স্বামী ধর্মেশানন্দজীর স্মৃতিচারণায় দেখছি রামকৃষ্ণ মিশনের দ্বিতীয় সঙ্ঘাধ্যক্ষ পরম পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজ ভাবের ঘোরে নিজেকে ঠাকুরের কুকুর বলে বর্ণনা করছেন। ওনাকে ইংরেজিতে পূজ্যপাদ মহারাজ বলছেন, "I am Thakur's dog, my Master's dog....Lying at my Master's door, I safeguard his wealth and his Monastic Order." মহারাজ বলছেন তাঁর কাজ হচ্ছে ঠাকুরের ধনসম্পত্তি আর ঠাকুরের সঙ্ঘকে রক্ষা করা। এই কথাগুলো খুবই গভীর। উনি যখন সঙ্ঘাধ্যক্ষ, তখন সঙ্ঘের ভার অবশ্যই তাঁর ওপরে, এবং তিনিই সশরীরে ঠাকুরের প্রতিনিধি, তাঁর মধ্যেই ঠাকুরের সাক্ষাৎ প্রকাশ। কিন্তু অন্য বিষয়টি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ঠাকুর তো ফকির মানুষ, ওঁর আবার জাগতিক সম্পত্তি কোথায়? আর তাঁর যিনি সাক্ষাৎ সন্তান, তাঁরই নিজের হাতে গড়া প্রিয় পার্ষদ, যিনি নিজে একজন আত্মবোধসম্পন্ন সর্বত্যাগী ঈশ্বরকোটির সন্ন্যাসী - তিনি কি আর রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পত্তি আগলে রাখার মতন বৈষয়িক কথা বলবেন?
এখানে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য - কুকুর আর সম্পত্তি। কুকুর কেন? কারণ মালিক তাকে খেদিয়ে দিতে চাইলেও সে কখনো মালিককে ছেড়ে যায়না, তাঁর দোরগোড়াতেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। আমেরিকায় কত দেখেছি, মালিক হয়তো বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেছেন বা স্বামী স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়ে ঘর ভেঙে গেছে, অমানুষের মতন পোষ্য কুকুরটিকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তারা যে যার মতন অন্যত্র চলে গেছেন, কুকুরটি কিন্ত অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় ওই বাড়ির কাছেই সারাদিনরাত বসে আছে, এই আশায় যে প্রভু কোনোদিন হয়তো ফিরে আসবেন। লোমে জট পড়ে গেছে, গায়ে পোকা হয়ে গেছে, তবু সে নড়বে না, যাকে বলে একেবারে শবরীর প্রতীক্ষা। এই যে প্রভুর প্রতি বিশ্বাস, এই নির্ভরতা, এই অসীম ভালোবাসা আর এই প্রত্যয়, এটাই একজন ভক্তের আসল চিহ্ন। পোষ্য কুকুরের ভাব হলো complete surrender, dedication and loyalty, সম্পুর্ন আত্মসমর্পণ, আত্মোৎসর্গ আর আনুগত্য, যেখানে ভক্তি দিয়ে, সেবা দিয়ে, প্রভুর ভালোবাসা জিতে নেওয়ার প্রয়াসটাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই ভাবটাই নারদীয় ভক্তির ভাব, যা রবীন্দ্রনাথের গানে বড় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে:
নাই বা ডাক, রইব তোমার দ্বারে;
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে।
বসব তোমার পথের ধুলার 'পরে
এড়িয়ে আমায় চলবে কেমন করে?
এবার ঠাকুরের সম্পত্তির কথা। ওমনি তো গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডের উনিই কর্তা কিন্তু অবতাররূপে জীবের কাছে ওঁর গচ্ছিত সম্পত্তি হলো জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক আর বৈরাগ্য, অর্থাৎ knowledge, devotion, discrimination and renunciation. উনি এই সম্পত্তিই সশরীরে নিজের ক্ষেত্রে বেছে বেছে আর শ্রীশ্রীমায়ের মাধ্যমে অকাতরে বিলোতে এসেছিলেন, এবং এত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া স্বত্তেও তা এখনো যেমন কে তেমন অক্ষুন্ন আছে, দৈবী ঐশ্বর্যের একটুও ঘাটতি হয়নি। এই সম্পত্তি হলো শাশ্বত, নিত্য বা সত্য - এ হলো আত্মা আর পরমাত্মার মধ্যে যোগাযোগের সনাতন বিদ্যা, যা যুগে যুগে অবতারেরা বিলোতে আসেন। উপনিষদ বলছেন,
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
অর্থাৎ, পরব্রহ্ম পূর্ণ, নামরূপ ব্রহ্মও পূর্ণ; পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্গত হন; পূর্ণের পূর্ণত্ব বিদ্যার সাহায্যে গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্মই) অবশিষ্ট থাকেন।
নিশ্চয় স্বরণে থাকবে যে একদিন সন্ধ্যায় দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিনীর কাছে সদ্যপিতৃহারা, প্রচন্ড অর্থকষ্টে জর্জরিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত জাগতিক স্বস্তি চাইতে গিয়ে বিফল হয়ে বারবার তিনবার কি বর চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দ সেদিন মহামায়াকে বলেছিলেন, "মা, জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, বিবেক দাও আর ভক্তি দাও মা; সদাই যেন তােমায় দেখতে পাই মা।" এটা ওঁর গুরুরই কথা, দৈবসংযোগে সেদিন ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল। মানুষ যাতে আধার অনুসারে ঠাকুরের এই সম্পত্তির খানিকটা হলেও ছোঁয়া পায়, এটা নিশ্চিত করাই সঙ্ঘগুরুর মূল দায়িত্ব, এই কথাটাই পূজ্যপাদ মহাপুরুষ মহারাজ বোঝাতে চেয়েছেন।
ঠাকুর স্বয়ং জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক আর বৈরাগ্য সম্পর্কে কি বলছেন, একবার দেখে নেওয়া যাক। ৩০শে জুন ১৮৮৪, দক্ষিনেশ্বরে ভক্তদের বলছেন, “শুধু জ্ঞানী একঘেয়ে, — কেবল বিচার কচ্চে ‘এ নয় এ নয়, — এ-সব স্বপ্নবৎ।’ আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই সব লই"। কিছুক্ষন পর বলছেন, “সংসারীর জ্ঞান আর সর্বত্যাগীর জ্ঞান — অনেক তফাত। সংসারীর জ্ঞান — দীপের আলোর ন্যায় ঘরের ভিতরটি আলো হয়, — নিজের দেহ ঘরকন্না ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে না। সর্বত্যাগীর জ্ঞান, সূর্যের আলোর ন্যায়। সে আলোতে ঘরের ভিতর বা’র সব দেখা যায়। চৈতন্যদেবের জ্ঞান সৌরজ্ঞান — জ্ঞানসূর্যের আলো! আবার তাঁর ভিতর ভক্তিচন্দ্রের শীতল আলোও ছিল। ব্রহ্মজ্ঞান, ভক্তিপ্রেম, দুইই ছিল।”
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫, দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের জন্মোৎসব পালনের দিনে জ্ঞানের বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, “আর একটি কথা — জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও। অনেকে বলে অমুক বড় জ্ঞানী, বস্তুতঃ তা নয়। বশিষ্ঠ এত বড় জ্ঞানী, পুত্রশোকে অস্থির হয়েছিল; তখন লক্ষ্মণ বললেন, ‘রাম এ কি আশ্চর্য! ইনিও এত শোকার্ত!’ রাম বললেন — ভাই, যার জ্ঞান আছে, তার অজ্ঞানও আছে; যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে; যার ভালবোধ আছে, তার মন্দবোধও আছে; যার সুখবোধ আছে, তার দুঃখবোধও আছে। ভাই, তুমি দুই-এর পারে যাও, সুখ-দুঃখের পারে যাও, জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যাও। তাই বলছি, জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও।”
আবার ওইদিনই গিরিশ ঘোষকে ভক্তির বিষয়ে ঠাকুর বলছেন, “ভক্তিই সার। সকাম ভক্তিও আছে, আবার নিষ্কাম ভক্তি, শুদ্ধাভক্তি, অহেতুকী ভক্তি এও আছে। কেশব সেন ওরা অহেতুকী ভক্তি জানত না; কোন কামনা নাই, কেবল ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি। আবার আছে, ঊর্জিতা ভক্তি। ভক্তি যেন উথলে পড়ছে। ‘ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।’ যেমন চৈতন্যদেবের। রাম বললেন লক্ষ্মণকে, ভাই যেখানে দেখবে ঊর্জিতা ভক্তি, সেইখানে জানবে আমি স্বয়ং বর্তমান।”
এর আগে অবশ্য কথামৃতে ১৪ই ডিসেম্বর ১৮৮২ সালে আমরা ঠাকুরকে বলতে শুনি, "কিন্তু ভক্তি অমনি করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। প্রেমাভক্তি না হলে ইশ্বরলাভ হয় না। প্রেমাভক্তির আর একটি নাম রাগভক্তি। প্রেম, অনুরাগ না হলে ভগবানলাভ হয় না ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না এলে তাঁকে লাভ করা যায় না।
“যতক্ষণ না তাঁর উপর ভালবাসা জন্মায় ততক্ষণ ভক্তি কাঁচা ভক্তি। তাঁর উপর ভালবাসা এলে, তখন সেই ভক্তির নাম পাকা ভক্তি।
“যাঁর কাঁচা ভক্তি, সে ঈশ্বরের কথা, উপদেশ, ধারণা করতে পারে না। পাকা ভক্তি হলে ধারণা করতে পারে। ফটোগ্রাফের কাচে যদি কালি (Silver Nitrate) মাখানো থাকে, তাহলে যা ছবি পড়ে তা রয়ে যায়। কিন্তু শুধু কাচের উপর হাজার ছবি পড়ুক একটাও থাকেনা — একটু সরে গেলেই, যেমন কাচ তেমনি কাচ। ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না থাকলে উপদেশ ধারণা হয় না।”
বিজয় — মহাশয়, ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে, তাঁকে দর্শন করতে গেলে ভক্তি হলেই হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ভক্তি দ্বারাই তাঁকে দর্শন হয়, কিন্তু পাকা ভক্তি, প্রেমাভক্তি, রাগভক্তি চাই। সেই ভক্তি এলেই তাঁর উপর ভালবাসা আসে। যেমন ছেলের মার উপর ভালবাসা, মার ছেলের উপর ভালবাসা, স্ত্রীর স্বামীর উপর ভালবাসা।
“এ-ভালবাসা, এ-রাগভক্তি এলে স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-কুটুম্বের উপর সে মায়ার টান থাকে না। দয়া থাকে। সংসার বিদেশ বোধ হয়, একটি কর্মভূমি মাত্র বোধ হয়। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিন্তু কলকাতা কর্মভূমি; কলকাতায় বাসা করে থাকতে হয়, কর্ম করবার জন্য। ঈশ্বরে ভালবাসা এলে সংসারাসক্তি — বিষয়বুদ্ধি — একেবারে যাবে।"
বিবেক মানে সত্য আর মিথ্যা, নিত্য আর অনিত্যের মধ্যে বিচার করার ক্ষমতা। ১৮৮২ সালের মার্চ মাসে দক্ষিনেশ্বরে মাষ্টারমশাইকে ঠাকুর বলছেন, "... বিচার করা খুব দরকার। কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, থাকবার জায়গা হয় — এই পর্যন্ত। ভগবানলাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না — এর নাম বিচার, বুঝেছ?
মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ; প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক আমি সম্প্রতি পড়েছি, তাতে আছে ‘বস্তুবিচার’ ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, বস্তুবিচার! এই দেখ, টাকাতেই বা কি আছে, আর সুন্দর দেহেই বা কি আছে! বিচার কর, সুন্দরীর দেহেতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি, মল, মূত্র — এই সব আছে। এই সব বস্তুতে মানুষ ঈশ্বরকে ছেড়ে কেন মন দেয়? কেন ঈশ্বরকে ভুলে যায়?"
এই বিবেক সংক্রান্ত প্রসঙ্গেই ঠাকুর ১লা জানুয়ারি ১৮৮৩, দক্ষিনেশ্বরে মারোয়াড়ী ভক্তেদের প্রশ্নের উত্তরে বলছেন,
“(ঈশ্বরলাভের উপায়) সৎ-অসৎ বিচার। একমাত্র সৎ বা নিত্যবস্তু ঈশ্বর, আর সমস্ত অসৎ বা অনিত্য। বাজিকরই সত্য, ভেলকি মিথ্যা। এইটি বিচার।
বিবেক আর বৈরাগ্য। এই সৎ-অসৎ বিচারের নাম বিবেক। বৈরাগ্য অর্থাৎ সংসারের দ্রব্যের উপর বিরক্তি। এটি একবারে হয় না। — রোজ অভ্যাস করতে হয়। — তারপর তাঁর ইচ্ছায় মনের ত্যাগও করতে হয়, বাহিরের ত্যাগও করতে হয়। কলকাতার লোকদের বলবার জো নাই ‘ঈশ্বরের জন্য সব ত্যাগ কর’ — বলতে হয় ‘মনে ত্যাগ কর।’
অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে — কাম, ক্রোধ বশ করতে — কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির করে না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।”
তাহলে বৈরাগ্য কি বিরক্তি থেকেই উৎপন্ন হয়? সিঁথির ব্রাহ্মসমাজের ষান্মাসিক মহোৎসব, চৈত্র পূর্ণিমা (১০ই বৈশাখ, রবিবার), ২২শে এপ্রিল, ১৮৮৩; একজন ব্রাহ্ম ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বলছেন,
ব্রাহ্মভক্ত — বৈরাগ্য কি করে হয়? আর সকলের হয় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগের শান্তি না হলে বৈরাগ্য হয় না। ছোট ছেলেকে খাবার আর পুতুল দিয়ে বেশ ভুলানো যায়। কিন্তু যখন খাওয়া হয়ে গেল, আর পুতুল নিয়ে খেলা হয়ে গেল, তখন “মা যাব” বলে। মার কাছে নিয়ে না গেলে পুতুল ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে কাঁদে।"
এর আগে ১৮৮২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঠাকুর ভক্ত বিজয় গোস্বামীকে একটি চমৎকার গল্পের মাধ্যমে তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দ বৈরাগ্যের পার্থক্যও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
“তীব্র বৈরাগ্য কাকে বলে, একটি গল্প শোন। এক দেশে অনাবৃষ্টি হয়েছে। চাষীরা সব খানা কেটে দূর থেকে জল আনছে। একজন চাষার খুব রোখ আছে; সে একদিন প্রতিজ্ঞা করলে যতক্ষণ না জল আসে, খানার সঙ্গে আর নদীর সঙ্গে এক হয়, ততক্ষণ খানা খুঁড়ে যাবে। এদিকে স্নান করবার বেলা হল। গৃহিণী মেয়ের হাতে তেল পাঠিয়ে দিল। মেয়ে বললে, ‘বাবা! বেলা হয়েছে, তেল মেখে নেয়ে ফেল।’ সে বললে, ‘তুই যা আমার এখন কাজ আছে।’ বেলা দুই প্রহর একটা হল, তখনও চাষা মাঠে কাজ করছে। স্নান করার নামটি নাই। তার স্ত্রী তখন মাঠে এসে বললে, ‘এখনও নাও নাই কেন? ভাত জুড়িয়ে গেল, তোমার যে সবই বাড়াবাড়ি! না হয় কাল করবে, কি খেয়ে-দেয়েই করবে।’ গালাগালি দিয়ে চাষা কোদাল হাতে করে তাড়া করলে; আর বললে, ‘তোর আক্কেল নেই? বৃষ্টি হয় নাই। চাষবাস কিছুই হল না, এবার ছেলেপুলে কি খাবে? না খেয়ে সব মারা যাবি! আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, মাঠে আজ জল আনব তবে আজ নাওয়া-খাওয়ার কথা কবো।’ স্ত্রী গতিক দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। চাষা সমস্ত দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যার সময় খানার সঙ্গে নদীর যোগ করে দিলে। তখন একধারে বসে দেখতে লাগল যে, নদীর জল মাঠে কুলকুল করে আসছে। তার মন তখন শান্ত আর আনন্দে পূর্ণ হল। বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললে, ‘নে এখন তেল দে আর একটু তামাক সাজ।’ তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে নেয়ে খেয়ে সুখে ভোঁসভোঁস করে নিদ্রা যেতে লাগল! এই রোখ তীব্র বৈরাগ্যের উপমা।
“আর একজন চাষা— সেও মাঠে জল আনছিল। তার স্ত্রী যখন গেল আর বললে, ‘অনেক বেলা হয়েছে এখন এস, এত বাড়াবাড়িতে কাজ নাই।’ তখন সে বেশি উচ্চবাচ্য না করে কোদাল রেখে স্ত্রীকে বললে, ‘তুই যখন বলছিস তো চল!’ (সকলের হাস্য) সে চাষার আর মাঠে জল আনা হল না। এটি মন্দ বৈরাগ্যের উপমা।
“খুব রোখ না হলে, চাষার যেমন মাঠে জল আসে না, সেইরূপ মানুষের ঈশ্বরলাভ হয় না।”