Monday, April 18, 2022

চিলেকোঠা

চিলেকোঠা ১
চিলেকোঠায় আমার ঘরের দক্ষিণদিকের কপাট হাট করে খোলা আছে এখন। তার ঠিক বাইরেই চৈত্রের খ্যাপা পবন হুহু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর পর্দা উড়িয়ে হুড়মুড় করে নির্বিচারে ঢুকে পড়ছে অন্দরেও। কার্নিশে গিন্নির গোটাকতক শখের ফুলগাছ সাজানো ছিল ছোট ছোট টবে, একটু আগেই বাতাসের বেগের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বেচারারা সশব্দে গড়িয়ে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ছুটে গিয়ে তাদের তুলে, ঝেড়েঝুরে মেঝেতেই বসিয়ে দিয়ে এলাম। হটাৎ কেমন যেন একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি চতুর্দিকে - গাছগাছালির পাতাগুলো সরসর করে আওয়াজ করে যেন হওয়ার বেগে ছুটে যেতে চাইছে। রোদ্দুর আজ অতটা কড়া নয়, তবুও আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘরের বাইরেটা, ফুলগুলোর সোনামুখ সব একেবারে চকচক করছে। একটা ঘুঘু গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে করতে কাকে যেন ক্রমাগত ডেকে চলেছে, কাঠবেড়ালিটাও তিড়িংবিরিং করে একবার এদিকে ছুটছে তো একবার ওদিকে, সব মিলিয়ে কেমন যেন ভয়ানক ব্যস্তসমস্ত সবাই। আমি নেওয়ারের খাটটা টেনে কপাটের মুখোমুখি নিয়ে এসেছি। হওয়ার দাপটে আমার ধুতিটা গোল হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। ছাদের বাগান থেকে গন্ধরাজের সুগন্ধ ভেসে এসে ম ম করছে আশপাশ। শুয়ে শুয়ে এই জেগে ওঠা জগৎটাকে দেখছি আর রবীন্দ্রনাথের বরযাত্রী কবিতাটি মনে পড়ছে,
পবন দিগন্তের দুয়ার নাড়ে
চকিত অরণ্যের সুপ্তি কাড়ে।
      যেন কোন্‌ দুর্দম
      বিপুল বিহঙ্গম
গগনে মুহুর্‌মুহু পক্ষ ছাড়ে।
পথপাশে মল্লিকা দাঁড়ালো আসি,
বাতাসে সুগন্ধের বাজালো বাঁশি।
      ধরার স্বয়ম্বরে
      উদার আড়ম্বরে
আসে বর অম্বরে ছড়ায়ে হাসি।
অশোক রোমাঞ্চিত মঞ্জরিয়া
দিল তার সঞ্চয় অঞ্জলিয়া।
      মধুকরগুঞ্জিত
      কিশলয়পুঞ্জিত
উঠিল বনাঞ্চল চঞ্চলিয়া।
কিংশুককুঙ্কুমে বসিল সেজে,
ধরণীর কিঙ্কিণী উঠিল বেজে।
      ইঙ্গিতে সংগীতে
      নৃত্যের ভঙ্গিতে
নিখিল তরঙ্গিত উৎসবে যে।

চিলেকোঠা ২
আমি বাড়ির তিনতলায় চিলেকোঠার ঘরে থাকি, দুপাশে একটুকরো করে ছাদ আর পেছনে উঠোন। একতলায় সামনের একফালি জমি জুড়ে বাড়ির পশ্চিমদিকের গোটা গা বেয়ে মাধবীলতারা ছড়িয়ে উঠেছে সোজা ছাদ অবধি, তাদের গন্ধে ম ম করে রাস্তার দিকের ছাদ আর তাদের ডালে আবডালে অজস্র চড়াই পাখির বাস। পূবদিকের ছাদে গিন্নির সাধের বাগান, সেখানেও রকমারি সুগন্ধি ফুলের মনোরম বাগিচা, যেখানে অনেকরাতেই আমি একা একা বসে গান শুনি। আর দক্ষিণদিকের উঠোনে বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে এক যুবতী পারিজাত বা বৃন্দাবনি চাঁপাফুলের গাছ, সন্ধ্যেবেলার দক্ষিণা বাতাস তার থোকা থোকা কুঁড়ির সুগন্ধ বয়ে নিয়ে বেড়ায় গোটা বাড়িময়। এই গাছটি আবার একটা গোটা বাস্তুতন্ত্রও বটে, এতে ভোরবেলার বুলবুলি আর টুনটুনি থেকে নিয়ে সকালবেলার কাঠবেড়ালি আর প্রজাপতিরা, দুপুরবেলার গিরগিটি আর ক্লান্ত কাক থেকে নিয়ে বিকেলবেলার মৌমাছি আর পিঁপড়েরা - কার না দখলদারী থাকে। এছাড়াও শালিক, বসন্তবৌরি, বেনেবউ, দোয়েল, ইত্যাদি আরো কত পাখিই না আসে যায়। আমার ঘরের তিনদিকে তিনটি জানলা - মুখোমুখি দুটি খোলে দুই ছাদের দিকে, আর একটা খোলে দক্ষিণে, ফলে নানারকমের বর্ণ গন্ধ ছন্দ আর কাণ্ডের মাঝে আমার যাপন। কখনো চড়াইরা জানলার রেলিংয়ে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে আমায় নিরীক্ষণ করে, কখনো ভোমরা আর মৌমাছিরা জরিপ করে কয়েকচক্কর কেটে বেরিয়ে যায়, কখনো ছাদের কার্নিশে ঘুঘুরা ঘুম ঘুম শব্দ করতে করতে আড়চোখে ঘরের ভেতরটা দেখে নেয় একবার, কখনো বা পিঁপড়ের দল খাবারের খোঁজে হানা দেয় ঘরের ভেতর। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার আগে তাই প্রতিদিনই আমায় সাবধান হতে হয়, না জানি কাকে হটাৎ অযথা ঝেঁটিয়ে ফেলে দিই আরকি! আজ মেঝেতে একটুকরো কি যে পড়েছিল ঠিক জানি না, একসময় দেখলাম একজন পিঁপড়ে বেশ করে সেটিকে চেখেটেখে গেল। তার কিছুক্ষন পরেই লাইন করে গোটা পরিবার একেবারে সোজা ঢুকে এলেন আর টানাটানি করে সেটিকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে চাঁপাগাছে নিজেদের আস্তানার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। লাড্ডু যথারীতি আমার ঘরেই বসেছিল, তাই আমি আর লাড্ডু দুজনেই খুব মন দিয়ে ব্যাপারটা দেখলুম, তবে মাঝপথে ছোট্ট একটা ভিডিও তোলার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলুম না।

No comments:

Post a Comment