শ্রীশ্রীমায়ের স্তবের দ্বিতীয় স্তবকে পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী অভেদানন্দজী মহারাজ লিখেছেন,
গুণহীন সুতান পরাধ যুতান্ ,
কৃপয়াহদ্য সমুদ্ধর মোহ গতান্ ।
তরণীং ভবসাগর পারকরীং ,
প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্ ।।
অর্থাৎ, মা আপনি কৃপা করে এই গুণহীন সন্তানকে মায়া-মোহ হতে উদ্ধার করুন এবং এই সংসার সাগরে আমার জীবনতরণী পার করুন। আপনি পরমা জগজ্জননী – আপনাকে প্রণাম করি।
কারো কারো মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে শ্রীশ্রীমায়ের তো রক্ত মাংসের শরীর, তাহলে তিনি জগজ্জননী পরব্রহ্মময়ী হন কি ভাবে? মা নিজের স্বরূপকে এতটাই যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন যে ওঁর দেহধারণকালে এই বিভ্রান্তি আরো বেশি সৃষ্টি হতো, এখন বরং কিছুটা কম হয়।
শাস্ত্রে দেবী দুর্গার নামের বর্ণনা এইভাবে করা হয়েছে:
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
অর্থাৎ, "দ" অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, "গ" অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪)। এখানে দৈত্য অর্থে কেবল দিতি+য, দিতির (কশ্যপ পত্নী) পুত্র নয়, খারাপ লোক, মানবজন্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে যে বাধা দেয়, সেই অসুর প্রকৃতির ব্যক্তি।
দশপ্রহরণধারিনি দুর্গারূপে ভগবতী দেবী পার্বতী দুর্গমনাশিনী। দেবী দুর্গার আর এক রূপ হলো জগতের ধাত্রী অর্থাৎ জগতের পালিকা, দেবী জগদ্ধাত্রী। একই শক্তি, কেবল একজন নাশিনীরূপা আর অন্যজন পালিনীরূপা। তাই জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- “জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে/জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।” দেবী হলেন সচ্চিদানন্দের এক এবং অভিন্ন শক্তিরূপ, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথায়, যেমন আগুন আর তার দহিকাশক্তি, যেমন সমুদ্র আর তার ঢেউ।
আদি শঙ্করাচার্য্যের টীকা অনুসারে (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী তপস্যানন্দের অনুবাদ) "রাম" শব্দের অর্থ হলো যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু, যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। আবার সন্ত কবিরদাস তাঁর দোহায় চার রকমের রামের কথা বলেছেন "এক রাম দশরথ কা বেটা, এক রাম ঘট ঘট মে বৈঠা; এক রাম কা সফল পাসারা, এক রাম হ্যায় সবসে ন্যায়ারা।"
মানে একজন রাম যিনি দশরথ পুত্র অর্থাৎ রাজা, যাঁকে আমরা "মর্যাদা পুরুষোত্তম" বলি, অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ"। দ্বিতীয় রাম যিনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছেন অর্থাৎ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৃতীয় রাম যিনি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডময় প্রসারিত অর্থাৎ স্রষ্টা। আর চতুর্থ রাম যিনি সবচেয়ে অপূর্ব এবং আশ্চর্যময় অর্থাৎ যিনি সমস্ত কল্পনার অতীত সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম।
রামবতারে শক্তিরূপিণী জগজ্জননী হলেন সীতাদেবী। মা লক্ষ্মীর অপর নাম শ্রী। শ্রীবিষ্ণু, শ্রীরাম আর সীতারাম বা সিয়ারাম তাই একই। অর্থাৎ যুগলে কমলাসীনা লক্ষ্মী আর যোগনিদ্রারত বিষ্ণু, ব্রহ্মের স্বগুণ রূপ আর নির্গুণ রূপ। বিভিন্ন শব্দবন্ধে ওঁদের জয়ধ্বনিও ওই একই যুগলের জয়ধ্বনি, কোনো পার্থক্য নেই। যাহা জয় শ্রীরাম তাহাই জয় সিয়ারাম। মূলত মা দুর্গা এবং শ্রীরাম একই আদিশক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ, যিনি যে ভাবে দেখতে চান, দেখতে পারেন।
বিষ্ণুপুরাণ বলছেন পরমাত্মা শ্রীবিষ্ণুই হচ্ছেন একমাত্র পুরুষ, আর সবই প্রকৃতি। শ্রীরামের পরবর্তী অবতারে শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিষ্ণু বা পরমাত্মার প্রতীক আর শক্তিরূপিণী শ্রীমতি রাধারানী হলেন সকল জীবাত্মার প্রতীক। তাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার প্রণয়াসক্তি পরমাত্মা-জীবাত্মার শাশ্বত মিলনাসক্তিরই নামান্তর, অর্থাৎ পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণ। এটাই রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বের মূল কথা এবং ভারতীয় দর্শনেরও সারাৎসারও বটে।
রাজা বৃষভানু শ্রীরাধাস্তুতিতে বলছেন, "হে বিশ্বেশ্বরী, বিশ্বেশ্বর পূজিতা, তোমার পাদপদ্মে আমি প্রনত হই। ব্রহ্মা, হরি, শিব, ইন্দ্র, সব তোমারই অনন্তরূপ। তুমি ভিন্ন জগতে আর অন্য ধেয় নেই। জগত ভ্রান্তি মাত্র। হে মাতঃ, কৃপা করে আমাকে নিজ দাস জেনে অনুগ্রহ করো।" এখানেও পুরুষ এবং প্রকৃতির সেই এক এবং অভিন্ন স্বত্তার কথাই বর্ণনা করা হয়েছে।
আমাদের যুগে শ্রীবিষ্ণুর নবীনতম অবতার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ঠাকুর যখন ক্যানসার রোগে যন্ত্রণায় অস্থির, ভাতের তরল মণ্ড পর্যন্ত গলাধঃকরণ হচ্ছে না, তখন একদিন নরেন্দ্রনাথ দত্ত ঠাকুরের কাছে বসে ভাবছেন, 'এই যন্ত্রণামধ্যে যদি বলেন যে, আমি সেই ঈশ্বরের অবতার তাহলে বিশ্বাস হয়'। চকিতের মধ্যে ঠাকুর বললেন, “যে রাম যে কৃষ্ণ, ইদানিং সে-ই রামকৃষ্ণরূপে ভক্তের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।”
কথামৃতে দেখি যে এই ঘটনারও বছরখানেক আগে, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা-৪টা হবে, ঠাকুর দক্ষিনেশ্বরের ঘরে তাঁর পদসেবাকারী ভক্তদের বলছেন, “এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।”
রামকৃষ্ণ অবতারে শ্রীশ্রীমা হচ্ছেন তাঁর মহাশক্তি। তাই পঞ্চবটীতে সীতামায়ের দর্শন কালে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর হাতে যেমন ডায়মন্ড কাট সোনার বালা দেখেছিলেন, অনুরূপ সোনার অলঙ্কার তিনি মায়ের জন্যেও গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কোনো ঘটনায় শ্রীমা ক্ষুণ্ণ হলে ঠাকুর খুবই বিচলিত হতেন। ভাগ্নে ও সেবক হৃদয়কে তিনি মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ‘এর ভিতরে যে আছে সে ফোঁস করলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরও তোকে রক্ষা করতে পারবে না’।
শ্রীরাধার যোগমায়া রূপ সম্পর্কে ঠাকুর বলছেন, "রাধিকা বিশুদ্ধসত্ত্ব, প্রেমময়ী! যোগমায়ার ভিতরে তিনগুণই আছে -- সত্ত্ব রজঃ তমঃ। শ্রীমতীর ভিতর বিশুদ্ধসত্ত্ব বই আর কিছুই নাই। (মাস্টারের প্রতি) নরেন্দ্র এখন শ্রীমতীকে খুব মানে, সে বলে, সচ্চিদানন্দকে যদি ভালবাসতে শিখতে হয় তো রাধিকার কাছে শেখা যায়।
“সচ্চিদানন্দ নিজে রসাস্বাদন করতে রাধিকার সৃষ্টি করেছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণের অঙ্গ থেকে রাধা বেরিয়েছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণই ‘আধার’ আর নিজেই শ্রীমতীরূপে ‘আধেয়’, -- নিজের রস আস্বাদন করতে -- অর্থাৎ সচ্চিদানন্দকে ভালবেসে আনন্দ সম্ভোগ করতে।
“তাই বৈষ্ণবদের গ্রন্থে আছে, রাধা জন্মগ্রহণ করে চোখ খুলেন নাই; অর্থাৎ এই ভাব যে -- এ-চক্ষে আর কাকে দেখব? রাধিকাকে দেখতে যশোদা যখন কৃষ্ণকে কোলে করে গেলেন, তখন কৃষ্ণকে দেখবার জন্য রাধা চোখ খুললেন। কৃষ্ণ খেলার ছলে রাধার চক্ষে হাত দিছলেন। (আসামী বালকের প্রতি) একি দেখেছ, ছোট ছেলে চোখে হাত দেয়?”
পরম পূজনীয়া প্রব্রাজিকা অমলাপ্রাণা মাতাজি তাঁর 'জন্মজন্মান্তরের মা' বইতে লিখছেন, 'রামকৃষ্ণ যদি অবতার হন, তবে শ্রীমা নিশ্চয় তাঁর শক্তি। পূর্ব পূর্ব অবতারগণের শক্তির তেমন বিকাশ ছিল না। এযুগে সবই নূতন, অদ্ভুত। শক্তির বিশেষ ভূমিকা। শ্রীমার মধ্যে আমরা দেখতে পাই সীতার অপার সহিষ্ণুতা—বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে যিনি মহাদুঃখের জীবন যাপন করে গেছেন, নিত্য সাধ্বী, নিত্য শুদ্ধস্বভাবা। দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার দেহবোধরহিত অপার ভালোবাসা—'তৎসুখে সুখিত্বম্', যশোধরার মতো তিনি একান্তভাবে স্বামীর আদর্শের অনুবর্তিনী, বিষ্ণুপ্রিয়ার মতোই নীরব মহাসাধিকা।'
মায়ের শিষ্য ও আশ্রিত শ্রী চন্দ্রমোহন দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় কিন্তু একেবারে 'হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন'। উনি লিখছেন, 'শ্রীমা যখন জয়রামবাটী যেতেন তখন কখনো কখনো আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। একবার জয়রামবাটী থেকে শ্রীমা কলকাতা ফিরছেন। গরুর গাড়ি করে কোয়ালপাড়া হয়ে বিষ্ণুপুরে যাচ্ছি আমরা। আমার হঠাৎ খুব ইচ্ছা হল শ্রীমায়ের আসল রূপ দেখার।
এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মা বিশ্রাম করছেন গাছের ছায়ায়। নিরিবিলি দেখে মাকে একান্তে বললাম, “মা, আপনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন। আপনার দয়াতেই আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বেঁচে আছি। সমস্ত আপদ-বিপদ থেকে আপনি রক্ষা করছেন, তবুও আমার একটা অতৃপ্ত বাসনা আছে। সেই বাসনা আপনি পূর্ণ করে দিলে আমার মনস্কামনা ষোলকলায় পূর্ণ হয়।”
শ্রীমা বাসনাটি জানতে চাইলেন। বললাম, “আপনার আসল রূপ দেখাই আমার শেষ বাসনা।” মা কিছুতেই রাজী হলেন না। অনেক কাকুতি-মিনতি করায় মা গররাজি হয়ে অন্যান্যদের বললেন, “তোমরা একটু সরে যাও। ওর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।”
আমাকে বললেন, “দেখ, শুধু তুমিই দেখবে। ওরা কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু বলবেও না যতদিন আমি বেঁচে থাকব।”
এই কথা বলে মা আমার সামনেই নিজমূর্তি ধরলেন। জগদ্ধাত্রী মূর্তি! মায়ের ওই দিব্য জ্যোতির্ময়ী মূর্তি দেখে আমি তো ভয়ে একেবারে কাঠ। মায়ের শরীর থেকে জ্যোতি বেরোচ্ছে। চারদিক জ্যোতির আলোয় আলো হয়ে গেছে। তীব্র আলোর জ্যোতিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তারই মধ্যে দেখতে পেলাম, মায়ের দুই পাশে জয়া-বিজয়া। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, কাঁপুনি আর থামে না। স্হির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম। শ্রীমা জগদ্ধাত্রীর রূপ সংবরণ করে মানবী হয়ে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে আমার কাঁপুনি থামল।
স্বাভাবিক হয়ে আসতে মা বললেন, “যা দেখলে তা কিন্তু কাউকে বলো না যতদিন আমি বেঁচে আছি।” মাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার জয়া বিজয়া কারা? মা বললেন, “গোলাপ আর যোগেন।”
শেষে দুটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্বামীজি সুদূর আমেরিকা থেকে গুরুভাই পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দজী মহারাজকে চিঠিতে লিখছেন, “দাদাগো, রাগ কোরো না। মা ঠাকুরানি কি বস্তু, তা তোমরা কেউ এখনো বোঝোনি। রামকৃষ্ণ পরমহংস চলে যান, ক্ষতি নেই। কিন্তু মা গেলেই সর্বনাশ! তোমাদের ‘জ্যান্ত দুর্গা’র পুজো কাকে বলে, দেখাব!” দেখি, স্বামী শিবানন্দজীই আবার মায়ের পূতমানবদেহের অন্তিম সৎকারের পর বলছেন, “সতীর দেহ ৫১ খন্ডে বিভক্ত হয়ে সারা দেশে ৫১ টি শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে। সেই সতীর গোটা দেহটাই আজ বেলুড় মঠের মাটিতে, বাতাসে মিশে গেল। ভক্তগণ সমস্ত সতীপীঠ ঘুরে যে পুণ্য সঞ্চয় করে, এক বেলুড় মঠে আসলেই তারা সমান পুণ্যের অধিকারী হবে।”
No comments:
Post a Comment