আমাদের মতন সাধারণ মানুষের মন যেন সবসময় অবান্তর একটা কিছু অবলম্বন করে engaged থাকতে চায়, তা সে রোজগারের চিন্তা হোক বা রাজনীতি, যার যেমন পেটে সয় আরকি। হয়তো যেটা নিয়ে ভাবছি, চর্চা করছি, তাতে জাগতিক কোনো ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানও নেই, তবুও চিন্তার স্রোতকে মন সে দিকেই টেনে নিয়ে যায় আর আমরাও ভেসে যাই। হয়তো যে সময়ে এককালের ডাকসাইটে সুন্দরীকে জীর্ণ শীর্ন অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় দেখে মন নিত্য আর অনিত্যের চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই কেউ হয়তো কথাচ্ছলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিলেন, এক নিমেষে মন আগের constructive চিন্তাধারা ছেড়ে ম্যালকম মার্শেল, এন্ডি রবার্টস আর জোয়েল গার্নারে চলে গেল, গাভাস্কারের হাত থেকে ব্যাট উড়ে যাওয়ার ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠলো, ব্যাস নিত্য-অনিত্য সব গুলিয়ে ঘাঁট হয়ে গেল। মন সারাক্ষন নিচে নামার জন্য ছটফট করছে, একে তো তাকে মায়ার construct থেকে ওপরে ওঠানোটাই সমস্যা, তারপর ক্রমাগত উঠিয়ে রাখাটা আরো অনেক বড় সমস্যা। আসলে সংসারে থাকতে হলে একা একা থাকা বা দীর্ঘসময় মৌন থাকাটা খুব মুশকিল। ওদিকে কেঁচাকেঁচির মধ্যে থাকলে ফালতু চিন্তা avoid করাও খুব কঠিন।
মন যখন উচ্চ অবস্থায় থাকে তখন জপ ধ্যান সব খুব সহজে হয়, তখনকার thought process-টাই আলাদা। আর যেই নীচে নামার chance পায়, ওমনি মন আমাদেরকে control করতে শুরু করে, তখন ধ্যানের শান্তি তো কোন ছাড়, জপ করতে বসলেও ইষ্টের মূর্তি ছেড়ে সে এদিক ওদিক দৌড়োতে থাকে, বারেবারে টেনে আনলেও দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। মনের উচ্চ আর নিচ অবস্থা অনেকটা ওই ঢেঁকি খেলার মতন, কখনো এক দিকটা ওপরে, আবার কখনো অন্যদিকটা ওপরে, ক্রমাগত ওপর-নিচ হয়েই চলেছে। শ্রীশ্রীমায়ের মন সবসময় যোগে থাকতো কিন্তু যাতে ঠাকুরের কাজ সম্পুর্ন করা যায়, মা রাধুদিদি বা কালীমামাদের উৎপাত অবলম্বন করে নিজের মনকে জোর করে জগতে নামিয়ে রাখতেন আর আমাদের দুরাবস্থা দেখুন - সবসময়ই ভোগে, অনেক কষ্ট করে হয়তো একটুখানি ওপরে উঠলো, আবার যে কে সেই। কিভাবে এই সময় নষ্ট করা থেকে বিরত হওয়া যায়? শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ তাঁর 'সরল রাজযোগ' বইটিকে এর উপায় বলে দিয়েছেন।
স্বামীজী বলছেন,
'মনকে সংযত করবার পূর্বে মনকে জানতে হবে।
চঞ্চল মনকে সংযত করে বিষয় থেকে টেনে এনে একটা ভাবে স্থির করে রাখতে হবে। বারবার এইরকম করতে হবে। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা মনকে সংযত করে, রুদ্ধ করে ভগবানের মহিমা চিন্তা কর।
মনকে সংযত করবার সব চেয়ে সোজা উপায় চুপ করে বসে কিছুক্ষণের জন্য মনকে ছেড়ে দেওয়া, যেখানে সে ভেসে যেতে চায় যাক—দৃঢ়ভাবে চিন্তা করবে, ‘আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী; বসে বসে মনের ভাসাডোবা—ভেসে-যাওয়া দেখছি। মন আমি নয়!’ তারপর মনটাকে দেখ। ভাবো, মন থেকে তুমি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। ভগবানের সঙ্গে নিজেকে অভিন্নভাবে চিন্তা কর, জড়বস্তুর বা মনের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেল না।
কল্পনা কর—মন যেন তোমার সম্মুখে প্রসারিত একটা নিস্তরঙ্গ হ্রদ, এবং যে চিন্তাগুলি মনে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলি যেন হ্রদে বুদ্বুদ্ উঠছে আর তার বুকে লয় পাচ্ছে। চিন্তাগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করবার কোন চেষ্টা কর না, কল্পনার চক্ষে সেগুলি কেবল সাক্ষীর মত দেখে যাও—কেমন করে তারা ভেসে চলেছে। একটা পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন প্রথমে খুব ঘন ঘন তরঙ্গ ওঠে, তারপর তরঙ্গের পরিধি যত বেড়ে যায়, তরঙ্গ তত কমে আসে; তেমনি মনকে ঐভাবে ছেড়ে দিলে তার চিন্তার পরিধি যত বেড়ে যাবে, মনোবৃত্তি তত কমে আসবে। কিন্তু আমরা এই প্রণালী উল্টে দিতে চাই। প্রথমে একটা চিন্তার বড় বৃত্ত থেকে আরম্ভ করে সেটাকে ছোট করতে করতে যখন মন একটা বিন্দুতে আসবে, তখন তাকে সেখানে স্থির করে রাখতে হবে। এই ভাবটি ধারণা করঃ আমি মন নই; আমি দেখছি—আমি চিন্তা করছি, আমি আমার মনের গতিবিধি লক্ষ্য করছি। এইরকম অভ্যাস করতে করতে নিজের সঙ্গে মনের যে অভিন্নভাব, তা দিন দিন কমে আসবে; শেষ পর্যন্ত নিজেকে মন থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে ফেলতে পারবে, এবং ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে, মন তোমার থেকে পৃথক।
এটা যখন হয়ে যাবে, তখন মন তোমার চাকর, তাকে তুমি ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে। যোগী হওয়ার প্রথম স্তর—ইন্দ্রিয়গুলিকে অতিক্রম করা; আর যখন মনকে জয় করা হয়ে গেছে, তখন সাধক সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে।'
তবে 'মন স্থির হও' বললেই তো আর সে automatically নিয়ন্ত্রণে আসবে না, তার জন্যেও একটা process আছে।
স্বামীজী বলছেন,
'সম্পদে বিপদে, স্বাস্থ্যে রোগে—সব সময় যোগ অভ্যাস করে যাও, একটি দিনও বাদ দিও না।
যোগ-সাধনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হচ্ছে দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ—সে-সময় দেহ ও মন খুব শান্ত থাকে, চঞ্চলতা ও অবসাদ কিছুরই তখন প্রাবল্য থাকে না। যদি সে-সময় না পার, তা হলে ঘুম থেকে উঠে এবং শুতে যাবার আগে সাধন অভ্যাস করবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুব পরিপাটিভাবে প্রয়োজন (প্রত্যহ স্নান করবে)।
স্নানের পর বেশ দৃঢ়ভাবে আসনে বসবে, মনে করবে তুমি যেন পাহাড়ের মত অটল, কোন কিছুই তোমাকে নড়াতে পারবে না। মেরুদণ্ডের উপর জোর না দিয়ে কোমর, ঘাড় ও মাথা ঋজুভাবে রাখবে। মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়েই সব ক্রিয়া হয়, কাজেই সেটিকে দুর্বল করা চলবে না।
পায়ের আঙুল থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ স্থির করবে। এই স্থির ভাবটি মনে মনে চিন্তা কর, দরকার মনে হয় তো প্রতি অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মাথায় না পৌঁছনো পর্যন্ত ধীরে ধীরে নীচের দিক থেকে শরীরের প্রতি অঙ্গ স্থির করতে করতে ওপরের দিকে আসবে, যেন একটি অঙ্গও বাদ না যায়। তারপর সমস্ত দেহটি স্থির করে রাখবে। সত্য লাভ করবার জন্য ভগবান তোমায় এই দেহ দিয়েছেন; এই নৌকা আশ্রয় করেই সংসার-সমুদ্রের পারে চিরন্তন সত্যের রাজ্যে তোমায় যেতে হবে।
এটি করা হয়ে গেলে দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস গ্রহণ করবে, তারপর দুই নাসা দিয়েই নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। তারপর যতক্ষণ বেশ স্বচ্ছন্দভাবে পার, শ্বাস রুদ্ধ করে থাকবে। এইরকম চারবার করা হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নেবে এবং জ্ঞানালোকের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে।
‘যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মহিমা আমি ধ্যান করি, তিনি আমাদের মনকে প্রবুদ্ধ করুন’—আসনে বসে দশ-পনর মিনিট এই মন্ত্রটির অর্থ চিন্তা কর।
যে-সব উপলব্ধি বা দর্শনাদি হবে, গুরু ছাড়া আর কাকেও তা বলবে না।
যতটা সম্ভব কম কথা বলবে।
সৎ চিন্তা করবে; আমরা যা চিন্তা করি, তাই হয়ে যাই। সৎ চিন্তা মনের সকল মলিনতা দগ্ধ করতে সাহায্য করে।'
No comments:
Post a Comment