Wednesday, April 26, 2023

শান্তি - the elusive gift of the Divine Mother

আমরা দিনরাত যা কিছুই খুঁজে মরি না কেন - নাম যশ টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি প্রভাব প্রতিপত্তি সন্মান ভালোবাসা প্রেম সুখ ব্যঞ্জন বিলাস ইত্যাদি, দিনের শেষে হিসেব করলে দেখা যাবে আসলে আমরা কেবল একটাই জিনিস খুঁজছিলাম, আর তা হলো শান্তি। আমরা অনেকেই হয়তো মনে করি যে একমাত্র সুখে থাকলেই বুঝি মানুষ শান্তিতে থাকে, শান্ত থাকে। আদপেই কি তাই? সুখ কি, সেটাই তো বোধহয় মানবসভ্যতার আজ অবধি সবচেয়ে বড় unresolved mystery আর শান্তি ও সুখের corelation নিয়েও তো সেই আবহমান কাল থেকে চর্চার শেষ নেই। 

কল্পনা করা যাক একটা বড় আলো ঝলমলে খোলামেলা বইয়ের ঘর, তার জানলাগুলোয় আধুনিক আওয়াজ নিরোধক কাঁচ লাগানো, ২৩°তে এসি চলছে, নরম আরামদায়ক কেদারায় বসে একজন স্বচ্ছল accomplished ব্যক্তি তাঁর প্রিয় উপন্যাসিকের সাম্প্রতিকতম রচনাটি পড়ছেন। বিরক্ত করার কেউ নেই, কোনো বাইরের চাপও নেই, ফ্লাস্কে গরম দার্জিলিং ফার্স্ট ফ্লাশ চা রাখা আছে, ইচ্ছেমত চুমুক দেওয়া যায় আর চোখ তুলে তাকালেই জানালাগুলো দিয়ে কেবল নয়নসুখকর সবুজের সমারোহ - ইনি সুখী, শান্ত না শান্তিতে আছেন? সুখের সমস্ত condition fulfilled, অশান্ত হবার মতনও কোনো distraction নেই, তাহলে এটাকেই কি শান্তিতে থাকা বলে? 

এবার ধরা যাক উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কোনো এক জায়গায় তাঁর জীবনের সাথে মিলে যাওয়া কোনো পুরানো স্মৃতি জেগে উঠলো এবং subconscious-এ ঘাপটি মেরে বসে থাকা সেই স্মৃতি বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক। যেই সে কথা মনে পড়লো অমনি আগের-পরের নানান ঘটনা, নানারকমের emotions একের পর এক ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে তাঁর মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুললো। যিনি কিছুক্ষন আগেও নির্বিঘ্নে একমনে পছন্দের বই পড়ছিলেন, তিনি এখন বই সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়েছেন, মন তাঁর ভাবনাগুলোকে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে নিয়ে গিয়ে ফেলছে, তিনি মনে মনে একটা topic থেকে অনায়াসে অন্য topic এ ভেসে চলে যাচ্ছেন এবং কে কবে অপমান করেছে, কে ঠকিয়েছে, কে use করেছে, কে betray করেছে - সব এক এক করে তাঁর মনের পর্দায় উঠে আসছে আর রাগে দুঃখে অভিমানে ঘৃণায় ভেতরটা যেন একেবারে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। 

ঘরটা এখনো নিঃশব্দ, ঠান্ডা, আরামদায়ক, চা-টা এখনো দার্জিলিং ফার্স্ট ফ্লাশ, হটাৎ করে অসহ্য মোবাইলটাও বেজে ওঠেনি, কেউ দরজায় ধাক্কাও দেয়নি, বাহ্যিকভাবে অ-সুখের কোনো কারণই ঘটেনি, তবু সুখের অনুভূতিটা গায়েব হয়ে গেল কিভাবে? আসলে সুখ এবং দুঃখ একটা বিশেষ জিনিসের ওপর নির্ভরশীল - অহং। অহং মানে আমি, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্যিকারের আমি নয়, আয়নায় যাকে দেখা যায়, সেই আমিটা। সেই আমিটা কখনো সুখী কখনো অসুখী, কখনো শান্ত কখনো অশান্ত তার কারণ তার মন তাকে চালায়, সে মনকে চালায় না। তার গোটা living experienceটাই শরীর-মন নির্ভর, ফলে সে external storage এবং internal storageএর input দ্বারা খুবই প্রভাবিত। তাহলে মানসিক শান্তি আসলে কি? 

শান্তি হলো মনের ওপর সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রণ আসার পর যে অবস্থা হয়, সেটা - যাতে জীবনের গতিপ্রকৃতিকে কেবল এই শরীর-মনরূপী পর্দার ওপর reflected চলচিত্র বলে মনে হয় আর নিজেকে কেবল সেই চলচিত্রের দর্শক। এতে কি হয়, ইচ্ছে মতন switch on switch off করা যায় - বাইরে ঝড় উঠলেও ভেতরটা শান্তই থাকে, আর জীবনের ওঠাপড়া মানসিক অবস্থার ওপর কোনো permanent দাগ কাটে না। যে কেউই কি এইরকম নিরভিমানি, নিস্পৃহ এবং নিরাসক্ত হতে পারেন? হ্যাঁ পারেন, তবে একাগ্রচিত্ত হয়ে অভ্যাস করতে হয় আর ইষ্টের কাছে "আমার অহংকার ধ্বংস করো প্রভু", প্রতিনিয়ত এই ultimate of all কৃপাটির জন্য একেবারে মন প্রাণ দিয়ে sincerely প্রার্থনা করতে হয়। 

একেবারে সোজাসুজি তো মানুষ হাঁটতেও পারেনা - প্রথমে পেট ঘষটে ঘষটে চলে, তারপর পিঠ তুলতে গিয়ে পেটের উপর পড়ে যায়, তারপর হামাগুড়ি, তারপর কোনোমতে এক দু সেকেন্ডের জন্য পিঠ বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই ধপ করে পড়ে যাওয়া, তারপর কোনোমতে নড়তে নড়তে এক-দু মিনিট সোজা হয়ে দাঁড়ানো, তারপর প্রথম step এবং পড়া, আবার ওঠা আর আবার পড়া, আবার ওঠা, দুপা হাঁটা আর পড়া, এমন করতে করতে একদিন অল্প কিছুটা distance হেঁটে যাওয়া এবং টলমল করতে করতে ধীরে ধীরে steady হয়ে গিয়ে অবশেষে গড়গড় করে হাঁটা। নিজের অহংকে বর্জন করাও ঠিক এই ক্রম ধরেই হয় কারণ ওটাও নিজের অন্তরের দিকে হাঁটতে শেখা। হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে পাটাই মচকে গেল বা ভেঙে গেল। তখন আবার গুরুরূপী ডাক্তারবদ্যি, সেরে গেলে আবার হাঁটি হাঁটি পা পা। এমনটাও হয়।

অনেকসময়ই দেখা যায় যে এই মেকি অহং আমাদের কেমন জানি অস্বাভাবিক করে তোলে। হয়তো প্রখর গরমে আরামদায়ক বাতানুকূল গাড়ি করে যাচ্ছি, বাইরে রাস্তায় ঘর্মাক্ত কলেবরে হেঁটে চলা মানুষদের জন্য মনকষ্ট হওয়ার বদলে নিজেকে কেমন যেন কেউকেটা মনে করে আত্মপ্রসাদ লাভ হচ্ছে - কি অদ্ভুত! আবার, হয়তো কোনো ফাংশনে গেছি, সামনের সিটে বসতে গেছি, কেউ এসে বললেন ওই row টা ভিআইপিদের জন্য reserved, আপনি পেছনে গিয়ে বসুন - ব্যস অমনি অপমানে গা জ্বলে উঠলো - কি, আমাকে পেছনে বসতে বলা, জানিস আমি কে? একটি শিশুর কিন্তু এইধরণের কোনো hangover থাকে না, যত সে বড় হয় তত এইসব aquired আবর্জনাগুলো জড় হয়, আর তত তার অহংকার বাড়তে বাড়তে শেষে একেবারে পৈশাচিক আকার ধারণ করে।

অহংকার ত্যাগ করতে গেলে আবার শিশু অবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তবেই শান্তি পাওয়া যাবে। তার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আবার মায়ের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতাকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনা। প্রত্যেকে শিশুই তো নিজে থেকে কোনকিছুরই সুরাহা করতে অক্ষম হওয়ায় এতটুকু অসুবিধা হলেই কেঁদে ওঠে, তা সে পেটব্যথাই হোক বা খিদে পাওয়া, ঢেঁকুর না ওঠাই হোক বা কাপড় ভিজিয়ে ফেলা। তারপর তার মা নিজে থেকেই বুঝে নেন অসুবিধাটা কোথায় এবং সমাধানও তৎক্ষণাৎ হয়ে যায়। শিশু মায়ের কোলে যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায়, সে জানে তার একবার ট্যাঁটুকু করাই যথেষ্ট, আপনেআপ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে - তার জন্য না তো সমস্যা কি তা বোঝার প্রয়োজন আছে, না বোঝানোর জন্য ভাষা আর না সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার। 

শিশুর একমাত্র একটাই কাজ - ট্যা‌ঁ করে উঠে মাকে একবার জানান মাত্র দেওয়া যে ওনাকে তার প্রয়োজন - ব্যস, ঝামেলা শেষ। এই যে সম্পুর্ন মাতৃনির্ভরতা, এই যে অভিমানশুন্যতা আর এই যে নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্বাস, এটাই হলো মাকে কাছে পাওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি। মা তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে, আমি বাপু মুক্তকচ্ছ। বস্তুত জগৎজননী মহামায়া যে জগৎপ্রসবিনীও, মহাশক্তির রূপই তো মাতৃশক্তি, তাই এই মা আমার সত্যিকারের মা, চিরকালের মা, অনন্তরূপিনী মা, কেবল এক শরীরের গর্ভধারিণী মা নন। আমার ইহকাল পরকালের ভার তোমার মাগো, আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, যেমন বাজাও তেমন বাজি, যেমন রাখো তেমনি থাকি, বাঁদিকে ফিরিয়ে রাখলে বাঁদিক ফিরেই নিশ্চিন্তে ঘুমাই, ডানদিকে ফিরিয়ে দিলেও তাই, আবার চিৎ করে শুইয়ে দিলেও তাইই। 

মায়ের পায়ে নিজের অহংকে সঁপে দিতে পারলে দুটো জিনিস হয় - ১. ধীরে ধীরে 'আমার সন্মান' 'আমার অভিমান' থেকে unneccesary appendages ঝরে গিয়ে কেবল 'আমার মা'টুকু রয়ে যায়, আর ২. মায়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার সাথে সাথে proportionately নিজের কাজ কখন যেন মায়ের কাজ হয়ে ওঠে। নির্ভরতা মানে কিন্তু নিষ্ক্রিয়তা নয়, নিশ্চিন্ততা - কারণ জানি যে মায়ের কাজ মা নিজেই ঠিক করিয়ে নেবেন, আমার এই শরীর-মন উপলক্ষ মাত্র। আর মায়ের কাজ যেহেতু সর্বদা নির্ভুল ও কল্যাণকারী, ফলে আমার ভুল পথে যাওয়ার তো আর কোনো যো নেই। এতে সুবিধা এই যে প্রথমত যে কোনো কাজের একটা greater sense of purpose তৈরি হয়ে যায় যা personal egoকে মাথা চাড়া দিতে দেয়না আর দ্বিতীয়ত মন ধীরে ধীরে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হতে থাকে, কোনো অধর্ম সে আর সইতে পারে না। জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্য এ দুটোই কিন্তু খুব জরুরি।

সমস্ত উপনিষদেই প্রতিটি শান্তিমন্ত্রের শেষে তিনবার ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ বলা আছে। এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য হলো আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নেরই যেন বিনাশ হয় কারণ নির্বিঘ্ন উদ্বেগশূন্য আনন্দময় জীবনই আসলে শান্তিময় জীবন। তারই পরম আশ্বাস দিয়ে উপনিষদ বলছেন,
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
অর্থাৎ,
পূর্ণ হতে পূর্ণ শুধু আসে
পূর্ণ ছিলাম পূর্ণ তাই আছি
এ পূর্ণের হবেনা যে ক্ষয়
এ অনাদি অজর অব্যয়
তোমার অমৃত দিয়ে
পূর্ণ হোক এ মানব
শান্তির অক্ষয় বারিধারায়
ধন্য হোক ধরা।
[ভাবানুবাদ : শ্রীমতি অনিন্দিতা গঙ্গোপাধ্যায়]

মায়ের বাড়ি - মাতৃমন্দির চত্বর

মায়ের গ্রাম জয়রামবাটি থেকে শরীরটা ফিরে আসলো বটে কিন্তু মন এখনো ঐখানেই ঘোরাঘুরি করছে। এখনো আমি চোখের সামনে গোটা মাতৃমন্দির চত্বরটি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি - ঢোকার আগে প্রথমেই ডানহাতে ভানুপিসীর বাড়ি, তারপর মায়ের বৈঠকখানার জগদ্ধাত্রীপূজার বারান্দা, মায়ের নতুন বাড়িতে প্রবেশের দরজা, ভেতরে মায়ের নতুন বাড়ি, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সামনের দাওয়া, পেছনদিকে মায়ের ভাইজিদের থাকার ঘরগুলো, বেরিয়ে এসে ডানদিকে মাতৃমন্দিরের বড় মেন গেট, ঢুকে বাঁ দিকে ফুলের বাগানের ধারে প্রথমে ছোট অডিটোরিয়াম, তারপর মায়ের পুরানো বাড়ি। তার পেছনদিকের গ্রিলের গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে মায়ের শোয়ার ঘর আর ভাঁড়ার, ডানদিকে দিদিমার বাড়ি, সামনে মায়ের রান্নাঘর, সোজাসুজি সদর দরজা, বাঁ দিকে বৈঠকখানা, তার পেছনে পাগলীমামীর ঘর। তারপর ওই পেছনদিকের গেট দিয়েই বেরিয়ে বাঁহাতে ছোট একটা লনের পর অফিসবাড়ি, সামনে স্বামীজীর মূর্তি, তার সামনে মন্দিরের পাশের লন। আগে যেখানে একটা বাঁধানো চাতাল ছিল সেখানে, মন্দিরের ঠিক পেছনে, নতুন বেসমেন্ট ও ভোগের রান্নাঘর কন্সট্রাকশন হচ্ছে আর তার সামনেই মায়ের সেই জগৎবিখ্যাত মন্দির, পাশে টেম্পোরারি শেড যেখানে পূজার ভাঁড়ার ও মায়ের পূজার প্রস্তুতি এবং ভোগ রাঁধা হয়। মন্দিরের সামনের রাস্তা, রাস্তার পাশে মায়ের পরিবারের গৃহদেবতাদের খড়ে ছাওয়া ঘর, তারপর ডান পাড়ে পূণ্যপুকুর, পেছনদিকে পরপর গেস্টহাউসগুলো, সেসব পেরিয়ে বাঁ দিকে খাওয়ার হলগুলো আর ডানদিকে সার দিয়ে হাতধোয়ার কল, তারপর পেছনের মাঠের গেট, তারপর গোয়াল আর তার পেছনে কর্মীদের লিভিং কোয়াটার্স। পূণ্যপুকুরের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটি গাড়ি ঢোকার গেটের দিকে এগিয়ে গেছে, সেটি গেস্টহাউস শেষ করে একটি থানাকে বাঁ দিকে রেখে অর্ধচন্দ্রকার হয়ে আবার মেন গেটের সামনে এসে মিশেছে। এদিকে ভেতরে, যেখানে বেসমেন্ট তৈরি হচ্ছে, তার পেছনে তিনটি আলাদা আলাদা সাধুনিবাস, তার মাঝখানে, একটু পিছিয়ে, পায়রাঘর। গোলাপের বাগান পেরিয়ে অফিসের পেছনের বাঁ দিকের দুটি মুখোমুখি সাধুনিবাসের পর সেই পুকুর যেখানে মা স্নান করতেন আর যেখান থেকে কলসি কাঁখে খাবার জল তুলে আনতেন, সেটির বেড়া - পুকুরটি এখনো মঠের আয়ত্তের মধ্যে নেই। ডাইনিং হলের পেছনে সাধু নিবাসের খিড়কি দরজা অবধি একটা ঘেরা জায়গা, মঠের গাভীদের বিচরণভূমি আর ডাইনিং হলের এপাশে, অর্থাৎ নির্মিয়মান বেসমেন্টের দিকটায় পরপর শ্রীসারদা সদাব্রতের ঘরগুলো, খাবার পরিবেশনের প্রস্তুতিকক্ষ, ভান্ডারী মহারাজের টেম্পোরারি ঘর আর রান্না করার ঢাকা জায়গা। অনেকেই হয়তো জানেন না যে এখন যেখানে মায়ের মন্দির, যার গর্ভগৃহ সেই দৈবস্থানে যেখানে মা ভূমিষ্ট হন, সেটি মায়ের বাবার বাড়িরই অংশ ছিল এবং এই বাড়িতেই ঠাকুরের সাথে মায়ের বিবাহ হয় এবং এখানেই তিনি ৯ বছর বয়স অবধি থাকতেন। সেইজন্যই পারিবারিক ঠাকুরঘরটি তখন বসতবাটি লাগোয়া ছিল, এখন বিচ্ছিন্নভাবে একা রয়ে গেছে। পরিবার বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন যেখানে অফিসবাড়ি, সেইখানে মায়ের বাবা নতুন বাড়ি তৈরি করে উঠে যান। সে বাড়িতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় যাকে আমরা মায়ের পুরানো বাড়ি বলি, সেই ঘরগুলো আরো পরে তৈরি করা হয়। এগুলো যেহেতু সবচেয়ে নতুন এবং ১৯১৬ পর্য্যন্ত এখানেই যেহেতু মা স্বয়ং এবং পরবর্তীতে তাঁর এক ভাইয়ের পরিবারবর্গ বাস করতেন, ফলে সৌভাগ্যবশত এগুলি অক্ষুন্ন থেকে গেছে, ঠাকুরঘর ছাড়া বাকি আগের অব্যবহৃত মাটির বাড়িগুলি কালের নিয়মে মাটিতেই মিশে গেছে। ফলে জয়রামবাটির মাতৃমন্দির কেবল মায়ের জন্মস্থানই নয়, মায়ের বিবাহমণ্ডপ এবং বাসস্থানও বটে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে মা এখনো ওখানে বসে প্রতিদিন পূজা গ্রহণ করেন এবং আমাদের মনের কথা শোনেন। অমন ভরসার জায়গা কি আর ভূভারতে আছে রে দাদা?

Tuesday, April 25, 2023

ফিরে যাওয়া

আর খানিকক্ষণ পরেই মায়ের বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। মাকে প্রাণভরে দেখে নিলাম, যাতে মনের মধ্যে এই ছবিটা থেকে যায়। আমি গতবার যখন মাকে দেখেছিলাম উনি তুঁতে রঙের বেনারসি শাড়ি পড়েছিলেন, চোখ বুজলে এতদিন ওঁকে ওই ভাবেই দেখতে পেতাম। আজ দেখলাম ইঁটের রঙের সিল্কের শাড়ি পরে আছেন, গলায় মুক্তোর মালা। এবার মা এই রূপে মনে ধরা থাকবেন বহুদিন। 

খুব কষ্ট হচ্ছে ফিরে যেতে কিন্ত উপায় নেই। ভোর চারটের মঙ্গলারতি, সংক্ষিপ্ত বেদমন্ত্র এবং গীতাপাঠ আর তারপর প্রয়োন্ধকার মন্দিরে আলোকোজ্জ্বল মায়ের সামনে বসে এক অখন্ড শান্তির পরিমণ্ডলে জপ এবং ধ্যান - মন এক সেকেন্ডে শান্ত হয়ে যায়। আমি যেমন মাকে দেখছি, মাও তো আমায় দেখছেন - গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। 

প্রতিদিন প্রসাদ তো যা পেয়েছি তা পেয়েছি - অনবদ্য। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো রোজ তিনবেলা হয় মায়ের অন্নভোগের প্রসাদী ভাত আর পায়েস, অথবা শীতলভোগের লুচির টুকরো আর প্রসাদী ফল - কে দেবে? আর ঘুরতে ফিরতে যখন ইচ্ছে এখানে মাকে যে দেখা যায় - মা সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন, অজস্র মানুষের প্রণাম নিচ্ছেন, পুজো নিচ্ছেন, অশান্ত ক্ষিপ্ত মানুষ হন্তদন্ত হয়ে মন্দিরে ঢুকে মায়ের কৃপায় খানিকক্ষণ পর একেবারে শান্ত অবস্থায় ধীরপায়ে প্রশান্ত মুখমন্ডল নিয়ে বেরিয়ে আসছেন - এ আর অন্য কোথায় রোজ রোজ চোখের সামনে দেখতে পাবো? 

সেই সাথে মহারাজদের স্নেহ - প্রোগ্রাম চলাকালীন অত মানুষের ভিড়ের মধ্যে হটাৎ করে চুপচাপ দুপ্যাকেট চিনেবাদাম হাতে গুঁজে দিয়ে যাওয়া বা কানে কানে বলে যাওয়া যে অফিস ঘরে ফ্লাস্কে চা করে রাখা আছে আর disposable cup ও রাখা আছে, আমার চা খেতে ইচ্ছে করলেই যেন আমি টুক করে গিয়ে খেয়ে আসি। এই যে একটা ভাব যে আমরা সবাই মায়ের ছেলে আর মাই হচ্ছেন আমাদের সকলের common binding factor, আমরা গেরুয়া পরি বা নাই পরি, সবাই মায়ের নামে একজায়গায় একাট্টা হয়েছি, এটাই আসল ব্যাপার। 

এই জায়গার আসল মজা এটাই - যেন লাগাতার মায়ের নামকীর্তন চলছে - একমাত্র মাকে ঘিরেই সবার existence, যা কিছু সব মায়ের নামেই হচ্ছে। আর বিশ্বাস, প্রগাঢ় বিশ্বাস, যে মা চাইলে যে কোনো আপাত অসম্ভব কাজও সম্ভব হয়, তিনিই করিয়ে নেন। এই অনুভূতিটা বিশেষ করে জয়রামবাটি মঠেই পাওয়া যায় কারণ যিনি হয়তো রেগে গিয়ে কাউকে বকছেন তিনি মায়ের কোনো কাজ ঠিকমতন করা হয়নি বলেই বকছেন আর যিনি বকুনি শুনছেন তিনিও মায়ের কোনো কাজে ঠিকমতো মনোযোগী হননি বলেই বকুনি শুনছেন, দুজনেরই ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নেই। এইখানে সংসারীর সংসার আর সাধুদের সংসারের তফাৎ - এটাই টানে। তাই মায়ের আপন সংসার ছেড়ে যেতে বোধহয় প্রতিবারই এত কষ্ট হয়। জয় মা।

জয়রামবাটি থেকে গোঘাট স্টেশনে আসার পথে কামারপুকুরে ঠাকুরকে দর্শন করে এলাম। যুগির শিবমন্দিরে, ঠাকুরের মন্দিরে, রঘুবীরের মন্দিরে আর ঠাকুরের শোবার ঘরের বারান্দায় একসাথে পুজো হচ্ছে, দেখলাম অনলাইন ডাইরেক্ট লাইভও হচ্ছে। ঠাকুর কামারপুকুরে সদাই গভীর সমাধিমগ্ন, আঁখিদ্বয় অর্ধনিমিলিত, এক অপূর্ব দিব্য রূপ তাঁর। একদম কাছ থেকে দর্শন করলাম, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম, সুখনো প্রসাদ নিলাম, এখন ট্রেনে বাড়ির পথে। ঠাকুরের ওই মুখটা আমায় অসম্ভব টানে। নিজের জন্মস্থানে ঠাকুরের যে রূপ, তেমনটা বুঝি আর কোথাও নেই। দেখলাম ঠাকুরের পোঁতা আঁটির আমগাছটা ফলে ফলে একেবারে ভরে আছে, এমন যে বাঁশ দিয়ে ডালগুলোকে ঠ্যাকা দিয়ে রাখতে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ ওটির তলায় দাঁড়িয়ে তার ছায়া মাখলাম সারা শরীরে। ঠাকুরের প্রিয় মোদকের দোকান থেকে ২০০ গ্রাম সাদা বোঁদে কিনেছি, মা আর ঠাকুরকে তাঁদের প্রিয় মিষ্টি আজ ভোগে দেবো। জয় মা, জয় ঠাকুর।

পুঃ : আমি জানতাম না যে আজ কামারপুকুরের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা দিবস। না জেনেই এই খুশির দিনে ঠিক হাজির হয়ে গিয়েছিলাম!

মায়ের গ্রাম

জয়রামবাটি গ্রামটির একটা বিশেষত্ব অবশ্যই যে এটি শ্রীশ্রীমায়ের জন্মভূমি, জগ্গজননি এই সাধারণ গ্রামটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মর্তে মানবী শরীর ধারণ করে প্রকাশিত হওয়ার জন্য। যতদিন দেহে ছিলেন ততদিন এই গ্রামের প্রতি, গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, তাঁর দরদ নানাভাবে প্রকাশ পেত। বস্তুত একমাত্র এইখানেই মা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। এ গ্রামে তিনি কারো পিসি কারো খুড়ি কারো বা মাসি। তিনি এ গ্রামের মেয়ে, এখানে তাঁকে একগলা ঘোমটা টেনে গরমে গলদঘর্ম হয়ে ভক্তদের প্রণাম গ্রহণ করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় বসে থাকতে হতো না। মা মর্তলীলা সম্বরণ করেছেন ১৯২০তে আর সেইবছরেই জয়রামবাটিতে শুরু হয়ে গেছে মঠ এবং মিশনের কাজ। মায়ের জন্মস্থানে ওপর মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২৩শে।

মা যে এখনো এই গ্রামকে কেন্দ্র করে তাঁর মাতৃভাব সমানভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটাই এই গ্রামের এবং আশেপাশের অঞ্চলের সমকালীন বিশেষত্ব। প্রথমত, গত একশ বছর ধরে মা স্বয়ং এখানে নিত্যপূজা নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, এতবছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে এসে মাতৃসান্নিধ্য অনুভব করে কৃতার্থ হয়েছেন, হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। তৃতীয়ত, মা এখানে আছেন তাই গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামোটা এত মজবুত, নইলে এমন গ্রাম তো বাংলার বুকে কতই আছে, তারা কি আর এমন বর্ধিষ্ণু? চতুর্থত, মায়ের নামে মায়ের ছেলেরা বছরের পর বছর ধরে যে অক্লান্ত সেবাকাজ করে চলেছেন তাতে কত দুঃস্থ পরিবার রোজ খেয়ে পরে বাঁচছে - শিশুর নিত্যদিনের দুধ থেকে নিয়ে মহিলাদের কর্মসংস্থান অবধি, শিক্ষা থেকে নিয়ে স্বাস্থ্য অবধি - কত কিই না রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সেবাশ্রম এবং পল্লীমঙ্গলের দ্বারা প্রতিদিন এই অঞ্চলে ঘটে চলেছে। পঞ্চমত, এই যে কামারপুকুর থেকে নিয়ে জয়রামবাটি অঞ্চলটি এবং তৎসংলগ্ন গ্রামগুলি যেমন সাতবেরিয়া, বেঙ্গাই, শিহড়, ফুলুই, দেশ্রা, পাণ্ডুগ্রাম, গার মন্দারণ ইত্যাদি যেখানে ঠাকুর এবং মায়ের পদরেণু এখনো প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে, গোটা এলাকা জুড়ে যে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, রেললাইন সম্প্রসারণ (গোঘাট অবধি রেল এসে গেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে কামারপুকুর এবং জয়রামবাটিকে যোগ করার কাজও দেখলাম জোরকদমে চলছে) ইত্যাদি যে মহাযজ্ঞ, তা ওঁদের প্রত্যক্ষ যোগ ছাড়া সম্ভবই ছিল না। 

ফলে যাঁদের মনে হয়তো এখনো প্রশ্ন আছে যে মা সত্যিসত্যিই জয়রামবাটিতে আছেন কিনা, তাঁরা একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন মায়েরই নামে যখন গত ১২৩ বছর ধরে এতকান্ড ঘটছে, সেখানে তাঁর নিজের ইচ্ছা ছাড়া কি করো পক্ষে একচুলও নড়া সম্ভব ছিল? মায়ের সবদিকে নজর, তাই নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় কাজ কাউকে না কাউকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নেন আর তাকে বুঝতেও দেননা। এখানে মায়ের কাছে যে যা আবদার করবে সে তাই পাবে। আজ ভোরে মা আমার বহুদিনের একটি সুপ্ত ইচ্ছাপূরণ করেছেন - আমি একেবারে এক হাত সামনে থেকে কোনো ফুল মালা ছাড়াই মায়ের দুটি রাঙ্গাচরণের পবিত্র পদচিহ্ন মন ভরে দেখতে পেয়েছি, আর মনে মনে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে যতক্ষণ আমার মন চেয়েছে প্রার্থনা করতে পেরেছি,
কৃপাং কুরু মহাদেবি সুতেষু প্রণতেষু চ ।
চরণাশ্রয়দানেন কৃপাময়ি নমোহস্তু তে ।।

মাতৃমন্দির ১০০

অনেকদিন মায়ের বাড়ি যাওয়া হয়নি, আগামীকাল যাবো। শেষ যেবার গিয়েছিলাম, সেবার এমন এক সঙ্গী ছিলেন যাঁর নিজের বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল প্রবল, ফলে যতক্ষণ মায়ের কাছে থাকার ইচ্ছে ছিল থাকতে পারিনি, কোনোমতে কামারপুকুরে মাথাটা ঠেকিয়েই কলকাতায় ফিরে আসতে হয়েছিল। 

যাইহোক, এবার মায়ের অশেষ কৃপায় আবার তিন রাত্তির তাঁর বাড়িতে থাকবো, এর আগের তিন রাত্তির থাকার স্মৃতি এখনো মানসে বাস্তবের মতন উজ্জ্বল। মাতৃমন্দিরের প্রতিটি খাঁজখোঁজ আমার জানা, চোখ বন্ধ করে ভাবলেই এই গোটা মহাতীর্থক্ষেত্রের আনাচকানাচ আমি যেন স্পষ্ট সিনেমার মতন দেখতে পাই। 

যখনই আমার মন খারাপ হয় আমি মনে মনে মায়ের বাড়ি চলে যাই, মায়ের সামনে গিয়ে বসি, শান্তি পাই। গতবার যখন গিয়েছিলাম তখন মন্দিরের বাইরে টেন্ট লাগেনি, গর্ভমন্দির কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়নি, প্রসাদের হলটা অত বড় হয়নি, হলের মাথায় সোলার ইউনিট লাগেনি ইত্যাদি, যদিও মহারাজের দৌলতে যথাসময়ে সব খবরই পেয়েছি। এবার সব নতুন করে দেখেশুনে মেন্টাল ম্যাপটা একবার রিনিউ করে নিতে হবে। 

মায়ের আদেশ হলো শেষ কথা। মা যখন যা করতে বলবেন করতেই হবে, সেখানে ব্যক্তিগত ইগো ফিগোর কোনো স্থান নেই। মা তো আর সরাসরি কিছু বলেন না, কোনো না কোনো মহারাজের মাধ্যমে আদেশ পাঠান। সেই আদেশ লঙ্ঘন করার সাধ্য আমার নেই। হয়তো সবসময় সফল হইনা, হয়তো অপারগ জেনেও মা কেবল পরীক্ষা করার জন্যই কাজ দেন, কিন্তু মা যে আমায় মনে করে তাঁর অমুক কাজটা করতে বলেছেন, সেই feelingটার মতন exhilarating আর কিই বা আছে! 

তার জন্য যদি আমায় কারো হাতে-পায়ে ধরতে হয় এখনো ধরি, ভবিষ্যতেও ধরবো, কারণ কাজটা মায়ের। আমার কোনো স্বতন্ত্র identity নেই, মা যেমন চালান তেমনিই চলি। যার মানই নেই তার আবার অপমানের ভয় কিসের? গিন্নি ভয় পাচ্ছেন রাস্তায় এবং বিষ্ণুপুরের এই প্রচন্ড দাবদাহে এসি ছাড়া রোদ্দুরে আমার হয়তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত মা আগলে রাখবেন, কোনো সমস্যাই হবে না।

অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে আগামী ২৩শে এপ্রিল মাতৃমন্দির স্থাপনার শতবর্ষ উজ্জাপন হবে, সেই উপলক্ষে ২২ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্য্যন্ত টানা celebration, বিশেষ পূজা ইত্যাদির সাথে প্রভাতফেরি, তিনদিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রচুর ভক্তসমাগম হবে। মা যে আমাকে তাঁর এই ঐতিহাসিক কাজে কাঠবেড়ালি হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, তাতেই আমি ধন্য। 

১০০ বছর আগে যেদিন পরম পূজ্যপাদ শরৎ মহারাজ জগৎজননীর জন্মস্থানের ওপর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মাকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেদিন আমি অন্য শরীরে ওখানে উপস্থিত ছিলাম কিনা জানিনা। কিন্তু এবার, ১০০ বছর পর, এই বিশেষ দিনটিতে যে ওখানে উপস্থিত থেকে ভোরে মায়ের মঙ্গলারতি দর্শন করতে পারবো, এ নিশ্চয় পূর্বজন্মের কোনো বিশেষ সুকৃতির ফল। 

যেহেতু জয়রামবাটি বা কামারপুকুর যাওয়ার জন্য এখনো পর্য্যন্ত না আছে ট্রেনলাইন, না আছে এসি বাস, তাই হওড়া থেকে সকাল ৭.২৫এর গোঘাট লোকাল ধরবো, সেখান থেকে হয় শেয়ারের ট্যাক্সি বা টোটো করে মায়ের বাড়িতে পৌঁছব। এতক্ষনে নিশ্চয় গোটা আশ্রম প্রাঙ্গণ আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে, যেই সুয্যি ডুববেন অমনি স্বপ্নপুরীর মতন মায়ের বাড়ি ঘর মন্দির সব জ্বলজ্বল করে উঠবে। আর তর সইছে না কাল ভোরের অপেক্ষায়। 

জয় মা জয় মা জয় মা।

Wednesday, April 19, 2023

প্রেম-আনন্দ


শ্রীচৈতন্যদেব নিজের হাতে যে আটটি শ্লোক লিখেছিলেন (মতান্তরে পাঁচটি), তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো,
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা। 
অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥
(যিনি নিজেকে ঘাসের চেয়েও ক্ষুদ্র মনে করেন, যিনি গাছের চেয়েও সহিষ্ণু হন, যিনি নিজে মানবোধশূন্য হয়ে অন্যকে সন্মান প্রদান করেন, তিনিই হরির নাম করার অধিকারী।)

গতকাল ইউটিউবে বৃন্দাবনবাসী শ্রীহিত প্রেমানন্দ গোবিন্দস্মরণজী মহারাজের একটি প্রবচন শুনছিলাম। ওনাকে চাক্ষুস দর্শন করার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি কিন্তু উনি যে একজন সত্যিকারের মহাত্মা, সে বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শ্রীচৈতন্যদেব যা বর্ণনা করেছেন, মহারাজ যেন তার জীবন্ত প্রতিরূপ। কিছুদিন আগে বিরাট কোহলি আর অনুষ্কা শর্মা ওনার আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার ফলে মহারাজ ইদানিং বহুচর্চিত কিন্তু বহুবছর ধরেই মানুষ রাত দেড়টা থেকে ওনার আশ্রমে ভিড় জমাতে শুরু করেন যাতে দিনের বেলায় নিজের চোখে তাঁকে কাছ থেকে দর্শন এবং শ্রবণ করতে পারেন। এমন রাধাময় সন্ত আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। 

যাইহোক, মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে উদ্ধৃত করে বলছিলেন যে অমৃতের পুকুরে তুমি নিজেই ডুব দাও বা পা পিছলে পরে যাও বা কেউ ঠেলেই ফেলে দিক, একবার অমৃত মুখে পড়লেই তুমি অমৃতময় হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, বিরক্ত হয়ে তাঁর নাম নাও বা অভ্যেসবশেই তাঁর নাম নাও বা ভক্তিভরে তাঁর নাম নাও, নাম নিয়েছ কি নাম তোমায় নিয়ে নেবে আর নাম তোমায় একবার নিলে তুমি যাই করো আর তাই করো, গতি তোমার ভগবানমুখীই হবে। উনি বলছিলেন, মাহাত্ম বোঝো আর নাই বোঝো, নাম করে যাও - যে অবস্থাতেই থাকো নাম ছেড়ো না, কেবল নাম করে যাও - একদিন ঠিকই বুঝবে নাম তোমার কি করলো। মা বলতেন 'জপাৎ সিদ্ধি'। এসব কথা শুনলেই মায়ের নির্দেশ মনে পড়ে।

প্রেমানন্দজীকে যখনই শুনি, যতবার শুনি, মনে হয় যেন ঠাকুর মাকে একশ বছর পর ফিরে আসার ব্যাপারে যা বলে গিয়েছিলেন, তাই যেন হয়েছে - only the form has changed! কি কঠিন তপস্যা, কি প্রচন্ড তপ‌ঃতেজ, কি সরল ভাষায় জটিল আধ্যাত্মিক সূত্রকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, কি বিনয়, কি মাতৃভাব, কি সখীভাব, অথচ ভক্তের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কি দারুন চেষ্টা, সেখানে কি অদ্ভুত uncompromising দৃঢ়তা। গত দশ বছর ধরে দুটো কিডনিই খারাপ, দুদিন অন্তর ডায়ালিসিস হয় কিন্তু প্রবচন এবং দর্শনে কোনো ছেদ নেই। এই অবস্থাতেও রোজ ভোররাতে পরিক্রমায় বের হন, খুব ইচ্ছে আছে যথাশীঘ্রসম্ভব বৃন্দাবনে গিয়ে পরিক্রমা মার্গে দাঁড়িয়ে ওনাকে একবার দর্শন করার। আর কি গুরুভক্তি - আহা! তারও ভিডিও দেখেছি - আহা যদি এর এক দশমাংশও পেতাম!

৬নং শ্লোকে শ্রীচৈতন্যদেব আরো লিখেছিলেন,
নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদগদরুদ্ধয়া গিয়া। 
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি॥
(হে নাথ! তোমার নাম গ্রহণে কবে আমার নয়ন-যুগল অশ্রুধারায় শোভিত হবে? বাক্য-নিঃসরণের সময়ে বদনে গদগদ-স্বর নির্গত হবে এবং আমার সমস্ত শরীর পুলকিত হবে?)
ভক্তরা শ্রীরাধিকার নাম করছেন, শ্রীকৃষ্ণের নাম করছেন আর মহারাজের চোখ বন্ধ, গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে আর মাঝেমাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ছে - একটা ভিডিওতে এই দৃশ্য দেখার পর থেকে কেবলই ঠাকুরের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে আর মনে হচ্ছে এ জীবনে এমন আনন্দ আমি কবে পাবো - কবে কেবলমাত্র 'মা' লেখা দেখেই বুকের ভেতরটা মায়ের জন্য এমন হু হু করে উঠবে?

Friday, April 14, 2023

নিশীথিনী

রাত্রি বড় একাকিনী। পৃথিবী যখন শান্ত, নিস্তব্ধ, ঘুমে অচেতন, তখন সে একা জাগে। পূর্ণিমার নরম আলোর আঁচল ছড়িয়ে সে প্রতীক্ষায় থাকে, কবে মাঝরাতে কেউ সেই জোছনা মাখতে উঠবে। এক অদ্ভুত উদাসীন আত্মবিস্মৃত ঘুমন্ত পৃথিবীর যেন সে একাকী জাগ্রতা দ্রষ্টা। হয়তো বেল, কামিনী আর হাস্নুহানার গন্ধে ম ম করছে চৌদিক, হয়তো কেউ একবার চোখ মেললেই সৌরভে ভরে যাবে তার অন্তর আর যাপন উদ্ভাসিত হবে নরম চাঁদের আলোয়, কিন্তু ঘুম যে আর ভাঙ্গে না। নীরবে, নিভৃতে, নিবিড় এক বন্ধনে রাত্রি বাঁধতে চায় সবাইকে কিন্তু পারে কৈ? আমি রাত্রির মতন অন্তরঙ্গ করে তোমাকে চাই, আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তোমাকে চাই, আমার দুঃখ বেদনায় তোমাকে চাই, আমার জীবনপুষ্পের যৌবনরেণু হিসেবে তোমাকে চাই, আমার সফলতার আকাশ জুড়ে তোমাকে চাই। আমি তোমাকে চাই সেই আলোকময় সুরভিত করুণাঘন গভীর রাত্রি রূপে, যে আপনাকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য, মিশিয়ে দেওয়ার জন্য সদা উদগ্রীব। আমি তোমায় রাত্রির সম্পূর্ণ ধারণার মতন ধারণ করতে চাই।

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥

গতকাল রাত থেকে এই গানটা আমায় তাড়া করে ফিরছে। হয়তো চৈত্রের শেষ রাত বলেই, হয়তোবা বৈশাখের নতুন সূর্য উদয়ের পথে বলেই, ঠিক জানা নেই। শুভ নববর্ষ।

Sunday, April 2, 2023

নতুন সংসদভবন

বিদিশার বিশাল বীজমন্ডল মন্দির, যাকে বিজয়া মন্দিরও বলা হয়, ঔরঙ্গজেব তোপ দেগে ধ্বংস করেছিল ১৬৮২তে আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর তৈরি করেছিল আলমগিরি মসজিদ। 

১১ শতকে সম্রাট নরবর্মন দেবী চার্চিকা বা বিজয়ারুপিনী মহিষাসুর মর্দিনীকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটির নির্মাণ শুরু করেছিলেন কিন্তু বোধহয় কাজ শেষ করে উঠতে পারেননি।

এখন এই ধ্বংসাবশেষ ASI দ্বারা সংরক্ষিত। গোমুখ আকৃতির এই বিশালাকায় মন্দিরটির আদলেই গড়ে উঠছে আমাদের নতুন সংসদ ভবন, যা ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ভারতের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠতে চলেছে। 

গোলামির মানসিকতা চিরতরে ছিন্ন করে প্রাচীনতম গণতন্ত্রের পারম্পরিক জীবনবোধ এবং আধুনিক জীবনযাত্রার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন আমাদের এই নতুন বীজমণ্ডলীয় গোমুখী সংসদভবন। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সেবাকালের যে দুর্দান্ত architectural footprint রেখে যাচ্ছেন, আমাদের সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে তা আমরা বারেবারে হতে দেখেছি। সেই অজন্তা ইলোরা থেকে নিয়ে চোলারাজারা হয়ে শিবাজী মহারাজ পর্য্যন্ত সবাই contemporary ভারতীয় শিল্পশৈলীর ছাপ রেখে গেছেন তাঁদের কীর্তিতে। 

আক্রমণকারী সাম্রাজ্যবাদীরাও তাদের মতো করে ছাপ রেখে গেছে এদেশীয় স্থাপত্যে। তারপর কয়েকদশক ধরে socialism এর চক্করে পরে ভারতীয়ত্ববিহীন nondescrpit কতগুলো দৃষ্টিকটু বিল্ডিং খাড়া করা হয়েছিল, অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে সে ধারার অবসান হয়েছে। 

আসলে অতীতের প্রতি যদি শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে বর্তমানকে নির্মাণ করা যায়না। এই নতুন সংসদ ভবন কেবলমাত্র ইতিহাস সচেতনতার ফসলই নয়, অতীতের ভুল শোধরানোর একটি উত্তম প্রয়াসও বটে, যেমনটা কাশী বিশ্বনাথ করিডর বা রাম মন্দির করিডোর নির্মাণের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী নির্মিয়মান সংসদ পরিদর্শনে গেছেন, তার কিছু ছবি দেখলাম এবং মধুবনি চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হলাম। ভাগ্যিস এই ভদ্রলোক ক্ষমতায় এসেছিলেন নইলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন বিরাট থামওলা রাজকীয় সিনেট হল ভেঙে তার জায়গায় একটি দৃষ্টিকটু multistoried বিল্ডিং উঠতে দেখতেই তো আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।