উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন আসন্ন। ফলাফল কি হবে তা আগামীমাসে জানা যাবে। বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত কোনো চ্যানেল কি ভবিষ্যৎবাণী করলেন সেটা এক্ষেত্রে একেবারেই গৌণ, সমাজের বৃহত্তর অংশের পছন্দ অপছন্দটাই মুখ্য। যদিও এই জনবহুল এবং বিশাল রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোট সংখ্যার নিরিখে আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে এবং দুবছর পর সাধারণ নির্বাচনকেও খানিকটা প্রভাবিত করবে, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং এই নির্বাচনকে ঘিরে যে ধরণের বিপরীতধর্মী ন্যারেটিভ উঠে আসছে, সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা বেশি প্রয়োজন, কারণ তাতে দেশের বর্তমান ও আগামীদিনের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির একটা স্পষ্ট ছবি হয়তো দেখা যাবে। যেহেতু উত্তরপ্রদেশের পূর্ববর্তী সব নির্বাচনেই জাতি ও পন্থভিত্তিক সমীকরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে, তাই স্থানাভাবে এই বিশ্লেষণ মূলত চারটি বিষয়ে সীমিত থাকবে:
১. জাতিভিত্তিক
২. পন্থভিত্তিক
৩. শাসনভিত্তিক
৪. সংস্কৃতিভিত্তিক
সংবাদমাধ্যমে যুযুধান দুই প্রধান প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টি এবং ভারতীয় জনতা পার্টির গোত্রপরিচয় বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থীরূপে হলেও, তথাকথিত বামপন্থীরা এক্ষেত্রে ভোটের জন্য জাতি এবং পন্থের ভিত্তিতে বিভাজিত সমাজের ক্ষেত্ৰীয় সমীকরণের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল আর তথাকথিত দক্ষিণপন্থীরা সামগ্রিকভাবে নাগরিকের দোরগোড়ায় সুশাসনের সুফল পৌঁছে দিয়ে সর্বস্তরে সমর্থনভিত্তি প্রসারে প্রয়াসী। অর্থাৎ একদিকে সমাজতন্ত্রের নামে সামাজিক ফল্টলাইনগুলোর সুযোগ নেওয়ার প্রচেষ্টা আর অন্যদিকে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে সরকারতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা - এটাই উত্তরপ্রদেশের এবারের বিধানসভা নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য। এবং যেহেতু লড়াইটা অসম, অর্থাৎ একদিকে অপশাসনের ইতিহাস আর সুশাসনের মৌখিক আশ্বাস আর অন্যদিকে দৃশ্যত সুশাসনের বাস্তবায়ন আর প্রগতি অব্যাহত রাখার আশ্বাস, ফলে কমজোরের তরফে সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরু, গণতন্ত্র বনাম সংখ্যাগুরুতন্ত্র আর সমতা বনাম বৈষম্যে ইত্যাদি নানান ন্যারেটিভের জাল বোনা শুরু হয়েছে, যাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের দিকে টানা যায়।
তাঁদের প্রথম অস্ত্র জাতিভিত্তিক বিভাজন। উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে জাতপাতের রাজনীতি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং সেটা বহুজনসমাজ পার্টির দলিত-ব্রাহ্মণ-মুসলমান ভোটব্যাঙ্কই হোক বা সমাজবাদী পার্টির যাদব-জাট-মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক, বহুদশক ধরে নির্বাচনী ফলাফল এই আইডেন্টিটি পলিটিক্সের আবর্তেই ঘোরাফেরা করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, সামগ্রিকভাবে গোটা উত্তরপ্রদেশের মানুষকে ছেড়ে, আজ কংগ্রেসের মতন একটি জাতীয় দলেরও লক্ষ্য শুধুমাত্র দলিত, ওবিসি আর মুসলমানদের ভোট। এই জাতপাতের রাজনীতির মুখোশটা অবশ্য খুবই মানবিক - সমাজের অবহেলিত এবং অশক্ত শ্রেণী, যাঁদের মূলধারার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে গনগন্ত্রকে ব্যবহার করে সেই শ্রেণীর সশক্তিকরণের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য তাতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর কার্যোদ্ধার কতটা হয়েছে বলা মুশকিল কিন্তু ছোট-মাঝারি-বড় নেতারা যে সবাই বেশ ক্ষমতাশালী এবং বড়লোক হয়েছেন, সেটা তাঁদের ঠাটবাট দেখলেই বোঝা যায়। এতদিন ধরে যারা কোনো বিশেষ জাত বা বিশেষ শ্রেণীর বা বিশেষ পন্থের নেতা ছিলেন, তাঁদেরই রমরমা ছিল। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিও খানিকটা ওই জাতপাতের লাইনেই ঘুঁটি সাজিয়েছিল কারণ স্বামী প্রসাদ মৌর্য ও দারা সিং চৌহানদের মতন জাতভিত্তিক নেতাদের দলে টেনে বা ওমপ্রকাশ রাজবর ইত্যাদিদের সাথে জোট না করলে ক্ষমতায় আসা হয়তো অত সহজ হতো না। একবার সরকার গড়ে ফেলার পর গত পাঁচবছর ধরে সামাজিক সমরসতায় বিশ্বাসী বিজেপি ধীরে ধীরে তার স্বরূপ দেখাতে শুরু করেছে।
সব জাতপাতভিত্তিক সরকারের আমলেই রাজ্যের কোনো না কোনো গোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার ছিল, বিজেপি সেই রাস্তা অনেকটাই বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আসলে সারা দেশ জুড়ে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর মুখগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে জাতের লৌহমুষ্টি ভাঙতে তারা বদ্ধপরিকর। ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীরা অধিবাসী নন, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী জাট নন, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মারাঠা নন, এসব তো সারা দেশ দেখেছে। জাতপাতের উর্দ্ধে একজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে মুখ্যমন্ত্রী করে উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি সেই একই বার্তা দিয়েছে। জাতের কৃত্তিমতার অনেক ওপরে মূল হিন্দু পরিচয়ই যে জাতবিদীর্ণ সমাজে মানুষের মুখ্য সামাজিক পরিচয়, জাত নির্বিশেষে সেই ধারণাটা তৈরি করতে বিজেপি খানিকটা সফল হয়েছে। আর বিজেপি যত মানুষের হিন্দু পরিচয়ের ওপর জোর দিচ্ছে তত বিজেপির ভেতরে ও বাইরে জাতভিত্তিক নেতাদের রাজনীতির মূল ভিতটাই নড়ে যাচ্ছে আর তারা বিজেপির তীব্র বিরোধীতা করছেন। আইডেন্টিটি পলিটিক্সের ক্ষেত্রে জাতপাতের ব্যাধির প্রমুখত্বই যদি না থাকলো, তাহলে নেতাদের আর মূল্য কি? দেশের বামপন্থী ইকোসিস্টেম কে ব্যবহার করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁরা লাগাতার বিজেপির বিরুদ্ধে দুরকমের বৈষম্যের কথা প্রচার করে চলেছেন, এক, তাঁদের নির্দিষ্ট জাতের বিরুদ্ধে তথাকথিত উচ্চজাতের সমর্থন-নির্ভর বিজেপির সামাজিক বৈষম্য আর দুই, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সরকারের মুসলমান সমাজের সাথে সার্বিক বৈষম্য। কেউ কেউ তো আবার হিন্দুকে হিন্দুত্বের থেকে আলাদা করে দিতে চাইছেন, শুনে মনে হচ্ছে যেন ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিই তাঁদের বেশি পছন্দ। তবে পন্থভিত্তিক বিভাজনের ন্যারেটিভটা অনেকদিন ধরেই চলছে এবং এটি কেবল উত্তরপ্রদেশে নয়, সারা দেশ জুড়ে।
এই যুদ্ধে তথাকথিত বামপন্থীদের হাতে দ্বিতীয় অস্ত্র হলো পন্থভিত্তিক বিভাজন। এই সূত্রে বলে রাখা প্রয়োজন যে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরাই আবার তথাকথিত সেকুলারও, যদিও তাঁদের সেই সেকুলারিজমের ফলিত রূপ কিন্তু সব পন্থের প্রতি সমান শ্রদ্ধা নয়, নিজস্ব ভোটব্যাঙ্কের ভিত্তিতে একটি বিশেষ পন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং বাকিদের প্রতি অবজ্ঞা। বামমনস্ক সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ, একাডেমিয়ার একাংশ, বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা প্রভাবশালীদের একাংশের সম্মিলিত যে ইকোসিস্টেমের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই পক্ষপাতদুষ্ট মিথ্যা ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এতদিন। এর প্রভাবে, বিশেষত মুসলমানদের মনে ধীরে ধীরে বিজেপির প্রতি একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছিল। তুষ্টিকরণের লাইন মেনে সেই ন্যারেটিভ কি রকমের? যেমন মুজাফফরনগরের হিংসায় নাকি নিরীহ মুসলমানরা বিজেপির অপপ্রচারের শিকার, কৈরানাতেও তাই, অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি এবং কাশীতে বাবা বিশ্বনাথধামের কায়াকল্পের পর নাকি এবার মথুরা আক্রমণের পালা, স্থানীয় কোনো বিবাদজনিত ভিন্নপন্থীয় কারো হত্যা নাকি কখনোই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ইত্যাদি। সমাজবাদী পার্টির নেতার গলায় জিন্নার প্রশংসাও এই একপেশে ন্যারেটিভেরই প্রসারণ। সেই সাথে হিন্দুদের বোঝানোর চেষ্টাও জারি আছে যে করোনার সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দুর লাশ তাদের পরিবারের লোক গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ উত্তরপ্রদেশ সরকার করোনাপীড়িতদের কোনো সহায়তাই নাকি করেননি, ইত্যাদি।
পন্থীয় রাজনীতির মধ্যে আবার কিছু দেখোনদারীও আছে - দেখো আমরা কতজন মুসলমানকে প্রার্থী করেছি আর বিজেপি মুসলমানদের প্রার্থীই করেনা। বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রে এবং ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে সরকারে আসার পর, এমন কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটেছে বা ঘটে চলেছে, যা এতদিনের ভয় দেখানো বামপন্থী ন্যারেটিভকে অবশেষে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মোট ৫৭টি আসনের মধ্যে ৩৮.৮% ভোট পেয়ে ৩৭টিতে জিতে বিজেপি ইতিমধ্যেই এগিয়ে আছে। বিজেপির ঘোষিত নীতি হলো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার উন্নয়ন আর সবার বিশ্বাসঅর্জন। মুসলমান সমাজ নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোয় দেখছেন যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে কি কেন্দ্রে, কিবা রাজ্যে, গরিব সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি সুবিধা তো কমেইনি, উল্টে বেড়েছে। যেটা বন্ধ হয়েছে সেটা পক্ষপাতিত্বতা। তাঁরা দেখছেন যে জনহিতকর প্রতিটি যোজনায় তাঁরাও হিন্দুদের সাথে সমভাবে ভাগিদার, তাঁরাও রাজ্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশের একইরকমের লাভার্থী এবং বিজেপির শাসনকালে উত্তরপ্রদেশের আইনশৃংখলা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হওয়ার ফলে তাঁদের বাড়ির মহিলারা আজ অনেকবেশি সুরক্ষিত আর পুরুষরাও সমাজবিরোধীদের জুলুমবাজির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন।
রাজ্যের মুসলমান সমাজের মধ্যে আরো দুটো বিষয় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত গরিব মুসলমান মহিলাদের মধ্যে - তিন তালাকের ভয় থেকে অবশেষে মুক্তি পাওয়া আর গোটা করোনাকাল ধরে পারিবারিক আয় ভীষণভাবে কমে যাওয়া সত্ত্বেও সরকারি বদান্যতায় প্রতিমাসে বিনামূল্যে পরিবারের সকলের খাদ্যের নিশ্চিত যোগান পাওয়া। আজ উত্তরপ্রদেশের আম মুসলমান এতদিনের কল্পকথা আর আজকের জমিনি হকিকত - দুটোকে যেন মেলাতে পারছেন না। তাঁদের একটা বড় অংশের মনে হচ্ছে যে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে বিজেপির থেকে দূরে দূরে থেকে রাজনৈতিকভাবে তাঁদের বেশ ক্ষতিই হয়েছে। আজ যখন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ খোলাখুলি বলছেন যে উত্তরপ্রদেশের মুসলমান সমাজ যেদিন ভালোবেসে বিজেপির দলীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে দল তাঁদের মধ্যে থেকে যোগ্য প্রার্থীও চয়ন করতে শুরু করবে, কথাটা কিন্তু মুসলমানদের একাংশকে বিজেপি সম্পর্কে সদর্থকভাবে ভাবাতে শুরু করেছে। তাঁরা তো নিজের চোখে দেখছেন যে গোটা আরব দুনিয়া আজ প্রধানমন্ত্রী মোদিজীকে নিজেদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে অলংকৃত করে গৌরবান্বিত বোধ করছেন - তাঁর সম্পর্কে যে ভয়ঙ্কর ছবি তৈরি করা হয়েছিল তার সাথে মক্কা-মদিনার দেশে এই মিলনসার মানুষটির ছবি মিলছে কই? এবারের নির্বাচনে যদি বিজেপি রাজ্যের মুসলমান সমাজের বিপুলাংশের ভোট পেতে শুরু করে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আসলে বিজেপির সরকারের কাজ কথা বলছে, তার সামনে বিরোধীদের মেকি ন্যারেটিভ আর তেমন দাঁড়াতে পারছে না।
মুখ্য বিষয় হলো সুশাসন। আমজনতা কি চান? মাথার ওপর ছাদ, পেটের ভাত, পরনের কাপড়, নিয়মিত এবং যথেষ্ট রোজগার, গ্রহণযোগ্য মানের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রহণযোগ্য মানের পরিষেবা আর আইনের সুশাসন - ব্যস, এটুকুই। এতদিনের ধারণা ছিল কাজ গতানুগতিক সরকারি ঢঙে হলেও ক্ষতি নেই, গরিবের জীবনধারণ সরকারের ওপর নির্ভরশীল করে তোলো আর দলের প্রতি আনুগত্য বাড়াও। যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় এসে এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছেন। উনি ডেলিভারি দিয়ে তার নিরিখে ভোট চাইছেন। বিরোধীরা অমুক ইনডেক্স তমুক ইনডেক্স বলে নানাভাবে উত্তরপ্রদেশের বিকাশযাত্রাকে ছোট করার চেষ্টা অবশ্যই করছেন, কিন্তু বাস্তব হলো এই, যে গত পাঁচ বছরে রাজ্যে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের দ্বারা বাস্তবিক প্রচুর কাজের কাজ হয়েছে, যার গতি অবিশ্বাস্য। তাই বলে সব কাজ কি আর শেষ হয়ে গেছে, তা নয়। শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে আছে, আখচাষিদের বকেয়া পাওনা এখনো পুরোপুরি মিটিয়ে দেওয়া যায়নি, ইত্যাদি। কিন্তু যা হয়েছে সেটা বড় কম কথা নয়। প্রথমেই আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের কথা বলতে হয় - একটি চরম অরাজক রাজ্য কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এত সুশৃঙ্খল হয়ে গেল, ভাবলে অবাক লাগে বৈকি। সমাজবাদীদের আমলের প্রায় রোজকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আজ ইতিহাস। বামপন্থীরা বলেন পুলিশ নাকি বেছে বেছে মুসলমান দুষ্কৃতীদের এনকাউন্টার করেন। যদি 'সন্ত্রাসবাদীর কোনো পন্থ নেই' মেনে নিতে হয়, তাহলে সমাজবিরোধীর পন্থ দেখা হবে কোন যুক্তিতে, বোঝা যায়না। সরাসরি উপভোক্তার হাতে অনুদান পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উত্তরপ্রদেশে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনধন একাউন্ট খোলা থেকে নিয়ে খোলা শৌচকর্ম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব রুখতে স্বচ্ছতা অভিযান, প্রধানমন্ত্রী আওয়াস যোজনা এবং মুখ্যমন্ত্রীর যোজনায় সমস্ত গরিবের জন্য পাকা বাড়ি থেকে নিয়ে মুদ্রা যোজনায় গরিব ছোট ব্যবসায়ীকে বিনা বন্ধকে অল্প সুদে লোন, প্রত্যেক কৃষকের ব্যাংক খাতায় বছরে ৬০০০ করে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া থেকে নিয়ে গরিব মহিলাদের অর্থনৈতিক সশক্তিকরণ, প্রত্যেক জেলায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা থেকে নিয়ে প্রত্যেক গরিবের জন্য ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা করে দেওয়া, নিবেদিত পণ্যবাহী রেল করিডোর তৈরি করা যাতে শহরের কারখানাজাত দ্রব্যের সাথে সাথে গরিব কৃষকের গ্রামীন ফসল এবং অন্যান্য গ্রামীন উৎপাদন সহজে এবং সস্তায় সারা দেশে বাহিত হতে পারে, সারা রাজ্যজুড়ে চওড়া চওড়া হাইওয়ে তৈরি করা, লখনৌ, নয়ডা এবং কানপুরের মতন শহরে মেট্রোরেল সহ পরিবহন ব্যবস্থার খোল-নোলচে বদলে ফেলা, একসাথে এতগুলো এয়ারপোর্ট তৈরি করা, জনসম্পত্তি ও জনপরিষেবা খাতে স্বাধীনতাযাবৎ সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা, গরিব শিশুর অপুষ্টি রোধ করা থেকে নিয়ে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু বিজেপির সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে - সবকটিই একটি কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের আদর্শ রূপায়ণ, অর্থাৎ ধ্রুপদী সমাজবাদী মডেল। আবার অন্যদিকে প্রতিরক্ষা করিডোর তৈরি করা, ইউনিকর্ন তৈরি হতে সাহায্য করা, নয়ডা ফিল্মসিটি তৈরি করে বলিউডকে টক্কর দেওয়া, পিপিপি মডেলে বিশ্বস্তরীয় অবকাঠামো গড়া, ইত্যাদি রাজ্যে দারুনভাবে ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহিত করছে, যা দক্ষিণপন্থী মডেল। এই যে দুদিকেই ভারসাম্য বজায় রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকাশ এবং ডোরস্টেপ ডেলিভারিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এটাই উত্তরপ্রদেশকে মাত্র পাঁচবছরের মধ্যে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থায় পরিণত করেছে, যার সুফল রাজ্যের নাগরিক উপভোগ করছেন। সবাই সমানভাবে করছেন কি? হয়তো এখনো তা সম্ভব হয়নি, আরো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে মানুষ আশা করছেন বিজেপির সরকারকে আবার সুযোগ দিলে তাঁরা উন্নয়নকে আরো সংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
এই বিশ্লেষণে দুই পক্ষের ব্যবহারিক পার্থক্যের শেষ বিন্দুটি হচ্ছে ইন্ডিয়া বনাম ভারতের দ্বন্দ্ব, যা কেবল এলাহাবাদ বনাম প্রয়াগরাজের মধ্যেই সীমিত নয়, এর দ্যোতনা অনেক গভীর। বামপন্থা যেহেতু একটি পাশ্চাত্য মতবাদ, প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, ন্যায়, নীতি এবং সাম্যভিত্তিক সামাজিক পরম্পরার চেয়ে তা অনেকটাই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে সেকুলারিজম হলো নিজের পন্থের প্রতি সমর্পিত থেকেও বাকি সমস্ত পন্থের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আর অপেক্ষাকৃত নবীন পাশ্চাত্যের সেকুলারিজম হলো নানাবিধ - পন্থকে একেবারে অস্বীকার করা থেকে শুরু করে অন্যের পন্থকে কেবলমাত্র সহ্য করা পর্যন্ত সবকিছু। একইভাবে পাশ্চাত্য ন্যায়বোধ আর প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে ন্যায়বোধের বহিঃপ্রকাশ একেবারে ভিন্নতর। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো অভুক্ত নাগরিক খাদ্য চুরি করতে বাধ্য হন, পাশ্চাত্য ন্যায়বোধে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর হিন্দু মননে তা দেশের রাজার অপরাধ - প্রজা অভুক্ত আছেন এই কর্তব্যঅনিষ্ঠার অপরাধে রাজাকেই শাস্তিভোগ করে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আসলে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা এবং সংস্কৃতি এতটাই উন্নত যে অন্য কোনো অপেক্ষিকভাবে সংকীর্ণমনা সংস্কৃতিকে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তথাকথিত বামপন্থীদের হাত ধরে তা আজও ঘটে চলেছে। তাই তাঁদের তৈরি ন্যারেটিভ বিভাজনকামী, বিভেদকামী এবং প্রত্যাখ্যানকামী। তাঁরা বুঝতেই রাজি নন যে শুধু শ্রেণী বা পন্থ বা কৃত্তিম কোনো ভেদভেদের দ্বারা দশ হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকদের বিশ্বাসব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করা যায়না। গত একহাজার বছর ধরে বিদেশি আক্রমণকারী শাসকরা বারবার সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, ভারতের মূলে তারা আঘাত করতে পারেনি। নতুনকে গ্রহণ করা মানে যে পুরাতনকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাকে আরো সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করা, সেই বোধটি কি সমাজবাদী পার্টি, কি বহুজন সমাজ পার্টি আর কি কংগ্রেস, কারোরই নেই। ফলে যে সামাজিক সংরচনার চিত্র তাঁরা পেশ করেছেন, সেটা কৃত্তিম, বেমানান আর প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। একজন হিন্দু কেমন সমাজ চান? যে সমাজ পক্ষপাত সহ্য করবে না, যে সমাজ রাষ্ট্রকে কোনো এক বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর পক্ষে এবং অন্য কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়াতে দেবে না, যে সমাজ ভারতের সুপ্রাচীন অন্তর্ভুক্তিকৃত রাষ্টচেতনাকে সংরক্ষণ করবে, যে সমাজ বিদেশী মদতপুষ্ট বিধ্বংসী শক্তির কুপ্রভাববিস্তারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং যে সমাজ প্রকৃতার্থে আমাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রগত হিন্দু জীবনদর্শনকে পাথেয় করে এগিয়ে যাবে, সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা এবং সংকীর্ণ পন্থতন্ত্রকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ঠিক এই পথ ধরেই হাঁটছে, ফলে এতদিন ধরে প্রচলিত ঔপনিবেশিক মডেলকে জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমান সরকার ভারতের অন্তরাত্মার অন্তঃস্থলে ফিরতে চাইছেন। মানুষ সবই দেখছেন এবং বুঝছেন। বস্তুত এ সংঘাত মতবাদের নয়, এ সভ্যতার সংঘাত। উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে তাই পরম্পরাগত ভারতীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি, সংখ্যাগুরুতন্ত্র নয়, মূল ভারতীয়ত্বের প্রতি জনগণের আস্থা ও অনুরাগের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় কাউন্টার ন্যারেটিভ সত্যিই যে আর কিছু হয়না।
No comments:
Post a Comment