Wednesday, February 2, 2022

অহঙ্কার

ঠাকুর বলছেন, “যে ‘আমি’তে সংসারী করে, কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত করে, সেই ‘আমি’ খারাপ। জীব ও আত্মার প্রভেদ হয়েছে, এই ‘আমি’ মাঝখানে আছে বলে। জলের উপর যদি একটা লাঠি ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে দুটো ভাগ দেখায়। বস্তুত, এক জল; লাঠিটার দরুন দুটো দেখাচ্ছে।


“অহং-ই এই লাঠি। লাঠি তুলে লও, সেই এক জলই থাকবে।


“বজ্জাৎ ‘আমি’ কে? যে ‘আমি’ বলে, ‘আমায়’ জানে না? আমার এত টাকা, আমার চেয়ে কে বড়লোক আছে? যদি চোরে দশ টাকা চুরি করে থাকে, প্রথমে টাকা কেড়ে লয়, তারপর চোরকে খুব মারে; তাতেও ছাড়ে না, পাহারাওয়ালাকে ডেকে পুলিসে দেয় ও ম্যাদ খাটায়, ‘বজ্জাৎ আমি’ বলে, জানে না — আমার দশ টাকা নিয়েছে! এত বড় আস্পর্ধা!”


এই সূত্রে একটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। তার আগে হয়তো একটু গৌরচন্দ্রিকা করা প্রয়োজন। বলে নাকি আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি অপচয়প্রবণ জাতি, তা আমরা কি? বাড়ি বদলাবার সময় ঠিক ঠিক বোঝা যায় দীর্ঘ সময় ধরে কত অপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্তর আমরা অকারণে জড়ো করে বসে আছি। ঠিক একই অবস্থা আমাদের মনেরও। সেখানেও দেখবেন কত উপাধি জড়ো করে করে অহংকারের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছি আমরা, যার সবকটা আমাদের সাথে সাথেই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, একটাও কিন্তু সঙ্গে যাবে না। নিজেও এককালে পুরোপুরি মূর্খ ছিলাম তো, প্রচুর অপচয় করেছি, ঘরের কোনে আর মনের মধ্যে হাব্জিগাব্জি জমানোর জন্য কত যে পাগলামি করেছি, সে আর বলার নয়। সেই স্যুট টাই পড়া ব্রাউন সাহেবটার কথা মনে পড়লে এখন বেশ কৌতুক হয়। তবে আশেপাশে শিক্ষিত মূর্খের তো অভাব নেই, ফলে মজার উপাদানের এখনও কোনো ঘাটতি নেই। 


একজন পূর্বপরিচিত সজ্জন ইংরিজি নববর্ষের গ্রিটিংস কার্ড পাঠিয়েছিলেন, যদিও পেয়েছিলাম প্রায় দিন পনেরো পরে, পোস্ট অফিসের কল্যাণে। কিশোর এবং যুবক অবস্থায় ইনি classless society-র খুব বড় সমর্থক ছিলেন। যাইহোক, ধন্যবাদ দেবো দেবো করেও এতদিন দেওয়া হয় ওঠেনি, গত রবিবার মনে করে ফোন করলাম। কার্ডটি বেশ বড়ো, ভারী এবং দামি। ওপরে একজন নামী শিল্পীর একটি চমৎকার commissioned painting ছাপা, ভেতরের দিকে ওপরের পাতায় সুন্দর ক্যালিগ্রাফি করে ছাপা Seasons Greetings আর নীচের পাতায় একটু ছেড়ে ছেড়ে তিনটি মোটা নিবের সই, সেগুলোর নীচে নীচে সুন্দর করে পরপর সইকারীদের নাম ছাপা, নামের নীচে নীচে প্রত্যেকের ডিগ্রিসমূহ, অমুক ইউনিভার্সিটির স্নাতকোত্তর, তমুক ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট (সবই বিদেশি), অমুক সংস্থার ফেলো, তমুক সংস্থার ফেলো, তার নীচে অমুক কোম্পানির বড়কর্তা, তমুক কলেজের অমুক বিষয়ের ডিন, তমুক সংস্থার গবেষক ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এটি এক স্বামী, স্ত্রী আর তাঁদের একমাত্র কন্যার supposedly ব্যক্তিগত পারিবারিক শুভেচ্ছাজ্ঞাপন। 


তা, যাইহোক, ফোনে খানিক সদালাপের পর আমি জিজ্ঞেস করলাম কন্যা কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চয়ন করেছেন কিনা। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সংস্কারের ছাঁকনিতে ছাঁকা পাত্রের উচ্ছসিত প্রশংসা শুরু হয়ে গেল - দেশের অমুক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অমুক স্কলার, তমুক তমুক আই ভি লীগ ইউনিভার্সিটিসমূহের এই এই ডিগ্রিধারী, আমেরিকায় তমুক কোম্পানির তমুক বড় পদে কর্মরত, খুব শিগগিরই দেশি থেকে বিদেশি হয়ে যাবেন, বাপ-মা কত বড় চাকুরে, কত নামকরা বংশ, ইত্যাদি। মেয়েটাকে ছোট বয়স থেকে দেখছি তো, বিবাহ হচ্ছে জেনে সত্যিই খুব খুশি হয়ে বললাম যে হবু জামাইয়ের biodataটিও কার্ডে ছাপা উচিৎ ছিল, তাহলে সর্বাঙ্গসুন্দর হতো। খারাপ তো কিছু বলিনি, ভদ্রলোক হটাৎ "biodata" শব্দটি শুনে রেগে কেন গেলেন, বুঝলামই না। আরে! ময়ূর যখন ভাবছে তার পুচ্ছই জীবনের সার, তাতে আরো গোটাকতক রঙ্গিন পালক গুঁজলে তো ভালোই হয়, তাই না? কার্ডটা কিন্তু জম্পেশ, ময়ূরপুচ্ছের তৈরি হাতপাখার মতোই গরমকালে হওয়া খাওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত।


ঠাকুরের জীবনেও এমন কৌতুকের অভাব ছিল না। মজা করে আসল কথা বলছেন, “টাকাও একটি বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হলেই মানুষ আর-একরকম হয়ে যায়, সে মানুষ থাকে না।


“এখানে একজন ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বাহিরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে আমরা কোন্নগরে গেছলুম। হৃদে সঙ্গে ছিল। নৌকা থেকে যাই নামছি, দেখি সেই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে বসে আছে। বোধ হয়, হাওয়া খাচ্ছিল। আমাদের দেখে বলছে, ‘কি ঠাকুর! বলি — আছ কেমন?’ তার কথার স্বর শুনে আমি হৃদেকে বললাম, ‘ওরে হৃদে! এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা।’ হৃদে হাসতে লাগল।


“একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! টাকার এত অহংকার।”


ঠাকুরের গল্পের মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে অহংকার ত্যাগই আসল ত্যাগ। যেখানে উপাধি সেখানেই অহংকার, অর্থাৎ সেখানে ভগবানের থাকার জায়গা নেই। তার মানে অহংকার থাকা মানে আসলে ঈশ্বরকে ত্যাগ করা। কতভাবে তো প্রতিদিন চেষ্টা করছি যাতে সবসময় একমাত্র 'দাস আমি'টাই জেগে থাকে, মাঝে মাঝেই উপাধি এসে সব গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে যে! মা সহায় হন।

No comments:

Post a Comment