আমরা যখন জন্মেছিলাম তখন বিশ্বজুড়ে বামপন্থার খুব রমরমা এবং সারা ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য আমাদের এই রাজ্যের সর্বনাশ করার জন্য একদিকে বামেরা আর অন্যদিকে অতিবাম নকশালরা তাদের নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তথাকথিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য জমি প্রস্তুত করা শুরু করে দিয়েছে। সে হলো কোল্ডওয়ারের যুগ, পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই ভাবধারাকে আশ্রয় করে দুই মহাশক্তির জোটের মধ্যে শীতল যুদ্ধ, যেখানে আমাদের দেশকে কেউ তেমন পাত্তাই দিত না।
একটু জ্ঞান হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বলতে আমরা বুঝতাম খুব উচ্চ কোয়ালিটির কাগজে ছাপা খুবই সস্তার ম্যাগাজিনের রংচঙে হাসিখুশি এক স্বপ্নের মুলুক আর চীন বলতে বুঝতাম প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড, কর্মঠ একটা জাতি যেখানে সবাই কাজ পায়, খাবার পায়, চিকিৎসা পায়, ঘর পায়, সবাই সুখী - আমাদের দেশের মতন অভাগা নয়, অসুখী নয়, আমাদের মতন ভয়ঙ্কর অভাবী, ভয়ঙ্কর গরিব, ঘনঘন লোডশেডিং আক্রান্ত, গুচ্ছের শিক্ষিত বেকারওয়ালা, সতীদাহ-জাতপাত কলঙ্কিত, গুরুবাদ-কবলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাপখেলা-বাঁদরখেলা সর্বস্ব একটা অনুন্নত দেশ নয়।
এদিকে দিদি-জামাইবাবু আমেরিকায় গেল, সেখান থেকে জাপানে, পিকচার পোস্টকার্ডে চিঠি পাঠাতো, দেখে বিস্মিত হতাম। সেও তো স্বর্গ! তারপর দাদারা সব স্কলারশিপ নিয়ে নিয়ে আমেরিকায় পড়তে গেল, গল্প শুনতাম, বিস্মিত হতাম, নিজেদের সাথে মেলাতে পারতাম না। ছোট ছিলাম তো, আমাদের দেশের এই বেহাল দশার অত কার্য কারণ বুঝতাম না, খালি মনে হতো আহা, আমাদের দেশটাও যদি ঐ ছবির দেশগুলোর মতন হতো! সোভিয়েত ইউনিয়নের বইগুলো খুব সস্তায় পাওয়া যেত ফলে ছোটবেলায় যত না আমি ইংলিশ ক্লাসিকাল লিটারেচার পড়েছি তার চেয়ে ঢের বেশি পড়েছি পুশকিন, দোস্তোভয়েসকি, গোর্কি, তলস্তয়, প্রমুখ।
ব্রন্টে বা ডিকেন্স বা অরওয়েল বা মার্ক টোয়েন বা এইচ জি ওয়েলস বা ডুমা ইত্যাদি ইস্কুলের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়েছি, কিনে পড়িনি কোনোদিন কারণ এফর্ড করতে পারতাম না, বাবা ছিলেন না তো। আর পড়েছি বাড়ির আলমারিতে থাকা পোকায় না কাটা বা অল্পকাটা বইগুলো - রবীন্দ্র রচনাবলী, স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী, রামকৃষ্ণ কথামৃত, কিছু পুরাণ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কালকূট, লীলা মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী, এলডাস হাক্সলে, বার্থনার্ড রাসেল, জঁ পল সাত্রে, এলবার্ট কামু, ভল্টেয়ার, কান্ট, কে নয় - বুঝি, না বুঝি অবিচারে পড়ে গেছি।
আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে আমি বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আশাপূর্না দেবী, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি, সুনীল, সমরেশ বসু, বিদ্যা নয়পল, ওরহান পামুখ, গ্যাব্রিয়েল সানচেজ ইত্যাদি অনেকের লেখাই ভালোভাবে পড়েছি অনেক পরে, যবে নিজে রোজগার করে কিনতে পেরেছি। একটা সুবিধা অবশ্য আমার ছিল, আমি যখন যেখানে পড়াশুনা করেছি, ফরচুনেটলি কোথাওই স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক রাজনৈতিক অনাচারটির খপ্পরে আমায় পড়তে হয়নি, ফলে আমি 'দাস ক্যাপিটাল' আর 'লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া' একই উৎসাহের সাথে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, কেউ আমার মাথায় ism-এর হাতুড়ি দিয়ে কখনো আঘাত করেনি।
তাই আমার যে ওয়ালর্ড ভিউ সেটা সংকীর্ণ নয়, তাতে সবাই আছেন এবং সবটাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক। সেই কারণেই তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার তো থেকেই যায়, তাই না? যেদিন সিএনএনের পর্দায় তিয়ানআনমেন স্কয়ারে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিতে দেখলাম সেদিন মনে হলো দেং জিয়াও পেং তো মাওয়ের দুষ্ট চতুষ্টয়ের চেয়ে কিছু আলাদা নন, একইরকমের নৃশংস। এরপর যেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল আর একের পর এক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোয় মানুষ বিদ্রোহ করতে শুরু করলেন, সেদিন বুঝলাম বৈকি যে ঐ চকচকে ভাবটা কেবল ম্যাগাজিনের প্রোপাগান্ডাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আসলে তো আম জনতার ঢুঁ ঢুঁ গোপাল আর চাউসেস্কুর বাথরুমে সোনার কল।
এই ঘটনার অবিলম্বেই যেদিন নিজের রাজ্যে মনের মতন চাকরি না পেয়ে পেটের তাগিদে পৈতৃক বাড়ি, বৃদ্ধা মা, বন্ধুবান্ধব এবং প্রেয়সীকে ছেড়ে চলে যেতে হলো, সেদিন বুঝলাম আমার জন্মের সময়কার ভরা সংসারগুলোকে বামপন্থীরা কিভাবে শ্মশান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তারপর তো সারা পৃথিবী ঘুরেছি, কত কিছু দেখেছি, কত কিছু পড়েছি, কত অভিজ্ঞতা, জীবনকে উভয়ত কাছ থেকে এবং দূর থেকে দেখতে শিখেছি। যেহেতু কোনো রঙিন কাঁচের বালাই ছাড়াই খোলা মন নিয়ে জীবনকে দেখতে পেরেছি আর ভালো মন্দের বিচার করতে পেরেছি, আমি বিশ্বাস করি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা objectivity আছে, যা অনেক indoctrinated মানুষেরই নেই।
এখন সার কথা এই বুঝেছি যে ধর্ম ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানক নেই যার নিরিখে জীবনকে evaluate করা যায়। আমাদের ছেলেবেলায় পা-চাটা আমলা অনেক কমসংখক ছিলেন তো, মন্ত্রী কোনো বেআইনি আদেশ করলে প্রথমে বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করতেন আর নেহাত fail করলে বলতেন, "লিখে দিন"। ওটাই মোক্ষম দাওয়াই ছিল, বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি। ধর্ম হলো সেই কাগজ যাতে লিখতে গেলে কলজে লাগে। Moralityর বাইরে মন যেতে চাইলেই বলতে হয় "লিখে দিন"। Indic religionগুলো ছাড়া অন্যান্য মতবাদের বহু বইও পড়েছি, তাতে অনেক জায়গাতেই দেখেছি যা লেখা আছে তা ধর্মত ঠিক দাঁড়ায় না, শোধরানো দরকার। কিন্তু যেখানে অন্ধ বিশ্বাসের প্রশ্ন, সেখানে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেটা কে? সৌদি আরবের যুবরাজ আশার আলো জ্বালিয়েছেন বটে, কতদূর সফল হন সেটা দেখার।
এতদিন ধরে এতকিছু দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের ছেলেবেলায় যে অনুন্নত ভারত আমরা দেখেছি তা আমাদের ধর্মহীনতার ফল। রাষ্ট্রের জীবনে ধর্ম যদি আবার অর্থ এবং কামকে guide করতে শুরু করে, তাহলে এককালে যেমন ভারত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে বিত্তশালী, সবচেয়ে আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক এবং সাংস্কৃতিকভাবেও সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ছিল, সেই জায়গাটা সে কয়েক দশকের মধ্যেই ফের ফিরে পাবে। হাজারটা মতবাদ থাকতে পারে, হাজার রকমের বিজাতীয় influence থাকতে পারে, কিন্তু এ দেশের প্রাণভোমরা বেদ আর উপনিষদের মধ্যেই বসে আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার অন্যথা হয়নি।
তর্জমা ছাড়া ওগুলো মূল ভাষায় পড়বো বলেই আমি নিজের চেষ্টায় অল্পস্বল্প সংস্কৃত শিখেছি, খানিকটা পড়েছি, এখনো পড়ছি, ভবিষ্যতেও যতদিন চোখে দেখতে পাবো পড়বো। আমি না পড়ে বা না জেনে বা না ভেবে কোনো কথা বলছি না। যা আমাদের ঋষিরা বলে গেছেন, ওগুলোই ধ্রুববাক্য, আমাদের আর বাইরের মানক দরকার নেই। এত প্রাচীন একটা চলমান সভ্যতার অভিজ্ঞতার ফলে এমন কোনো প্রশ্ন নেই যার উত্তর ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতিতে নেই। যাঁরা এর ছোঁয়া পাননি তাঁরা ডক্টরেট হয়েও মহামূর্খ। আর যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা সামান্য অক্ষরজ্ঞানযুক্ত হলেও মহাজ্ঞানী। প্রমান চাই? একবার রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন।