Saturday, April 30, 2022

রামকৃষ্ণ মিশন ১২৫

আজ ১লা মে, রামকৃষ্ণ মিশনের শুভ প্রতিষ্ঠা দিবস। এই উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সকলকে শুভেচ্ছা জানাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহাসমাধিতে প্রবেশ করলেন ১৬ই অগাস্ট ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর অধিকাংশ সন্তানরা সংসার ত্যাগ করে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে বরানগরে টাকির জমিদারদের একটি জরাজীর্ণ বাগান বাড়ি ভাড়া করে একসাথে থাকতে শুরু করলেন। 

কয়েকমাস পর বাবুরাম মহারাজ অর্থাৎ স্বামী প্রেমানন্দজীর মায়ের আমন্ত্রণে তাঁর আঁটপুরের পৈতৃকভিটায় তাঁরা নয়জন গুরুভাই বেড়াতে গেলেন এবং সেখানে ২৪শে ডিসেম্বর ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের রাতে স্বামী বিবেকানন্দজীর প্রেরণায় সবাই একসাথে সন্ন্যাসদীক্ষা নিলেন। 

স্বামীজী বরানগর মঠ থেকে প্রবজ্যায় বেরিয়ে গেলেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে আর তারপর ধীরে ধীরে একমাত্র ঠাকুরের নিত্যপূজার পূজারী স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী ছাড়া বাকি পার্ষদরাও যে যার মতন এক এক করে বেরিয়ে পড়লেন প্রবজ্যায়, তবে সবাই মাঝেমধ্যে মঠে আসতেন - যেতেন।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মঠ স্থানান্তরিত হলো আলমবাজারের এক কুখ্যাত ভুতুড়ে বাড়িতে। স্বামী অভেদানন্দজী তপস্যা শেষ করে সেই বছরই মঠের নতুন ঠিকানায় ফিরে এলেন আর ১৮৯২-৯৪ একটানা দুবছর সেই মঠবাড়িতে কাটিয়ে গেলেন ১৮৯১ সালে পোর্বন্দরে স্বামীজীর সাথে হটাৎ দেখা হয়ে যাওয়া স্বামী ত্রিগুনাতীতানন্দজীও। 

তারপর ৩১শে মে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্বামীজী বোম্বে থেকে জাহাজে শিকাগোর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন আর পাশ্চাত্যজয় করে দক্ষিণ ভারত কাঁপিয়ে কলকাতায় ফিরলেন চার বছর পর ১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে বা হয়তো কিছু আগে-পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দজী সহ মোটামুটি ঠাকুরের অন্য সব সন্ন্যাসী সন্তানেরাও নিজেদের প্রবজ্যা সেরে মঠে ফিরে এসেছিলেন। 

অবশেষে ১লা মে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও অন্তরঙ্গ গৃহী শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার বাগবাজারে, ৭নং গিরিশ এভিনিউস্থিত শ্রী বলরাম বসুর বাসভবনে স্বামীজী প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন, আজ যার ১২৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে। 

প্রাথমিক উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট : to spread the teachings of Vedanta as embodied in the life of Sri Ramakrishna and to improve the social conditions of the Indian people, অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে প্রতিভাত বৈদান্তিক ভাবধারার প্রচার এবং ভারতের দরিদ্রনারায়ণের সামাজিক উত্থান। অবশ্যই এর বিশ্বজনীন উদ্দেশ্যও আছে, যা মূলতঃ শিবজ্ঞানে জীবসেবা ও ধর্ম সেবা ও শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যর ওপর আধারিত, যার কার্যপ্রণালী বলরামবাবুর বাড়িতেই ৫ই মের দ্বিতীয় বৈঠকে স্থিরীকৃত হয় এবং এখনো বলবৎ আছে। 

১৮৯৮-৯৯ কালখন্ড জুড়ে বিভিন্ন সময়ে স্বামীজী মিশনের পরিবর্ধিত নিয়মাবলী স্বামী সুবোধানন্দজীকে ডিক্টেশনের মাধ্যমে গোটাটা লিখিয়ে দিয়েছিলেন, যা পরে ৪ঠা মে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারি আইন মোতাবেক পঞ্জিকৃত হয়। 

স্বামীজী নিজের হাতে রামকৃষ্ণ মিশনের যে প্রতীক তৈরি করে দিয়েছিলেন, যার নীচে 'तन्नो हंस: प्रचोदयात्' (তন্নো হংসঃ প্রচোদয়াৎ) লিখেছিলেন, তার ব্যাখ্যাও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন, “The wavy waters in the picture are symbolic of Karma, the lotus of Bhakti, and the rising-sun of Jnana. The encircling serpent is indicative of Yoga and awakened Kunadalini Shakti, while the swan in the picture stands for Paramatman. Therefore, the ideal of the picture is that by the union of Karma, Jnana, Bhakti and Yoga, the vision of the Paramatman is obtained.” অর্থাৎ তরঙ্গায়িত জল কর্মের প্রতীক, পদ্ম ভক্তির প্রতীক। উদীয়মান সূর্য জ্ঞান, কুণ্ডলিত সর্প যোগ ও কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের প্রতীক; যেখানে রাজহাঁস হ'লো পরমাত্মার প্রতীক। সুতরাং, ছবিটার সামগ্রিক ভাবনা হ'লো কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও যোগের সমন্বয়ের মাধ্যমে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করা যায়।

'তন্নো হংসঃ প্রচোদয়াৎ" শব্দবন্ধটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়  তৎ + নহ্ + হংস + প্রচোদয়াৎ। 'তৎ' মানে তিনি, 'নহ্' মানে আমার, 'হংসঃ' মানে এক্ষেত্রে পরমহংসদেব আর 'প্রচোদয়াৎ' মানে উদ্ভাসিত করুন। অর্থাৎ, হে পরমহংসদেব, আমার হৃদয়কে আপনি উদ্ভাসিত করুন। এর আরো নানান বিস্তারিত শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আমি এটির অর্থ এইভাবেই বুঝি।

Wednesday, April 27, 2022

পরমজ্ঞান

যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে মহামুনি বশিষ্ঠদেব শিষ্য শ্রীরামচন্দ্রকে একজায়গায় বলছেন, "বৎস রামচন্দ্র, স্বর্গ-মর্ত-পাতালের এই ত্রিজগৎ মনের কল্পনাতেই নির্মিত। তাই তুমি যদি জগতের অনিত্যতাকে উপলব্ধি করতে পার, তোমার আত্মা প্রশান্ত হবে। মনে রেখ, রাগদ্বেষাদিতে দূষিত চিত্তকেই সংসার বলা হয়।... হে রাম, অজ্ঞানতা বশত বিষয়ের আকাঙ্খা জন্মায়। এটাই বাসনার প্রথম অঙ্কুর। এখান থেকে মোহ জন্মায়, চিৎ আপন পূর্ণতা বিস্মৃত হন। রামচন্দ্র, চিত্তকে অখণ্ডিত অদ্বৈতে পরিণত করো। এই নিখিল জগৎ অদ্বৈত ব্রহ্মের প্রকাশ।"

শিষ্যকে বোঝাবার জন্য গুরু নানারকমের গল্প বলে বলে ধীরে ধীরে ব্রহ্মতত্ত্ব আর সংসারের অনিত্যতার সূত্র উন্মোচিত করছেন। এমনই একটি গল্পের চরিত্র ইন্দ্র নামক এক লম্পট ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণ, যিনি অহল্যা নামক এক রাজমহিষীর প্রেমে পাগল। গল্পটি বাদ দিয়ে, শেষে এই ইন্দ্রের মুখ দিয়ে বশিষ্ঠ যা বলাচ্ছেন ওটিই আসল, "মন দিয়ে যা করা যায়, সেটিই যথার্থ কৃত। আর শরীর দিয়ে যা করা হয়, সেটি অযথার্থ। যার দেহ-ভাবনা নেই, সে কখনও দেহধর্মে বাধ্য হয় না। যোগীরা যেমন! অন্তর্দৃষ্টির কারণেই তাঁদের আত্মদেহে সুখদুঃখের বোধ থাকে না।"

শ্রীরামকৃষ্ণদেবও এমনই এক গল্প শুনিয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শিবনাথ শাস্ত্রীকে।
"শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি গুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধর্তে ছিল। একটি চিল এসে একটা মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যে দিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেই দিকে যেতে লাগল। দক্ষিণ দিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেই দিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন গেল, ওরাও সেই দিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিত্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর বসল। বসে ভাবতে লাগল - ঐ মাছটাই যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই আমি নিশ্চিত্ত হলুম।'
অবধূত চিলের কাছে এই শিক্ষা করলেন যে যতক্ষণ সঙ্গে মাছ থাকে অর্থাৎ বাসনা থাকে ততক্ষণ কর্ম থাকে আর কর্মের দরুন ভাবনা চিন্তা, অশান্তি। বাসনা ত্যাগ হলেই কর্মক্ষয় হয় আর শান্তি হয়।" (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত ১,১০৬-০৮)

আমাদের গোটা শাস্ত্র জুড়ে এমন ভুরিভুরি উপাখ্যান ছড়িয়ে আছে। বেদে যম এবং বালক নচিকেতার সেই বিখ্যাত কথোপকথনে দেখা যায় যে তৃতীয় বর চাওয়ার বেলায় নচিকেতা বললেন, "মানুষের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন জাগে তার কী হয়। কেউ বলে তার অস্তিত্ব থাকে না, কেউ বলে থাকে। অনুগ্রহ করে আমায় যথার্থ উত্তর বলে দিন।"

মৃত্যুরাজ যম উত্তর দিলেন "প্রাচীনকালে দেবতারা এই রহস্যভেদ করতে চেয়েছিলেন। এই রহস্য এত সূক্ষ্ম যে জানা খুবই কষ্টকর। অন্য কোনও বর চাও, এটি চেয়ো না। শতবর্ষব্যাপী দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করো। গবাদি পশু, অশ্ব প্রার্থনা করো। বিশাল সাম্রাজ্য প্রার্থনা করো। এর উত্তরের জন্য আমায় অনুরোধ কোরো না। মানুষ জীবন উপভোগের জন্য যা কিছু কামনা করে, সেই সব প্রার্থনা করো, আমি প্রার্থনা পূর্ণ করব। কিন্তু এই রহস্য জানতে চেয়ো না"। নচিকেতা বললেন, "না মানুষ সম্পদে তৃপ্ত থাকতে পারে না। এমনকি দীর্ঘতম জীবনও খুব সংক্ষিপ্ত। এইসব ঘোড়া, রথ, নাচ-গান, আপনার কাছে থাক। মানুষ সম্পদে সন্তুষ্ট হতে পারে না। আপনি যতদিন চান ততদিনই আমরা জীবিত থাকব। আমি যে বর প্রার্থনা করেছি সেইটি শুধু আমি চেয়েছি।"

যম এই উত্তরে খুশি হয়ে বললেন, "পূর্ণতা এক বস্তু, ভোগ অন্য বস্তু, এই দুয়ের লক্ষ্য আলাদা, এরা মানুষকে দু-ভাবে আকৃষ্ট করে। যে পূর্ণতা বেছে নেয়, সে শুদ্ধ হয়। যে ভোগকে বেছে নেয়, সে প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। পূর্ণতা এবং ভোগ উভয়ই মানুষের কাছে আসে। জ্ঞানী দুটিকে পরীক্ষা করে একটিকে অন্যটির থেকে আলাদা করেন। তিনি পূর্ণতাকে ভোগের চেয়ে বড়ো বলে বেছে নেন, কিন্তু মূর্খ ব্যক্তি দেহের সুখের জন্য ভোগকে বেছে নেয়। হে নচিকেতা, যেসব বস্তু আপাতকাম্য, চিন্তা করে জ্ঞানীর মতো তুমি তা ত্যাগ করেছ।"

যোগবাশিষ্ঠতে অন্য একজায়গায় শ্রীরামচন্দ্র গুরুকে জিজ্ঞেস করছেন, "হে ব্রহ্মণ্‌! সৃষ্টির রূপ-রেখা সম্পর্কে আপনি যা বললেন, তা শুনলাম। কিন্ত শুদ্ধসত্ত্ব হরি-হরও যে অবিদ্যার বিলাস, এই কথায় আমি বিভ্রান্ত হচ্ছি।"
উত্তরে বশিষ্ঠ বলছেন, "এই দৃশ্যমান সৃষ্টি উন্মেষিত হওয়ার পূর্বে সৎ-চিৎ-আনন্দরূপে নির্বিকার ও নিরাকার ছিল। সচ্চিদানন্দত্বের মৌলিক নির্মল সত্তা নাম-রূপের অতীত। সেই অমলিন সত্তা নামরূপ আকারে প্রকাশিত হওয়া অবধি শান্ত এবং বিকারশূন্য থাকে। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ সংস্কারের আকারেই ভাসমান ছিল। তত্ত্বজ্ঞানীর বোধে সেই ভাসমান জগৎ-সংস্কার সর্বাত্মক ও সম্বিৎ মাত্র। সৃষ্টির উন্মেষ-সম্ভাবনায় চিদাভাস উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ফুরণশীল হয় এবং মায়াশক্তির প্রভাবে জগৎ-সংস্কারের সূচনা হয়। সেই জগৎ-সংস্কার হতে অতি সূক্ষ্ম রেখার মত আগামী কালে প্রথমে অতিসূক্ষ্ম, পরে মধ্যসূক্ষ্ম ও স্থূল জগৎ প্রকাশিত হয়। অতিসূক্ষ্ম জগৎ চিদাভাসের দেহবৎ নিরাকার। সেই সূক্ষ্মমূল হতে সমষ্টিমন বা হিরণ্যগর্ভ এবং পরে স্থূল জগৎ কল্পিত হয়। সূক্ষ্ম, মধ্যসূক্ষ্ম এবং স্থূল, এই কল্পিত ত্রয়ীকে সত্ত্ব, রজ ও তম ত্রিগুণ আখ্যায় কল্পনা করা হয়। সেই ত্রিগুণের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি এবং অবিদ্যা বলে। অবিদ্যাই সংসার এবং অবিদ্যার অপর পারে চিদ্‌ব্রহ্মের পরমপদ।"

বিবেকানন্দ পত্রবলী পড়লে দেখা যাবে যে তাতে স্বামীজী ২৩ জুন ১৯০০ সালে মিস মেরী হালেকে লেখা চিঠিতে নিজের সম্পর্কে সোজাসুজি বলছেন, "আমি অদ্বৈতবাদী; আমাদের লক্ষ্য জ্ঞানার্জন - সেখানে কোনো অনুভূতি, কোনো ভালোবাসার স্থান নেই, কারণ এই সবই বস্তু, কুসংস্কার এবং বন্ধনের বাহন। আমি শুধু অস্তিত্ব এবং জ্ঞান।" এটাই সত্যের সারাৎসার।

Tuesday, April 19, 2022

ভারত-পাক ও কাশ্মীর

আমাদের দেশে যেমন প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা, প্রত্যেকের নির্দিষ্ট নিজস্ব দায়িত্ব আছে এবং ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড স্ট্রাকচারের কান্ডারীরা সবাই দেশের নির্বাচিত সরকারের আজ্ঞাবহ, ফলে আমাদের দেশে সেনাবাহিনী সরকারের একটি বিভাগ বৈ আর কিছু নয়, পাকিস্তানে তেমনটি নয়। ভারতে আসল ক্ষমতা যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার হাতে, ভারতীয় গণতন্ত্রে আখেরে প্রতিষ্ঠান বলতে তাঁরাই এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলতেও মূলত সরকারি নীতির বিরোধিতাকেই বোঝায়। কোনোদিন কাউকে আদালত বা সংসদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে কেউ কি দেখেছেন - যদিও তাত্বিকভাবে এক্সেকিউটিভ, জুডিসিয়ারী আর লেজিস্লেচার মিলিয়েই সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ন্যাশনাল এসট্যাবলিশমেন্ট ইউনিট হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। পাকিস্তানে কিন্তু ফৌজকেই এসট্যাবলিশমেন্ট বলে, কারণ সমস্ত রাষ্ট্রক্ষমতাটা একমাত্র তাদের হাতেই কেন্দ্রীভূত। ওদেশে প্রথমত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠ হয়না, দ্বিতীয়ত ওখানে সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক পরম্পরা এখনো তৈরিই হয়নি, তৃতীয়ত ওঁদের দেশে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা রাজনেতা হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের আর চতুর্থত ওঁদের প্রধানমন্ত্রী এবং বাকি এক্সেকিউটিভ, জুডিসিয়ারী আর লেজিস্লেচার কেউই স্বাধীন নন, তাঁরা সবাই বকলমে ফৌজের অধীন। ১৯৫৬ সাল থেকে নিয়ে ওদেশের মূল সংবিধানই এখনো অবধি চারবার বদলেছে, ৫৬, ৬২ আর ৭৩, মাঝখানে সংবিধানই গায়েব, আবার ২০০২তে ১৯৭৩এর সংবিধানকে ফিরিয়ে আনা, এতটাই হাস্যকর ওদেশে আইনের শাসন।


পাকিস্তানের তথাকথিত সিভিলিয়ান সরকার ফৌজের ইচ্ছামত ক্ষমতায় থাকেন বা ক্ষমতাচ্যুত হন আর ফৌজের সম্মতি ছাড়া কেউই কোনো নির্ণয় নিতে পারেননা। কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী নিজেদের সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করেছিলেন বটে - একজন ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন, একজন খুন হয়েছিলেন, একজন দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছিলেন আর সর্বশেষজনকে মারমূখী লাবেকদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে, ভুল পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধ শুরুর দিনে রুশ পাঠিয়ে দিয়ে, বেইজ্জত করে বিতাড়িত করা হয়েছে। আসলে পাকফৌজ ওঁদের দেশের সিভিলিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেমটাকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করে। এই যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও ইমরান খান এখনো এত খরচা করে চতুর্দিকে বিশাল বড় বড় জলসা করে বেড়াচ্ছেন, এই যে রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভী নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং তাঁর মন্ত্রীসভাকে শপথবাক্য পাঠ করাতে রাজি হচ্ছেন না, এই যে বিলায়ল ভুট্টো প্রথমে রাজি হয়েও পরে মন্ত্রী হতে অস্বীকার করলেন - এগুলো কাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে বলে মনে হয়? এগুলোর মাধ্যমে আসলে ওদেশের এসট্যাবলিশমেন্ট মিঞা শাহবাজ শরীফকে বার্তা দিচ্ছে, 'নিজের দাদার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েওনা, তোমার প্রাণভ্রমরা কিন্তু আমাদের হাতে, বেশি ট্যাঁফু করলেই সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেবো'।


পাকফৌজ হলো দুনিয়ার সেই একমাত্র আনোখা ফৌজ যারা স্যানিটারি ন্যাপকিন থেকে নিয়ে বেভিফুড, সব বানায়, বাচ্চাদের লবনচুস আর খেলনা বেচে, আবার জমি-বাড়ির দালালিও করে, তবে এখন পাকিস্তানে বাজার খুবই মন্দা, মুদ্রাস্ফীতির চোটে খরিদ্দারের পকেট গড়ের মাঠ। ফৌজ এইমুহূর্তে খুব ঝামেলায় আছে, বলা যায় একপ্রকার অস্তিত্বসঙ্কটে ভুগছে। একদিকে আমেরিকা টাকা এবং হাতিয়ার, দুটোই দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, চীনের দেওয়া অস্ত্রগুলো প্রায় অব্যাবহারযোগ্যই, যুদ্ধের বাজারে ইউক্রেনের অস্ত্র কারখানাগুলোকে রুশ ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে মেন ব্যাটেল ট্যাঙ্কের বারুদ আর স্পেয়ার পার্টস কোথা থেকে আসবে ভেবে মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেছে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতই খারাপ যে পয়সা খরচ করে ভাল হাতিয়ার ও কলকব্জা কেনার ক্ষমতাই নেই, তার ওপর আবার নিজেদের হাতে তৈরি আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা কিছুতেই ডুরান্ড লাইন মানতে চাইছে না, রোজ ফৌজি হামলা করেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো বালুচ স্বাধীনতাসংগ্রামী আর পাকিস্তানি তালিবানরা, এদের হাতে প্রতিদিন গাদাগাদা পাকসেনা মারা যাচ্ছে, চীনি ইঞ্জিনিয়াররাও এদের প্রাণঘাতী আক্রমণের ভয়ে দাসু ড্যাম আর সিপেক ছেড়ে পোঁ পাঁ পালিয়েছেন। কাশ্মীর কাশ্মীর করে হাজার প্রোপাগান্ডা করেও ফৌজ আর নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারছে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণ খোলাখুলি খিল্লি করতে শুরু করেছে, যা এতদিন অভাবনীয় ছিল। জেনারেল বাজওয়া বুদ্ধিমান লোক, এমনটা যে হবে অনেকদিন আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই ভারতের সাথে সিজ-ফায়ার চুক্তি করে একটা দিক অন্তত উনি সুরক্ষিত করেছিলেন কারণ এর ওপর যদি সীমান্তে ভারতের মার সামলাতে হতো, পাকফৌজ এতদিনে পুরো পাগল হয়ে যেত।


এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দুদিন আগে লেখা মিঞা শাহবাজ শরীফের একটি ধন্যবাদমূলক চিঠি। তাতে একজায়গায় উনি লিখেছেন, 'আমরা চাই যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠুক। আমাদের জনগণ ও অঞ্চলের অগ্রগতি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য দুদশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা অপরিহার্য। আমাদের জম্মু ও কাশ্মীরের মূল ইস্যু-সহ প্রতিটি মতান্তরের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে'। উল্লেখযোগ্য যে এর আগে মিঞাসাহেবকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছিলেন, 'পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য মহামহিম মিঞা মহম্মদ শাহবাজ় শরিফকে অভিনন্দন। ভারত এমন একটি সন্ত্রাসমুক্ত শান্ত ও স্থিতিশীল আঞ্চলিক পরিবেশ চায় যাতে আমরা আমাদের দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলি উপর মনোসংযোগ করতে পারি এবং আমাদের জনগণের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি'। নতুন প্রধানমন্ত্রী আসতেই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই যে একটা সদর্থক বার্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার পেছনে বহুলাংশে কিন্তু পরিস্থিতির শিকার পাক এসট্যাবলিশমেন্টের এখনকার বাধ্যবাধকতা আর তাদের অনুপ্রেরণায় ইদানিং নিশ্চুপে ঘটে চলা ব্যাক-চ্যানেল বার্তাসমূহের অগ্রগতি দায়ী। হয়তো এমনও হতে পারে যে আসন্ন জুলাই মাসের এসসিও সামিটের আড়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা হয়তো একবার একসাথে বৈঠকেই বসে গেলেন।


গত ২রা এপ্রিলে 'ইসলামাবাদ সিকিউরিটি ডায়ালগ ২০২২' উপলক্ষে জেনারেল বাজওয়ার ভাষণে দুতরফের প্রতিটি কথারই হুবহু প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। উনি বলেছিলেন, “We believe that peace and stability in our wider region are pre-requisites for achieving shared regional prosperity and development.... Pakistan continues to believe in using dialogue and diplomacy to resolve all outstanding issues including the Kashmir dispute and is ready to move forward in this front if India agrees to do so. With one-third of the world in the Gulf region involved in some sort of conflict and war it is important that we keep the flames of fire away from our region.... I believe it is time for the political leadership of the region to rise above their emotional and perceptional biases and break the shackles of history to bring peace and prosperity to almost three billion people of the region”. সোজাকথা, পাক ফৌজ চায়নি, তাই নওয়াজ শরিফ বা বেনজির ভুট্টোরা এতদিন কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান পাকিস্তানিদের দিয়ে মানিয়ে নিতে পারেননি, এখন চাইছে তাই হতে পারে। এখন পরিস্থিতি এমন যে ফৌজ নিজেদের আর্থিক ও জনসমর্থনজনিত সমস্যায় নিজেরা এতটাই জেরবার যে একদিনের মধ্যে ক্যাপ্টেন অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, ধারা ৩৭০ আর ৩৫এ উঠিয়ে দিলেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বদলা নেওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই, ব্রহ্মস উড়ে গিয়ে পড়লেও খানিকটা চেঁচামেচি করে বেইজ্জতি হজম করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। এই হলো সুবর্ণ সুযোগ মহর্ষি কাশ্যপ আর কালহনের বিচরণভূমি পাকঅধিকৃত কাশ্মীরকে পুনরায় ভারতভুক্তি করার এবং সেটা একটিও গুলি না ছুঁড়ে। জেনারেল বাজওয়া তো বলেইছেন “we want it to be settled quickly through dialogue and diplomacy”, তাহলে আর অসুবিধেটা কোথায়? চীন ব্যাগরা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে নিশ্চয়, কিন্তু আশাকরি নতুন ভারতের আত্মবিশ্বাসী বিদেশনীতি সাফল্যের সঙ্গে সেই হস্তক্ষেপ রুখে দিতে সমর্থ হবে। জয় শঙ্কর।

Monday, April 18, 2022

চিলেকোঠা

চিলেকোঠা ১
চিলেকোঠায় আমার ঘরের দক্ষিণদিকের কপাট হাট করে খোলা আছে এখন। তার ঠিক বাইরেই চৈত্রের খ্যাপা পবন হুহু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর পর্দা উড়িয়ে হুড়মুড় করে নির্বিচারে ঢুকে পড়ছে অন্দরেও। কার্নিশে গিন্নির গোটাকতক শখের ফুলগাছ সাজানো ছিল ছোট ছোট টবে, একটু আগেই বাতাসের বেগের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বেচারারা সশব্দে গড়িয়ে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ছুটে গিয়ে তাদের তুলে, ঝেড়েঝুরে মেঝেতেই বসিয়ে দিয়ে এলাম। হটাৎ কেমন যেন একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি চতুর্দিকে - গাছগাছালির পাতাগুলো সরসর করে আওয়াজ করে যেন হওয়ার বেগে ছুটে যেতে চাইছে। রোদ্দুর আজ অতটা কড়া নয়, তবুও আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘরের বাইরেটা, ফুলগুলোর সোনামুখ সব একেবারে চকচক করছে। একটা ঘুঘু গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে করতে কাকে যেন ক্রমাগত ডেকে চলেছে, কাঠবেড়ালিটাও তিড়িংবিরিং করে একবার এদিকে ছুটছে তো একবার ওদিকে, সব মিলিয়ে কেমন যেন ভয়ানক ব্যস্তসমস্ত সবাই। আমি নেওয়ারের খাটটা টেনে কপাটের মুখোমুখি নিয়ে এসেছি। হওয়ার দাপটে আমার ধুতিটা গোল হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। ছাদের বাগান থেকে গন্ধরাজের সুগন্ধ ভেসে এসে ম ম করছে আশপাশ। শুয়ে শুয়ে এই জেগে ওঠা জগৎটাকে দেখছি আর রবীন্দ্রনাথের বরযাত্রী কবিতাটি মনে পড়ছে,
পবন দিগন্তের দুয়ার নাড়ে
চকিত অরণ্যের সুপ্তি কাড়ে।
      যেন কোন্‌ দুর্দম
      বিপুল বিহঙ্গম
গগনে মুহুর্‌মুহু পক্ষ ছাড়ে।
পথপাশে মল্লিকা দাঁড়ালো আসি,
বাতাসে সুগন্ধের বাজালো বাঁশি।
      ধরার স্বয়ম্বরে
      উদার আড়ম্বরে
আসে বর অম্বরে ছড়ায়ে হাসি।
অশোক রোমাঞ্চিত মঞ্জরিয়া
দিল তার সঞ্চয় অঞ্জলিয়া।
      মধুকরগুঞ্জিত
      কিশলয়পুঞ্জিত
উঠিল বনাঞ্চল চঞ্চলিয়া।
কিংশুককুঙ্কুমে বসিল সেজে,
ধরণীর কিঙ্কিণী উঠিল বেজে।
      ইঙ্গিতে সংগীতে
      নৃত্যের ভঙ্গিতে
নিখিল তরঙ্গিত উৎসবে যে।

চিলেকোঠা ২
আমি বাড়ির তিনতলায় চিলেকোঠার ঘরে থাকি, দুপাশে একটুকরো করে ছাদ আর পেছনে উঠোন। একতলায় সামনের একফালি জমি জুড়ে বাড়ির পশ্চিমদিকের গোটা গা বেয়ে মাধবীলতারা ছড়িয়ে উঠেছে সোজা ছাদ অবধি, তাদের গন্ধে ম ম করে রাস্তার দিকের ছাদ আর তাদের ডালে আবডালে অজস্র চড়াই পাখির বাস। পূবদিকের ছাদে গিন্নির সাধের বাগান, সেখানেও রকমারি সুগন্ধি ফুলের মনোরম বাগিচা, যেখানে অনেকরাতেই আমি একা একা বসে গান শুনি। আর দক্ষিণদিকের উঠোনে বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে এক যুবতী পারিজাত বা বৃন্দাবনি চাঁপাফুলের গাছ, সন্ধ্যেবেলার দক্ষিণা বাতাস তার থোকা থোকা কুঁড়ির সুগন্ধ বয়ে নিয়ে বেড়ায় গোটা বাড়িময়। এই গাছটি আবার একটা গোটা বাস্তুতন্ত্রও বটে, এতে ভোরবেলার বুলবুলি আর টুনটুনি থেকে নিয়ে সকালবেলার কাঠবেড়ালি আর প্রজাপতিরা, দুপুরবেলার গিরগিটি আর ক্লান্ত কাক থেকে নিয়ে বিকেলবেলার মৌমাছি আর পিঁপড়েরা - কার না দখলদারী থাকে। এছাড়াও শালিক, বসন্তবৌরি, বেনেবউ, দোয়েল, ইত্যাদি আরো কত পাখিই না আসে যায়। আমার ঘরের তিনদিকে তিনটি জানলা - মুখোমুখি দুটি খোলে দুই ছাদের দিকে, আর একটা খোলে দক্ষিণে, ফলে নানারকমের বর্ণ গন্ধ ছন্দ আর কাণ্ডের মাঝে আমার যাপন। কখনো চড়াইরা জানলার রেলিংয়ে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে আমায় নিরীক্ষণ করে, কখনো ভোমরা আর মৌমাছিরা জরিপ করে কয়েকচক্কর কেটে বেরিয়ে যায়, কখনো ছাদের কার্নিশে ঘুঘুরা ঘুম ঘুম শব্দ করতে করতে আড়চোখে ঘরের ভেতরটা দেখে নেয় একবার, কখনো বা পিঁপড়ের দল খাবারের খোঁজে হানা দেয় ঘরের ভেতর। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার আগে তাই প্রতিদিনই আমায় সাবধান হতে হয়, না জানি কাকে হটাৎ অযথা ঝেঁটিয়ে ফেলে দিই আরকি! আজ মেঝেতে একটুকরো কি যে পড়েছিল ঠিক জানি না, একসময় দেখলাম একজন পিঁপড়ে বেশ করে সেটিকে চেখেটেখে গেল। তার কিছুক্ষন পরেই লাইন করে গোটা পরিবার একেবারে সোজা ঢুকে এলেন আর টানাটানি করে সেটিকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে চাঁপাগাছে নিজেদের আস্তানার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। লাড্ডু যথারীতি আমার ঘরেই বসেছিল, তাই আমি আর লাড্ডু দুজনেই খুব মন দিয়ে ব্যাপারটা দেখলুম, তবে মাঝপথে ছোট্ট একটা ভিডিও তোলার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলুম না।

Sunday, April 17, 2022

শিবের মাথায় জল

শিবের মাথায় জল ঢালার একটা বিশেষ কারণ আছে আর সেটার মূলে হলো শিবের সাথে দেবতাদের একটা অলিখিত covenant বা অঙ্গীকারনামা। সেটা কি? তাহলে পুরাণের গল্পে ফিরে যেতে হয়। যখন সমুদ্রমন্থনের সময় লাগাতার গরল উঠে আসছে তখন তার ঝাঁঝে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা পালাতে পারলে বাঁচেন। শিবের কাছে খবর গেল। শিব অর্থে কল্যাণময়, মঙ্গলময়, উদ্ধারকারী শুভশক্তি। তিনি এসে সমস্ত বিষটাই ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন আর তারপর তাঁর শরীরে দারুণ ক্লেশ উৎপন্ন হলো। তিনি অমরকণ্টক পর্বতের ওপর গিয়ে বসলেন আর তাঁর গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো। সেই ঘামের মূল ধারাটি বয়ে গেল পশ্চিমের দিকে, যা শিবপুত্রী নর্মদারূপে আজো পূজ্যা। আর অন্য একটি ক্ষীণতর ধারা বয়ে গেল পূবদিকে, যার নাম শোনভদ্রা এবং সেটি পাটনার কাছে এসে গঙ্গায় বিলীন হয়ে গেল। এই পুণ্যসলিলা নদীটিও প্রবাহমানা। এখন, বিষক্রিয়ায় শিবের গা যখন তেতেপুড়ে একেবারে আগুন, তখন ব্রহ্মা দেবতাদের ধমক দিয়ে বললেন সব কাজ ফেলে আগে শিবের গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে তাঁকে একটু আরাম দিতে। তখন তাঁদের যার কাছে যা ছিল, কারো কমন্ডুলু, কারো শিঙ্গা, কারো বা শুধুই করপুট, তাতেই জল ভরে ভরে তাঁরা শিবের মাথায় ঢালতে লাগলেন এবং শিব তাতে বেশ আরাম বোধ করলেন। প্রসন্ন হয়ে মহাদেব দেবতাদের কথা দিলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর উদ্দেশ্যে যারাই জল উৎসর্গ করবেন, তিনি তাদের অন্তরের বিষ শুষে নিয়ে তাদের অমৃতের অধিকারী করে দেবেন। এখন লোকের লোভ বেড়েছে, ঘুষ দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে তাই শিবলিঙ্গে দুধ, দই, মধু, ঘি, নানারকম সব ঢালার রেওয়াজ হয়েছে বটে কিন্তু সত্যিকারের শিবোপাসনায় সাধারণ জলই যথেষ্ট। লিঙ্গ হলো শিবের প্রতীক। আমাদের কড়ে আঙুলের ডগাটা যতটুকু, আত্মার সূক্ষ্মরূপ ঠিক তেমনই। মাতৃদেহে ভ্রূণ গঠনের সাথেসাথে মানবশরীরে তাঁর আগমন হয়, জীবৎকালে তিনি ব্রহ্মতালুতে বিরাজ করেন আর মৃত্যুর সাথেসাথে তিনি নির্গত হন। এই আত্মা হলেন নিত্য শুদ্ধ মুক্ত চৈতন্যস্বরূপ, যা মহাজাগতিক চৈতন্য বা পরাচৈতন্যের প্রতিভূ শিবের স্বরূপও বটে। শিবলিঙ্গের অবয়ব একদিকে যেমন আত্মার সুক্ষ্মদেহ-সম্পন্ন ডিম্বাকৃতি সত্তাকে প্রতিভাত করে, অন্যদিকে আবার মহাজগতের বিশালাকায় ব্যপ্তিকেও সম্মিলিত করে। যাইহোক, রোজ শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালার কারণ কিন্তু একটাই - মহাদেব যেন আমাদের ভেতরের সমস্ত নিচতা, ক্রূরতা, ক্রোধ, মোহ, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, লালসা ইত্যাদি যত রকমের বিষ শুষে নিয়ে আমাদের একেবারে শুদ্ধ করে অমৃতের অধিকারী করে দেন, যাতে আমরা নিশ্চিন্তে এই জীবনেই মানুষের দেহ পাওয়ার আসল উদ্দেশ্য সাধন করতে পারি। আমাদের দেহে বসবাসকারী শিব তুষ্ট হোন, তাঁর কৃপায় আমাদের শরীর-মন-বুদ্ধিও শান্ত হোক। আমরা যেন সেই পরমশান্তির আবহে অন্তরস্থ চিরশান্ত আদিযোগীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হই, রোজ শিবের মাথায় জল ঢালার সময় তাঁর কাছে করজোড়ে এই বরই প্রার্থনা করি।

Thursday, April 14, 2022

হিন্দুমেলা ফিরে আসুক

বাঙালি বহুশতক ধরে মানসিকভাবে এবং জাতিগতভাবে পরের অধীন ছিল, ফলে বিজাতীয় চিন্তাধারা তার মননকে যত বেশি প্রভাবিত করেছে, দেশীয় সংস্কৃতি এবং তার নিজের জাতিস্বত্তা থেকে সে তত দূরে সরে গেছে। এটা সেই নবাবদের আমল থেকে শুরু হয়ে লাগাতার বাম শাসন অবধি চলেছে, মাঝে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাও বাঙালির কম সর্বনাশ করেনি। বাঙালির যে নিজস্ব একটি গৌরবময় ইতিহাস ছিল, বঙ্গমাতার এক কৃতী সন্তান অতীশ দীপঙ্কর পায়ে হেঁটে তিব্বতে ভারতীয় দর্শনের আলো জ্বালাতে গিয়েছিলেন তো আর এক কৃতী সন্তান বিজয় সিংহ সাতশো বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে সিংহল জয় করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন, সে কথা বাঙালি ভুলে গেছে। 

বাঙালি ভুলে গেছে ভারতের নৌসেনার ইতিহাসের সেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন যেদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ১০ই নভেম্বর ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে কেদার রায় আক্রমণকারী মগ রণবহরকে বিধস্ত করে দিয়েছিলেন। বাঙালি এও ভুলে গেছে যে জিনমিত্র, ধর্মপাল, বোধিধর্ম, মঞ্জুশ্রী, বোধিসেন, রামচন্দ্র কবি ভারতী প্রভৃতি বাঙালি ধর্মপ্রচারকরা এককালে গোটা এশিয়া জুড়ে নিজেদের কীর্তি স্থাপন করেছিলেন যার প্রভাব এখনো নেপাল থেকে নিয়ে তিব্বত, চীন, পূর্ব-উপদ্বীপ, জাভা এবং বালিতে দেখতে পাওয়া যায়। আজকের বাঙালির মতন এমন আত্মবিস্মৃত জাতি আর দুটি মেলা ভার। তাই নীরদচন্দ্র চৌধরী তাঁর বিখ্যাত বই 'আত্মঘাতী বাঙালি'তে লিখেছিলেন, 'যে হিন্দুশাসক ও অভিজাত সমাজ হিন্দু সভ্যতার অবলম্বন স্বরূপ ছিল, মুসলমানের আক্রমণে উহারা একেবারে বিনষ্ট না হইলেও, শক্তিহীন হইয়া পড়ে। এই অবস্থায় তাহাদের পক্ষে আর হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন ধারা অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হয় নাই এবং এই নেতৃত্ব হারাইয়া ভারতবর্ষের সাধারণ জনসমষ্টি, সমস্ত মুসলমান যুগ ধরিয়া কি ধর্মে, কি সাহিত্যে, কি ভাষায়, কি আর্টে, কি আচার-ব্যবহারে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একটি অপভ্রংশ সৃষ্টি ভিন্ন আর কিছু করিতে পারে নাই।'

প্রতিটি সভ্যতার মূলে থাকে তার সংস্কৃতি, যা দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে পরিশীলিত হতে হতে সমাজে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে আত্মস্থাপিত হয়। তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে থাকে জীবনদর্শন, যাকে আমরা এই হিন্দু সভ্যতায় ধর্ম বলি, যার মূল সূত্র হলো বহুত্ববাদ এবং বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। দুর্ভাগ্যবশত, বাঙালির জীবনে এই হিন্দু ধর্মবোধ যত কমেছে তত বাঙালি তার বাঙালিত্ব এবং হিন্দুত্বকে হারিয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেকালের কয়েকজন আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি মনীষী যেমন রাজনারায়ন বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র প্রমুখরা বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। অধ্যাপক অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, 'রাজনারায়ণ বসু ছিলেন হিন্দু পুনঃজাগরণের উদগাতা। ১৮৬৬ সালে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেন- ‘‘Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal’’ নামে। রাজনারায়ণ বসু-র চিন্তাভাবনারই বাস্তবায়ন ঘটান নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দু মেলা’ আয়োজনের মাধ্যমে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, হিন্দু মেলা বাংলায় জাতীয়তাবোধের বিকাশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ সালে ‘জাতীয় মেলা’ শুরু করেন। চৈত্র মাসের শেষ দিন আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়া বাগানে প্রথম মেলাটি হয়।' 

পরেরবছর ১৮৬৮ সালে মেলার সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, "এই মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, কোনো বিষয় সুখের জন্য নহে, কেবল আমোদ প্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য - ইহা ভারতভূমির জন্য"। তারপর ১৮৭০ সালে চতুর্থ বর্ষ থেকে মেলাটি ‘হিন্দু মেলা’ রূপে পরিচিত হয়। ওই মেলার সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন বলেছিলেন, "অদ্যকার এই যে অপূর্ব সমারোহ ইহা এতদিন পরে ইহার প্রকৃত নাম ধারণ করিয়াছে, ইহা হিন্দুমেলা নামে আপনাকে লোক সমক্ষে পরিচয় দিতেছে...... এক্ষণে 'হিন্দুমেলা' এই সুস্পষ্ট নাম দ্বারা মেলার প্রকৃত মূর্তি প্রকাশ পাইতেছে।" হিন্দুমেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তৃতায় গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "ইহার আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য আত্মনির্ভরতা। .... যাহাতে এই আত্মনির্ভরতা ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়, ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। স্বদেশের হিতসাধনের জন্য পরের সাহায্য না চাহিয়া যাহাতে আমরা আপনারাই তাহা সাধন করিতে পারি- এই ইহার প্রকৃত ও প্রধান উদ্দেশ্য।" এই মেলায় কুটির শিল্প-জাত দ্রব্য ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি প্রদর্শিত হত। এর সঙ্গে থাকত শিল্প প্রদর্শনী ও কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদি ভারতীয় খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। মেলায় সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হত। ১৮৮০ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই হিন্দুমেলা। কিন্তু ততদিনে তার ঈপ্সিত হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে গেছে তৎকালীন বঙ্গে। 

আমরা যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুটি দশকের ঘটনাবলীর দিকে ফিরে দেখি, তাহলে দেখবো যে নবজাগরণের ভরকেন্দ্র কিন্তু ১৮৮০-১৯২০, এই চল্লিশ বছরের কালখণ্ডে। তার আগে থেকেই অবশ্য আত্মপর্য্যালোচনার একটি ধারা শুরু হয়েছিলো। বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় ১৮২৯ সালে সতীদাহপ্রথা বন্ধ করিয়েছেন, নির্ভীক এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পুরোধা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পত্রিকা 'হিন্দু প্যাট্রিওট' এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ১৮৫৩ সালে, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করিয়েছেন ১৮৫৬ সালে, নীল বিদ্রোহ ঘটেছে ১৮৬৪ সালে আর আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়েছে ১৮৮২ সালে। কিন্তু হিন্দুমেলা পরবর্তী কালখণ্ডে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল ১৮৮৬ সালের ২৪শে ডিসেম্বরের রাত্রে। নয়জন ঈশ্বরকোটি বাঙালি যুবক আঁটপুরে তাঁদের সদ্য ব্রহ্মলীন গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে বিরোজা হোম করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন আর বাংলার তথা ভারতের ইতিহাস চিরকালের জন্য বদলে গেল। তাঁদের নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বেরিয়ে পড়লেন ভারতের অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে, তারপর একসময় পৌঁছে গেলেন শিকাগোর বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে এবং আধুনিক জগৎ নতুন করে শুনতে পেল ভারতের চিরন্তন উদ্ঘোষ: মানুষের জীবন 'আত্মনো মোক্ষার্থম্ জগদ্ধিতায় চ' (নিজের মোক্ষলাভ এবং জগতের মঙ্গলের জন্য)। ১৯০২ সালে শরীর ত্যাগ করলেন এই বীর সন্ন্যাসী। ইতিমধ্যে জন্ম হয়েছে আধুনিক বাংলার তিন পুরোধা পুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ, সুভাষচন্দ্র এবং শ্যামাপ্রসাদের। সেই সময়ই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের যুগ শুরু হচ্ছে, আর কিছু পরেই নোবেল পাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।

এর মধ্যে ১৯০৩ সালে আরো একটি ঘটনা ঘটে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী হিন্দু মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' নামে একটি মেলার সভাপতিত্ব করলেন, যা পরাধীন বঙ্গে এক নবজাগরণ আর নবচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ওনার আত্মজীবনী 'জীবনের ঝরাপাতা'য় উনি লিখছেন, "যেসব ছেলেরা তখন আমার কাছে আসত তার মধ্যে মণিলাল গাঙ্গুলী বলে একটি ছেলে ছিল। সে Dawn পত্রিকার সম্পাদক সতীশ মুখুয্যের ভাগিনেয়।সতীশবাবুও মাঝে মাঝে এসেছেন। মণিলালের সাহিত্যের দিকে একটু ঝোঁক ছিল। তার পরিচালিত একটা সাহিত্য-সমিতি ছিল ভবানীপুরের ছেলেদের। সে একদিন আমায় অনুরোধ করলে তাদের সাম্বৎসরিক উৎসবের দিন আসছে আমি যেন তাতে সভানেত্রীত্ব করি। যদিও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে এসেছি -কিন্তু কলকাতা শহরে ছেলেদের সভায় উপস্থিত হওয়া ও সভানেত্রীত্ব  করা তখন আমার কল্পনার বাইরে। আমি ইতস্ততঃ করতে লাগলুম। সে আবার পীড়াপীড়ি করাতে আমি একটু ভেবে তাকে বললুম-"আচ্ছা, তোমাদের সভায় সভানেত্রীত্ব করতে যাব- এটাকে যদি তোমাদের সাহিত্যালোচনার সাম্বৎসরিক না করে সেদিন তোমাদের সভা থেকে "প্রতাপাদিত্য উৎসব কর, আর দিনটা আরও পিছিয়ে ১লা বৈশাখে ফেলে, যেদিন প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।সভায় কোন বক্তৃতাদি রেখ না। সমস্ত কলকাতা ঘুরে খুঁজে বের কর কোথায় কোন বাঙালী ছেলে কুস্তি জানে,তলোয়ার খেলতে পারে,বক্সিং করে, লাঠি চালায়। তাদের খেলার প্রদর্শনী কর-আর আমি তাদের এক-একটি বিষয়ে এক-একটি মেডেল দেব। একটিমাত্ৰ প্রবন্ধ পাঠ হবে-সে তোমাদের সাহিত্য-সভার সাম্বৎসরিক রিপোর্ট নয় -প্রতাপাদিত্যের জীবনী। বই আনাও-পড় তাঁর জীবনী, তার সার শোনাও সভায়।" মনিলাল রাজি হল। তলোয়ার খেলা দেখানর জন্য তাদের পাড়ার বাঙালী হয়ে- যাওয়া রাজপুত ছেলে হরদয়ালকে জোগাড় করলে, কুস্তির জন্যে মসজিদবাড়ির গুহদের ছেলেরা এল, বক্সিংয়ের জন্য ভুপেন বসুর ভাইপো শৈলেন বসুর দলবল এবং লাঠির জন্য দু-চারজন লোক কোথা হতে সংগ্রহ হল। আমি যেভাবে বলেছিলুম,সেইভাবে সভার কার্যক্রম পরিচালিত হল"। দেখা যাচ্ছে এই মেলা প্রসঙ্গে বিপিন চন্দ্র পাল তাঁর Young India-তে টিপ্পনী করলেন, "As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengali!"

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯০৪ সালে ঘোর জাতীয়তাবাদী এই অগ্নিকন্যা বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনে সহায়তা করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁতবস্ত্র প্রচার ও লক্ষ্মীর ভান্ডার স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’। কলকাতায় এর আগেই, ১৯৩০ সালে, তিনি অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত স্ত্রীশিক্ষা সদন’ গড়ে তোলেন ও বাঙালি মহিলাদের মধ্যে তরবারি চালনা, লাঠি খেলা ইত্যাদি প্রচলিত করেন। আমরা দেখতে পাই যে বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সূত্রটি সেই হিন্দুমেলা থেকে শুরু হয়ে লাগাতার প্রভাব বিস্তার করে গেছে এবং বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার প্রভাব অনস্বীকার্য।

এখন প্রশ্ন হলো আজ এই হিন্দু মেলা বা পরবর্তীকালের প্রতাপাদিত্য উৎসবকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু বঙ্গবাসীকে তার হিন্দু ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেওয়ার সুপরিকল্পিত প্রয়াস ঘটেছে, ফলে আজ তার ভাষা, কৃষ্টি, মেধা এবং সংস্কৃতি বিপন্ন। যে জাতি তার নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, সেই অভাগা জাতির কোনো ভবিষ্যত থাকতে পারেনা। বরং তার বৌদ্ধিক শিরদাঁড়া ক্ষয়ে যেতে যেতে একসময়ে অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। আমরা আজ ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি যখন বাঙালি জাতিতত্বের ভিত্তি কি, তার পর্য্যালোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাঙালির ভাষা, বাঙালির ভাষ্য, বাঙালির আচার-ব্যবহার এমনকি বাঙালির রাজনৈতিক চেতনায় পর্য্যন্ত বিজাতীয় তত্ত্ব আমদানি করা হয়েছে এবং বাঙালি বিশ্বজনীন হতে গিয়ে ক্রমশঃ আত্মবিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। 

আজ প্রয়োজন বাঙালির শিকড়ে ফিরে যাওয়া এবং অনেকেই তা চাইছেন। হিন্দু বঙ্গনিবাসী যেদিন তার আত্মবিস্মৃতি কাটিয়ে উঠে বাংলার পূর্ব গৌরবগাথা সম্পর্কে অবহিত হবেন, সেদিন আবার ভারতের প্রমুখ প্রবুদ্ধ এবং আর্থিক শক্তি হিসেবে এই জাতির পুনরুত্থান ঘটবে। সাথে সাথে এ প্রশ্নও উঠছে যে জাতীয়তাবাদ আর রাষ্ট্রবাদের মধ্যে সংস্কৃতিকেন্দ্রিকতা কোন অবধারণায় বেশি প্রাসঙ্গিক আর সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র্ববাদের সাথে হিন্দুত্বের (Hinduness) ঐতিহাসিক এবং ব্যবহারিক - দুটি সম্পর্কই সুদৃঢ় না থাকলে, হিন্দুসংস্কৃতি তথা সভ্যতার স্থায়িত্ব ও ক্রমবিকাশ কিভাবে সম্ভব? যেভাবে হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে হচ্ছে আজ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ব সুরক্ষিত না থাকলে আগামীদিনে পৃথিবীতে বহুত্ববাদ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অস্তিত্ব থাকবে কি? বঙ্গবাসী যদি তার জাতিসত্তাকে পুনরাবিষ্কার না করতে পারে, নিশ্চিতরূপে তাতে এক সভ্যতার সংকট সৃষ্টি হবে। সবদিক দিয়ে ভেবে দেখলে, বাঙালির এখন তার নিজস্ব আত্মগরিমার উৎসে ফিরে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। একমাত্র হিন্দুমেলার মতন উদ্যোগই আয়না হয়ে বঙ্গনিবাসী হিন্দুর সামনে তার প্রকৃত পরিচয়টুকু তুলে ধরতে পারে। তারপর বৃহত্তর সমাজ কিভাবে সেই পরিদৃশ্যকে ব্যবহার করবে সেটা নাহয় বাংলার আত্মসচেতন নাগরিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক।

Saturday, April 9, 2022

শ্রীরামনবমী

আজ শুভ রামনবমী, মর্য্যাদাপুরুষোত্তম প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের পুণ্য আবির্ভাব তিথি। রঘুবীরশিলারূপে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরিবারের গৃহদেবতা হিসেবে আজো তাঁর নিত্যপূজা হয়। শ্রীশ্রীমায়ের জন্ম যে শ্রীরামচন্দ্রের নামাঙ্কিত জয়রামবাটি গ্রামে এবং তাঁর পিতার নামও যে রামচন্দ্র, সেটাও বোধহয় কাকতলীয় নয়। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের একেবারে শুরুর দিকেই শ্রীমর সাথে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের তৃতীয় সাক্ষাৎকারে ঠাকুর ওনাকে বলছেন, "বিশ্বাসের কত জোর তা তো শুনেছ? পুরাণে আছে, রামচন্দ্র যিনি সাক্ষাৎ পূর্নব্রহ্ম নারায়ণ, তাঁর লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হল। কিন্তু হনুমান রামনামে বিশ্বাস করে লাফ দিয়ে সমুদ্রের পারে গিয়ে পড়ল। তার সেতুর দরকার নেই"। 

বারবার ঠাকুর শ্রীরামচন্দ্রের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন গল্পছলে, তার কিছু ঘটনা আমি ছেলেবেলায় পড়েছি, অনেকটাই অজানা, যা যৌবনে নতুন করে বাল্মীকি রামায়ণ পড়তে উদ্বুদ্ধ করলো। আসলে বুঝতে চাইছিলাম কেন বোধ হওয়া ইস্তক ঠাকুমা-দিদিমাদের দেখেছি সুর করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রামায়ণ পড়তে, কেন অন্ধকারে ভয় পেলে মা বলতেন, "বলবি, 'ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি / রাম-লক্ষণ বুকে আছেন, করবি আমায় কি', দেখবি কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না", আর আমরাও সেই মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে দিব্যি গা ছমছম করা অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে দৌড়ে স্নানঘরে চলে যেতাম। অবশ্য পরে বড় হয়ে বাড়ির অদ্যিকালের 'পুরোহিত দর্পন' ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, তাতে বিস্তারিতভাবে শ্রীরামচন্দ্রের পূজাবিধি দেওয়া আছে এবং তিনি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর অবতার।

একজন অমিতবিক্রম রাজপুত্র, যিনি এক বিখ্যাত রাজবংশের পরবর্তী রাজা, যাঁকে বিয়ে করার জন্য তৎকালীন সমস্ত বিবাহযোগ্যা রাজকন্যারা উদগ্রীব, তিনি গুরুবাক্যের মর্য্যাদা রক্ষা করতে হরধনু ভেঙে কাকে বিয়ে করছেন, না জনকরাজার এক অজ্ঞাত কুলশীল পালিতা কন্যাকে! রামের তখন বয়স ২৫ আর সীতার ১৮। তারপর ১২ বছর সুখে ঘরকন্যা করার পর, যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই রাজকুমার বিমাতাকে দেওয়া পিতার কথার মর্য্যাদা রক্ষা করতে সব ছেড়েছুড়ে পত্রপাঠ বনে চলে গেলেন, তখন তাঁর বয়স ৩৭ আর সীতার ৩০।

তারপর চোদ্দ বছরের বনবাসের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৩তম বছরে সীতা অপহৃত হলেন। তারপর আমরা দেখি এক মধ্যবয়সী স্বামী তাঁর মধ্যবয়সী স্ত্রীকে খুঁজতে খুঁজতে এবং সেই পথ চলতে চলতে, সারা ভারতবর্ষকে এক সূত্রে বাঁধতে বাঁধতে, সৈন্য জোগাড় করতে করতে ঠিক রাবণের দরজায় হাজির হয়ে যাচ্ছেন আর কঠিন যুদ্ধের শেষে স্ত্রীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন। মর্য্যাদা সম্পর্কিত অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে রামের বনবাসের সময়ের আচরণে। সে আমলে তো রাজপুরুষদের বহুবিবাহ প্রচলিত এবং স্বাভাবিক ছিল, শ্রীরামচন্দ্র কেন সে পথে হাঁটলেন না? তারপর, একজন রাজকুমারের বন্ধু হবেন ক্ষমতাবান উচ্চবংশের সন্তানরা, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধু হলেন চন্ডাল, যে মধুর সম্পর্কটিকে বাঙালি রামায়নকার কৃত্তিবাস বর্ণনা করেছেন এইভাবে,
'প্রভাতে করিয়া যাত্রা দিবসের শেষে ।
পৌঁছাইল গঙ্গা তীরে গুহকের দেশে ।।
রামের সে বন্ধু ছিল গুহক চন্ডাল ।
থাকিতে বলিল রামে সেথা চিরকাল ।।
গুহকে কহিল রাম আলিঙ্গন করি ।
চোদ্দসাল পর ঠিক আসিবেন ফিরি।।'

তারপর আরো মজার ব্যাপার হলো, ভবিষ্যতের রানী অপহৃত হলেন অথচ রাজপুত্র কিন্তু তাঁর ভাইয়ের কাছে সৈন্যসামন্ত চেয়ে পাঠালেন না, যা তিনি সহজেই করতে পারতেন, যেহেতু তিনি পিতৃশর্ত পালন করে তখন রাজদায়িত্বমুক্ত। এই যে বিরাট সৈন্য তিনি একত্রিত করলেন, সেটা তো আর ভয় দেখিয়ে হয়নি, দুই কপর্দকশূন্য, ক্ষমতাহীন ভবঘুরে ভাইকে কেই বা ভয় পাবে? সারা ভারতবর্ষের সমস্ত জনজাতিকে শ্রীরামচন্দ্র প্রেম দিয়ে জয় করেছিলেন, এবং আমরা যদি রামায়ণে বর্ণিত যাত্রাপথটিকে অনুসরণ করি, তাহলে দেখবো যে উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা ভারতবর্ষকে এক সূত্রে গেঁথে তার বর্তমান ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক রূপ দেওয়ার পুরোধা হলেন ইক্ষাকুবংশীয় চক্রবর্তী সম্রাট শ্রীরামচন্দ্র। কারো ওপর নিজেকে জোর করে চাপিয়ে দেননি, কারো মর্য্যাদাহানি করেননি, অথচ আপামর জনতার হৃদয় জিতে নিয়ে অবিসংবাদী ভারতসম্রাট হয়েছেন, তাই নিঃসন্দেহে তিনিই আমাদের রাষ্ট্রপুরুষ। 

কেন বারেবারে শ্রীরামচন্দ্রকে মাপকাঠি করে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর ভাব ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা বুঝতে গিয়ে মনে হয়েছে যে পিতৃভক্ত, বন্ধু-বৎসল, প্রজাহিতৈষী, ভ্রাতৃ-বৎসল, দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক, যজ্ঞকারী, মর্য্যাদা-পুরুষোত্তম, একাধারে এমন মহানায়ক আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। তাই যখন তাঁর স্বকণ্ঠে পূর্ব অবতাররূপের বর্ণনা শুনলাম তখন মনে হলো এইবার ঠিক ঠিক মিলেছে। তারপর যখন দেখলাম ভাবে মা সীতার হাতের মকরমুখী বালা দেখে শ্রীশ্রীমায়ের জন্য অমনটাই তিনি বানিয়ে দিচ্ছেন, তখন মনে হলো রাম আর সীতা তো যুগে যুগে এক এবং অবিচ্ছেদ্য। এই শ্রীরামচন্দ্র এবং সীতামাঈয়াকেই আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীমায়ের অবতারে এযুগে নতুনরূপে পেয়েছি, তাঁদের দৈবীলীলার প্রবাহমান ধারায় রোজ অবগাহন করে আমাদের চেতনা নিত্য শুদ্ধ হচ্ছে, আর কি চাই?

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্বমুখে আমরা শুনেছি যে পঞ্চবটিতে সাধনাকালে মা সীতার দর্শনের পরে তিনি যখন তাঁর চরণে প্রণত হতে যাচ্ছেন তখন সেই মূর্তি তড়িঘড়ি তাঁর দেহে প্রবিষ্ট হন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীমা বলেছিলেন, "পঞ্চবটিতে সীতাকে দেখেছিলেন, হাতে ডায়মনকাটা বালা। সীতার সেই বালা দৃষ্টে আমাকে সোনার বালা গড়িয়ে দিয়েছিলেন।"

"যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই ইদানিং এই শরীরে রামকৃষ্ণ", ১৮৮৫ সালে কাশীপুরে এভাবেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব অন্তরঙ্গদের কাছে তাঁর আত্মপরিচয় শেষবার প্রকাশ করেছিলেন। নিজের স্বরূপ সর্বদা গোপন করে রাখা শ্রীশ্রীমাও ১৯১১র মার্চে সীতাদেবীর সহস্ত নির্মিত এবং শ্রী রামচন্দ্রের দ্বারা পূজিত অনাবৃত বালির রামেশ্বর শিবলিঙ্গ দেখে আনন্দে অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন, "যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনটিই আছেন", ভাগ্যক্রমে এই কথাটি তাঁর সঙ্গীরা কেউ কেউ শুনে ফেলেন। 

শ্রীরামকৃষ্ণের স্থূলদেহ অপ্রকট হওয়ার পরে শ্রীশ্রীমা বৃন্দাবন যাত্রা করেন কিন্তু পথে বারাণসী দর্শনের পরেই অযোধ্যা দর্শনের জন্য বড় অধীর হয়ে পড়েন, যা তাঁর তৎকালীন ভ্রমণসূচিতে ছিলনা। তাঁর যাত্রাসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী সন্তান স্বামী যোগানন্দজী, যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে শ্রীশ্রীমায়ের স্বরূপ উন্মোচিত হলেই ভগবতী তনু নাশ হয়ে যাবে এবং শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি তাঁর অন্তরের ভাব যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়, সে বিষয়ে সদাসতর্ক থাকতেন। 

জানা যায় যে অযোধ্যাতীর্থে পৌঁছে শ্রীশ্রীমা সদা ভাবরাজ্যে বিচরণ করছিলেন, অযোধ্যার পথঘাট সব তাঁর পূর্বপরিচিত মনে হচ্ছিল এবং ওখানে স্বহস্তে রেঁধে তিনি তাঁর সন্তানদের ভোজনও করিয়েছিলেন। সেই আনন্দ চেপে না রাখতে পারে এ হেন যোগীন মহারাজ পর্য্যন্ত প্রকাশ্যে বলে ফেলেছিলেন, "কি ভাগ্য, আজ আমরা অযোধ্যাতীর্থে সীতামাঈর প্রসাদ পাইলাম!" 

এই বিষয়ে স্বামীজীর কথা না বললে ব্যাখ্যাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১৮৯৭ এর এপ্রিল, স্বামীজী বিশ্বজয় করে ফিরে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে কলকাতায় এসেছেন। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে করজোড়ে বলছেন, "মা, আপনার আশীর্বাদে এযুগে লাফিয়ে না গিয়ে তাদের তৈরি জাহাজে চড়ে সে মুল্লুকে গিয়েছি"। স্বামীজী তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণস্তোত্রেও লিখেছেন "জানকীপ্রাণবন্ধঃ", আরো লিখেছেন "ভক্ত‍্যা জ্ঞানং বৃতবরবপু‌ঃ সীতয়া যো হি রাম", অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ রামচন্দ্রের তনুদেহ ভক্তিস্বরূপিণী সীতার দ্বারা আবৃত। এটি তাঁর কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা নয়। বিদেশ থেকে গুরুভাই স্বামী শিবানন্দজীকে পত্রে বলছেন, "তারক ভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুপ করে পগার পার, এই বুঝ।" যিনি কবিতায় লেখেন "দাস তোমা দোঁহাকার, সশক্তিক নমি তব পদে" তিনি তো সমুদ্রপারকে 'হুপ'ই বলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?

যদিও উত্তরকান্ড এবং যুদ্ধভূমিতে সীতার অগ্নিপরীক্ষা প্রমাণিতভাবে বাল্মীকির লেখা নয়, পরবর্তী সংযোজন, এবং শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতার সিংহাসন আরোহনের শুভঅনুষ্ঠানের পরেই আসল রামায়ণের ইতি, তবুও আজো প্রশ্ন ওঠে এত কিছুর পরেও কেন সীতাকে বনবাসে পাঠালেন শ্রীরামচন্দ্র। যেদিন বিদ্যাসাগরের 'সীতার বনবাস' পড়লাম, সেদিন বিষয়টা একদম দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল। শ্রীরামচন্দ্র জানতেন যে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা এবং অবশ্যই সেই সন্তান একদিন তাঁর সাম্রাজ্যের সম্রাট হবেন। কিন্তু যেহেতু গুপ্তচর মারফত খবর পেলেন যে প্রজাদের মধ্যে রানীর চরিত্র নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে রাজকর্তব্য স্থির হয়ে গেল যাতে ভবিষ্যতের রাজা এবং প্রজার মধ্যে সন্দেহের আবহ সৃষ্টি না হয় এবং রাজ্যপরিচালনা নির্বিবাদে চলে। চরম ক্ষমতাবান এবং জনপ্রিয় একজন মানুষের কি অপরিসীম ত্যাগ, আজকের দিনে কল্পনাও করা যায়না; প্রজার স্বার্থে বহুকষ্টার্জিত সাংসারিক সুখ, প্রিয়া, গর্ভস্থ সন্তান - সব বিসর্জন দিয়ে নিজের সাম্রাজ্য ভাইয়ের ছেলেদের হাতে তুলে দিতে যাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। রাষ্ট্রনায়ক বলুন, রাষ্ট্রপুরুষ বলুন, রাষ্ট্রবিধাতা বলুন, অথবা অবতারপুরুষ বলুন, এমন একজন দেবচরিত্রের অধিকারীই তো অনুকরণীয় হবেন, তবে না ধর্ম আধারিত রাষ্ট্রজীবনের সঠিক মাপদন্ড তৈরি হবে।

Tuesday, April 5, 2022

চৈতি

চিলেকোঠায় আমার ঘরের দক্ষিণদিকের কপাট হাট করে খোলা আছে এখন। তার ঠিক বাইরেই চৈত্রের খ্যাপা পবন হুহু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর পর্দা উড়িয়ে হুড়মুড় করে নির্বিচারে ঢুকে পড়ছে অন্দরেও। কার্নিশে গিন্নির গোটাকতক শখের ফুলগাছ সাজানো ছিল ছোট ছোট টবে, একটু আগেই বাতাসের বেগের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বেচারারা সশব্দে গড়িয়ে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ছুটে গিয়ে তাদের তুলে, ঝেড়েঝুরে মেঝেতেই বসিয়ে দিয়ে এলাম। হটাৎ কেমন যেন একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি চতুর্দিকে - গাছগাছালির পাতাগুলো সরসর করে আওয়াজ করে যেন হওয়ার বেগে ছুটে যেতে চাইছে। রোদ্দুর আজ অতটা কড়া নয়, তবুও আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘরের বাইরেটা, ফুলগুলোর সোনামুখ সব একেবারে চকচক করছে। একটা ঘুঘু গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে করতে কাকে যেন ক্রমাগত ডেকে চলেছে, কাঠবেড়ালিটাও তিড়িংবিরিং করে একবার এদিকে ছুটছে তো একবার ওদিকে, সব মিলিয়ে কেমন যেন ভয়ানক ব্যস্তসমস্ত সবাই। আমি নেওয়ারের খাটটা টেনে কপাটের মুখোমুখি নিয়ে এসেছি। হওয়ার দাপটে আমার ধুতিটা গোল হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। ছাদের বাগান থেকে গন্ধরাজের সুগন্ধ ভেসে এসে ম ম করছে আশপাশ। শুয়ে শুয়ে এই জেগে ওঠা জগৎটাকে দেখছি আর রবীন্দ্রনাথের বরযাত্রী কবিতাটি মনে পড়ছে,
পবন দিগন্তের দুয়ার নাড়ে
চকিত অরণ্যের সুপ্তি কাড়ে।
      যেন কোন্‌ দুর্দম
      বিপুল বিহঙ্গম
গগনে মুহুর্‌মুহু পক্ষ ছাড়ে।
পথপাশে মল্লিকা দাঁড়ালো আসি,
বাতাসে সুগন্ধের বাজালো বাঁশি।
      ধরার স্বয়ম্বরে
      উদার আড়ম্বরে
আসে বর অম্বরে ছড়ায়ে হাসি।
অশোক রোমাঞ্চিত মঞ্জরিয়া
দিল তার সঞ্চয় অঞ্জলিয়া।
      মধুকরগুঞ্জিত
      কিশলয়পুঞ্জিত
উঠিল বনাঞ্চল চঞ্চলিয়া।
কিংশুককুঙ্কুমে বসিল সেজে,
ধরণীর কিঙ্কিণী উঠিল বেজে।
      ইঙ্গিতে সংগীতে
      নৃত্যের ভঙ্গিতে
নিখিল তরঙ্গিত উৎসবে যে।