একদিকে মা সরস্বতীর ভাসানযাত্রা হচ্ছে আর অন্যদিকে আমার মতোই অনেকের প্রিয়তম গায়িকা শ্রীমতি লতা মঙ্গেশকরের পার্থিব শরীরটি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, একই সাথে, একই দিনে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এত কীর্তি, এত যশ, এত সন্মান, এত লোকের এত হাহুতাশ - শেষে সেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোম, এই অনন্য জীবনের কিছুমাত্র নতুন শরীরধরণের পর স্মরণেও আসবে না। তাহলে রয়ে গেলটা কি? রয়ে গেল সংগীত আর তার সুর তাল ছন্দ লয়, যার মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠেন ঈশ্বরীয় আনন্দরূপ, যার প্রতিটি স্বর এক একটি বীজমন্ত্র, যাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পরলে ঈশ্বরকে সরাসরি ছোঁয়া যায় - যে পথে সঠিকভাবে সাধনা করে সফল হতে পারলে মা সরস্বতী স্বয়ং কণ্ঠে বা যন্ত্রে এসে ভর করেন। লতাজির সেই উপলব্ধিটি তাঁর আনন্দকোষে গচ্চিত রয়ে যাবে চিরকাল, জন্মের পর জন্ম ধরে, হয়তো অন্য কোনো নামে, অন্য কোনো শরীরে, অন্য কোনো কালে।
১৯৪২ সাল থেকে নিয়ে ২০১৮ - লতাজির দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সংগীত জীবনে কত কিছুই না হয়েছে - দেশ থেকে ইংরেজদের ঝেঁটিয়ে তাড়ানো হয়েছে, তারপর ভারতবর্ষে ১৪জন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন আর ১৮জন প্রধানমন্ত্রী, যাঁরা প্রত্যেকে তাঁর গুনগ্রাহী। অন্তত এমন তিনটি প্রজন্ম তাঁর গান শুনে বড় হয়েছেন, যারা ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক হ্যাঙ্গোভার ঝেড়ে ফেলে 'সাহেবদের সময় সবকিছু কত ভালো ছিল' থেকে 'সাহেবরা আমাদের চেয়ে ভালো - কে বলেছে হে?', এই দীর্ঘ পথটা হেঁটে এসেছেন। আর এই দীর্ঘ কালখণ্ডে ভারতীয় জীবনের এমন কোনো অধ্যায় নেই যেখানে লতাজির কোনো না কোনো গান মানুষকে কোনো না কোনোভাবে প্ৰভাবিত করেনি, এত ব্যাপক ও সমৃদ্ধ সে সম্ভার।
লতাজি যেটা করতে পেরেছেন, সেটা তো কিছু কম নয়। এত বড় একটা দেশ, এতগুলো ভাষা, এত রকমের স্থানীয় সুরশরীর - সব বাধা পেরিয়ে তিনি সমস্ত ভারতবাসীর সুরের কান তৈরি করে দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে যাঁদের জন্ম, তা তিনি বাঙালি হন বা মারাঠি, ভোজপুরী হন বা কান্নাডিগা, নন ক্যাসিকাল ফরম্যাটে নিখুঁত সুর লাগানো কাকে বলে, ৩৬টি ভাষায় কমার্শিয়াল গান গেয়ে সেই মানকটি তাদের সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন লতাজি। আহা, তার সপ্তকেও গলার স্বর নিখুঁত থাকে, তাও আবার দশকের পর দশক ধরে, দুনিয়া জুড়ে এই অত্যাশ্চর্য্য ফেনোমেননের খুব বেশি উদাহরণ বোধহয় আর নেই।
দ্বিতীয়, লতাজির দৌলতে আমাদের দেশের soft power বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে বিরাট লাভ হয়েছে সেটা হলো পন্ডিত রবিশঙ্করের মতোই তিনিও ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বজনীন হতে খুব সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন কন্টিনেন্ট মিলিয়ে কর্মসুত্রে এমন কোনো দেশে যাইনি যেখানে লতাজির জনপ্ৰিয় latest গান পৌঁছয়নি, এবং তাতে বিদেশিদের প্রভাবিত হতে দেখিনি। এছাড়া বিদেশে জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও তাঁর গানের মাধ্যমে দেশের সাথে সহজে একটা আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছেন।
তৃতীয় যে জিনিসটা লতাজিকে সবার চেয়ে আলাদা করে দেয় সেটা হলো ওঁর underlying জাতীয়তাবোধ এবং sublime feminism, যার ছাপ তাঁর পরিধান, আচরণ এবং আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যে চিরকাল দারুণভাবে ফুটে ওঠেছে। নার্গিস থেকে নিয়ে করিনা কাপুর, সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টেছে কিন্তু লতাজি একই থেকে গেছেন - একজন অত্যন্ত সফল ভারতীয় নারীর মূর্ত প্রতীক হয়ে। সত্যিই, ক'জনের পক্ষেই বা আর ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর হয়ে ওঠা সম্ভব?
No comments:
Post a Comment