তি চাইতে গিয়ে বিফল হয়ে বারবার তিনবার কি বর চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দ সেদিন মহামায়াকে বলেছিলেন, "মা, জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, বিবেক দাও আর ভক্তি দাও মা; সদাই যেন তােমায় দেখতে পাই মা।" এটা ওঁর গুরুরই কথা, দৈবসংযোগে সেদিন ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল। মানুষ যাতে আধার অনুসারে ঠাকুরের এই সম্পত্তির খানিকটা হলেও ছোঁয়া পায়, এটা নিশ্চিত করাই সঙ্ঘগুরুর মূল দায়িত্ব, এই কথাটাই পূজ্যপাদ মহাপুরুষ মহারাজ বোঝাতে চেয়েছেন।


ঠাকুর স্বয়ং জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক আর বৈরাগ্য সম্পর্কে কি বলছেন, একবার দেখে নেওয়া যাক। ৩০শে জুন ১৮৮৪, দক্ষিনেশ্বরে ভক্তদের বলছেন, “শুধু জ্ঞানী একঘেয়ে, — কেবল বিচার কচ্চে ‘এ নয় এ নয়, — এ-সব স্বপ্নবৎ।’ আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই সব লই"। কিছুক্ষন পর বলছেন, “সংসারীর জ্ঞান আর সর্বত্যাগীর জ্ঞান — অনেক তফাত। সংসারীর জ্ঞান — দীপের আলোর ন্যায় ঘরের ভিতরটি আলো হয়, — নিজের দেহ ঘরকন্না ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে না। সর্বত্যাগীর জ্ঞান, সূর্যের আলোর ন্যায়। সে আলোতে ঘরের ভিতর বা’র সব দেখা যায়। চৈতন্যদেবের জ্ঞান সৌরজ্ঞান — জ্ঞানসূর্যের আলো! আবার তাঁর ভিতর ভক্তিচন্দ্রের শীতল আলোও ছিল। ব্রহ্মজ্ঞান, ভক্তিপ্রেম, দুইই ছিল।”

২২শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫, দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের জন্মোৎসব পালনের দিনে জ্ঞানের বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, “আর একটি কথা — জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও। অনেকে বলে অমুক বড় জ্ঞানী, বস্তুতঃ তা নয়। বশিষ্ঠ এত বড় জ্ঞানী, পুত্রশোকে অস্থির হয়েছিল; তখন লক্ষ্মণ বললেন, ‘রাম এ কি আশ্চর্য! ইনিও এত শোকার্ত!’ রাম বললেন — ভাই, যার জ্ঞান আছে, তার অজ্ঞানও আছে; যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে; যার ভালবোধ আছে, তার মন্দবোধও আছে; যার সুখবোধ আছে, তার দুঃখবোধও আছে। ভাই, তুমি দুই-এর পারে যাও, সুখ-দুঃখের পারে যাও, জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যাও। তাই বলছি, জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও।”


আবার ওইদিনই গিরিশ ঘোষকে ভক্তির বিষয়ে ঠাকুর বলছেন, “ভক্তিই সার। সকাম ভক্তিও আছে, আবার নিষ্কাম ভক্তি, শুদ্ধাভক্তি, অহেতুকী ভক্তি এও আছে। কেশব সেন ওরা অহেতুকী ভক্তি জানত না; কোন কামনা নাই, কেবল ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি। আবার আছে, ঊর্জিতা ভক্তি। ভক্তি যেন উথলে পড়ছে। ‘ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।’ যেমন চৈতন্যদেবের। রাম বললেন লক্ষ্মণকে, ভাই যেখানে দেখবে ঊর্জিতা ভক্তি, সেইখানে জানবে আমি স্বয়ং বর্তমান।”

এর আগে অবশ্য কথামৃতে ১৪ই ডিসেম্বর ১৮৮২ সালে আমরা ঠাকুরকে বলতে শুনি, "কিন্তু ভক্তি অমনি করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। প্রেমাভক্তি না হলে ইশ্বরলাভ হয় না। প্রেমাভক্তির আর একটি নাম রাগভক্তি। প্রেম, অনুরাগ না হলে ভগবানলাভ হয় না ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না এলে তাঁকে লাভ করা যায় না।

“যতক্ষণ না তাঁর উপর ভালবাসা জন্মায় ততক্ষণ ভক্তি কাঁচা ভক্তি। তাঁর উপর ভালবাসা এলে, তখন সেই ভক্তির নাম পাকা ভক্তি।

“যাঁর কাঁচা ভক্তি, সে ঈশ্বরের কথা, উপদেশ, ধারণা করতে পারে না। পাকা ভক্তি হলে ধারণা করতে পারে। ফটোগ্রাফের কাচে যদি কালি (Silver Nitrate) মাখানো থাকে, তাহলে যা ছবি পড়ে তা রয়ে যায়। কিন্তু শুধু কাচের উপর হাজার ছবি পড়ুক একটাও থাকেনা — একটু সরে গেলেই, যেমন কাচ তেমনি কাচ। ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না থাকলে উপদেশ ধারণা হয় না।”

বিজয় — মহাশয়, ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে, তাঁকে দর্শন করতে গেলে ভক্তি হলেই হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ভক্তি দ্বারাই তাঁকে দর্শন হয়, কিন্তু পাকা ভক্তি, প্রেমাভক্তি, রাগভক্তি চাই। সেই ভক্তি এলেই তাঁর উপর ভালবাসা আসে। যেমন ছেলের মার উপর ভালবাসা, মার ছেলের উপর ভালবাসা, স্ত্রীর স্বামীর উপর ভালবাসা।

“এ-ভালবাসা, এ-রাগভক্তি এলে স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-কুটুম্বের উপর সে মায়ার টান থাকে না। দয়া থাকে। সংসার বিদেশ বোধ হয়, একটি কর্মভূমি মাত্র বোধ হয়। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিন্তু কলকাতা কর্মভূমি; কলকাতায় বাসা করে থাকতে হয়, কর্ম করবার জন্য। ঈশ্বরে ভালবাসা এলে সংসারাসক্তি — বিষয়বুদ্ধি — একেবারে যাবে।"


বিবেক মানে সত্য আর মিথ্যা, নিত্য আর অনিত্যের মধ্যে বিচার করার ক্ষমতা। ১৮৮২ সালের মার্চ মাসে দক্ষিনেশ্বরে মাষ্টারমশাইকে ঠাকুর বলছেন, "... বিচার করা খুব দরকার। কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, থাকবার জায়গা হয় — এই পর্যন্ত। ভগবানলাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না — এর নাম বিচার, বুঝেছ?

মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ; প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক আমি সম্প্রতি পড়েছি, তাতে আছে ‘বস্তুবিচার’ ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, বস্তুবিচার! এই দেখ, টাকাতেই বা কি আছে, আর সুন্দর দেহেই বা কি আছে! বিচার কর, সুন্দরীর দেহেতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি, মল, মূত্র — এই সব আছে। এই সব বস্তুতে মানুষ ঈশ্বরকে ছেড়ে কেন মন দেয়? কেন ঈশ্বরকে ভুলে যায়?" 

এই বিবেক সংক্রান্ত প্রসঙ্গেই ঠাকুর ১লা জানুয়ারি ১৮৮৩, দক্ষিনেশ্বরে মারোয়াড়ী ভক্তেদের প্রশ্নের উত্তরে বলছেন,

“(ঈশ্বরলাভের উপায়) সৎ-অসৎ বিচার। একমাত্র সৎ বা নিত্যবস্তু ঈশ্বর, আর সমস্ত অসৎ বা অনিত্য। বাজিকরই সত্য, ভেলকি মিথ্যা। এইটি বিচার।

বিবেক আর বৈরাগ্য। এই সৎ-অসৎ বিচারের নাম বিবেক। বৈরাগ্য অর্থাৎ সংসারের দ্রব্যের উপর বিরক্তি। এটি একবারে হয় না। — রোজ অভ্যাস করতে হয়। — তারপর তাঁর ইচ্ছায় মনের ত্যাগও করতে হয়, বাহিরের ত্যাগও করতে হয়। কলকাতার লোকদের বলবার জো নাই ‘ঈশ্বরের জন্য সব ত্যাগ কর’ — বলতে হয় ‘মনে ত্যাগ কর।’

অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে — কাম, ক্রোধ বশ করতে — কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির করে না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।”


তাহলে বৈরাগ্য কি বিরক্তি থেকেই উৎপন্ন হয়? সিঁথির ব্রাহ্মসমাজের ষান্মাসিক মহোৎসব, চৈত্র পূর্ণিমা (১০ই বৈশাখ, রবিবার), ২২শে এপ্রিল, ১৮৮৩; একজন ব্রাহ্ম ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বলছেন, 

ব্রাহ্মভক্ত — বৈরাগ্য কি করে হয়? আর সকলের হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগের শান্তি না হলে বৈরাগ্য হয় না। ছোট ছেলেকে খাবার আর পুতুল দিয়ে বেশ ভুলানো যায়। কিন্তু যখন খাওয়া হয়ে গেল, আর পুতুল নিয়ে খেলা হয়ে গেল, তখন “মা যাব” বলে। মার কাছে নিয়ে না গেলে পুতুল ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে কাঁদে।"

এর আগে ১৮৮২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঠাকুর ভক্ত বিজয় গোস্বামীকে একটি চমৎকার গল্পের মাধ্যমে তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দ বৈরাগ্যের পার্থক্যও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

“তীব্র বৈরাগ্য কাকে বলে, একটি গল্প শোন। এক দেশে অনাবৃষ্টি হয়েছে। চাষীরা সব খানা কেটে দূর থেকে জল আনছে। একজন চাষার খুব রোখ আছে; সে একদিন প্রতিজ্ঞা করলে যতক্ষণ না জল আসে, খানার সঙ্গে আর নদীর সঙ্গে এক হয়, ততক্ষণ খানা খুঁড়ে যাবে। এদিকে স্নান করবার বেলা হল। গৃহিণী মেয়ের হাতে তেল পাঠিয়ে দিল। মেয়ে বললে, ‘বাবা! বেলা হয়েছে, তেল মেখে নেয়ে ফেল।’ সে বললে, ‘তুই যা আমার এখন কাজ আছে।’ বেলা দুই প্রহর একটা হল, তখনও চাষা মাঠে কাজ করছে। স্নান করার নামটি নাই। তার স্ত্রী তখন মাঠে এসে বললে, ‘এখনও নাও নাই কেন? ভাত জুড়িয়ে গেল, তোমার যে সবই বাড়াবাড়ি! না হয় কাল করবে, কি খেয়ে-দেয়েই করবে।’ গালাগালি দিয়ে চাষা কোদাল হাতে করে তাড়া করলে; আর বললে, ‘তোর আক্কেল নেই? বৃষ্টি হয় নাই। চাষবাস কিছুই হল না, এবার ছেলেপুলে কি খাবে? না খেয়ে সব মারা যাবি! আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, মাঠে আজ জল আনব তবে আজ নাওয়া-খাওয়ার কথা কবো।’ স্ত্রী গতিক দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। চাষা সমস্ত দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যার সময় খানার সঙ্গে নদীর যোগ করে দিলে। তখন একধারে বসে দেখতে লাগল যে, নদীর জল মাঠে কুলকুল করে আসছে। তার মন তখন শান্ত আর আনন্দে পূর্ণ হল। বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললে, ‘নে এখন তেল দে আর একটু তামাক সাজ।’ তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে নেয়ে খেয়ে সুখে ভোঁসভোঁস করে নিদ্রা যেতে লাগল! এই রোখ তীব্র বৈরাগ্যের উপমা।

“আর একজন চাষা— সেও মাঠে জল আনছিল। তার স্ত্রী যখন গেল আর বললে, ‘অনেক বেলা হয়েছে এখন এস, এত বাড়াবাড়িতে কাজ নাই।’ তখন সে বেশি উচ্চবাচ্য না করে কোদাল রেখে স্ত্রীকে বললে, ‘তুই যখন বলছিস তো চল!’ (সকলের হাস্য) সে চাষার আর মাঠে জল আনা হল না। এটি মন্দ বৈরাগ্যের উপমা। 

“খুব রোখ না হলে, চাষার যেমন মাঠে জল আসে না, সেইরূপ মানুষের ঈশ্বরলাভ হয় না।”

Sunday, February 13, 2022

শ্রীশ্রীমায়ের স্বরূপ

শ্রীশ্রীমায়ের স্তবের দ্বিতীয় স্তবকে পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী অভেদানন্দজী মহারাজ লিখেছেন,

গুণহীন সুতান পরাধ যুতান্ ,

কৃপয়াহদ্য সমুদ্ধর মোহ গতান্ ।

তরণীং ভবসাগর পারকরীং ,

প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্ ।। 


অর্থাৎ, মা আপনি কৃপা করে এই গুণহীন সন্তানকে মায়া-মোহ হতে উদ্ধার করুন এবং এই সংসার সাগরে আমার জীবনতরণী পার করুন। আপনি পরমা জগজ্জননী – আপনাকে প্রণাম করি।


কারো কারো মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে শ্রীশ্রীমায়ের তো রক্ত মাংসের শরীর, তাহলে তিনি জগজ্জননী পরব্রহ্মময়ী হন কি ভাবে? মা নিজের স্বরূপকে এতটাই যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন যে ওঁর দেহধারণকালে এই বিভ্রান্তি আরো বেশি সৃষ্টি হতো, এখন বরং কিছুটা কম হয়।


শাস্ত্রে দেবী দুর্গার নামের বর্ণনা এইভাবে করা হয়েছে:

দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।

উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।

রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।

ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।


অর্থাৎ, "দ" অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, "গ" অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪)। এখানে দৈত্য অর্থে কেবল দিতি+য, দিতির (কশ্যপ পত্নী) পুত্র নয়, খারাপ লোক, মানবজন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে যে বাধা দেয়, সেই অসুর প্রকৃতির ব্যক্তি।


দশপ্রহরণধারিনি দুর্গারূপে ভগবতী দেবী পার্বতী দুর্গমনাশিনী। দেবী দুর্গার আর এক রূপ হলো জগতের ধাত্রী অর্থাৎ জগতের পালিকা, দেবী জগদ্ধাত্রী। একই শক্তি, কেবল একজন নাশিনীরূপা আর অন্যজন পালিনীরূপা। তাই জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- “জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে/জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।” দেবী হলেন সচ্চিদানন্দের এক এবং অভিন্ন শক্তিরূপ, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথায়, যেমন আগুন আর তার দহিকাশক্তি, যেমন সমুদ্র আর তার ঢেউ।


আদি শঙ্করাচার্য্যের টীকা অনুসারে (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী তপস্যানন্দের অনুবাদ) "রাম" শব্দের অর্থ হলো যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু, যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। আবার সন্ত কবিরদাস তাঁর দোহায় চার রকমের রামের কথা বলেছেন "এক রাম দশরথ কা বেটা, এক রাম ঘট ঘট মে বৈঠা; এক রাম কা সফল পাসারা, এক রাম হ্যায় সবসে ন্যায়ারা।"


মানে একজন রাম যিনি দশরথ পুত্র অর্থাৎ রাজা, যাঁকে আমরা "মর্যাদা পুরুষোত্তম" বলি, অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ"। দ্বিতীয় রাম যিনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছেন অর্থাৎ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৃতীয় রাম যিনি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডময় প্রসারিত অর্থাৎ স্রষ্টা। আর চতুর্থ রাম যিনি সবচেয়ে অপূর্ব এবং আশ্চর্যময় অর্থাৎ যিনি সমস্ত কল্পনার অতীত সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম।


রামবতারে শক্তিরূপিণী জগজ্জননী হলেন সীতাদেবী। মা লক্ষ্মীর অপর নাম শ্রী। শ্রীবিষ্ণু, শ্রীরাম আর সীতারাম বা সিয়ারাম তাই একই। অর্থাৎ যুগলে কমলাসীনা লক্ষ্মী আর যোগনিদ্রারত বিষ্ণু, ব্রহ্মের স্বগুণ রূপ আর নির্গুণ রূপ। বিভিন্ন শব্দবন্ধে ওঁদের জয়ধ্বনিও ওই একই যুগলের জয়ধ্বনি, কোনো পার্থক্য নেই। যাহা জয় শ্রীরাম তাহাই জয় সিয়ারাম। মূলত মা দুর্গা এবং শ্রীরাম একই আদিশক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ, যিনি যে ভাবে দেখতে চান, দেখতে পারেন।


বিষ্ণুপুরাণ বলছেন পরমাত্মা শ্রীবিষ্ণুই হচ্ছেন একমাত্র পুরুষ, আর সবই প্রকৃতি। শ্রীরামের পরবর্তী অবতারে শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিষ্ণু বা পরমাত্মার প্রতীক আর শক্তিরূপিণী শ্রীমতি রাধারানী হলেন সকল জীবাত্মার প্রতীক। তাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার প্রণয়াসক্তি পরমাত্মা-জীবাত্মার শাশ্বত মিলনাসক্তিরই নামান্তর, অর্থাৎ পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণ। এটাই রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বের মূল কথা এবং ভারতীয় দর্শনেরও সারাৎসারও বটে। 


রাজা বৃষভানু শ্রীরাধাস্তুতিতে বলছেন, "হে বিশ্বেশ্বরী, বিশ্বেশ্বর পূজিতা, তোমার পাদপদ্মে আমি প্রনত হই। ব্রহ্মা, হরি, শিব, ইন্দ্র, সব তোমারই অনন্তরূপ। তুমি ভিন্ন জগতে আর অন্য ধেয় নেই। জগত ভ্রান্তি মাত্র। হে মাতঃ, কৃপা করে আমাকে নিজ দাস জেনে অনুগ্রহ করো।" এখানেও পুরুষ এবং প্রকৃতির সেই এক এবং অভিন্ন স্বত্তার কথাই বর্ণনা করা হয়েছে।


আমাদের যুগে শ্রীবিষ্ণুর নবীনতম অবতার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ঠাকুর যখন ক্যানসার রোগে যন্ত্রণায় অস্থির, ভাতের তরল মণ্ড পর্যন্ত গলাধঃকরণ হচ্ছে না, তখন একদিন নরেন্দ্রনাথ দত্ত ঠাকুরের কাছে বসে ভাবছেন, 'এই যন্ত্রণামধ্যে যদি বলেন যে, আমি সেই ঈশ্বরের অবতার তাহলে বিশ্বাস হয়'। চকিতের মধ্যে ঠাকুর বললেন, “যে রাম যে কৃষ্ণ, ইদানিং সে-ই রামকৃষ্ণরূপে ভক্তের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।” 


কথামৃতে দেখি যে এই ঘটনারও বছরখানেক আগে, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা-৪টা হবে, ঠাকুর দক্ষিনেশ্বরের ঘরে তাঁর পদসেবাকারী ভক্তদের বলছেন, “এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।”


রামকৃষ্ণ অবতারে শ্রীশ্রীমা হচ্ছেন তাঁর মহাশক্তি। তাই পঞ্চবটীতে সীতামায়ের দর্শন কালে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর হাতে যেমন ডায়মন্ড কাট সোনার বালা দেখেছিলেন, অনুরূপ সোনার অলঙ্কার তিনি মায়ের জন্যেও গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কোনো ঘটনায় শ্রীমা ক্ষুণ্ণ হলে ঠাকুর খুবই বিচলিত হতেন। ভাগ্নে ও সেবক হৃদয়কে তিনি মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ‘এর ভিতরে যে আছে সে ফোঁস করলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরও তোকে রক্ষা করতে পারবে না’।


শ্রীরাধার যোগমায়া রূপ সম্পর্কে ঠাকুর বলছেন, "রাধিকা বিশুদ্ধসত্ত্ব, প্রেমময়ী! যোগমায়ার ভিতরে তিনগুণই আছে -- সত্ত্ব রজঃ তমঃ। শ্রীমতীর ভিতর বিশুদ্ধসত্ত্ব বই আর কিছুই নাই। (মাস্টারের প্রতি) নরেন্দ্র এখন শ্রীমতীকে খুব মানে, সে বলে, সচ্চিদানন্দকে যদি ভালবাসতে শিখতে হয় তো রাধিকার কাছে শেখা যায়।


“সচ্চিদানন্দ নিজে রসাস্বাদন করতে রাধিকার সৃষ্টি করেছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণের অঙ্গ থেকে রাধা বেরিয়েছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণই ‘আধার’ আর নিজেই শ্রীমতীরূপে ‘আধেয়’, -- নিজের রস আস্বাদন করতে -- অর্থাৎ সচ্চিদানন্দকে ভালবেসে আনন্দ সম্ভোগ করতে।


“তাই বৈষ্ণবদের গ্রন্থে আছে, রাধা জন্মগ্রহণ করে চোখ খুলেন নাই; অর্থাৎ এই ভাব যে -- এ-চক্ষে আর কাকে দেখব? রাধিকাকে দেখতে যশোদা যখন কৃষ্ণকে কোলে করে গেলেন, তখন কৃষ্ণকে দেখবার জন্য রাধা চোখ খুললেন। কৃষ্ণ খেলার ছলে রাধার চক্ষে হাত দিছলেন। (আসামী বালকের প্রতি) একি দেখেছ, ছোট ছেলে চোখে হাত দেয়?”


পরম পূজনীয়া প্রব্রাজিকা অমলাপ্রাণা মাতাজি তাঁর 'জন্মজন্মান্তরের মা' বইতে লিখছেন, 'রামকৃষ্ণ যদি অবতার হন, তবে শ্রীমা নিশ্চয় তাঁর শক্তি। পূর্ব পূর্ব অবতারগণের শক্তির তেমন বিকাশ ছিল না। এযুগে সবই নূতন, অদ্ভুত। শক্তির বিশেষ ভূমিকা। শ্রীমার মধ্যে আমরা দেখতে পাই সীতার অপার সহিষ্ণুতা—বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে যিনি মহাদুঃখের জীবন যাপন করে গেছেন, নিত্য সাধ্বী, নিত্য শুদ্ধস্বভাবা। দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার দেহবোধরহিত অপার ভালোবাসা—'তৎসুখে সুখিত্বম্', যশোধরার মতো তিনি একান্তভাবে স্বামীর আদর্শের অনুবর্তিনী, বিষ্ণুপ্রিয়ার মতোই নীরব মহাসাধিকা।'


মায়ের শিষ্য ও আশ্রিত শ্রী চন্দ্রমোহন দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় কিন্তু একেবারে 'হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন'। উনি লিখছেন, 'শ্রীমা যখন জয়রামবাটী যেতেন তখন কখনো কখনো আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। একবার জয়রামবাটী থেকে শ্রীমা কলকাতা ফিরছেন। গরুর গাড়ি করে কোয়ালপাড়া হয়ে বিষ্ণুপুরে যাচ্ছি আমরা। আমার হঠাৎ খুব ইচ্ছা হল শ্রীমায়ের আসল রূপ দেখার।


এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মা বিশ্রাম করছেন গাছের ছায়ায়। নিরিবিলি দেখে মাকে একান্তে বললাম, “মা, আপনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন। আপনার দয়াতেই আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বেঁচে আছি। সমস্ত আপদ-বিপদ থেকে আপনি রক্ষা করছেন, তবুও আমার একটা অতৃপ্ত বাসনা আছে। সেই বাসনা আপনি পূর্ণ করে দিলে আমার মনস্কামনা ষোলকলায় পূর্ণ হয়।”


শ্রীমা বাসনাটি জানতে চাইলেন। বললাম, “আপনার আসল রূপ দেখাই আমার শেষ বাসনা।” মা কিছুতেই রাজী হলেন না। অনেক কাকুতি-মিনতি করায় মা গররাজি হয়ে অন্যান্যদের বললেন, “তোমরা একটু সরে যাও। ওর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।”


আমাকে বললেন, “দেখ, শুধু তুমিই দেখবে। ওরা কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু বলবেও না যতদিন আমি বেঁচে থাকব।”


এই কথা বলে মা আমার সামনেই নিজমূর্তি ধরলেন। জগদ্ধাত্রী মূর্তি! মায়ের ওই দিব্য জ্যোতির্ময়ী মূর্তি দেখে আমি তো ভয়ে একেবারে কাঠ। মায়ের শরীর থেকে জ্যোতি বেরোচ্ছে। চারদিক জ্যোতির আলোয় আলো হয়ে গেছে। তীব্র আলোর জ্যোতিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তারই মধ্যে দেখতে পেলাম, মায়ের দুই পাশে জয়া-বিজয়া। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, কাঁপুনি আর থামে না। স্হির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম। শ্রীমা জগদ্ধাত্রীর রূপ সংবরণ করে মানবী হয়ে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে আমার কাঁপুনি থামল।


স্বাভাবিক হয়ে আসতে মা বললেন, “যা দেখলে তা কিন্তু কাউকে বলো না যতদিন আমি বেঁচে আছি।” মাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার জয়া বিজয়া কারা? মা বললেন, “গোলাপ আর যোগেন।”


শেষে দুটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্বামীজি সুদূর আমেরিকা থেকে গুরুভাই পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দজী মহারাজকে চিঠিতে লিখছেন, “দাদাগো, রাগ কোরো না। মা ঠাকুরানি কি বস্তু, তা তোমরা কেউ এখনো বোঝোনি। রামকৃষ্ণ পরমহংস চলে যান, ক্ষতি নেই। কিন্তু মা গেলেই সর্বনাশ! তোমাদের ‘জ্যান্ত দুর্গা’র পুজো কাকে বলে, দেখাব!” দেখি, স্বামী শিবানন্দজীই আবার মায়ের পূতমানবদেহের অন্তিম সৎকারের পর বলছেন, “সতীর দেহ ৫১ খন্ডে বিভক্ত হয়ে সারা দেশে ৫১ টি শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে। সেই সতীর গোটা দেহটাই আজ বেলুড় মঠের মাটিতে, বাতাসে মিশে গেল। ভক্তগণ সমস্ত সতীপীঠ ঘুরে যে পুণ্য সঞ্চয় করে, এক বেলুড় মঠে আসলেই তারা সমান পুণ্যের অধিকারী হবে।”

Friday, February 11, 2022

মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ

আমাদের মতন সাধারণ মানুষের মন যেন সবসময় অবান্তর একটা কিছু অবলম্বন করে engaged থাকতে চায়, তা সে রোজগারের চিন্তা হোক বা রাজনীতি, যার যেমন পেটে সয় আরকি। হয়তো যেটা নিয়ে ভাবছি, চর্চা করছি, তাতে জাগতিক কোনো ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানও নেই, তবুও চিন্তার স্রোতকে মন সে দিকেই টেনে নিয়ে যায় আর আমরাও ভেসে যাই। হয়তো যে সময়ে এককালের ডাকসাইটে সুন্দরীকে জীর্ণ শীর্ন অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় দেখে মন নিত্য আর অনিত্যের চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই কেউ হয়তো কথাচ্ছলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিলেন, এক নিমেষে মন আগের constructive চিন্তাধারা ছেড়ে ম্যালকম মার্শেল, এন্ডি রবার্টস আর জোয়েল গার্নারে চলে গেল, গাভাস্কারের হাত থেকে ব্যাট উড়ে যাওয়ার ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠলো, ব্যাস নিত্য-অনিত্য সব গুলিয়ে ঘাঁট হয়ে গেল। মন সারাক্ষন নিচে নামার জন্য ছটফট করছে, একে তো তাকে মায়ার construct থেকে ওপরে ওঠানোটাই সমস্যা, তারপর ক্রমাগত উঠিয়ে রাখাটা আরো অনেক বড় সমস্যা। আসলে সংসারে থাকতে হলে একা একা থাকা বা দীর্ঘসময় মৌন থাকাটা খুব মুশকিল। ওদিকে কেঁচাকেঁচির মধ্যে থাকলে ফালতু চিন্তা avoid করাও খুব কঠিন।


মন যখন উচ্চ অবস্থায় থাকে তখন জপ ধ্যান সব খুব সহজে হয়, তখনকার thought process-টাই আলাদা। আর যেই নীচে নামার chance পায়, ওমনি মন আমাদেরকে control করতে শুরু করে, তখন ধ্যানের শান্তি তো কোন ছাড়, জপ করতে বসলেও ইষ্টের মূর্তি ছেড়ে সে এদিক ওদিক দৌড়োতে থাকে, বারেবারে টেনে আনলেও দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। মনের উচ্চ আর নিচ অবস্থা অনেকটা ওই ঢেঁকি খেলার মতন, কখনো এক দিকটা ওপরে, আবার কখনো অন্যদিকটা ওপরে, ক্রমাগত ওপর-নিচ হয়েই চলেছে। শ্রীশ্রীমায়ের মন সবসময় যোগে থাকতো কিন্তু যাতে ঠাকুরের কাজ সম্পুর্ন করা যায়, মা রাধুদিদি বা কালীমামাদের উৎপাত অবলম্বন করে নিজের মনকে জোর করে জগতে নামিয়ে রাখতেন আর আমাদের দুরাবস্থা দেখুন - সবসময়ই ভোগে, অনেক কষ্ট করে হয়তো একটুখানি ওপরে উঠলো, আবার যে কে সেই। কিভাবে এই সময় নষ্ট করা থেকে বিরত হওয়া যায়? শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ তাঁর 'সরল রাজযোগ' বইটিকে এর উপায় বলে দিয়েছেন।


স্বামীজী বলছেন, 

'মনকে সংযত করবার পূর্বে মনকে জানতে হবে।


চঞ্চল মনকে সংযত করে বিষয় থেকে টেনে এনে একটা ভাবে স্থির করে রাখতে হবে। বারবার এইরকম করতে হবে। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা মনকে সংযত করে, রুদ্ধ করে ভগবানের মহিমা চিন্তা কর।


মনকে সংযত করবার সব চেয়ে সোজা উপায় চুপ করে বসে কিছুক্ষণের জন্য মনকে ছেড়ে দেওয়া, যেখানে সে ভেসে যেতে চায় যাক—দৃঢ়ভাবে চিন্তা করবে, ‘আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী; বসে বসে মনের ভাসাডোবা—ভেসে-যাওয়া দেখছি। মন আমি নয়!’ তারপর মনটাকে দেখ। ভাবো, মন থেকে তুমি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। ভগবানের সঙ্গে নিজেকে অভিন্নভাবে চিন্তা কর, জড়বস্তুর বা মনের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেল না।


কল্পনা কর—মন যেন তোমার সম্মুখে প্রসারিত একটা নিস্তরঙ্গ হ্রদ, এবং যে চিন্তাগুলি মনে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলি যেন হ্রদে বুদ্‌বুদ্ উঠছে আর তার বুকে লয় পাচ্ছে। চিন্তাগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করবার কোন চেষ্টা কর না, কল্পনার চক্ষে সেগুলি কেবল সাক্ষীর মত দেখে যাও—কেমন করে তারা ভেসে চলেছে। একটা পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন প্রথমে খুব ঘন ঘন তরঙ্গ ওঠে, তারপর তরঙ্গের পরিধি যত বেড়ে যায়, তরঙ্গ তত কমে আসে; তেমনি মনকে ঐভাবে ছেড়ে দিলে তার চিন্তার পরিধি যত বেড়ে যাবে, মনোবৃত্তি তত কমে আসবে। কিন্তু আমরা এই প্রণালী উল্টে দিতে চাই। প্রথমে একটা চিন্তার বড় বৃত্ত থেকে আরম্ভ করে সেটাকে ছোট করতে করতে যখন মন একটা বিন্দুতে আসবে, তখন তাকে সেখানে স্থির করে রাখতে হবে। এই ভাবটি ধারণা করঃ আমি মন নই; আমি দেখছি—আমি চিন্তা করছি, আমি আমার মনের গতিবিধি লক্ষ্য করছি। এইরকম অভ্যাস করতে করতে নিজের সঙ্গে মনের যে অভিন্নভাব, তা দিন দিন কমে আসবে; শেষ পর্যন্ত নিজেকে মন থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে ফেলতে পারবে, এবং ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে, মন তোমার থেকে পৃথক।


এটা যখন হয়ে যাবে, তখন মন তোমার চাকর, তাকে তুমি ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে। যোগী হওয়ার প্রথম স্তর—ইন্দ্রিয়গুলিকে অতিক্রম করা; আর যখন মনকে জয় করা হয়ে গেছে, তখন সাধক সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে।'


তবে 'মন স্থির হও' বললেই তো আর সে automatically নিয়ন্ত্রণে আসবে না, তার জন্যেও একটা process আছে। 

স্বামীজী বলছেন, 

'সম্পদে বিপদে, স্বাস্থ্যে রোগে—সব সময় যোগ অভ্যাস করে যাও, একটি দিনও বাদ দিও না।


যোগ-সাধনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হচ্ছে দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ—সে-সময় দেহ ও মন খুব শান্ত থাকে, চঞ্চলতা ও অবসাদ কিছুরই তখন প্রাবল্য থাকে না। যদি সে-সময় না পার, তা হলে ঘুম থেকে উঠে এবং শুতে যাবার আগে সাধন অভ্যাস করবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুব পরিপাটিভাবে প্রয়োজন (প্রত্যহ স্নান করবে)।


স্নানের পর বেশ দৃঢ়ভাবে আসনে বসবে, মনে করবে তুমি যেন পাহাড়ের মত অটল, কোন কিছুই তোমাকে নড়াতে পারবে না। মেরুদণ্ডের উপর জোর না দিয়ে কোমর, ঘাড় ও মাথা ঋজুভাবে রাখবে। মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়েই সব ক্রিয়া হয়, কাজেই সেটিকে দুর্বল করা চলবে না।


পায়ের আঙুল থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ স্থির করবে। এই স্থির ভাবটি মনে মনে চিন্তা কর, দরকার মনে হয় তো প্রতি অঙ্গ স্পর্শ করবে।


মাথায় না পৌঁছনো পর্যন্ত ধীরে ধীরে নীচের দিক থেকে শরীরের প্রতি অঙ্গ স্থির করতে করতে ওপরের দিকে আসবে, যেন একটি অঙ্গও বাদ না যায়। তারপর সমস্ত দেহটি স্থির করে রাখবে। সত্য লাভ করবার জন্য ভগবান তোমায় এই দেহ দিয়েছেন; এই নৌকা আশ্রয় করেই সংসার-সমুদ্রের পারে চিরন্তন সত্যের রাজ্যে তোমায় যেতে হবে।


এটি করা হয়ে গেলে দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস গ্রহণ করবে, তারপর দুই নাসা দিয়েই নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। তারপর যতক্ষণ বেশ স্বচ্ছন্দভাবে পার, শ্বাস রুদ্ধ করে থাকবে। এইরকম চারবার করা হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নেবে এবং জ্ঞানালোকের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে।


‘যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মহিমা আমি ধ্যান করি, তিনি আমাদের মনকে প্রবুদ্ধ করুন’—আসনে বসে দশ-পনর মিনিট এই মন্ত্রটির অর্থ চিন্তা কর।


যে-সব উপলব্ধি বা দর্শনাদি হবে, গুরু ছাড়া আর কাকেও তা বলবে না।


যতটা সম্ভব কম কথা বলবে।


সৎ চিন্তা করবে; আমরা যা চিন্তা করি, তাই হয়ে যাই। সৎ চিন্তা মনের সকল মলিনতা দগ্ধ করতে সাহায্য করে।'

Tuesday, February 8, 2022

ইউপি বিধানসভা ২০২২

উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন আসন্ন। ফলাফল কি হবে তা আগামীমাসে জানা যাবে। বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত কোনো চ্যানেল কি ভবিষ্যৎবাণী করলেন সেটা এক্ষেত্রে একেবারেই গৌণ, সমাজের বৃহত্তর অংশের পছন্দ অপছন্দটাই মুখ্য। যদিও এই জনবহুল এবং বিশাল রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোট সংখ্যার নিরিখে আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে এবং দুবছর পর সাধারণ নির্বাচনকেও খানিকটা প্রভাবিত করবে, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং এই নির্বাচনকে ঘিরে যে ধরণের বিপরীতধর্মী ন্যারেটিভ উঠে আসছে, সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা বেশি প্রয়োজন, কারণ তাতে দেশের বর্তমান ও আগামীদিনের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির একটা স্পষ্ট ছবি হয়তো দেখা যাবে। যেহেতু উত্তরপ্রদেশের পূর্ববর্তী সব নির্বাচনেই জাতি ও পন্থভিত্তিক সমীকরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে, তাই স্থানাভাবে এই বিশ্লেষণ মূলত চারটি বিষয়ে সীমিত থাকবে:

১. জাতিভিত্তিক

২. পন্থভিত্তিক

৩. শাসনভিত্তিক

৪. সংস্কৃতিভিত্তিক


সংবাদমাধ্যমে যুযুধান দুই প্রধান প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টি এবং ভারতীয় জনতা পার্টির গোত্রপরিচয় বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থীরূপে হলেও, তথাকথিত বামপন্থীরা এক্ষেত্রে ভোটের জন্য জাতি এবং পন্থের ভিত্তিতে বিভাজিত সমাজের ক্ষেত্ৰীয় সমীকরণের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল আর তথাকথিত দক্ষিণপন্থীরা সামগ্রিকভাবে নাগরিকের দোরগোড়ায় সুশাসনের সুফল পৌঁছে দিয়ে সর্বস্তরে সমর্থনভিত্তি প্রসারে প্রয়াসী। অর্থাৎ একদিকে সমাজতন্ত্রের নামে সামাজিক ফল্টলাইনগুলোর সুযোগ নেওয়ার প্রচেষ্টা আর অন্যদিকে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে সরকারতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা - এটাই উত্তরপ্রদেশের এবারের বিধানসভা নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য। এবং যেহেতু লড়াইটা অসম, অর্থাৎ একদিকে অপশাসনের ইতিহাস আর সুশাসনের মৌখিক আশ্বাস আর অন্যদিকে দৃশ্যত সুশাসনের বাস্তবায়ন আর প্রগতি অব্যাহত রাখার আশ্বাস, ফলে কমজোরের তরফে সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরু, গণতন্ত্র বনাম সংখ্যাগুরুতন্ত্র আর সমতা বনাম বৈষম্যে ইত্যাদি নানান ন্যারেটিভের জাল বোনা শুরু হয়েছে, যাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের দিকে টানা যায়। 


তাঁদের প্রথম অস্ত্র জাতিভিত্তিক বিভাজন। উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে জাতপাতের রাজনীতি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং সেটা বহুজনসমাজ পার্টির দলিত-ব্রাহ্মণ-মুসলমান ভোটব্যাঙ্কই হোক বা সমাজবাদী পার্টির যাদব-জাট-মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক, বহুদশক ধরে নির্বাচনী ফলাফল এই আইডেন্টিটি পলিটিক্সের আবর্তেই ঘোরাফেরা করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, সামগ্রিকভাবে গোটা উত্তরপ্রদেশের মানুষকে ছেড়ে, আজ কংগ্রেসের মতন একটি জাতীয় দলেরও লক্ষ্য শুধুমাত্র দলিত, ওবিসি আর মুসলমানদের ভোট। এই জাতপাতের রাজনীতির মুখোশটা অবশ্য খুবই মানবিক - সমাজের অবহেলিত এবং অশক্ত শ্রেণী, যাঁদের মূলধারার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে গনগন্ত্রকে ব্যবহার করে সেই শ্রেণীর সশক্তিকরণের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য তাতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর কার্যোদ্ধার কতটা হয়েছে বলা মুশকিল কিন্তু ছোট-মাঝারি-বড় নেতারা যে সবাই বেশ ক্ষমতাশালী এবং বড়লোক হয়েছেন, সেটা তাঁদের ঠাটবাট দেখলেই বোঝা যায়। এতদিন ধরে যারা কোনো বিশেষ জাত বা বিশেষ শ্রেণীর বা বিশেষ পন্থের নেতা ছিলেন, তাঁদেরই রমরমা ছিল। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিও খানিকটা ওই জাতপাতের লাইনেই ঘুঁটি সাজিয়েছিল কারণ স্বামী প্রসাদ মৌর্য ও দারা সিং চৌহানদের মতন জাতভিত্তিক নেতাদের দলে টেনে বা ওমপ্রকাশ রাজবর ইত্যাদিদের সাথে জোট না করলে ক্ষমতায় আসা হয়তো অত সহজ হতো না। একবার সরকার গড়ে ফেলার পর গত পাঁচবছর ধরে সামাজিক সমরসতায় বিশ্বাসী বিজেপি ধীরে ধীরে তার স্বরূপ দেখাতে শুরু করেছে। 


সব জাতপাতভিত্তিক সরকারের আমলেই রাজ্যের কোনো না কোনো গোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার ছিল, বিজেপি সেই রাস্তা অনেকটাই বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আসলে সারা দেশ জুড়ে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর মুখগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে জাতের লৌহমুষ্টি ভাঙতে তারা বদ্ধপরিকর। ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীরা অধিবাসী নন, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী জাট নন, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মারাঠা নন, এসব তো সারা দেশ দেখেছে। জাতপাতের উর্দ্ধে একজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে মুখ্যমন্ত্রী করে উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি সেই একই বার্তা দিয়েছে। জাতের কৃত্তিমতার অনেক ওপরে মূল হিন্দু পরিচয়ই যে জাতবিদীর্ণ সমাজে মানুষের মুখ্য সামাজিক পরিচয়, জাত নির্বিশেষে সেই ধারণাটা তৈরি করতে বিজেপি খানিকটা সফল হয়েছে। আর বিজেপি যত মানুষের হিন্দু পরিচয়ের ওপর জোর দিচ্ছে তত বিজেপির ভেতরে ও বাইরে জাতভিত্তিক নেতাদের রাজনীতির মূল ভিতটাই নড়ে যাচ্ছে আর তারা বিজেপির তীব্র বিরোধীতা করছেন। আইডেন্টিটি পলিটিক্সের ক্ষেত্রে জাতপাতের ব্যাধির প্রমুখত্বই যদি না থাকলো, তাহলে নেতাদের আর মূল্য কি? দেশের বামপন্থী ইকোসিস্টেম কে ব্যবহার করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁরা লাগাতার বিজেপির বিরুদ্ধে দুরকমের বৈষম্যের কথা প্রচার করে চলেছেন, এক, তাঁদের নির্দিষ্ট জাতের বিরুদ্ধে তথাকথিত উচ্চজাতের সমর্থন-নির্ভর বিজেপির সামাজিক বৈষম্য আর দুই, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সরকারের মুসলমান সমাজের সাথে সার্বিক বৈষম্য। কেউ কেউ তো আবার হিন্দুকে হিন্দুত্বের থেকে আলাদা করে দিতে চাইছেন, শুনে মনে হচ্ছে যেন ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিই তাঁদের বেশি পছন্দ। তবে পন্থভিত্তিক বিভাজনের ন্যারেটিভটা অনেকদিন ধরেই চলছে এবং এটি কেবল উত্তরপ্রদেশে নয়, সারা দেশ জুড়ে।


এই যুদ্ধে তথাকথিত বামপন্থীদের হাতে দ্বিতীয় অস্ত্র হলো পন্থভিত্তিক বিভাজন। এই সূত্রে বলে রাখা প্রয়োজন যে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরাই আবার তথাকথিত সেকুলারও, যদিও তাঁদের সেই সেকুলারিজমের ফলিত রূপ কিন্তু সব পন্থের প্রতি সমান শ্রদ্ধা নয়, নিজস্ব ভোটব্যাঙ্কের ভিত্তিতে একটি বিশেষ পন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং বাকিদের প্রতি অবজ্ঞা। বামমনস্ক সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ, একাডেমিয়ার একাংশ, বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা প্রভাবশালীদের একাংশের সম্মিলিত যে ইকোসিস্টেমের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই পক্ষপাতদুষ্ট মিথ্যা ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এতদিন। এর প্রভাবে, বিশেষত মুসলমানদের মনে ধীরে ধীরে বিজেপির প্রতি একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছিল। তুষ্টিকরণের লাইন মেনে সেই ন্যারেটিভ কি রকমের? যেমন মুজাফফরনগরের হিংসায় নাকি নিরীহ মুসলমানরা বিজেপির অপপ্রচারের শিকার, কৈরানাতেও তাই, অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি এবং কাশীতে বাবা বিশ্বনাথধামের কায়াকল্পের পর নাকি এবার মথুরা আক্রমণের পালা, স্থানীয় কোনো বিবাদজনিত ভিন্নপন্থীয় কারো হত্যা নাকি কখনোই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ইত্যাদি। সমাজবাদী পার্টির নেতার গলায় জিন্নার প্রশংসাও এই একপেশে ন্যারেটিভেরই প্রসারণ। সেই সাথে হিন্দুদের বোঝানোর চেষ্টাও জারি আছে যে করোনার সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দুর লাশ তাদের পরিবারের লোক গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ উত্তরপ্রদেশ সরকার করোনাপীড়িতদের কোনো সহায়তাই নাকি করেননি, ইত্যাদি।


পন্থীয় রাজনীতির মধ্যে আবার কিছু দেখোনদারীও আছে - দেখো আমরা কতজন মুসলমানকে প্রার্থী করেছি আর বিজেপি মুসলমানদের প্রার্থীই করেনা। বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রে এবং ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে সরকারে আসার পর, এমন কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটেছে বা ঘটে চলেছে, যা এতদিনের ভয় দেখানো বামপন্থী ন্যারেটিভকে অবশেষে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মোট ৫৭টি আসনের মধ্যে ৩৮.৮% ভোট পেয়ে ৩৭টিতে জিতে বিজেপি ইতিমধ্যেই এগিয়ে আছে। বিজেপির ঘোষিত নীতি হলো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার উন্নয়ন আর সবার বিশ্বাসঅর্জন। মুসলমান সমাজ নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোয় দেখছেন যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে কি কেন্দ্রে, কিবা রাজ্যে, গরিব সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি সুবিধা তো কমেইনি, উল্টে বেড়েছে। যেটা বন্ধ হয়েছে সেটা পক্ষপাতিত্বতা। তাঁরা দেখছেন যে জনহিতকর প্রতিটি যোজনায় তাঁরাও হিন্দুদের সাথে সমভাবে ভাগিদার, তাঁরাও রাজ্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশের একইরকমের লাভার্থী এবং বিজেপির শাসনকালে উত্তরপ্রদেশের আইনশৃংখলা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হওয়ার ফলে তাঁদের বাড়ির মহিলারা আজ অনেকবেশি সুরক্ষিত আর পুরুষরাও সমাজবিরোধীদের জুলুমবাজির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। 


রাজ্যের মুসলমান সমাজের মধ্যে আরো দুটো বিষয় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত গরিব মুসলমান মহিলাদের মধ্যে - তিন তালাকের ভয় থেকে অবশেষে মুক্তি পাওয়া আর গোটা করোনাকাল ধরে পারিবারিক আয় ভীষণভাবে কমে যাওয়া সত্ত্বেও সরকারি বদান্যতায় প্রতিমাসে বিনামূল্যে পরিবারের সকলের খাদ্যের নিশ্চিত যোগান পাওয়া। আজ উত্তরপ্রদেশের আম মুসলমান এতদিনের কল্পকথা আর আজকের জমিনি হকিকত - দুটোকে যেন মেলাতে পারছেন না। তাঁদের একটা বড় অংশের মনে হচ্ছে যে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে বিজেপির থেকে দূরে দূরে থেকে রাজনৈতিকভাবে তাঁদের বেশ ক্ষতিই হয়েছে। আজ যখন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ খোলাখুলি বলছেন যে উত্তরপ্রদেশের মুসলমান সমাজ যেদিন ভালোবেসে বিজেপির দলীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে দল তাঁদের মধ্যে থেকে যোগ্য প্রার্থীও চয়ন করতে শুরু করবে, কথাটা কিন্তু মুসলমানদের একাংশকে বিজেপি সম্পর্কে সদর্থকভাবে ভাবাতে শুরু করেছে। তাঁরা তো নিজের চোখে দেখছেন যে গোটা আরব দুনিয়া আজ প্রধানমন্ত্রী মোদিজীকে নিজেদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে অলংকৃত করে গৌরবান্বিত বোধ করছেন - তাঁর সম্পর্কে যে ভয়ঙ্কর ছবি তৈরি করা হয়েছিল তার সাথে মক্কা-মদিনার দেশে এই মিলনসার মানুষটির ছবি মিলছে কই? এবারের নির্বাচনে যদি বিজেপি রাজ্যের মুসলমান সমাজের বিপুলাংশের ভোট পেতে শুরু করে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আসলে বিজেপির সরকারের কাজ কথা বলছে, তার সামনে বিরোধীদের মেকি ন্যারেটিভ আর তেমন দাঁড়াতে পারছে না।


মুখ্য বিষয় হলো সুশাসন। আমজনতা কি চান? মাথার ওপর ছাদ, পেটের ভাত, পরনের কাপড়, নিয়মিত এবং যথেষ্ট রোজগার, গ্রহণযোগ্য মানের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রহণযোগ্য মানের পরিষেবা আর আইনের সুশাসন - ব্যস, এটুকুই। এতদিনের ধারণা ছিল কাজ গতানুগতিক সরকারি ঢঙে হলেও ক্ষতি নেই, গরিবের জীবনধারণ সরকারের ওপর নির্ভরশীল করে তোলো আর দলের প্রতি আনুগত্য বাড়াও। যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় এসে এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছেন। উনি ডেলিভারি দিয়ে তার নিরিখে ভোট চাইছেন। বিরোধীরা অমুক ইনডেক্স তমুক ইনডেক্স বলে নানাভাবে উত্তরপ্রদেশের বিকাশযাত্রাকে ছোট করার চেষ্টা অবশ্যই করছেন, কিন্তু বাস্তব হলো এই, যে গত পাঁচ বছরে রাজ্যে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের দ্বারা বাস্তবিক প্রচুর কাজের কাজ হয়েছে, যার গতি অবিশ্বাস্য। তাই বলে সব কাজ কি আর শেষ হয়ে গেছে, তা নয়। শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে আছে, আখচাষিদের বকেয়া পাওনা এখনো পুরোপুরি মিটিয়ে দেওয়া যায়নি, ইত্যাদি। কিন্তু যা হয়েছে সেটা বড় কম কথা নয়। প্রথমেই আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের কথা বলতে হয় - একটি চরম অরাজক রাজ্য কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এত সুশৃঙ্খল হয়ে গেল, ভাবলে অবাক লাগে বৈকি। সমাজবাদীদের আমলের প্রায় রোজকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আজ ইতিহাস। বামপন্থীরা বলেন পুলিশ নাকি বেছে বেছে মুসলমান দুষ্কৃতীদের এনকাউন্টার করেন। যদি 'সন্ত্রাসবাদীর কোনো পন্থ নেই' মেনে নিতে হয়, তাহলে সমাজবিরোধীর পন্থ দেখা হবে কোন যুক্তিতে, বোঝা যায়না। সরাসরি উপভোক্তার হাতে অনুদান পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উত্তরপ্রদেশে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনধন একাউন্ট খোলা থেকে নিয়ে খোলা শৌচকর্ম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব রুখতে স্বচ্ছতা অভিযান, প্রধানমন্ত্রী আওয়াস যোজনা এবং মুখ্যমন্ত্রীর যোজনায় সমস্ত গরিবের জন্য পাকা বাড়ি থেকে নিয়ে মুদ্রা যোজনায় গরিব ছোট ব্যবসায়ীকে বিনা বন্ধকে অল্প সুদে লোন, প্রত্যেক কৃষকের ব্যাংক খাতায় বছরে ৬০০০ করে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া থেকে নিয়ে গরিব মহিলাদের অর্থনৈতিক সশক্তিকরণ, প্রত্যেক জেলায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা থেকে নিয়ে প্রত্যেক গরিবের জন্য ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা করে দেওয়া, নিবেদিত পণ্যবাহী রেল করিডোর তৈরি করা যাতে শহরের কারখানাজাত দ্রব্যের সাথে সাথে গরিব কৃষকের গ্রামীন ফসল এবং অন্যান্য গ্রামীন উৎপাদন সহজে এবং সস্তায় সারা দেশে বাহিত হতে পারে, সারা রাজ্যজুড়ে চওড়া চওড়া হাইওয়ে তৈরি করা, লখনৌ, নয়ডা এবং কানপুরের মতন শহরে মেট্রোরেল সহ পরিবহন ব্যবস্থার খোল-নোলচে বদলে ফেলা, একসাথে এতগুলো এয়ারপোর্ট তৈরি করা, জনসম্পত্তি ও জনপরিষেবা খাতে স্বাধীনতাযাবৎ সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা, গরিব শিশুর অপুষ্টি রোধ করা থেকে নিয়ে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু বিজেপির সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে - সবকটিই একটি কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের আদর্শ রূপায়ণ, অর্থাৎ ধ্রুপদী সমাজবাদী মডেল। আবার অন্যদিকে প্রতিরক্ষা করিডোর তৈরি করা, ইউনিকর্ন তৈরি হতে সাহায্য করা, নয়ডা ফিল্মসিটি তৈরি করে বলিউডকে টক্কর দেওয়া, পিপিপি মডেলে বিশ্বস্তরীয় অবকাঠামো গড়া, ইত্যাদি রাজ্যে দারুনভাবে ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহিত করছে, যা দক্ষিণপন্থী মডেল। এই যে দুদিকেই ভারসাম্য বজায় রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকাশ এবং ডোরস্টেপ ডেলিভারিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এটাই উত্তরপ্রদেশকে মাত্র পাঁচবছরের মধ্যে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থায় পরিণত করেছে, যার সুফল রাজ্যের নাগরিক উপভোগ করছেন। সবাই সমানভাবে করছেন কি? হয়তো এখনো তা সম্ভব হয়নি, আরো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে মানুষ আশা করছেন বিজেপির সরকারকে আবার সুযোগ দিলে তাঁরা উন্নয়নকে আরো সংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।


এই বিশ্লেষণে দুই পক্ষের ব্যবহারিক পার্থক্যের শেষ বিন্দুটি হচ্ছে ইন্ডিয়া বনাম ভারতের দ্বন্দ্ব, যা কেবল এলাহাবাদ বনাম প্রয়াগরাজের মধ্যেই সীমিত নয়, এর দ্যোতনা অনেক গভীর। বামপন্থা যেহেতু একটি পাশ্চাত্য মতবাদ, প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, ন্যায়, নীতি এবং সাম্যভিত্তিক সামাজিক পরম্পরার চেয়ে তা অনেকটাই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে সেকুলারিজম হলো নিজের পন্থের প্রতি সমর্পিত থেকেও বাকি সমস্ত পন্থের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আর অপেক্ষাকৃত নবীন পাশ্চাত্যের সেকুলারিজম হলো নানাবিধ - পন্থকে একেবারে অস্বীকার করা থেকে শুরু করে অন্যের পন্থকে কেবলমাত্র সহ্য করা পর্যন্ত সবকিছু। একইভাবে পাশ্চাত্য ন্যায়বোধ আর প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে ন্যায়বোধের বহিঃপ্রকাশ একেবারে ভিন্নতর। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো অভুক্ত নাগরিক খাদ্য চুরি করতে বাধ্য হন, পাশ্চাত্য ন্যায়বোধে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর হিন্দু মননে তা দেশের রাজার অপরাধ - প্রজা অভুক্ত আছেন এই কর্তব্যঅনিষ্ঠার অপরাধে রাজাকেই শাস্তিভোগ করে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আসলে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা এবং সংস্কৃতি এতটাই উন্নত যে অন্য কোনো অপেক্ষিকভাবে সংকীর্ণমনা সংস্কৃতিকে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তথাকথিত বামপন্থীদের হাত ধরে তা আজও ঘটে চলেছে। তাই তাঁদের তৈরি ন্যারেটিভ বিভাজনকামী, বিভেদকামী এবং প্রত্যাখ্যানকামী। তাঁরা বুঝতেই রাজি নন যে শুধু শ্রেণী বা পন্থ বা কৃত্তিম কোনো ভেদভেদের দ্বারা দশ হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকদের বিশ্বাসব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করা যায়না। গত একহাজার বছর ধরে বিদেশি আক্রমণকারী শাসকরা বারবার সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, ভারতের মূলে তারা আঘাত করতে পারেনি। নতুনকে গ্রহণ করা মানে যে পুরাতনকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাকে আরো সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করা, সেই বোধটি কি সমাজবাদী পার্টি, কি বহুজন সমাজ পার্টি আর কি কংগ্রেস, কারোরই নেই। ফলে যে সামাজিক সংরচনার চিত্র তাঁরা পেশ করেছেন, সেটা কৃত্তিম, বেমানান আর প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। একজন হিন্দু কেমন সমাজ চান? যে সমাজ পক্ষপাত সহ্য করবে না, যে সমাজ রাষ্ট্রকে কোনো এক বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর পক্ষে এবং অন্য কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়াতে দেবে না, যে সমাজ ভারতের সুপ্রাচীন অন্তর্ভুক্তিকৃত রাষ্টচেতনাকে সংরক্ষণ করবে, যে সমাজ বিদেশী মদতপুষ্ট বিধ্বংসী শক্তির কুপ্রভাববিস্তারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং যে সমাজ প্রকৃতার্থে আমাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রগত হিন্দু জীবনদর্শনকে পাথেয় করে এগিয়ে যাবে, সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা এবং সংকীর্ণ পন্থতন্ত্রকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ঠিক এই পথ ধরেই হাঁটছে, ফলে এতদিন ধরে প্রচলিত ঔপনিবেশিক মডেলকে জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমান সরকার ভারতের অন্তরাত্মার অন্তঃস্থলে ফিরতে চাইছেন। মানুষ সবই দেখছেন এবং বুঝছেন। বস্তুত এ সংঘাত মতবাদের নয়, এ সভ্যতার সংঘাত। উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে তাই পরম্পরাগত ভারতীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি, সংখ্যাগুরুতন্ত্র নয়, মূল ভারতীয়ত্বের প্রতি জনগণের আস্থা ও অনুরাগের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় কাউন্টার ন্যারেটিভ সত্যিই যে আর কিছু হয়না।

Sunday, February 6, 2022

সুরসম্রাজ্ঞী

একদিকে মা সরস্বতীর ভাসানযাত্রা হচ্ছে আর অন্যদিকে আমার মতোই অনেকের প্রিয়তম গায়িকা শ্রীমতি লতা মঙ্গেশকরের পার্থিব শরীরটি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, একই সাথে, একই দিনে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এত কীর্তি, এত যশ, এত সন্মান, এত লোকের এত হাহুতাশ - শেষে সেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোম, এই অনন্য জীবনের কিছুমাত্র নতুন শরীরধরণের পর স্মরণেও আসবে না। তাহলে রয়ে গেলটা কি? রয়ে গেল সংগীত আর তার সুর তাল ছন্দ লয়, যার মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠেন ঈশ্বরীয় আনন্দরূপ, যার প্রতিটি স্বর এক একটি বীজমন্ত্র, যাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পরলে ঈশ্বরকে সরাসরি ছোঁয়া যায় - যে পথে সঠিকভাবে সাধনা করে সফল হতে পারলে মা সরস্বতী স্বয়ং কণ্ঠে বা যন্ত্রে এসে ভর করেন। লতাজির সেই উপলব্ধিটি তাঁর আনন্দকোষে গচ্চিত রয়ে যাবে চিরকাল, জন্মের পর জন্ম ধরে, হয়তো অন্য কোনো নামে, অন্য কোনো শরীরে, অন্য কোনো কালে।


১৯৪২ সাল থেকে নিয়ে ২০১৮ - লতাজির দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সংগীত জীবনে কত কিছুই না হয়েছে - দেশ থেকে ইংরেজদের ঝেঁটিয়ে তাড়ানো হয়েছে, তারপর ভারতবর্ষে ১৪জন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন আর ১৮জন প্রধানমন্ত্রী, যাঁরা প্রত্যেকে তাঁর গুনগ্রাহী। অন্তত এমন তিনটি প্রজন্ম তাঁর গান শুনে বড় হয়েছেন, যারা ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক হ্যাঙ্গোভার ঝেড়ে ফেলে 'সাহেবদের সময় সবকিছু কত ভালো ছিল' থেকে 'সাহেবরা আমাদের চেয়ে ভালো - কে বলেছে হে?', এই দীর্ঘ পথটা হেঁটে এসেছেন। আর এই দীর্ঘ কালখণ্ডে ভারতীয় জীবনের এমন কোনো অধ্যায় নেই যেখানে লতাজির কোনো না কোনো গান মানুষকে কোনো না কোনোভাবে প্ৰভাবিত করেনি, এত ব্যাপক ও সমৃদ্ধ সে সম্ভার।


লতাজি যেটা করতে পেরেছেন, সেটা তো কিছু কম নয়। এত বড় একটা দেশ, এতগুলো ভাষা, এত রকমের স্থানীয় সুরশরীর - সব বাধা পেরিয়ে তিনি সমস্ত ভারতবাসীর সুরের কান তৈরি করে দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে যাঁদের জন্ম, তা তিনি বাঙালি হন বা মারাঠি, ভোজপুরী হন বা কান্নাডিগা, নন ক্যাসিকাল ফরম্যাটে নিখুঁত সুর লাগানো কাকে বলে, ৩৬টি ভাষায় কমার্শিয়াল গান গেয়ে সেই মানকটি তাদের সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন লতাজি। আহা, তার সপ্তকেও গলার স্বর নিখুঁত থাকে, তাও আবার দশকের পর দশক ধরে, দুনিয়া জুড়ে এই অত্যাশ্চর্য্য ফেনোমেননের খুব বেশি উদাহরণ বোধহয় আর নেই। 


দ্বিতীয়, লতাজির দৌলতে আমাদের দেশের soft power বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে বিরাট লাভ হয়েছে সেটা হলো পন্ডিত রবিশঙ্করের মতোই তিনিও ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বজনীন হতে খুব সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন কন্টিনেন্ট মিলিয়ে কর্মসুত্রে এমন কোনো দেশে যাইনি যেখানে লতাজির জনপ্ৰিয় latest গান পৌঁছয়নি, এবং তাতে বিদেশিদের প্রভাবিত হতে দেখিনি। এছাড়া বিদেশে জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও তাঁর গানের মাধ্যমে দেশের সাথে সহজে একটা আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছেন। 


তৃতীয় যে জিনিসটা লতাজিকে সবার চেয়ে আলাদা করে দেয় সেটা হলো ওঁর underlying জাতীয়তাবোধ এবং sublime feminism, যার ছাপ তাঁর পরিধান, আচরণ এবং আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যে চিরকাল দারুণভাবে ফুটে ওঠেছে। নার্গিস থেকে নিয়ে করিনা কাপুর, সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টেছে কিন্তু লতাজি একই থেকে গেছেন - একজন অত্যন্ত সফল ভারতীয় নারীর মূর্ত প্রতীক হয়ে। সত্যিই, ক'জনের পক্ষেই বা আর ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর হয়ে ওঠা সম্ভব?

Thursday, February 3, 2022

সৃষ্টিতত্ত্ব

সৃষ্টির তত্ত্ব একটু একটু করে বোঝবার চেষ্টা করা হচ্ছে আর মা যেটুকু বুঝতে দিচ্ছেন, সেটুকুই আপাতত বোঝা যাচ্ছে। আদি থেকে শুরু করাই শিষ্ঠাচার। আক্ষরিক অর্থে আদ্যাশক্তি মানে আদি শক্তি আর শিব মানে সাক্ষাৎ শুভ, যিনি আদি যোগীও বটেন। শক্তি মানে ব্রহ্মের সগুণ রূপ অর্থাৎ যে মহামায়ারূপকে ব্যবহার করে ব্রহ্ম এক থেকে ছদ্ম-বহুরূপ ধারণ করেন। এই কাজটি মহামায়া করেন কিভাবে? তিনি প্রথমে একটা মায়ার ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেন, তারপর তাতে জড় এবং চেতন সৃষ্টি করেন, তারপর তিনটি গুণ অর্থাৎ সত্ত্ব (জ্ঞান), রজঃ (অহংকার) আর তমঃ (অন্ধকার) তৈরি করে সেই ব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে দেন, আর সেই গুণগুলি অনুভব এবং গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের মায়াশরীরের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী যথোচিতভাবে পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটা কর্মেন্দ্রিয় আর মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত - এই চারটে অন্তরিন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে দেন। এখান থেকেই ভেদাভেদের খেলা শুরু হয়ে যায়, যে যার পছন্দের ভাব বেছে নিতে শুরু করে। ফলে কেউ দেবতা হন, কেউ মানুষ, কেউ রাক্ষস আর কেউ বা খিচুড়ি। 


এটা অনেকটা গায়ে সেন্ট মাখার মতন। সবাই জানেন চিরকাল গন্ধটি থাকবে না, তবু মাখা হয় - ওই সাময়িক সুখের জন্য। যার যা গন্ধ পছন্দ, সে সেই গন্ধটি গায়ে মাখে আর তাতে সে নিজেও যেমন আমোদিত হয়, আশেপাশের অন্যরাও তার পছন্দ বেশ টের পায়। অন্য কারো সেই গন্ধ ভালো লাগতেও পারে, আবার নাও লাগতে পারে। সেই অনুযায়ী কেউ হয়তো সুখ পান আর কেউ অস্বস্তিতে দূরে সরে যান। এটাই মহামায়ার খেলা। নিজেই মানুষের নাক সৃষ্টি করেন, নিজেই নানারকমের গন্ধ সৃষ্টি করেন, তারপর সাময়িক সুখের জন্য মানুষকে গন্ধ বেছে নেওয়ার choice-ও দেন। সে যখন নিজের সুখের জন্য সেই choice excercise করে অন্য কোনো মানুষের অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে, তখন সেই বাজে কর্মফলের ভার কিন্তু একান্তভাবেই তার নিজের হয়ে যায়। ওই সেই দস্যু রত্নাকরের গল্পের মতন, পরিবারের সবাই তার বেআইনি রোজগারে প্রতিপালিত কিন্তু দুষ্কর্মের দায় শুধুই তার, সেই পাপের ভাগ নিতে পরিবারের কেউ রাজি নন।


এইভাবে কর্মফলের debit credit-এর হিসেব চলতে চলতে প্রারব্ধ তৈরি হয়। সেই প্রারব্ধ অনুযায়ী জীব বারেবারে জন্ম আর মৃত্যুর বৃত্তে ক্রমাগত ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না সে তিতিবিরক্ত হয়ে এই বৃথা চক্কর কাটা থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজতে শুরু করে। খুঁজতে খুঁজতে তার realisation হয় যে যে ব্রহ্মরূপ মহাশক্তি বা ব্রহ্মময়ীর ইচ্ছাতে সে বদ্ধজীব হয়ে রয়েছে, একমাত্র তাঁর কৃপাতেই সে মুক্ত হতে পারে। তখন সে ব্যাকুল হয়ে ব্রহ্মময়ীর পা দুটি জড়িয়ে ধরে অনুনয় বিনয় করতে থাকে, যাকে আমরা সাধারণ লোকে সাধনা বলি। তারপর স্বামীজীর ভাষায়, 'Maya is the energy of the universe, potential and kinetic. Until Mother releases us, we cannot get free.'


আসলে ব্রহ্মের নির্গুণ থেকে সগুণ হওয়ার উদ্দেশ্য কি? একটু আধটু শাস্ত্র পড়ে আর সাধু-মহাত্মাদের শ্রীমুখের বাণী শুনে যেটুকু অনুধাবন করা গেছে, তাতে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য - নিজের ঈশ্বরত্বকেই উপভোগ করা। একা একা থাকতে থাকতে ভদ্রলোক বোধহয় বড্ড বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাই প্রথমে নিজেরই অনেকগুলো প্রতিচ্ছবি তৈরি করলেন আর তাদের দেখে দেখে কিছুদিন বেশ আনন্দ পেলেন। তিনি হাত নাড়লে তারাও হাত নাড়ে, তিনি চোখ বুজলে তারাও চোখ বোজে আবার এও জানে যে তিনি ছাড়া তাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই। ফলে কিছুদিন তাঁর থেকে আলাদা হয়ে জীবন কাটানোর পরই তারা যখন তপস্যা টপস্যা করে তাঁতেই আবার merge করে যেতে লাগলো, তখন তাঁর মজা শেষ - সত্যযুগটা ব্রহ্মের জন্য বড়ই বোরিং হয়ে গেল। সত্যযুগ এই কারণে যে তখনো সত্য আর অসত্য অর্থাৎ নিত্য আর অনিত্যের মধ্যে পার্থক্য তেমন তৈরি হয়নি।


তখন ব্রহ্ম বুঝলেন যে এর চেয়ে ঢের বেশি মজা হবে যদি প্রতিচ্ছবিগুলোকে যথাস্থানে রেখে নিজেরই সগুণ রূপের আড়ালে নিজের নির্গুণ রূপটিকে লুকিয়ে ফেলা যায় আর তারপর তাঁকে দেখতে না পেয়ে confused হয়ে তারা কে কিরকম অদ্ভুত ব্যবহার করতে থাকে, সেটা যদি তাদেরই হৃদকমলে বসে নিঃশব্দে উপভোগ করা যায়। যাঁর প্রতিচ্ছবি, তিনিই যেহেতু আয়নার সামনে থেকে সরে গেলেন, প্রতিচ্ছবিরা কিন্তু আর বাস্তবিক রইলো না, তাদের বাহ্যিক existence-টাই মিথ্যে হয়ে গেল। আসলেরই প্রতিচ্ছবি হয়, প্রতিচ্ছবি কখনো আসল হয়না। এবার যুগে যুগে ধাপে ধাপে তারা ব্রহ্ম অর্থাৎ তাদের স্বরূপের থেকে আরো দূরে, আরো দূরে সরে যেতে লাগলো, নিত্যকে ভুলতে শুরু করল আর মায়ার তৈরি করা ইন্দ্রিয়ের বশে পড়ে অনিত্যকে সত্য ভেবে নিয়ে নিজেদের জন্য কর্মফলরূপী নানারকমের উৎপাত সৃষ্টি করতে লাগলো। 


তারপর ব্রহ্ম কিছু শুদ্ধস্বত্তাকে (যাঁদের আমরা ঋষি বলি) বেছে নিয়ে তাঁদের মনে এই পরমসত্য জাগরিত করলেন যে 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' - তাঁরা মন্ত্ররূপে এই সত্যের যুক্তি-কাঠামোটা মানসচক্ষে দেখলেন এবং তা বেদের (বেদ মানে জ্ঞান) শেষে বেদান্ত (বেদের অন্ত বা পরমজ্ঞান) বা উপনিষদরূপে গ্রন্থিত হলো। ত্রেতায় সেইকথাই মানুষকে মনে করিয়ে দিতে ব্রহ্ম স্বয়ং অবতাররূপ ধারণ করে শ্রীরামচন্দ্র হয়ে এলেন, দ্বাপরে এলেন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে আর কলিতে, যে যুগে স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে বিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশি, বারেবারে এলেন বুদ্ধ, যীশু, শ্রীচৈতন্য আর সবার শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ হয়ে। তাঁরা প্রত্যেকে যুগোপযোগী করে একই কথা বলে গেলেন - নিজের স্বরূপ অর্থাৎ ব্রহ্মের সাথে আবার যোগাযোগ স্থাপন করো, একমাত্র তাহলেই এই meaningless existence থেকে মুক্তি পাবে। স্বামীজী ৬ই জুলাই ১৮৯৫ সালে তাঁর Inspired Talks-এ বলছেন, 'In one sense Brahman is known to every human being; he knows, “I am”; but man does not know himself as he is. We all know we are, but not how we are.'। তাহলে ব্রহ্মের অবুঝ প্রতিচ্ছবিরা self-realise করবে কিভাবে? শ্রীকৃষ্ণ বললেন জ্ঞান দিয়েও করা যায়, কর্ম দিয়েও করা যায়, ভক্তি দিয়েও করা যায়, আবার ধ্যান দিয়েও করা যায় - যোগচতুষ্টয়ের মধ্যে যেটা তোমার পছন্দ, সেই পথ তুমি বেছে নাও। আর যে এরজন্য খাটতে চায় তার হাত ধরে ব্রহ্মের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য গুরুরূপী কিছু মহাত্মাকে তিনি আগে থেকেই পাঠিয়ে রেখেছিলেন।


সনাতন ধর্মে নিরাকারকে সাকার রূপে কল্পনা করার একটা খুব চমৎকার tradition আছে, তাতে স্বরূপের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে খুব সুবিধা হয় কারণ অব্যক্তকে ধারণা করা কঠিন, বিশেষতঃ যেহেতু তিনি মায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছেন। তাই ঠাকুর শ্রীমকে বলছেন, "আর তোমায় বলছি, রূপ, ঈশ্বরীয় রূপ অবিশ্বাস করো না। রূপ আছে বিশ্বাস কর! তারপর যে রূপটি ভালবাস সেই রূপ ধ্যান করো"। স্বামী ঈশাত্মানন্দজী মহারাজ প্রভু জগন্নাথদেবের দারুব্রহ্ম রূপটি বড় চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন। জগতের নাথ তো সর্বত্র আছেন, ফলে তাঁর এক জায়গা থেকে আর একজায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাই পা নেই। তাঁর ইচ্ছামাত্রই সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় হয়, ফলে কোনকিছু করার জন্য তাঁর হাতের প্রয়োজন নেই। আর আমরা যে যেখানে যা কিছু করি বা ভাবি বা বলি (কায়-মন-বাক্য) সব তাঁর গোচরে আসে, তিনি আমাদের মধ্যেই সদা সর্বদা জাগ্রত, ফলে তাঁর আঁখিপলকেরও প্রয়োজন নেই। এই যে নিত্যকে অনিত্যের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা, এটা হিন্দুদের একটা মস্ত বড় hallmark। এইরকমই একটি ঈশ্বরীয় রূপে আমরা দেখি মহাদেব শিব শুয়ে আছেন আর ঘোরশ্যামবর্ণা আদ্যাশক্তি মহামায়া তাঁর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে, গলায় কাটা মুন্ডমালা, এক হাতে সদ্যছিন্ন নরমুন্ড, আর এক হাতে খড়্গ, অন্যদুটি হাতের একটিতে বর আর অন্যটিতে বরাভয়। 


এই যে দক্ষিণাকালিকা রূপে শক্তির একাধারে ভয়ঙ্করী ও কল্যাণকারী একটা মূর্তি, এর পেছনে কিন্তু মুক্তির সুন্দর একটা ধারণা কাজ করে। শিব হলেন শুভবুদ্ধি, যেটি না জাগলে জীবনের আসল উদ্দেশ্য যে স্বরূপের সাথে যোগস্থাপন, সেই বোধ জাগা সম্ভব নয়। আবার শিব হলেন নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক, শান্ত, সমাহিত, মহাযোগী। শিব কি করেন, না মায়ার দৌড় রুখে দেন। সেই মায়া যেহেতু একইসাথে বন্ধনকারিণী আবার মুক্তিদায়িনী সেহেতু মানুষ একবার জীবনের আসল উদ্দেশ্য ঠিকঠিক বুঝতে পারলেই তাঁর জ্ঞানরূপী কৃপার খড়্গ দিয়ে তিনি তার বন্ধনের অন্ধকার, প্রারব্ধ আর মিথ্যা অহংকারকে কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মুক্তির পথ খুলে দেন। আসলে তো শিবও ব্রহ্ম, কালীও ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া নিত্যসত্য যে আর কিছু নেই। তাই গুরুর আদেশে কালী সম্পর্কে সভায় বলতে উঠে নিবেদিতা বলছেন, "কালী ওই সদাশিবের দৃষ্টির সৃষ্টি। নিজেকে আড়াল করে সাক্ষীরূপে তিনি দেখছেন দেবাত্মশক্তিকে। শিবই কালী, কালীই শিব"।


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে এই বিষয়ে স্বয়ং ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ব্যাখ্যা আছে, তারিখ ২২শে জুলাই, ১৮৮৩। মাষ্টারমশাই লিখছেন, 'সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতেছে। সন্ধ্যা সমাগমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে ঠাকুরদের নাম করিতেছেন। ঘরে ধূনা দেওয়া হইল। ঠাকুর বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ছোট তক্তপোশটির উপর বসিয়া আছেন। মার চিন্তা করিতেছেন। বেলঘরের শ্রীযুক্ত গোবিন্দ মুখুজ্জে ও তাহার বন্ধুগণ আসিয়া প্রণাম করিয়া মেঝেতে বসিলেন। মাস্টারও বসিয়া আছেন। রাখালও বসিয়া আছেন। বাহিরে চাঁদ উঠিয়াছে। জগৎ নিঃশব্দে হাসিতেছে। ঘরের ভিতর সকলে নিঃশব্দে বসিয়া ঠাকুরের শান্তমূর্তি দেখিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। কিয়ৎক্ষণ পরে কথা কহিলেন। এখনও ভাবাবস্থা।' 


শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ) — বল, তোমাদের যা সংশয়। আমি সব বলছি।


গোবিন্দ ও অন্যান্য ভক্তেরা ভাবিতে লাগিলেন।


গোবিন্দ — আজ্ঞা, শ্যামা এরূপটি হল কেন?


শ্রীরামকৃষ্ণ — সে দূর বলে। কাছে গেলে কোন রঙই নাই। দীঘির জল দূর থেকে কালো দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে করে তোল, কোন রঙ নাই। আকাশ দূর থেকে যেন নীলবর্ণ। কাছের আকাশ দেখ, কোন রঙ নাই। ঈশ্বরের যত কাছে যাবে ততই ধারণা হবে, তাঁর নাম, রূপ নাই। পেছিয়ে একটু দূরে এলে আবার “আমার শ্যামা মা!” যেন ঘাসফুলের রঙ। শ্যামা পুরুষ না প্রকৃতি? একজন ভক্ত পূজা করেছিল। একজন দর্শন করতে এসে দেখে ঠাকুরের গলায় পৈতে! সে বললে, তুমি মার গলায় পৈতে পরিয়েছ! ভক্তটি বললে, “ভাই, তুমিই মাকে চিনেছ। আমি এখনও চিনতে পারি নাই তিনি পুরুষ কি প্রকৃতি। তাই পৈতে পরিয়েছি!”


“যিনি শ্যামা, তিনিই ব্রহ্ম। যাঁরই রূপ, তিনিই অরূপ। যিনি সগুণ, তিনিই নির্গুণ। ব্রহ্ম শক্তি — শক্তি ব্রহ্ম। অভেদ। সচ্চিদানন্দময় আর সচ্চিদানন্দময়ী।”


গোবিন্দ — যোগমায়া কেন বলে?


শ্রীরামকৃষ্ণ — যোগমায়া অর্থাৎ পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। যা কিছু দেখছ সবই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। শিবকালীর মূর্তি, শিবের উপর কালী দাঁড়িয়া আছেন। শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। কালী শিবের দিকে চেয়ে আছেন। এই সমস্তই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, তাই শিব শব হয়ে আছেন। পুরুষের যোগে প্রকৃতি সমস্ত কাজ করছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন!


“রাধাকৃষ্ণ-যুগলমূর্তিরও মানে ওই। ওই যোগের জন্য বঙ্কিমভাব। সেই যোগ দেখাবার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের নাকে মুক্তা, শ্রীমতীর নাকে নীল পাথর। শ্রীমতীর গৌর বরণ মুক্তার ন্যায় উজ্জ্বল। শ্রীকৃষ্ণের শ্যামবর্ণ, তাই শ্রীমতীর নীল পাথর। আবার শ্রীকৃষ্ণ পীতবসন ও শ্রীমতী নীলবসন পরেছেন।


“উত্তম ভক্ত কে? যে ব্রহ্মজ্ঞানের পর দেখে, তিনিই জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। প্রথমে ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করে ছাদে পৌঁছিতে হয়। তারপর সে দেখে, ছাদও যে জিনিসে তৈয়ারি — ইট, চুন, সুড়কি — সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারি। তখন দেখে, ব্রহ্মই জীবজগৎ সমস্ত হয়েছেন।


“শুধু বিচার! থু! থু! — কাজ নাই।

(ঠাকুর মুখামৃত ফেলিলেন।)


“কেন বিচার করে শুষ্ক হয়ে থাকব? যতক্ষণ ‘আমি তুমি’ আছে, ততক্ষণ যেন তাঁর পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে।”


(গোবিন্দের প্রতি) — কখনও বলি — তুমিই আমি, আমিই তুমি। আবার কখনও ‘তুমিই তুমি’ হয়ে যায়। তখন ‘আমি’ খুঁজে পাই না।


“শক্তিরই অবতার। এক মতে রাম ও কৃষ্ণ চিদানন্দসাগরের দুটি ঢেউ।


“অদ্বৈতজ্ঞানের পর চৈতন্যলাভ হয়। তখন দেখে, সর্বভূতে চৈতন্যরূপে তিনি আছেন। চৈতন্যলাভের পর আনন্দ। অদ্বৈত, চৈতন্য, নিত্যানন্দ।”

হিন্দুমেলাকে ফেরানো দরকার

 বাঙালি বহুশতক ধরে মানসিকভাবে এবং জাতিগতভাবে পরের অধীন ছিল, ফলে বিজাতীয় চিন্তাধারা তার মননকে যত বেশি প্রভাবিত করেছে, দেশীয় সংস্কৃতি এবং তার নিজের জাতিস্বত্তা থেকে সে তত দূরে সরে গেছে। এটা সেই নবাবদের আমল থেকে শুরু হয়ে লাগাতার বাম শাসন অবধি চলেছে, মাঝে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাও বাঙালির কম সর্বনাশ করেনি। বাঙালির যে নিজস্ব একটি গৌরবময় ইতিহাস ছিল, বঙ্গমাতার এক কৃতী সন্তান অতীশ দীপঙ্কর পায়ে হেঁটে তিব্বতে ভারতীয় দর্শনের আলো জ্বালাতে গিয়েছিলেন তো আর এক কৃতী সন্তান বিজয় সিংহ সাতশো বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে সিংহল জয় করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন, সে কথা বাঙালি ভুলে গেছে। 


বাঙালি ভুলে গেছে ভারতের নৌসেনার ইতিহাসের সেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন যেদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ১০ই নভেম্বর ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে কেদার রায় আক্রমণকারী মগ রণবহরকে বিধস্ত করে দিয়েছিলেন। বাঙালি এও ভুলে গেছে যে জিনমিত্র, ধর্মপাল, বোধিধর্ম, মঞ্জুশ্রী, বোধিসেন, রামচন্দ্র কবি ভারতী প্রভৃতি বাঙালি ধর্মপ্রচারকরা এককালে গোটা এশিয়া জুড়ে নিজেদের কীর্তি স্থাপন করেছিলেন যার প্রভাব এখনো নেপাল থেকে নিয়ে তিব্বত, চীন, পূর্ব-উপদ্বীপ, জাভা এবং বালিতে দেখতে পাওয়া যায়। আজকের বাঙালির মতন এমন আত্মবিস্মৃত জাতি আর দুটি মেলা ভার। তাই নীরদচন্দ্র চৌধরী তাঁর বিখ্যাত বই 'আত্মঘাতী বাঙালি'তে লিখেছিলেন, 'যে হিন্দুশাসক ও অভিজাত সমাজ হিন্দু সভ্যতার অবলম্বন স্বরূপ ছিল, মুসলমানের আক্রমণে উহারা একেবারে বিনষ্ট না হইলেও, শক্তিহীন হইয়া পড়ে। এই অবস্থায় তাহাদের পক্ষে আর হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন ধারা অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হয় নাই এবং এই নেতৃত্ব হারাইয়া ভারতবর্ষের সাধারণ জনসমষ্টি, সমস্ত মুসলমান যুগ ধরিয়া কি ধর্মে, কি সাহিত্যে, কি ভাষায়, কি আর্টে, কি আচার-ব্যবহারে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একটি অপভ্রংশ সৃষ্টি ভিন্ন আর কিছু করিতে পারে নাই।'


প্রতিটি সভ্যতার মূলে থাকে তার সংস্কৃতি, যা দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে পরিশীলিত হতে হতে সমাজে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে আত্মস্থাপিত হয়। তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে থাকে জীবনদর্শন, যাকে আমরা এই হিন্দু সভ্যতায় ধর্ম বলি, যার মূল সূত্র হলো বহুত্ববাদ এবং বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। দুর্ভাগ্যবশত, বাঙালির জীবনে এই হিন্দু ধর্মবোধ যত কমেছে তত বাঙালি তার বাঙালিত্ব এবং হিন্দুত্বকে হারিয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেকালের কয়েকজন আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি মনীষী যেমন রাজনারায়ন বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র প্রমুখরা বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। অধ্যাপক অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, 'রাজনারায়ণ বসু ছিলেন হিন্দু পুনঃজাগরণের উদগাতা। ১৮৬৬ সালে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেন- ‘‘Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal’’ নামে। রাজনারায়ণ বসু-র চিন্তাভাবনারই বাস্তবায়ন ঘটান নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দু মেলা’ আয়োজনের মাধ্যমে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, হিন্দু মেলা বাংলায় জাতীয়তাবোধের বিকাশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ সালে ‘জাতীয় মেলা’ শুরু করেন। চৈত্র মাসের শেষ দিন আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়া বাগানে প্রথম মেলাটি হয়।' 


পরেরবছর ১৮৬৮ সালে মেলার সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, "এই মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, কোনো বিষয় সুখের জন্য নহে, কেবল আমোদ প্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য - ইহা ভারতভূমির জন্য"। তারপর ১৮৭০ সালে চতুর্থ বর্ষ থেকে মেলাটি ‘হিন্দু মেলা’ রূপে পরিচিত হয়। ওই মেলার সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন বলেছিলেন, "অদ্যকার এই যে অপূর্ব সমারোহ ইহা এতদিন পরে ইহার প্রকৃত নাম ধারণ করিয়াছে, ইহা হিন্দুমেলা নামে আপনাকে লোক সমক্ষে পরিচয় দিতেছে...... এক্ষণে 'হিন্দুমেলা' এই সুস্পষ্ট নাম দ্বারা মেলার প্রকৃত মূর্তি প্রকাশ পাইতেছে।" হিন্দুমেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তৃতায় গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "ইহার আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য আত্মনির্ভরতা। .... যাহাতে এই আত্মনির্ভরতা ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়, ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। স্বদেশের হিতসাধনের জন্য পরের সাহায্য না চাহিয়া যাহাতে আমরা আপনারাই তাহা সাধন করিতে পারি- এই ইহার প্রকৃত ও প্রধান উদ্দেশ্য।" এই মেলায় কুটির শিল্প-জাত দ্রব্য ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি প্রদর্শিত হত। এর সঙ্গে থাকত শিল্প প্রদর্শনী ও কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদি ভারতীয় খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। মেলায় সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হত। ১৮৮০ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই হিন্দুমেলা। কিন্তু ততদিনে তার ঈপ্সিত হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে গেছে তৎকালীন বঙ্গে। 


আমরা যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুটি দশকের ঘটনাবলীর দিকে ফিরে দেখি, তাহলে দেখবো যে নবজাগরণের ভরকেন্দ্র কিন্তু ১৮৮০-১৯২০, এই চল্লিশ বছরের কালখণ্ডে। তার আগে থেকেই অবশ্য আত্মপর্য্যালোচনার একটি ধারা শুরু হয়েছিলো। বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় ১৮২৯ সালে সতীদাহপ্রথা বন্ধ করিয়েছেন, নির্ভীক এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পুরোধা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পত্রিকা 'হিন্দু প্যাট্রিওট' এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ১৮৫৩ সালে, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করিয়েছেন ১৮৫৬ সালে, নীল বিদ্রোহ ঘটেছে ১৮৬৪ সালে আর আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়েছে ১৮৮২ সালে। কিন্তু হিন্দুমেলা পরবর্তী কালখণ্ডে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল ১৮৮৬ সালের ২৪শে ডিসেম্বরের রাত্রে। নয়জন ঈশ্বরকোটি বাঙালি যুবক আঁটপুরে তাঁদের সদ্য ব্রহ্মলীন গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে বিরোজা হোম করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন আর বাংলার তথা ভারতের ইতিহাস চিরকালের জন্য বদলে গেল। তাঁদের নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বেরিয়ে পড়লেন ভারতের অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে, তারপর একসময় পৌঁছে গেলেন শিকাগোর বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে এবং আধুনিক জগৎ নতুন করে শুনতে পেল ভারতের চিরন্তন উদ্ঘোষ: মানুষের জীবন 'আত্মনো মোক্ষার্থম্ জগদ্ধিতায় চ' (নিজের মোক্ষলাভ এবং জগতের মঙ্গলের জন্য)। ১৯০২ সালে শরীর ত্যাগ করলেন এই বীর সন্ন্যাসী। ইতিমধ্যে জন্ম হয়েছে আধুনিক বাংলার তিন পুরোধা পুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ, সুভাষচন্দ্র এবং শ্যামাপ্রসাদের। সেই সময়ই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের যুগ শুরু হচ্ছে, আর কিছু পরেই নোবেল পাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।


এর মধ্যে ১৯০৩ সালে আরো একটি ঘটনা ঘটে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী হিন্দু মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' নামে একটি মেলার সভাপতিত্ব করলেন, যা পরাধীন বঙ্গে এক নবজাগরণ আর নবচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ওনার আত্মজীবনী 'জীবনের ঝরাপাতা'য় উনি লিখছেন, "যেসব ছেলেরা তখন আমার কাছে আসত তার মধ্যে মণিলাল গাঙ্গুলী বলে একটি ছেলে ছিল। সে Dawn পত্রিকার সম্পাদক সতীশ মুখুয্যের ভাগিনেয়।সতীশবাবুও মাঝে মাঝে এসেছেন। মণিলালের সাহিত্যের দিকে একটু ঝোঁক ছিল। তার পরিচালিত একটা সাহিত্য-সমিতি ছিল ভবানীপুরের ছেলেদের। সে একদিন আমায় অনুরোধ করলে তাদের সাম্বৎসরিক উৎসবের দিন আসছে আমি যেন তাতে সভানেত্রীত্ব করি। যদিও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে এসেছি -কিন্তু কলকাতা শহরে ছেলেদের সভায় উপস্থিত হওয়া ও সভানেত্রীত্ব  করা তখন আমার কল্পনার বাইরে। আমি ইতস্ততঃ করতে লাগলুম। সে আবার পীড়াপীড়ি করাতে আমি একটু ভেবে তাকে বললুম-"আচ্ছা, তোমাদের সভায় সভানেত্রীত্ব করতে যাব- এটাকে যদি তোমাদের সাহিত্যালোচনার সাম্বৎসরিক না করে সেদিন তোমাদের সভা থেকে "প্রতাপাদিত্য উৎসব কর, আর দিনটা আরও পিছিয়ে ১লা বৈশাখে ফেলে, যেদিন প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।সভায় কোন বক্তৃতাদি রেখ না। সমস্ত কলকাতা ঘুরে খুঁজে বের কর কোথায় কোন বাঙালী ছেলে কুস্তি জানে,তলোয়ার খেলতে পারে,বক্সিং করে, লাঠি চালায়। তাদের খেলার প্রদর্শনী কর-আর আমি তাদের এক-একটি বিষয়ে এক-একটি মেডেল দেব। একটিমাত্ৰ প্রবন্ধ পাঠ হবে-সে তোমাদের সাহিত্য-সভার সাম্বৎসরিক রিপোর্ট নয় -প্রতাপাদিত্যের জীবনী। বই আনাও-পড় তাঁর জীবনী, তার সার শোনাও সভায়।" মনিলাল রাজি হল। তলোয়ার খেলা দেখানর জন্য তাদের পাড়ার বাঙালী হয়ে- যাওয়া রাজপুত ছেলে হরদয়ালকে জোগাড় করলে, কুস্তির জন্যে মসজিদবাড়ির গুহদের ছেলেরা এল, বক্সিংয়ের জন্য ভুপেন বসুর ভাইপো শৈলেন বসুর দলবল এবং লাঠির জন্য দু-চারজন লোক কোথা হতে সংগ্রহ হল। আমি যেভাবে বলেছিলুম,সেইভাবে সভার কার্যক্রম পরিচালিত হল"। দেখা যাচ্ছে এই মেলা প্রসঙ্গে বিপিন চন্দ্র পাল তাঁর Young India-তে টিপ্পনী করলেন, "As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengali!"


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯০৪ সালে ঘোর জাতীয়তাবাদী এই অগ্নিকন্যা বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনে সহায়তা করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁতবস্ত্র প্রচার ও লক্ষ্মীর ভান্ডার স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’। কলকাতায় এর আগেই, ১৯৩০ সালে, তিনি অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত স্ত্রীশিক্ষা সদন’ গড়ে তোলেন ও বাঙালি মহিলাদের মধ্যে তরবারি চালনা, লাঠি খেলা ইত্যাদি প্রচলিত করেন। আমরা দেখতে পাই যে বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সূত্রটি সেই হিন্দুমেলা থেকে শুরু হয়ে লাগাতার প্রভাব বিস্তার করে গেছে এবং বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার প্রভাব অনস্বীকার্য।


এখন প্রশ্ন হলো আজ এই হিন্দু মেলা বা পরবর্তীকালের প্রতাপাদিত্য উৎসবকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু বঙ্গবাসীকে তার হিন্দু ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেওয়ার সুপরিকল্পিত প্রয়াস ঘটেছে, ফলে আজ তার ভাষা, কৃষ্টি, মেধা এবং সংস্কৃতি বিপন্ন। যে জাতি তার নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, সেই অভাগা জাতির কোনো ভবিষ্যত থাকতে পারেনা। বরং তার বৌদ্ধিক শিরদাঁড়া ক্ষয়ে যেতে যেতে একসময়ে অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। আমরা আজ ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি যখন বাঙালি জাতিতত্বের ভিত্তি কি, তার পর্য্যালোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাঙালির ভাষা, বাঙালির ভাষ্য, বাঙালির আচার-ব্যবহার এমনকি বাঙালির রাজনৈতিক চেতনায় পর্য্যন্ত বিজাতীয় তত্ত্ব আমদানি করা হয়েছে এবং বাঙালি বিশ্বজনীন হতে গিয়ে ক্রমশঃ আত্মবিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। 


আজ প্রয়োজন বাঙালির শিকড়ে ফিরে যাওয়া এবং অনেকেই তা চাইছেন। হিন্দু বঙ্গনিবাসী যেদিন তার আত্মবিস্মৃতি কাটিয়ে উঠে বাংলার পূর্ব গৌরবগাথা সম্পর্কে অবহিত হবেন, সেদিন আবার ভারতের প্রমুখ প্রবুদ্ধ এবং আর্থিক শক্তি হিসেবে এই জাতির পুনরুত্থান ঘটবে। সাথে সাথে এ প্রশ্নও উঠছে যে জাতীয়তাবাদ আর রাষ্ট্রবাদের মধ্যে সংস্কৃতিকেন্দ্রিকতা কোন অবধারণায় বেশি প্রাসঙ্গিক আর সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র্ববাদের সাথে হিন্দুত্বের (Hinduness) ঐতিহাসিক এবং ব্যবহারিক - দুটি সম্পর্কই সুদৃঢ় না থাকলে, হিন্দুসংস্কৃতি তথা সভ্যতার স্থায়িত্ব ও ক্রমবিকাশ কিভাবে সম্ভব? যেভাবে হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে হচ্ছে আজ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ব সুরক্ষিত না থাকলে আগামীদিনে পৃথিবীতে বহুত্ববাদ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অস্তিত্ব থাকবে কি? বঙ্গবাসী যদি তার জাতিসত্তাকে পুনরাবিষ্কার না করতে পারে, নিশ্চিতরূপে তাতে এক সভ্যতার সংকট সৃষ্টি হবে। সবদিক দিয়ে ভেবে দেখলে, বাঙালির এখন তার নিজস্ব আত্মগরিমার উৎসে ফিরে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। একমাত্র হিন্দুমেলার মতন উদ্যোগই আয়না হয়ে বঙ্গনিবাসী হিন্দুর সামনে তার প্রকৃত পরিচয়টুকু তুলে ধরতে পারে। তারপর বৃহত্তর সমাজ কিভাবে সেই পরিদৃশ্যকে ব্যবহার করবে সেটা নাহয় বাংলার আত্মসচেতন নাগরিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক।

Wednesday, February 2, 2022

অহঙ্কার

ঠাকুর বলছেন, “যে ‘আমি’তে সংসারী করে, কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত করে, সেই ‘আমি’ খারাপ। জীব ও আত্মার প্রভেদ হয়েছে, এই ‘আমি’ মাঝখানে আছে বলে। জলের উপর যদি একটা লাঠি ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে দুটো ভাগ দেখায়। বস্তুত, এক জল; লাঠিটার দরুন দুটো দেখাচ্ছে।


“অহং-ই এই লাঠি। লাঠি তুলে লও, সেই এক জলই থাকবে।


“বজ্জাৎ ‘আমি’ কে? যে ‘আমি’ বলে, ‘আমায়’ জানে না? আমার এত টাকা, আমার চেয়ে কে বড়লোক আছে? যদি চোরে দশ টাকা চুরি করে থাকে, প্রথমে টাকা কেড়ে লয়, তারপর চোরকে খুব মারে; তাতেও ছাড়ে না, পাহারাওয়ালাকে ডেকে পুলিসে দেয় ও ম্যাদ খাটায়, ‘বজ্জাৎ আমি’ বলে, জানে না — আমার দশ টাকা নিয়েছে! এত বড় আস্পর্ধা!”


এই সূত্রে একটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। তার আগে হয়তো একটু গৌরচন্দ্রিকা করা প্রয়োজন। বলে নাকি আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি অপচয়প্রবণ জাতি, তা আমরা কি? বাড়ি বদলাবার সময় ঠিক ঠিক বোঝা যায় দীর্ঘ সময় ধরে কত অপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্তর আমরা অকারণে জড়ো করে বসে আছি। ঠিক একই অবস্থা আমাদের মনেরও। সেখানেও দেখবেন কত উপাধি জড়ো করে করে অহংকারের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছি আমরা, যার সবকটা আমাদের সাথে সাথেই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, একটাও কিন্তু সঙ্গে যাবে না। নিজেও এককালে পুরোপুরি মূর্খ ছিলাম তো, প্রচুর অপচয় করেছি, ঘরের কোনে আর মনের মধ্যে হাব্জিগাব্জি জমানোর জন্য কত যে পাগলামি করেছি, সে আর বলার নয়। সেই স্যুট টাই পড়া ব্রাউন সাহেবটার কথা মনে পড়লে এখন বেশ কৌতুক হয়। তবে আশেপাশে শিক্ষিত মূর্খের তো অভাব নেই, ফলে মজার উপাদানের এখনও কোনো ঘাটতি নেই। 


একজন পূর্বপরিচিত সজ্জন ইংরিজি নববর্ষের গ্রিটিংস কার্ড পাঠিয়েছিলেন, যদিও পেয়েছিলাম প্রায় দিন পনেরো পরে, পোস্ট অফিসের কল্যাণে। কিশোর এবং যুবক অবস্থায় ইনি classless society-র খুব বড় সমর্থক ছিলেন। যাইহোক, ধন্যবাদ দেবো দেবো করেও এতদিন দেওয়া হয় ওঠেনি, গত রবিবার মনে করে ফোন করলাম। কার্ডটি বেশ বড়ো, ভারী এবং দামি। ওপরে একজন নামী শিল্পীর একটি চমৎকার commissioned painting ছাপা, ভেতরের দিকে ওপরের পাতায় সুন্দর ক্যালিগ্রাফি করে ছাপা Seasons Greetings আর নীচের পাতায় একটু ছেড়ে ছেড়ে তিনটি মোটা নিবের সই, সেগুলোর নীচে নীচে সুন্দর করে পরপর সইকারীদের নাম ছাপা, নামের নীচে নীচে প্রত্যেকের ডিগ্রিসমূহ, অমুক ইউনিভার্সিটির স্নাতকোত্তর, তমুক ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট (সবই বিদেশি), অমুক সংস্থার ফেলো, তমুক সংস্থার ফেলো, তার নীচে অমুক কোম্পানির বড়কর্তা, তমুক কলেজের অমুক বিষয়ের ডিন, তমুক সংস্থার গবেষক ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এটি এক স্বামী, স্ত্রী আর তাঁদের একমাত্র কন্যার supposedly ব্যক্তিগত পারিবারিক শুভেচ্ছাজ্ঞাপন। 


তা, যাইহোক, ফোনে খানিক সদালাপের পর আমি জিজ্ঞেস করলাম কন্যা কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চয়ন করেছেন কিনা। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সংস্কারের ছাঁকনিতে ছাঁকা পাত্রের উচ্ছসিত প্রশংসা শুরু হয়ে গেল - দেশের অমুক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অমুক স্কলার, তমুক তমুক আই ভি লীগ ইউনিভার্সিটিসমূহের এই এই ডিগ্রিধারী, আমেরিকায় তমুক কোম্পানির তমুক বড় পদে কর্মরত, খুব শিগগিরই দেশি থেকে বিদেশি হয়ে যাবেন, বাপ-মা কত বড় চাকুরে, কত নামকরা বংশ, ইত্যাদি। মেয়েটাকে ছোট বয়স থেকে দেখছি তো, বিবাহ হচ্ছে জেনে সত্যিই খুব খুশি হয়ে বললাম যে হবু জামাইয়ের biodataটিও কার্ডে ছাপা উচিৎ ছিল, তাহলে সর্বাঙ্গসুন্দর হতো। খারাপ তো কিছু বলিনি, ভদ্রলোক হটাৎ "biodata" শব্দটি শুনে রেগে কেন গেলেন, বুঝলামই না। আরে! ময়ূর যখন ভাবছে তার পুচ্ছই জীবনের সার, তাতে আরো গোটাকতক রঙ্গিন পালক গুঁজলে তো ভালোই হয়, তাই না? কার্ডটা কিন্তু জম্পেশ, ময়ূরপুচ্ছের তৈরি হাতপাখার মতোই গরমকালে হওয়া খাওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত।


ঠাকুরের জীবনেও এমন কৌতুকের অভাব ছিল না। মজা করে আসল কথা বলছেন, “টাকাও একটি বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হলেই মানুষ আর-একরকম হয়ে যায়, সে মানুষ থাকে না।


“এখানে একজন ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বাহিরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে আমরা কোন্নগরে গেছলুম। হৃদে সঙ্গে ছিল। নৌকা থেকে যাই নামছি, দেখি সেই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে বসে আছে। বোধ হয়, হাওয়া খাচ্ছিল। আমাদের দেখে বলছে, ‘কি ঠাকুর! বলি — আছ কেমন?’ তার কথার স্বর শুনে আমি হৃদেকে বললাম, ‘ওরে হৃদে! এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা।’ হৃদে হাসতে লাগল।


“একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! টাকার এত অহংকার।”


ঠাকুরের গল্পের মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে অহংকার ত্যাগই আসল ত্যাগ। যেখানে উপাধি সেখানেই অহংকার, অর্থাৎ সেখানে ভগবানের থাকার জায়গা নেই। তার মানে অহংকার থাকা মানে আসলে ঈশ্বরকে ত্যাগ করা। কতভাবে তো প্রতিদিন চেষ্টা করছি যাতে সবসময় একমাত্র 'দাস আমি'টাই জেগে থাকে, মাঝে মাঝেই উপাধি এসে সব গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে যে! মা সহায় হন।

Tuesday, February 1, 2022

রাখাল মহারাজ

 বাজেটটা এতক্ষনে ভালোভাবে পড়লাম। আমাদের দেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষ নিয়মিতভাবে কেনাকাটা করেন কারণ তাঁরা অধিকাংশই organised sector-এ কাজ করেন, তাঁদের একটা stable income আছে। বাকিদের কিন্তু নেই, তাঁদের খরচ সম্পূর্ণভাবে income নির্ভর - মানে রোজগার হলে খরচ করেন, না হলে করেন না। এর মধ্যেও আবার State to State family spending rate vary করে, manufaturing States-এর বাসিন্দারা অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি consistent, ওখানে unorganised sector-ও যেহেতু organised sector-এর সঙ্গে জুড়ে থাকে, ফলে steady income-এর একটা parity আছে। পশ্চিমবঙ্গের মতন trading States এ stable income-এর কোনো স্থিরতাই নেই। Service sector-এর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। Service কথাটা শুনলেই আমাদের IT-র কথা মনে পড়ে কিন্তু এখানেও organised sector-এর থেকে unorganised sector অনেক বড়, যেমন electrician, plumber ইত্যাদির সংখ্যা IT ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যার থেকে অনেক অনেক বেশি। এঁদের রোজগার সরাসরি গ্রাহকের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল, যা আবার বকলমে তাঁদের income stability-র ওপর নির্ভরশীল। কৃষি নিয়ে গতবছর এত বেশি কচাকচি হয়েছে যে ঐ সেক্টরের সমস্যা দেশের মানুষের আর জানতে বাকি নেই, ওটাও পুরোপুরি unorganised। এতদিন ধরে তাই ভারতের অধিকাংশ মানুষের standard of living-এ মারাত্মক যুগান্তকারী পরিবর্তন কিছু হয়নি, সময়ের সাথে সাথে technology বদলেছে, aspiration বদলেছে আর তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এতদিন মোটামুটি generic improvement-ই হয়েছে - অধিকাংশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্তরে wealth creation প্রায় হয়েইনি। 


আজকে যে বাজেট পেশ হয়েছে, তাতে মূলতঃ ওই বাকি ১১০ কোটি জনতাকেই টার্গেট করা হয়েছে। কেন বলছি, দুএকটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতদিন আমাদের revenue expenditure ছিল মুখ্য আর capital expenditure ছিল গৌণ। অর্থাৎ মাইনে, পেনশন ইত্যাদিতে এত বেশি টাকা খরচ করা হতো যে mass scale-এ social asset তৈরি করার মতো যথেষ্ট টাকাই থাকতো না। এবারে দেখলাম capital খাতে বাজেটের প্রায় ১৮% ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ২০০৯-১১ অবধিও ৯% এর উপরে উঠতোই না। এর আগে কোনোদিন শুনিনি যে একসঙ্গে ১৯টা নতুন বিমানবন্দর বা একসাথে ৪০০ টা নতুন বন্দেভারত ট্রেন বা একবছরে ২৫০০০ কিমি নতুন হাইওয়ে তৈরি হবে। এটা যুগান্তকারী এবং এর ফলে ভারত সত্যি সত্যিই বদলাতে শুরু করবে, অর্থাৎ দেশের প্রগতি অনেকবেশি visible হবে এবং এই scale-এ social asset creation হলে বহু মানুষের income stability-ও বাড়বে। দ্বিতীয়, যেমন defence sector। এই যে সরকার প্রতিরক্ষার দরজা private player-দের কাছে খুলে দিলেন এবং তাদের R&Dতে সরকার টাকা লাগাবেন ঘোষণা করেছেন আর প্রতিরক্ষার চাহিদার ৬৮% মাল দেশের manufacturer-দের কাছ থেকেই কেনার নির্ণয় নিয়েছেন, এতে net importer থেকে net exporter হতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। আর এতে organised sector তো আরো বাড়বেই, সেই সাথে আরো অনেক মানুষের stable income-ও। সরকার এই বাজেটে আরো অনেক কিছু ঘোষণা করেছেন, যার সুদূরপ্রসারী impact হবে। এই যেমন ধরুন গঙ্গার দুপারে ৫ কিলোমিটার অবধি প্রাকৃতিক ক্ষেতের বিষয়টা - এতে গঙ্গার দূষণ কতগুণ কমবে ভাবা যায় না, যা এতদিন এত চেষ্টা করেও করা যায়নি। বাজেটে এমন অনেক nuances আছে, খুঁটিয়ে পড়লে চমকৃত হতে হয় কিন্তু অত কিছুর মধ্যে আর ঢুকলাম না। যাঁরা personal income tax নিয়ে গাল ফোলাচ্ছেন, তাঁরা ১৩০ কোটির মধ্যে মাত্র ১.৫ কোটি। বাকি, দুবছর ধরে সরকারকে যখন ৮০ কোটি লোককে বিনি পয়সায় খাওয়াতে হয় আর ১৩০ কোটি লোককে বিনি পয়সায় ভ্যাক্সিন দিতে হয়, তখন standard deduction যে কমে যায়নি এবং slab-এ বা rate-এ যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, এই অনেক ভাগ্যি।


শেষে একটা কথা না বললে অন্যায় হবে। এখন দেশে ২০ কোটি মানুষ consistently consume করেন, তাতেই আমরা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। Organised sector-কে খুব দ্রুতহারে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আর বাতিল হয়ে যাওয়া কৃষি আইনগুলোকে একটু শুধরে বলবৎ করার পর এই সংখ্যাটা যখন ১০০ কোটি ছাড়াবে, তখন কি হবে আন্দাজ করা যাচ্ছে কি? আমরা না করলেও, প্রধানমন্ত্রী যে অনেক আগেই করেছেন, সেটা লাগাতার একটার পর একটা বাজেটে ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। খালি এই চিনা ভাইরাসের জন্য আমাদের ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়াটা খামোখা দেড়-দু বছরের জন্য পিছিয়ে গেল, এটাই দুঃখ।

বাজেট ২০২২

বাজেটটা এতক্ষনে ভালোভাবে পড়লাম। আমাদের দেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষ নিয়মিতভাবে কেনাকাটা করেন কারণ তাঁরা অধিকাংশই organised sector-এ কাজ করেন, তাঁদের একটা stable income আছে। বাকিদের কিন্তু নেই, তাঁদের খরচ সম্পূর্ণভাবে income নির্ভর - মানে রোজগার হলে খরচ করেন, না হলে করেন না। এর মধ্যেও আবার State to State family spending rate vary করে, manufaturing States-এর বাসিন্দারা অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি consistent, ওখানে unorganised sector-ও যেহেতু organised sector-এর সঙ্গে জুড়ে থাকে, ফলে steady income-এর একটা parity আছে। পশ্চিমবঙ্গের মতন trading States এ stable income-এর কোনো স্থিরতাই নেই। Service sector-এর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। Service কথাটা শুনলেই আমাদের IT-র কথা মনে পড়ে কিন্তু এখানেও organised sector-এর থেকে unorganised sector অনেক বড়, যেমন electrician, plumber ইত্যাদির সংখ্যা IT ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যার থেকে অনেক অনেক বেশি। এঁদের রোজগার সরাসরি গ্রাহকের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল, যা আবার বকলমে তাঁদের income stability-র ওপর নির্ভরশীল। কৃষি নিয়ে গতবছর এত বেশি কচাকচি হয়েছে যে ঐ সেক্টরের সমস্যা দেশের মানুষের আর জানতে বাকি নেই, ওটাও পুরোপুরি unorganised। এতদিন ধরে তাই ভারতের অধিকাংশ মানুষের standard of living-এ মারাত্মক যুগান্তকারী পরিবর্তন কিছু হয়নি, সময়ের সাথে সাথে technology বদলেছে, aspiration বদলেছে আর তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এতদিন মোটামুটি generic improvement-ই হয়েছে - অধিকাংশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্তরে wealth creation প্রায় হয়েইনি। 


আজকে যে বাজেট পেশ হয়েছে, তাতে মূলতঃ ওই বাকি ১১০ কোটি জনতাকেই টার্গেট করা হয়েছে। কেন বলছি, দুএকটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতদিন আমাদের revenue expenditure ছিল মুখ্য আর capital expenditure ছিল গৌণ। অর্থাৎ মাইনে, পেনশন ইত্যাদিতে এত বেশি টাকা খরচ করা হতো যে mass scale-এ social asset তৈরি করার মতো যথেষ্ট টাকাই থাকতো না। এবারে দেখলাম capital খাতে বাজেটের প্রায় ১৮% ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ২০০৯-১১ অবধিও ৯% এর উপরে উঠতোই না। এর আগে কোনোদিন শুনিনি যে একসঙ্গে ১৯টা নতুন বিমানবন্দর বা একসাথে ৪০০ টা নতুন বন্দেভারত ট্রেন বা একবছরে ২৫০০০ কিমি নতুন হাইওয়ে তৈরি হবে। এটা যুগান্তকারী এবং এর ফলে ভারত সত্যি সত্যিই বদলাতে শুরু করবে, অর্থাৎ দেশের প্রগতি অনেকবেশি visible হবে এবং এই scale-এ social asset creation হলে বহু মানুষের income stability-ও বাড়বে। দ্বিতীয়, যেমন defence sector। এই যে সরকার প্রতিরক্ষার দরজা private player-দের কাছে খুলে দিলেন এবং তাদের R&Dতে সরকার টাকা লাগাবেন ঘোষণা করেছেন আর প্রতিরক্ষার চাহিদার ৬৮% মাল দেশের manufacturer-দের কাছ থেকেই কেনার নির্ণয় নিয়েছেন, এতে net importer থেকে net exporter হতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। আর এতে organised sector তো আরো বাড়বেই, সেই সাথে আরো অনেক মানুষের stable income-ও। সরকার এই বাজেটে আরো অনেক কিছু ঘোষণা করেছেন, যার সুদূরপ্রসারী impact হবে। এই যেমন ধরুন গঙ্গার দুপারে ৫ কিলোমিটার অবধি প্রাকৃতিক ক্ষেতের বিষয়টা - এতে গঙ্গার দূষণ কতগুণ কমবে ভাবা যায় না, যা এতদিন এত চেষ্টা করেও করা যায়নি। বাজেটে এমন অনেক nuances আছে, খুঁটিয়ে পড়লে চমকৃত হতে হয় কিন্তু অত কিছুর মধ্যে আর ঢুকলাম না। যাঁরা personal income tax নিয়ে গাল ফোলাচ্ছেন, তাঁরা ১৩০ কোটির মধ্যে মাত্র ১.৫ কোটি। বাকি, দুবছর ধরে সরকারকে যখন ৮০ কোটি লোককে বিনি পয়সায় খাওয়াতে হয় আর ১৩০ কোটি লোককে বিনি পয়সায় ভ্যাক্সিন দিতে হয়, তখন standard deduction যে কমে যায়নি এবং slab-এ বা rate-এ যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, এই অনেক ভাগ্যি।


শেষে একটা কথা না বললে অন্যায় হবে। এখন দেশে ২০ কোটি মানুষ consistently consume করেন, তাতেই আমরা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। Organised sector-কে খুব দ্রুতহারে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আর বাতিল হয়ে যাওয়া কৃষি আইনগুলোকে একটু শুধরে বলবৎ করার পর এই সংখ্যাটা যখন ১০০ কোটি ছাড়াবে, তখন কি হবে আন্দাজ করা যাচ্ছে কি? আমরা না করলেও, প্রধানমন্ত্রী যে অনেক আগেই করেছেন, সেটা লাগাতার একটার পর একটা বাজেটে ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। খালি এই চিনা ভাইরাসের জন্য আমাদের ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়াটা খামোখা দেড়-দু বছরের জন্য পিছিয়ে গেল, এটাই দুঃখ।