আজ শুভ রামনবমী, মর্য্যাদাপুরুষোত্তম প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের পুণ্য আবির্ভাব তিথি। রঘুবীরশিলারূপে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরিবারের গৃহদেবতা হিসেবে আজো তাঁর নিত্যপূজা হয়। শ্রীশ্রীমায়ের জন্ম যে শ্রীরামচন্দ্রের নামাঙ্কিত জয়রামবাটি গ্রামে এবং তাঁর পিতার নামও যে রামচন্দ্র, সেটাও বোধহয় কাকতলীয় নয়। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের একেবারে শুরুর দিকেই শ্রীমর সাথে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের তৃতীয় সাক্ষাৎকারে ঠাকুর ওনাকে বলছেন, "বিশ্বাসের কত জোর তা তো শুনেছ? পুরাণে আছে, রামচন্দ্র যিনি সাক্ষাৎ পূর্নব্রহ্ম নারায়ণ, তাঁর লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হল। কিন্তু হনুমান রামনামে বিশ্বাস করে লাফ দিয়ে সমুদ্রের পারে গিয়ে পড়ল। তার সেতুর দরকার নেই"।
বারবার ঠাকুর শ্রীরামচন্দ্রের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন গল্পছলে, তার কিছু ঘটনা আমি ছেলেবেলায় পড়েছি, অনেকটাই অজানা, যা যৌবনে নতুন করে বাল্মীকি রামায়ণ পড়তে উদ্বুদ্ধ করলো। আসলে বুঝতে চাইছিলাম কেন বোধ হওয়া ইস্তক ঠাকুমা-দিদিমাদের দেখেছি সুর করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রামায়ণ পড়তে, কেন অন্ধকারে ভয় পেলে মা বলতেন, "বলবি, 'ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি / রাম-লক্ষণ বুকে আছেন, করবি আমায় কি', দেখবি কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না", আর আমরাও সেই মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে দিব্যি গা ছমছম করা অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে দৌড়ে স্নানঘরে চলে যেতাম। অবশ্য পরে বড় হয়ে বাড়ির অদ্যিকালের 'পুরোহিত দর্পন' ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, তাতে বিস্তারিতভাবে শ্রীরামচন্দ্রের পূজাবিধি দেওয়া আছে এবং তিনি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর অবতার।
একজন অমিতবিক্রম রাজপুত্র, যিনি এক বিখ্যাত রাজবংশের পরবর্তী রাজা, যাঁকে বিয়ে করার জন্য তৎকালীন সমস্ত বিবাহযোগ্যা রাজকন্যারা উদগ্রীব, তিনি গুরুবাক্যের মর্য্যাদা রক্ষা করতে হরধনু ভেঙে কাকে বিয়ে করছেন, না জনকরাজার এক অজ্ঞাত কুলশীল পালিতা কন্যাকে! রামের তখন বয়স ২৫ আর সীতার ১৮। তারপর ১২ বছর সুখে ঘরকন্যা করার পর, যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই রাজকুমার বিমাতাকে দেওয়া পিতার কথার মর্য্যাদা রক্ষা করতে সব ছেড়েছুড়ে পত্রপাঠ বনে চলে গেলেন, তখন তাঁর বয়স ৩৭ আর সীতার ৩০।
তারপর চোদ্দ বছরের বনবাসের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৩তম বছরে সীতা অপহৃত হলেন। তারপর আমরা দেখি এক মধ্যবয়সী স্বামী তাঁর মধ্যবয়সী স্ত্রীকে খুঁজতে খুঁজতে এবং সেই পথ চলতে চলতে, সারা ভারতবর্ষকে এক সূত্রে বাঁধতে বাঁধতে, সৈন্য জোগাড় করতে করতে ঠিক রাবণের দরজায় হাজির হয়ে যাচ্ছেন আর কঠিন যুদ্ধের শেষে স্ত্রীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন। মর্য্যাদা সম্পর্কিত অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে রামের বনবাসের সময়ের আচরণে। সে আমলে তো রাজপুরুষদের বহুবিবাহ প্রচলিত এবং স্বাভাবিক ছিল, শ্রীরামচন্দ্র কেন সে পথে হাঁটলেন না? তারপর, একজন রাজকুমারের বন্ধু হবেন ক্ষমতাবান উচ্চবংশের সন্তানরা, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধু হলেন চন্ডাল, যে মধুর সম্পর্কটিকে বাঙালি রামায়নকার কৃত্তিবাস বর্ণনা করেছেন এইভাবে,
'প্রভাতে করিয়া যাত্রা দিবসের শেষে ।
পৌঁছাইল গঙ্গা তীরে গুহকের দেশে ।।
রামের সে বন্ধু ছিল গুহক চন্ডাল ।
থাকিতে বলিল রামে সেথা চিরকাল ।।
গুহকে কহিল রাম আলিঙ্গন করি ।
চোদ্দসাল পর ঠিক আসিবেন ফিরি।।'
তারপর আরো মজার ব্যাপার হলো, ভবিষ্যতের রানী অপহৃত হলেন অথচ রাজপুত্র কিন্তু তাঁর ভাইয়ের কাছে সৈন্যসামন্ত চেয়ে পাঠালেন না, যা তিনি সহজেই করতে পারতেন, যেহেতু তিনি পিতৃশর্ত পালন করে তখন রাজদায়িত্বমুক্ত। এই যে বিরাট সৈন্য তিনি একত্রিত করলেন, সেটা তো আর ভয় দেখিয়ে হয়নি, দুই কপর্দকশূন্য, ক্ষমতাহীন ভবঘুরে ভাইকে কেই বা ভয় পাবে? সারা ভারতবর্ষের সমস্ত জনজাতিকে শ্রীরামচন্দ্র প্রেম দিয়ে জয় করেছিলেন, এবং আমরা যদি রামায়ণে বর্ণিত যাত্রাপথটিকে অনুসরণ করি, তাহলে দেখবো যে উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা ভারতবর্ষকে এক সূত্রে গেঁথে তার বর্তমান ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক রূপ দেওয়ার পুরোধা হলেন ইক্ষাকুবংশীয় চক্রবর্তী সম্রাট শ্রীরামচন্দ্র। কারো ওপর নিজেকে জোর করে চাপিয়ে দেননি, কারো মর্য্যাদাহানি করেননি, অথচ আপামর জনতার হৃদয় জিতে নিয়ে অবিসংবাদী ভারতসম্রাট হয়েছেন, তাই নিঃসন্দেহে তিনিই আমাদের রাষ্ট্রপুরুষ।
কেন বারেবারে শ্রীরামচন্দ্রকে মাপকাঠি করে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর ভাব ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা বুঝতে গিয়ে মনে হয়েছে যে পিতৃভক্ত, বন্ধু-বৎসল, প্রজাহিতৈষী, ভ্রাতৃ-বৎসল, দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক, যজ্ঞকারী, মর্য্যাদা-পুরুষোত্তম, একাধারে এমন মহানায়ক আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। তাই যখন তাঁর স্বকণ্ঠে পূর্ব অবতাররূপের বর্ণনা শুনলাম তখন মনে হলো এইবার ঠিক ঠিক মিলেছে। তারপর যখন দেখলাম ভাবে মা সীতার হাতের মকরমুখী বালা দেখে শ্রীশ্রীমায়ের জন্য অমনটাই তিনি বানিয়ে দিচ্ছেন, তখন মনে হলো রাম আর সীতা তো যুগে যুগে এক এবং অবিচ্ছেদ্য। এই শ্রীরামচন্দ্র এবং সীতামাঈয়াকেই আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীমায়ের অবতারে এযুগে নতুনরূপে পেয়েছি, তাঁদের দৈবীলীলার প্রবাহমান ধারায় রোজ অবগাহন করে আমাদের চেতনা নিত্য শুদ্ধ হচ্ছে, আর কি চাই?
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্বমুখে আমরা শুনেছি যে পঞ্চবটিতে সাধনাকালে মা সীতার দর্শনের পরে তিনি যখন তাঁর চরণে প্রণত হতে যাচ্ছেন তখন সেই মূর্তি তড়িঘড়ি তাঁর দেহে প্রবিষ্ট হন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীমা বলেছিলেন, "পঞ্চবটিতে সীতাকে দেখেছিলেন, হাতে ডায়মনকাটা বালা। সীতার সেই বালা দৃষ্টে আমাকে সোনার বালা গড়িয়ে দিয়েছিলেন।"
"যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই ইদানিং এই শরীরে রামকৃষ্ণ", ১৮৮৫ সালে কাশীপুরে এভাবেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব অন্তরঙ্গদের কাছে তাঁর আত্মপরিচয় শেষবার প্রকাশ করেছিলেন। নিজের স্বরূপ সর্বদা গোপন করে রাখা শ্রীশ্রীমাও ১৯১১র মার্চে সীতাদেবীর সহস্ত নির্মিত এবং শ্রী রামচন্দ্রের দ্বারা পূজিত অনাবৃত বালির রামেশ্বর শিবলিঙ্গ দেখে আনন্দে অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন, "যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনটিই আছেন", ভাগ্যক্রমে এই কথাটি তাঁর সঙ্গীরা কেউ কেউ শুনে ফেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্থূলদেহ অপ্রকট হওয়ার পরে শ্রীশ্রীমা বৃন্দাবন যাত্রা করেন কিন্তু পথে বারাণসী দর্শনের পরেই অযোধ্যা দর্শনের জন্য বড় অধীর হয়ে পড়েন, যা তাঁর তৎকালীন ভ্রমণসূচিতে ছিলনা। তাঁর যাত্রাসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী সন্তান স্বামী যোগানন্দজী, যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে শ্রীশ্রীমায়ের স্বরূপ উন্মোচিত হলেই ভগবতী তনু নাশ হয়ে যাবে এবং শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি তাঁর অন্তরের ভাব যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়, সে বিষয়ে সদাসতর্ক থাকতেন।
জানা যায় যে অযোধ্যাতীর্থে পৌঁছে শ্রীশ্রীমা সদা ভাবরাজ্যে বিচরণ করছিলেন, অযোধ্যার পথঘাট সব তাঁর পূর্বপরিচিত মনে হচ্ছিল এবং ওখানে স্বহস্তে রেঁধে তিনি তাঁর সন্তানদের ভোজনও করিয়েছিলেন। সেই আনন্দ চেপে না রাখতে পারে এ হেন যোগীন মহারাজ পর্য্যন্ত প্রকাশ্যে বলে ফেলেছিলেন, "কি ভাগ্য, আজ আমরা অযোধ্যাতীর্থে সীতামাঈর প্রসাদ পাইলাম!"
এই বিষয়ে স্বামীজীর কথা না বললে ব্যাখ্যাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১৮৯৭ এর এপ্রিল, স্বামীজী বিশ্বজয় করে ফিরে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে কলকাতায় এসেছেন। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে করজোড়ে বলছেন, "মা, আপনার আশীর্বাদে এযুগে লাফিয়ে না গিয়ে তাদের তৈরি জাহাজে চড়ে সে মুল্লুকে গিয়েছি"। স্বামীজী তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণস্তোত্রেও লিখেছেন "জানকীপ্রাণবন্ধঃ", আরো লিখেছেন "ভক্ত্যা জ্ঞানং বৃতবরবপুঃ সীতয়া যো হি রাম", অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ রামচন্দ্রের তনুদেহ ভক্তিস্বরূপিণী সীতার দ্বারা আবৃত। এটি তাঁর কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা নয়। বিদেশ থেকে গুরুভাই স্বামী শিবানন্দজীকে পত্রে বলছেন, "তারক ভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুপ করে পগার পার, এই বুঝ।" যিনি কবিতায় লেখেন "দাস তোমা দোঁহাকার, সশক্তিক নমি তব পদে" তিনি তো সমুদ্রপারকে 'হুপ'ই বলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?
যদিও উত্তরকান্ড এবং যুদ্ধভূমিতে সীতার অগ্নিপরীক্ষা প্রমাণিতভাবে বাল্মীকির লেখা নয়, পরবর্তী সংযোজন, এবং শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতার সিংহাসন আরোহনের শুভঅনুষ্ঠানের পরেই আসল রামায়ণের ইতি, তবুও আজো প্রশ্ন ওঠে এত কিছুর পরেও কেন সীতাকে বনবাসে পাঠালেন শ্রীরামচন্দ্র। যেদিন বিদ্যাসাগরের 'সীতার বনবাস' পড়লাম, সেদিন বিষয়টা একদম দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল। শ্রীরামচন্দ্র জানতেন যে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা এবং অবশ্যই সেই সন্তান একদিন তাঁর সাম্রাজ্যের সম্রাট হবেন। কিন্তু যেহেতু গুপ্তচর মারফত খবর পেলেন যে প্রজাদের মধ্যে রানীর চরিত্র নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে রাজকর্তব্য স্থির হয়ে গেল যাতে ভবিষ্যতের রাজা এবং প্রজার মধ্যে সন্দেহের আবহ সৃষ্টি না হয় এবং রাজ্যপরিচালনা নির্বিবাদে চলে। চরম ক্ষমতাবান এবং জনপ্রিয় একজন মানুষের কি অপরিসীম ত্যাগ, আজকের দিনে কল্পনাও করা যায়না; প্রজার স্বার্থে বহুকষ্টার্জিত সাংসারিক সুখ, প্রিয়া, গর্ভস্থ সন্তান - সব বিসর্জন দিয়ে নিজের সাম্রাজ্য ভাইয়ের ছেলেদের হাতে তুলে দিতে যাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। রাষ্ট্রনায়ক বলুন, রাষ্ট্রপুরুষ বলুন, রাষ্ট্রবিধাতা বলুন, অথবা অবতারপুরুষ বলুন, এমন একজন দেবচরিত্রের অধিকারীই তো অনুকরণীয় হবেন, তবে না ধর্ম আধারিত রাষ্ট্রজীবনের সঠিক মাপদন্ড তৈরি হবে।
No comments:
Post a Comment