Saturday, July 30, 2022
আবার কুরুক্ষেত্র
Friday, July 29, 2022
আসন্ন মহাযুদ্ধ
Monday, July 25, 2022
কর্ম ও ফল
Monday, July 18, 2022
শ্রীম
আজ শুভ নাগপঞ্চমী, কথামৃতকার পূজ্যপাদ শ্রীমর জন্মতিথি। শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এমন এক অনন্য শিষ্য যাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে ঠাকুর আজও আমাদের সঙ্গে কথা কন আর ভবিষ্যতেও বিভিন্ন দেশ-জাতি জুড়ে সেই কথোপকথন চলতেই থাকবে। ঠাকুরের অন্য সন্ন্যাসী ও গৃহী পার্ষদরাও ঠাকুরের কথা বলেছেন, কেউ কেউ লিখেওছেন, কিন্তু শ্রীমলিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত তার অনন্যতায় ব্যতিক্রমী হয়েই রয়েছে।
শ্রীমর একটি বিশেষত্ব হলো কথামৃতে স্থান কাল পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যার ফলে পড়তে পড়তে আমাদের মনের মধ্যে একেবারে সেই দিনটির, সেই বিশেষ মুহূর্তটির যেন স্পষ্ট একটা ছবি তৈরি যায় - আমরা যেন ঠাকুরকে চলতে ফিরতে দেখি, তাঁর গরম লাগছে না ঠান্ডা লাগছে, তাঁর আশেপাশে কারা কারা আছেন, তিনি কি খাচ্ছেন, কি পরছেন, কখন সমাধিস্থ হচ্ছেন, সমাধি ভাঙছে - সবকিছু যেন আমাদের উপস্থিতিতে চোখের সামনেই ঘটছে বলে মনে হয়। সেই জন্যই ঠাকুরকে কৃত্তিম বা দূরের বলে বোধ হয়না, আর তাঁর দেখানো পথও সাধনযোগ্য বলেই মনে হয়।
এযাবৎ যত অবতার পুরুষ এসেছেন, প্রত্যেকের বাণীই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কেউ না কেউ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে একজন রক্ত মাংসের শরীরধারীরূপে শ্রীম যেমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন, এমনটা এর আগে আর কোনোকালে হয়নি। ঠাকুর হাসছেন গাইছেন খাচ্ছেন স্নান করছেন, বার্নিশকরা জুতো পরছেন, মোলস্কিনের র্যাপার গায়ে দিচ্ছেন, পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যাচ্ছে, ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন, শিষ্যদের শাসন করছেন, শিক্ষা দিচ্ছেন, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কচুরি খাচ্ছেন, থিয়েটার দেখছেন, সার্কাস দেখছেন, একদিকে শিশুর সারল্য আর অন্যদিকে সাক্ষাৎ অবতারবরিষ্ঠায় - জীবন্ত প্রাণবন্ত প্রত্যয়ী রসিক একজন দেবমানুষ, শ্রীম না থাকলে এই ব্যক্তিগত শ্রীরামকৃষ্ণকে হয়তো আমারা এমনভাবে পেতামই না।
এই যে ধ্যানালোকে আমরা বিভিন্নভাবে ঠাকুরকে দেখি, তার অধিকাংশ দৃশ্যকল্পেরই রচয়িতা শ্রীম। উনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের পাঁচটি খন্ড লিখেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন, গোটাটার সময়কাল ১৯০২-৩২, যার প্রথম চারটি খন্ড আট বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় আর শেষেরটি ২২ বছর পর। ডায়েরিতে সাংকেতিক এন্ট্রি দেখে দেখে গুরুর সাথে প্রতিটিদিনের সাক্ষাৎকার যদি বহুবছর পরেও অত বিশদে এবং নির্ভুলভাবে শ্রীম অনুধ্যান না করতে পারতেন, তাহলে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে, বিশেষতঃ গৃহস্থদের ক্ষেত্রে, ভক্তিমার্গের অপেক্ষাকৃত সহজ পথ এত প্রশস্ত হতো না। কথামৃতে ব্যবহৃত 'ভক্তি' শব্দের মোট সংখ্যা ৪০৯৪ আর ভক্তি-শব্দ বিযুক্ত পৃষ্ঠার সংখ্যা ১৩১।
শ্রীম নিজে লিখছেন, 'ঠাকুরের ভক্তির কথা যত ভাবিতেছি ততই অবাক হইতেছি। কেশব সেন হরিনাম করেন, অমনি তাঁকে দেখতে ছুটছেন, অমনি কেশব আপনার লোক হলেন। তখন কাপ্তেনের কথা আর শুনলেন না। তিনি বিলাতে গিয়েছিলেন, সাহেবের সঙ্গে খেয়েছেন, কন্যাকে ভিন্ন জাতিতে বিবাহ দিয়েছেন - এসব কথা ভেসে গেল। কুলটি খাই, কাঁটায় আমার কি কাজ? ভক্তিসূত্রে সকারবাদী, নিরাকারবাদী, এক হয়; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এক হয়; চারি বর্ণ এক হয়। ভক্তিরই জয়। ধন্য শ্রীরামকৃষ্ণ! তোমারই জয়!'।
ইংরিজি ১৮৮১-৮৬ সালের মধ্যে মোট ১৯৬ দিনের বিবরণ আছে কথামৃতে, যা শ্রীশ্রীমা স্বয়ং কেবল নিয়মিত শুনতে ভালোবাসতেনই না, অন্যদেরও পড়তে উৎসাহ দিতেন। মা বলেছিলেন, "মাষ্টার কি সুন্দরভাবে সব মনে করে লিখেছে! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ সামনে সব কথা হচ্ছে। কি বর্ণনা! আর এসব কথা যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে। এই সমস্ত পড়ে-শুনেই তো আজকাল এত লোক তাঁর দিকে ঝুঁকছে। শান্তি পাচ্ছে। এসব অমোঘ কথা।..." এটাই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রীদের কাছে শ্রীমর আসল দান। ঠাকুর শ্রীমকে বলেছিলেন, "তোমাকে গৌরাঙ্গর দলে দেখেছিলাম"। তাই ঠাকুরের সেই কল্পতরু অবস্থার আশীর্বাদ 'তোমাদের চৈতন্য হোক', শ্রীমর লেখনীর মাধ্যমেই বুঝি আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হচ্ছে।
Wednesday, July 13, 2022
গুরুদেব
Thursday, July 7, 2022
মা কালী
Tuesday, July 5, 2022
মৃত্যু-দর্শন
এক বন্ধু আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি অতুলপ্রসাদের গান পাঠালেন, 'আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার'। শুনতে শুনতে মনে হলো রবীন্দ্রনাথ একজায়গায় বলেছেন, 'জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন' (ফাল্গুনী, ১৩২২)। কবি জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যু শোক’ পর্যায়ে লিখেছেন ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর।'
মৃত্যু যে আসলে কি, সেটা আমরা হিন্দুরা যেভাবে বুঝি, বোধহয় অন্য কোনো ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ তেমনভাবে বোঝেন না। অন্য সবার কাছে ঈশ্বর একজন আলাদা মহাশক্তি, যিনি এই জগতের বাইরে কোনো এক স্বর্গলোকে থাকেন ও সেখান থেকে সমগ্র জীবজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং জগৎ তাঁর অধীন, আজ্ঞাবহ। আমাদের হিন্দুদের কাছে কিন্তু ঈশ্বর, যাঁকে আমরা ব্রহ্ম বলি, বাইরের কোনো শক্তি নন, আমরা স্বয়ংই ঈশ্বর, যদিও সেটা হয়তো আমরা সারা জীবন বুঝতেই পারিনা। ঈশ্বর যেহেতু অনন্ত, নিত্য, সত্য, অবিকার, ফলে আমরাও ঠিক তাইই - আমরা অমর। আমরা সাময়িকভাবে একটা শরীর ধারণ করি বটে যাতে এই সারসত্যটি উপলব্ধি করা যায় এবং সেই শরীরটি থাকাকালীন তা করা সম্ভব না হলে একসময় সেই শরীরটির মৃত্যু হয় এবং আবার নতুন করে একটি অন্য শরীর ধারণ করতে হয় কিন্তু তার সাথে আত্মার জন্ম-মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই - সে চিরন্তন, অক্ষয়।
তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতার ২য় অধ্যায়ের ২০নং শ্লোকে শ্রীভগবান বলছেন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥
অর্থাৎ, (আত্মার) না জন্ম হয়, না মৃত্যু হয় অথবা না কখনো উৎপন্ন হয় বা হবে বা হয়েছে। এ জন্মরহিত, নিত্য, চিরস্থায়ী, শরীর হত হলেও এ নিহত হয়না।
এটাই তো সেই শাশ্বত সত্য, যার ওপর গোটা বেদান্ত টিকে আছে। পার্থক্য কেবল এই, যে গীতায় আমরা স্বয়ং শ্রীভগবানের মুখ থেকে শুনতে পাই যে পরমাত্মা আর জীবাত্মা এক এবং অবিচ্ছেদ্য ফলে আত্মার মৃত্যু নেই, যা এর আগে ঋষিরা বহুবার বহুভাবে বলে গেছেন। এই শ্লোকের মধ্যেই তো বেদের সেই মহাবাক্যগুলি লুকিয়ে আছে, যা আমাদের শেখায় 'সোহহমস্মি = সঃ + অহম্ + অস্মি' - সেই পুরুষই আমি অথবা 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম = অহম্ + আত্মা + ব্রহ্ম' - আমি আত্মা ব্রহ্ম ইত্যাদি।
যজুর্বেদে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলছেন,
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তৎ ত্বং পূষন্নাপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।
পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্।
সমূহ তেজো যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি।
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি।
বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
অর্থাৎ, জ্যোতির্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যব্রহ্মের স্বরূপটি আবৃত রয়েছে। হে পূষণ, সত্যধর্মা, আমার দর্শনের জন্য আপনি সেটি উন্মোচন করুন। হে পূষণ, হে একর্ষি, হে যম, হে সূর্য, হে প্রজাপতিপুত্র, আপনি কিরণরাজি অপসৃত করুন। তেজ সংযত করুন; আপনার যেটি কল্যাণতম রূপ, আমরা যেন সেটাই দেখতে পাই। সেই পুরুষই তো আমি, আমিই সেই, আমিই অমৃত। আমার প্রাণবায়ু মহাবায়ুতে লীন হোক। এই শরীর ভস্মীভূত হোক।
যিনি সর্বভূতের হৃদয়ে বাস করেন, প্রাণ ও বুদ্ধিরূপে সমস্ত জগৎকে পূর্ণ করেন, যিনি পুরুষাকার - তাঁকেই এখানে পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষই আমার চৈতন্য স্বরূপ। আমি আর সেই পুরুষ অভিন্ন। বলা হচ্ছে যে পরমসত্য স্বরূপ সেই অগ্নিনামক ব্রহ্ম বা ওঁ-কার স্বরূপ ব্রহ্ম আর আমি অভেদ। বেদে বর্ণিত মহাজাগতিক সৃষ্টির ভিত্তি হলো পঞ্চভূত - ক্ষিতি, বরুণ, মরুত, তেজ ও ব্যোম। এখানে বরুণ বা বায়ুকে উপলক্ষ করে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে - প্রাণবায়ু আর মহাবায়ুর মাধ্যমে।
নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে যখন মহাবায়ু দেহে প্রবেশ করে, সেটি আমার বলে মনে হয়। আর্থাৎ আমার দেহে আবদ্ধ বায়ুর মালিক আমি। যতক্ষণ দেহ ততক্ষণ আমিত্ব আর ততক্ষণ দেহ নামক পাত্রে মহাবায়ু আর প্রাণবায়ুর ভেদজ্ঞান। দেহের মৃত্যুর সাথেসাথেই প্রাণবায়ু আবার মহাবায়ুতেই বিলীন হয়। মূলত এখানে বায়ুই মূখ্য। মহাবায়ুই আমাকে জীবন্ত রেখেছে। আমার দেহে আবদ্ধ যে বায়ু তা কিন্তু কখনোই মহাবায়ু থেকে আলাদা ছিল না। কিন্তু দেহ নামক পাত্রের জন্য সেটি আবদ্ধ ও ভিন্ন বলে মনে হচ্ছিল। দেহ না থাকলেই এই পার্থক্য ঘুচে যাবে। ঠিক সেইরকমই, আমিই সেই পুরুষ, কিন্তু সেই পুরুষ হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা আবৃত। পাত্র মানে দেহ। অর্থাৎ এই আবরণের অপসারণ ঘটলেই জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতা প্রকাশ পাবে। এই আবরণ মুক্ত করার জন্যই ঋষি উপাসনা করছেন। আর ঋষিবাক্য পড়তে পড়তে আমরাও হয়তো বুঝতে পারছি যে গভীর মনোযোগ দিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে মৃত্যুচিন্তা করতে পারলে একদিন না একদিন, কোনো না কোনো জন্মে, 'আমিই ব্রহ্ম' - এই সত্য আমাদের মধ্যে উদ্ভাসিত হবেই।
আমাদের যুগের ঋষি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, ওনাকে দিয়েই নাহয় আজ শেষ হোক। আমাদের মাতৃভাষাতেই এইভাবে কবি তাঁর মৃত্যু-দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন:
এ মৃত্যু ছেদিতে হবে, এই ভয়জালে,
এই পুঞ্জপুঞ্জীভূত জড়ের জঞ্জালে,
মৃত আবর্জনা। ওরে, জাগিতেই হবে
এ দীপ্ত প্রভাতকালে, এ জাগ্রত ভবে
এই কর্মধামে। দুই নেত্র করি আঁধা
জ্ঞানে বাধা, কর্মে বাধা, গতিপথে বাধা,
আচারে বিচারে বাধা, করি দিয়া দূর
ধরিতে হইবে মুক্ত বিহঙ্গের সুর
আনন্দে উদার উচ্চ।
সমস্ত তিমির
ভেদ করি দেখিতে হইবে ঊর্দ্ধশির
এক পূর্ণ জ্যোতির্ময়ে অনন্ত ভুবনে।
ঘোষণা করিতে হবে অসংশয়মনে--
"ওগো দিব্যধামবাসী দেবগণ যত,
মোরা অমৃতের পুত্র তোমাদের মতো।"
(নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ৬১নং কবিতা)