Sunday, April 17, 2022
শিবের মাথায় জল
শিবের মাথায় জল ঢালার একটা বিশেষ কারণ আছে আর সেটার মূলে হলো শিবের সাথে দেবতাদের একটা অলিখিত covenant বা অঙ্গীকারনামা। সেটা কি? তাহলে পুরাণের গল্পে ফিরে যেতে হয়। যখন সমুদ্রমন্থনের সময় লাগাতার গরল উঠে আসছে তখন তার ঝাঁঝে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা পালাতে পারলে বাঁচেন। শিবের কাছে খবর গেল। শিব অর্থে কল্যাণময়, মঙ্গলময়, উদ্ধারকারী শুভশক্তি। তিনি এসে সমস্ত বিষটাই ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন আর তারপর তাঁর শরীরে দারুণ ক্লেশ উৎপন্ন হলো। তিনি অমরকণ্টক পর্বতের ওপর গিয়ে বসলেন আর তাঁর গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো। সেই ঘামের মূল ধারাটি বয়ে গেল পশ্চিমের দিকে, যা শিবপুত্রী নর্মদারূপে আজো পূজ্যা। আর অন্য একটি ক্ষীণতর ধারা বয়ে গেল পূবদিকে, যার নাম শোনভদ্রা এবং সেটি পাটনার কাছে এসে গঙ্গায় বিলীন হয়ে গেল। এই পুণ্যসলিলা নদীটিও প্রবাহমানা। এখন, বিষক্রিয়ায় শিবের গা যখন তেতেপুড়ে একেবারে আগুন, তখন ব্রহ্মা দেবতাদের ধমক দিয়ে বললেন সব কাজ ফেলে আগে শিবের গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে তাঁকে একটু আরাম দিতে। তখন তাঁদের যার কাছে যা ছিল, কারো কমন্ডুলু, কারো শিঙ্গা, কারো বা শুধুই করপুট, তাতেই জল ভরে ভরে তাঁরা শিবের মাথায় ঢালতে লাগলেন এবং শিব তাতে বেশ আরাম বোধ করলেন। প্রসন্ন হয়ে মহাদেব দেবতাদের কথা দিলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর উদ্দেশ্যে যারাই জল উৎসর্গ করবেন, তিনি তাদের অন্তরের বিষ শুষে নিয়ে তাদের অমৃতের অধিকারী করে দেবেন। এখন লোকের লোভ বেড়েছে, ঘুষ দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে তাই শিবলিঙ্গে দুধ, দই, মধু, ঘি, নানারকম সব ঢালার রেওয়াজ হয়েছে বটে কিন্তু সত্যিকারের শিবোপাসনায় সাধারণ জলই যথেষ্ট। লিঙ্গ হলো শিবের প্রতীক। আমাদের কড়ে আঙুলের ডগাটা যতটুকু, আত্মার সূক্ষ্মরূপ ঠিক তেমনই। মাতৃদেহে ভ্রূণ গঠনের সাথেসাথে মানবশরীরে তাঁর আগমন হয়, জীবৎকালে তিনি ব্রহ্মতালুতে বিরাজ করেন আর মৃত্যুর সাথেসাথে তিনি নির্গত হন। এই আত্মা হলেন নিত্য শুদ্ধ মুক্ত চৈতন্যস্বরূপ, যা মহাজাগতিক চৈতন্য বা পরাচৈতন্যের প্রতিভূ শিবের স্বরূপও বটে। শিবলিঙ্গের অবয়ব একদিকে যেমন আত্মার সুক্ষ্মদেহ-সম্পন্ন ডিম্বাকৃতি সত্তাকে প্রতিভাত করে, অন্যদিকে আবার মহাজগতের বিশালাকায় ব্যপ্তিকেও সম্মিলিত করে। যাইহোক, রোজ শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালার কারণ কিন্তু একটাই - মহাদেব যেন আমাদের ভেতরের সমস্ত নিচতা, ক্রূরতা, ক্রোধ, মোহ, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, লালসা ইত্যাদি যত রকমের বিষ শুষে নিয়ে আমাদের একেবারে শুদ্ধ করে অমৃতের অধিকারী করে দেন, যাতে আমরা নিশ্চিন্তে এই জীবনেই মানুষের দেহ পাওয়ার আসল উদ্দেশ্য সাধন করতে পারি। আমাদের দেহে বসবাসকারী শিব তুষ্ট হোন, তাঁর কৃপায় আমাদের শরীর-মন-বুদ্ধিও শান্ত হোক। আমরা যেন সেই পরমশান্তির আবহে অন্তরস্থ চিরশান্ত আদিযোগীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হই, রোজ শিবের মাথায় জল ঢালার সময় তাঁর কাছে করজোড়ে এই বরই প্রার্থনা করি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment