যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে মহামুনি বশিষ্ঠদেব শিষ্য শ্রীরামচন্দ্রকে একজায়গায় বলছেন, "বৎস রামচন্দ্র, স্বর্গ-মর্ত-পাতালের এই ত্রিজগৎ মনের কল্পনাতেই নির্মিত। তাই তুমি যদি জগতের অনিত্যতাকে উপলব্ধি করতে পার, তোমার আত্মা প্রশান্ত হবে। মনে রেখ, রাগদ্বেষাদিতে দূষিত চিত্তকেই সংসার বলা হয়।... হে রাম, অজ্ঞানতা বশত বিষয়ের আকাঙ্খা জন্মায়। এটাই বাসনার প্রথম অঙ্কুর। এখান থেকে মোহ জন্মায়, চিৎ আপন পূর্ণতা বিস্মৃত হন। রামচন্দ্র, চিত্তকে অখণ্ডিত অদ্বৈতে পরিণত করো। এই নিখিল জগৎ অদ্বৈত ব্রহ্মের প্রকাশ।"
শিষ্যকে বোঝাবার জন্য গুরু নানারকমের গল্প বলে বলে ধীরে ধীরে ব্রহ্মতত্ত্ব আর সংসারের অনিত্যতার সূত্র উন্মোচিত করছেন। এমনই একটি গল্পের চরিত্র ইন্দ্র নামক এক লম্পট ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণ, যিনি অহল্যা নামক এক রাজমহিষীর প্রেমে পাগল। গল্পটি বাদ দিয়ে, শেষে এই ইন্দ্রের মুখ দিয়ে বশিষ্ঠ যা বলাচ্ছেন ওটিই আসল, "মন দিয়ে যা করা যায়, সেটিই যথার্থ কৃত। আর শরীর দিয়ে যা করা হয়, সেটি অযথার্থ। যার দেহ-ভাবনা নেই, সে কখনও দেহধর্মে বাধ্য হয় না। যোগীরা যেমন! অন্তর্দৃষ্টির কারণেই তাঁদের আত্মদেহে সুখদুঃখের বোধ থাকে না।"
শ্রীরামকৃষ্ণদেবও এমনই এক গল্প শুনিয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শিবনাথ শাস্ত্রীকে।
"শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি গুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধর্তে ছিল। একটি চিল এসে একটা মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যে দিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেই দিকে যেতে লাগল। দক্ষিণ দিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেই দিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন গেল, ওরাও সেই দিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিত্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর বসল। বসে ভাবতে লাগল - ঐ মাছটাই যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই আমি নিশ্চিত্ত হলুম।'
অবধূত চিলের কাছে এই শিক্ষা করলেন যে যতক্ষণ সঙ্গে মাছ থাকে অর্থাৎ বাসনা থাকে ততক্ষণ কর্ম থাকে আর কর্মের দরুন ভাবনা চিন্তা, অশান্তি। বাসনা ত্যাগ হলেই কর্মক্ষয় হয় আর শান্তি হয়।" (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত ১,১০৬-০৮)
আমাদের গোটা শাস্ত্র জুড়ে এমন ভুরিভুরি উপাখ্যান ছড়িয়ে আছে। বেদে যম এবং বালক নচিকেতার সেই বিখ্যাত কথোপকথনে দেখা যায় যে তৃতীয় বর চাওয়ার বেলায় নচিকেতা বললেন, "মানুষের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন জাগে তার কী হয়। কেউ বলে তার অস্তিত্ব থাকে না, কেউ বলে থাকে। অনুগ্রহ করে আমায় যথার্থ উত্তর বলে দিন।"
মৃত্যুরাজ যম উত্তর দিলেন "প্রাচীনকালে দেবতারা এই রহস্যভেদ করতে চেয়েছিলেন। এই রহস্য এত সূক্ষ্ম যে জানা খুবই কষ্টকর। অন্য কোনও বর চাও, এটি চেয়ো না। শতবর্ষব্যাপী দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করো। গবাদি পশু, অশ্ব প্রার্থনা করো। বিশাল সাম্রাজ্য প্রার্থনা করো। এর উত্তরের জন্য আমায় অনুরোধ কোরো না। মানুষ জীবন উপভোগের জন্য যা কিছু কামনা করে, সেই সব প্রার্থনা করো, আমি প্রার্থনা পূর্ণ করব। কিন্তু এই রহস্য জানতে চেয়ো না"। নচিকেতা বললেন, "না মানুষ সম্পদে তৃপ্ত থাকতে পারে না। এমনকি দীর্ঘতম জীবনও খুব সংক্ষিপ্ত। এইসব ঘোড়া, রথ, নাচ-গান, আপনার কাছে থাক। মানুষ সম্পদে সন্তুষ্ট হতে পারে না। আপনি যতদিন চান ততদিনই আমরা জীবিত থাকব। আমি যে বর প্রার্থনা করেছি সেইটি শুধু আমি চেয়েছি।"
যম এই উত্তরে খুশি হয়ে বললেন, "পূর্ণতা এক বস্তু, ভোগ অন্য বস্তু, এই দুয়ের লক্ষ্য আলাদা, এরা মানুষকে দু-ভাবে আকৃষ্ট করে। যে পূর্ণতা বেছে নেয়, সে শুদ্ধ হয়। যে ভোগকে বেছে নেয়, সে প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। পূর্ণতা এবং ভোগ উভয়ই মানুষের কাছে আসে। জ্ঞানী দুটিকে পরীক্ষা করে একটিকে অন্যটির থেকে আলাদা করেন। তিনি পূর্ণতাকে ভোগের চেয়ে বড়ো বলে বেছে নেন, কিন্তু মূর্খ ব্যক্তি দেহের সুখের জন্য ভোগকে বেছে নেয়। হে নচিকেতা, যেসব বস্তু আপাতকাম্য, চিন্তা করে জ্ঞানীর মতো তুমি তা ত্যাগ করেছ।"
যোগবাশিষ্ঠতে অন্য একজায়গায় শ্রীরামচন্দ্র গুরুকে জিজ্ঞেস করছেন, "হে ব্রহ্মণ্! সৃষ্টির রূপ-রেখা সম্পর্কে আপনি যা বললেন, তা শুনলাম। কিন্ত শুদ্ধসত্ত্ব হরি-হরও যে অবিদ্যার বিলাস, এই কথায় আমি বিভ্রান্ত হচ্ছি।"
উত্তরে বশিষ্ঠ বলছেন, "এই দৃশ্যমান সৃষ্টি উন্মেষিত হওয়ার পূর্বে সৎ-চিৎ-আনন্দরূপে নির্বিকার ও নিরাকার ছিল। সচ্চিদানন্দত্বের মৌলিক নির্মল সত্তা নাম-রূপের অতীত। সেই অমলিন সত্তা নামরূপ আকারে প্রকাশিত হওয়া অবধি শান্ত এবং বিকারশূন্য থাকে। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ সংস্কারের আকারেই ভাসমান ছিল। তত্ত্বজ্ঞানীর বোধে সেই ভাসমান জগৎ-সংস্কার সর্বাত্মক ও সম্বিৎ মাত্র। সৃষ্টির উন্মেষ-সম্ভাবনায় চিদাভাস উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ফুরণশীল হয় এবং মায়াশক্তির প্রভাবে জগৎ-সংস্কারের সূচনা হয়। সেই জগৎ-সংস্কার হতে অতি সূক্ষ্ম রেখার মত আগামী কালে প্রথমে অতিসূক্ষ্ম, পরে মধ্যসূক্ষ্ম ও স্থূল জগৎ প্রকাশিত হয়। অতিসূক্ষ্ম জগৎ চিদাভাসের দেহবৎ নিরাকার। সেই সূক্ষ্মমূল হতে সমষ্টিমন বা হিরণ্যগর্ভ এবং পরে স্থূল জগৎ কল্পিত হয়। সূক্ষ্ম, মধ্যসূক্ষ্ম এবং স্থূল, এই কল্পিত ত্রয়ীকে সত্ত্ব, রজ ও তম ত্রিগুণ আখ্যায় কল্পনা করা হয়। সেই ত্রিগুণের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি এবং অবিদ্যা বলে। অবিদ্যাই সংসার এবং অবিদ্যার অপর পারে চিদ্ব্রহ্মের পরমপদ।"
বিবেকানন্দ পত্রবলী পড়লে দেখা যাবে যে তাতে স্বামীজী ২৩ জুন ১৯০০ সালে মিস মেরী হালেকে লেখা চিঠিতে নিজের সম্পর্কে সোজাসুজি বলছেন, "আমি অদ্বৈতবাদী; আমাদের লক্ষ্য জ্ঞানার্জন - সেখানে কোনো অনুভূতি, কোনো ভালোবাসার স্থান নেই, কারণ এই সবই বস্তু, কুসংস্কার এবং বন্ধনের বাহন। আমি শুধু অস্তিত্ব এবং জ্ঞান।" এটাই সত্যের সারাৎসার।
No comments:
Post a Comment