আমাদের দেশে যেমন প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা, প্রত্যেকের নির্দিষ্ট নিজস্ব দায়িত্ব আছে এবং ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড স্ট্রাকচারের কান্ডারীরা সবাই দেশের নির্বাচিত সরকারের আজ্ঞাবহ, ফলে আমাদের দেশে সেনাবাহিনী সরকারের একটি বিভাগ বৈ আর কিছু নয়, পাকিস্তানে তেমনটি নয়। ভারতে আসল ক্ষমতা যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার হাতে, ভারতীয় গণতন্ত্রে আখেরে প্রতিষ্ঠান বলতে তাঁরাই এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলতেও মূলত সরকারি নীতির বিরোধিতাকেই বোঝায়। কোনোদিন কাউকে আদালত বা সংসদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে কেউ কি দেখেছেন - যদিও তাত্বিকভাবে এক্সেকিউটিভ, জুডিসিয়ারী আর লেজিস্লেচার মিলিয়েই সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ন্যাশনাল এসট্যাবলিশমেন্ট ইউনিট হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। পাকিস্তানে কিন্তু ফৌজকেই এসট্যাবলিশমেন্ট বলে, কারণ সমস্ত রাষ্ট্রক্ষমতাটা একমাত্র তাদের হাতেই কেন্দ্রীভূত। ওদেশে প্রথমত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠ হয়না, দ্বিতীয়ত ওখানে সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক পরম্পরা এখনো তৈরিই হয়নি, তৃতীয়ত ওঁদের দেশে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা রাজনেতা হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের আর চতুর্থত ওঁদের প্রধানমন্ত্রী এবং বাকি এক্সেকিউটিভ, জুডিসিয়ারী আর লেজিস্লেচার কেউই স্বাধীন নন, তাঁরা সবাই বকলমে ফৌজের অধীন। ১৯৫৬ সাল থেকে নিয়ে ওদেশের মূল সংবিধানই এখনো অবধি চারবার বদলেছে, ৫৬, ৬২ আর ৭৩, মাঝখানে সংবিধানই গায়েব, আবার ২০০২তে ১৯৭৩এর সংবিধানকে ফিরিয়ে আনা, এতটাই হাস্যকর ওদেশে আইনের শাসন।
পাকিস্তানের তথাকথিত সিভিলিয়ান সরকার ফৌজের ইচ্ছামত ক্ষমতায় থাকেন বা ক্ষমতাচ্যুত হন আর ফৌজের সম্মতি ছাড়া কেউই কোনো নির্ণয় নিতে পারেননা। কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী নিজেদের সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করেছিলেন বটে - একজন ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন, একজন খুন হয়েছিলেন, একজন দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছিলেন আর সর্বশেষজনকে মারমূখী লাবেকদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে, ভুল পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধ শুরুর দিনে রুশ পাঠিয়ে দিয়ে, বেইজ্জত করে বিতাড়িত করা হয়েছে। আসলে পাকফৌজ ওঁদের দেশের সিভিলিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেমটাকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করে। এই যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও ইমরান খান এখনো এত খরচা করে চতুর্দিকে বিশাল বড় বড় জলসা করে বেড়াচ্ছেন, এই যে রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভী নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং তাঁর মন্ত্রীসভাকে শপথবাক্য পাঠ করাতে রাজি হচ্ছেন না, এই যে বিলায়ল ভুট্টো প্রথমে রাজি হয়েও পরে মন্ত্রী হতে অস্বীকার করলেন - এগুলো কাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে বলে মনে হয়? এগুলোর মাধ্যমে আসলে ওদেশের এসট্যাবলিশমেন্ট মিঞা শাহবাজ শরীফকে বার্তা দিচ্ছে, 'নিজের দাদার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েওনা, তোমার প্রাণভ্রমরা কিন্তু আমাদের হাতে, বেশি ট্যাঁফু করলেই সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেবো'।
পাকফৌজ হলো দুনিয়ার সেই একমাত্র আনোখা ফৌজ যারা স্যানিটারি ন্যাপকিন থেকে নিয়ে বেভিফুড, সব বানায়, বাচ্চাদের লবনচুস আর খেলনা বেচে, আবার জমি-বাড়ির দালালিও করে, তবে এখন পাকিস্তানে বাজার খুবই মন্দা, মুদ্রাস্ফীতির চোটে খরিদ্দারের পকেট গড়ের মাঠ। ফৌজ এইমুহূর্তে খুব ঝামেলায় আছে, বলা যায় একপ্রকার অস্তিত্বসঙ্কটে ভুগছে। একদিকে আমেরিকা টাকা এবং হাতিয়ার, দুটোই দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, চীনের দেওয়া অস্ত্রগুলো প্রায় অব্যাবহারযোগ্যই, যুদ্ধের বাজারে ইউক্রেনের অস্ত্র কারখানাগুলোকে রুশ ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে মেন ব্যাটেল ট্যাঙ্কের বারুদ আর স্পেয়ার পার্টস কোথা থেকে আসবে ভেবে মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেছে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতই খারাপ যে পয়সা খরচ করে ভাল হাতিয়ার ও কলকব্জা কেনার ক্ষমতাই নেই, তার ওপর আবার নিজেদের হাতে তৈরি আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা কিছুতেই ডুরান্ড লাইন মানতে চাইছে না, রোজ ফৌজি হামলা করেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো বালুচ স্বাধীনতাসংগ্রামী আর পাকিস্তানি তালিবানরা, এদের হাতে প্রতিদিন গাদাগাদা পাকসেনা মারা যাচ্ছে, চীনি ইঞ্জিনিয়াররাও এদের প্রাণঘাতী আক্রমণের ভয়ে দাসু ড্যাম আর সিপেক ছেড়ে পোঁ পাঁ পালিয়েছেন। কাশ্মীর কাশ্মীর করে হাজার প্রোপাগান্ডা করেও ফৌজ আর নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারছে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণ খোলাখুলি খিল্লি করতে শুরু করেছে, যা এতদিন অভাবনীয় ছিল। জেনারেল বাজওয়া বুদ্ধিমান লোক, এমনটা যে হবে অনেকদিন আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই ভারতের সাথে সিজ-ফায়ার চুক্তি করে একটা দিক অন্তত উনি সুরক্ষিত করেছিলেন কারণ এর ওপর যদি সীমান্তে ভারতের মার সামলাতে হতো, পাকফৌজ এতদিনে পুরো পাগল হয়ে যেত।
এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দুদিন আগে লেখা মিঞা শাহবাজ শরীফের একটি ধন্যবাদমূলক চিঠি। তাতে একজায়গায় উনি লিখেছেন, 'আমরা চাই যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠুক। আমাদের জনগণ ও অঞ্চলের অগ্রগতি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য দুদশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা অপরিহার্য। আমাদের জম্মু ও কাশ্মীরের মূল ইস্যু-সহ প্রতিটি মতান্তরের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে'। উল্লেখযোগ্য যে এর আগে মিঞাসাহেবকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছিলেন, 'পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য মহামহিম মিঞা মহম্মদ শাহবাজ় শরিফকে অভিনন্দন। ভারত এমন একটি সন্ত্রাসমুক্ত শান্ত ও স্থিতিশীল আঞ্চলিক পরিবেশ চায় যাতে আমরা আমাদের দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলি উপর মনোসংযোগ করতে পারি এবং আমাদের জনগণের মঙ্গল ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি'। নতুন প্রধানমন্ত্রী আসতেই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই যে একটা সদর্থক বার্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার পেছনে বহুলাংশে কিন্তু পরিস্থিতির শিকার পাক এসট্যাবলিশমেন্টের এখনকার বাধ্যবাধকতা আর তাদের অনুপ্রেরণায় ইদানিং নিশ্চুপে ঘটে চলা ব্যাক-চ্যানেল বার্তাসমূহের অগ্রগতি দায়ী। হয়তো এমনও হতে পারে যে আসন্ন জুলাই মাসের এসসিও সামিটের আড়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা হয়তো একবার একসাথে বৈঠকেই বসে গেলেন।
গত ২রা এপ্রিলে 'ইসলামাবাদ সিকিউরিটি ডায়ালগ ২০২২' উপলক্ষে জেনারেল বাজওয়ার ভাষণে দুতরফের প্রতিটি কথারই হুবহু প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। উনি বলেছিলেন, “We believe that peace and stability in our wider region are pre-requisites for achieving shared regional prosperity and development.... Pakistan continues to believe in using dialogue and diplomacy to resolve all outstanding issues including the Kashmir dispute and is ready to move forward in this front if India agrees to do so. With one-third of the world in the Gulf region involved in some sort of conflict and war it is important that we keep the flames of fire away from our region.... I believe it is time for the political leadership of the region to rise above their emotional and perceptional biases and break the shackles of history to bring peace and prosperity to almost three billion people of the region”. সোজাকথা, পাক ফৌজ চায়নি, তাই নওয়াজ শরিফ বা বেনজির ভুট্টোরা এতদিন কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান পাকিস্তানিদের দিয়ে মানিয়ে নিতে পারেননি, এখন চাইছে তাই হতে পারে। এখন পরিস্থিতি এমন যে ফৌজ নিজেদের আর্থিক ও জনসমর্থনজনিত সমস্যায় নিজেরা এতটাই জেরবার যে একদিনের মধ্যে ক্যাপ্টেন অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, ধারা ৩৭০ আর ৩৫এ উঠিয়ে দিলেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বদলা নেওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই, ব্রহ্মস উড়ে গিয়ে পড়লেও খানিকটা চেঁচামেচি করে বেইজ্জতি হজম করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। এই হলো সুবর্ণ সুযোগ মহর্ষি কাশ্যপ আর কালহনের বিচরণভূমি পাকঅধিকৃত কাশ্মীরকে পুনরায় ভারতভুক্তি করার এবং সেটা একটিও গুলি না ছুঁড়ে। জেনারেল বাজওয়া তো বলেইছেন “we want it to be settled quickly through dialogue and diplomacy”, তাহলে আর অসুবিধেটা কোথায়? চীন ব্যাগরা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে নিশ্চয়, কিন্তু আশাকরি নতুন ভারতের আত্মবিশ্বাসী বিদেশনীতি সাফল্যের সঙ্গে সেই হস্তক্ষেপ রুখে দিতে সমর্থ হবে। জয় শঙ্কর।
No comments:
Post a Comment