Sunday, February 19, 2023

আনন্দ

অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়। সফলতা এবং অসফলতার মধ্যে যদি কোনো অদৃশ্য রেখা থেকে থাকে, তা হলো পরিমিতিবোধ। নিজের যতটা প্রয়োজন ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকো, অন্যের দেখে নিজের চাহিদা এবং মনের অশান্তি বাড়িও না, আর যাতে মন স্বভাবতই শান্ত থাকে, সবসময় মনে একটা contended ভাব থাকে, overall একটা সুখের আবহে বাঁচতে পারো, সেটা করো - অভিজ্ঞতা আমায় এটাই শিখিয়েছে। 

কেউ ক্ষমতার পেছনে দৌড়োচ্ছে, একটুখানি adulation পেলে আরো বেশি, আরো বেশি, আরো বেশি পাওয়ার জন্য নিজের বিবেক শরীর মন সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে - দূর থেকে দেখো কিন্তু জড়িও না। হ্যাঁও না নাও না, নির্লিপ্ত। Judgemental হওয়ার প্রয়োজন নেই, indifferent হয়ে কেবল observe করো but never become a party to it. 

কেউ নিত্যদিন নতুন নতুন ভোগ্যবস্তু জড় করছে, ভাবছে এতেই বুঝি সুখভোগ হচ্ছে, কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারছে যে তার কেনা latest মডেলটাও পুরানো হয়ে গেছে, একদম নতুন কিছু বেরিয়েছে যাতে আরো বেশি features, অর্থাৎ আরো বেশি সুখ - এবার ওগুলো চাই - চাই চাই চাই করে নিজের মাথা নিজেই খারাপ করছে - দেখো এবং শেখো। কি শিখলে? সেধে পাগল হয়ে কাজ কি, এই তো বেশ আছি - অল্পতে বাঁচি, অল্পতে সুখী। 

আর জীবন কি শিখিয়েছে? মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত, বাকিগুলো হতেও পারে নাও হতে পারে। ভোগ হোক বা না হোক, সুখ পাই বা না পাই, পয়সা থাকুক বা না থাকুক, বুড়ো বয়সে ছেলেমেয়েরা দেখুক বা না দেখুক, দেহের মৃত্যু অনিবার্য - the only constant. ফলে, এই যদি মানক হয়, তাহলে তাকে ঘিরে জীবনের content গড়ে তুললেই তো হয়, যাতে খামোখা মরীচিকার পেছনে দৌড়ে না মরা হয়। 

স্বামী সোমেশ্বরানন্দজি মহারাজ বলতেন ধ্যান করলে মন শান্ত হয় না, মন শান্ত হলে ধ্যান হয়। আর অশান্ত মনে rational thinking সম্ভব না, ফলে আমার জীবনের উদ্দেশ্য যদি মৃত্যুর পারে যাওয়া হয়, নিজের eternal existence এর স্বাদ পাওয়া হয়, তাহলে প্রথমেই মনকে শান্ত করতে হবে আর সেটা করতে গেলে সমস্ত distraction থেকে তাকে সরিয়ে এনে এই উদ্দেশ্যের ওপর focus করতে হবে। একেই সাধন বলে আর undistracted হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে বলে ত্যাগ। নিরাসক্ত হও, অন্তর্মুখী হও, সাধক হও, এদিক ওদিক ছড়িয়ে থেকো না, নিজেকে গুটিয়ে নাও - জীবনে ওঠাপড়ার অভিজ্ঞতা এটাই মানুষকে শেখায়, আমাকেও শিখিয়েছে। 

আমার মনটা এখন দুটো ভিন্ন স্তরে বসবাস করে। একটা ওপরের স্তর যেখানে যে পরিবেশে আমার যাপন, তার ছন্দের সাথে আমার responses aligned আর অন্য একটা স্তর যা অন্তরের, যেখানে কেবল আমি আর আমার অনন্তচেতনা। একটা স্তরে আমার বৃত্তি, প্রবৃত্তি আর বাহ্যিক acceptance ও rejection, অন্য স্তরে মনের কপাট শক্ত করে সাঁটা, বাইরের কোলাহল মুক্ত, সেখানে কেবল একাত্মতা ও আনন্দ। আসল মজাটা হলো এইখানেই - বাইরের অসহনীয় পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব ভেতরে একদমই পড়েনা কিন্তু অন্তর্নিহিত প্রবাহমান তৃপ্তিবোধের প্রভাব বাইরেটাকেও বেশ সহনীয় করে তোলে।

Saturday, February 18, 2023

বরিষা রামকৃষ্ণ মিশন

গতকাল বরিষার শ্রীরামকৃষ্ণ মঠে গিয়েছিলাম মায়ের একখানি ছবি সংগ্রহ করতে। এই প্রথম গেলাম। ছোটছেলে আজ ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। ওখানে ওর ডেস্কের ওপর মা থাকবেন, মায়ের দৃষ্টির বাইরে যেন ও কখনো না যায়। যাইহোক, অধ্যক্ষ মহারাজকে প্রণাম করতেই তিনি পাকড়াও করে অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন, উদ্দেশ্য আলাপ করা। আমি ওনার টেবিলের ওপর মায়ের ছবিটি রেখে বেশ খানিকক্ষণ উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিলাম। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ভক্তরা আসছেন, স্বেচ্ছাসেবকরা আসছেন, কর্মচারীরা আসছেন, অন্যান্য ভিসিটররা আসছেন, ল্যান্ডলাইন এবং মোবাইলে নানান ফোনও আসছে, মহারাজ দক্ষ হাতে সবটাই সামলাচ্ছেন। তারই মাঝে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, "ছেলের সাথে মায়ের পরিচয় আছে?", তারপর দুজনেই হেসে ফেললাম।

ওখানে মঠপ্রাঙ্গণে মিশনের একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে, দেখলাম সেখানকার একজন বৃদ্ধ আবাসিক এসে মহারাজকে ফয়েলটি দিয়ে তাঁর প্রয়োজনীয় ওষুধের কথা বললেন। মহারাজ খুব সহমর্মিতার সাথে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে আনিয়ে দেবেন। কিছুক্ষণ পর একটা ফর্দ নিয়ে একজন স্বেচ্ছাসেবক এলেন, বুঝলাম আবাসিকদের ওষুধের লিস্ট, কিনতে যাবেন, তাই টাকা নিতে এসেছেন। আগেই দেখেছিলাম মহারাজ একটি কাঠের চেয়ারে বসেন আর তার backrest থেকে একটি বহুব্যবহৃত কাপড়ের ঝোলা ঝুলছে, যিনিই প্রণাম করে সাধুসেবার জন্য দক্ষিণা দিতে যান, মহারাজ তাঁকেই আঙ্গুল দিয়ে ওই মুখখোলা ঝোলাটি দেখিয়ে দেন। আমার পাশে আরো দুজন বসেছিলেন, আমরাও সবাই প্রণাম করে ওতেই প্রনামি দিয়েছিলাম। 

যাইহোক, মহারাজ যেই ওই স্বেচ্ছাসেবককে সেই বৃদ্ধের ওষুধটিকে ওনার লিস্টে যোগ করতে বলেছেন অমনি তিনি একেবারে রে রে করে উঠলেন, "আরে ওর ঘরে খুঁজে দেখুন বান্ডিল বান্ডিল ওষুধ পাবেন, উনি নেন আর ভুলে যান"। দেখলাম মহারাজ স্মিত মুখে পেছন ফিরে ঝোলাটা টেনে তুললেন, তারপর টেবিলের কাঁচের ওপর ঝাড়লেন, টং টং শব্দ করে কিছু কয়েন সহ দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ, একশ, দুশ আর একআধটা পাঁচশ টাকার নোট ঝরে পড়লো। দুহাত দিয়ে সব কিছু একসাথে কুড়িয়ে অঞ্জলি ভরে উনি ওই স্বেচ্ছাসেবকের হাতে তুলে দিয়ে গুণে দেখতে বললেন। 

একদিকে ভদ্রলোক টাকা গুনছেন আর অন্যদিকে মহারাজ লিস্ট দেখে ওই বৃদ্ধের ওষুধটি যোগ করে মোট ওষুধের জন্য কত লাগবে তার হিসাব কষছেন, আমরা চুপচাপ বসে বসে দেখছি। এদিকে মহারাজের হিসেব শেষ, ওদিকে টাকা গোনাও শেষ। মহারাজ মুখ তুলে বললেন "মোটামুটি ১৬০০ টাকা মতো লাগবে, কত আছে?" আমরা তিনজনেই পার্সে হাত দিয়েছি, যা কম পরে দিয়ে দেবো - স্বেচ্ছাসেবক বললেন, "কয়েনটয়েন মিলিয়ে exactly ১৬০০ই"। মহারাজ স্মিত হেসে একবার ওনার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর খুব ধীরে ধীরে নিম্নস্বরে বললেন, "-- বাবু, স্বামীজী বলেছিলেন আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ, ওই চ টি ভুলে গেলে কি চলে?" মহারাজের নামটি আমার জিজ্ঞেস করা হয়নি। আবার যাবো, তখন জেনে নেব। বললেন তিন বছর আট মাস হলো উনি বরিষা মঠে এসেছেন, তার আগে সম্ভবত শিশুমঙ্গলে দীর্ঘদিন posted ছিলেন। ইস্কুলের উইনিফর্ম পরলে যেমন বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায়না তেমনি গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীদের চেনাও ভীষণ কঠিন। তবু কেন যেন বড্ড চেনা চেনা লাগলো।

Friday, February 10, 2023

পাকিস্তান

পাকিস্তান

উর্দুতে একটি দারুন শব্দ আছে - ভিরাসত, বাংলায় যার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের সদর্থক সংমিশ্রণ। শব্দটি যতই দারুন হোক না কেন, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু, সেই পাকিস্তানের পক্ষে এই ভিরাসতই আজ এক নিদারুণ বোঝা। নির্বুদ্ধিতার বশবর্তী হয়ে একটি সদর্থক বিষয়কে নেতিবাচক করে ফেললে তা যে নিজেরই বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এর প্রেক্ষাপটটি বুঝতে পারলেই পাকিস্তানের আজকের অস্তিত্বসংকটের পেছনের ইতিহাসও স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমরা বলি এক জাতি, এক প্রাণ, একতা আর পাকিস্তান বলে দিনী এবং কাফের - যার মধ্যে আবার এক ফিরকের দৃষ্টিতে অন্য ফিরকে কাফের, যেমন সুন্নির কাছে আহমেদিয়া বা সিয়া কাফের। কেন যে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল সেটা এঁরা প্রথম দিন থেকেই ভুলে গেছেন, ফলে কেবল মন্দির বা গুরুদ্বয়ারা বা চার্চই নয়, এঁরা একেঅপরের মসজিদও ভেঙে দেন বা বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। পাকিস্তান যখন তৈরি হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল যে হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলমান সুরক্ষিত নয়। পঁচাত্তর বছর পর আজ প্রমান হয়ে গেছে যে একমাত্র ভারতেই মুসলমান সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত এবং পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত, এমনই বিধির বিধান। আসলে পাকিস্তান কোনোদিন তৈরিই হয়নি, পাকিস্তানের নামে কেবল এক প্রহসন দাঁড়িয়ে আছে।

৭১১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আগ্রাসনের আগের ভারত আর তারপর থেকে ওই সন্ত্রাসী, বিপন্থবিদ্বেষী ও লুঠমারের মানসিকতাসম্পন্ন বর্বর দস্যুদের দ্বারা লুন্ঠিত, নির্যাতিত, ধর্ষিত ভারতের যাপন এক নয়, হতেও পারেনা। প্রাচীন ভারতের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, মধ্যযুগীয় ভারতের যে সমৃদ্ধি, বস্তুত অষ্টম শতাব্দী পর্য্যন্ত যে জয়যাত্রা, যে বিশ্বজনীনতা, যে সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং যে নৈতিক, ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চতা, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তার জুড়ি মেলা ভার। আরবের প্রথম আক্রমণে এবং পরবর্তীতে লাগাতার মরুদস্যুদের হামলার সময় এই সহিষ্ণু উচ্চমেধাসম্পন্ন, ন্যায়নিষ্ঠ সভ্যতাকে এমন বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা হজম করার সাহস সকলের ছিলনা। ফলে ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, ভুল বুঝে হোক, লোভে হোক, রাগে হোক অথবা নিছক ক্ষমতালিপ্সার স্রোতে ভেসে গিয়ে হোক, একশ্রেণীর ভারতীয় ওই বিজাতীয় অনাদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের ঐতিহ্য, ইতিহাস, উত্তরাধিকার এবং সভ্যতার সংস্কারকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই হলো মূল দ্বিজাতীয় তত্ব - এক দেশ কিন্তু দুই বিপরীতধর্মী ভাবধারা।

এই যে যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন - কেউ সুন্নি হয়েছিলেন, কেউ সিয়া হয়েছিলেন, কেউ আহমেদিয়া হয়েছিলেন, কেউ সুফি হয়েছিলেন ইত্যাদি, এঁরা প্রায় কেউই বিদেশ থেকে আসেননি, সবাই এদেশীয়, নিদেনপক্ষে তাঁদের জননী তো এদেশীয় বটেই এবং সবাই আগে কোনো না কোনো ভারতীয় পূজাপদ্ধতি বা মতবাদ মানতেন। পরে তাঁদের মধ্যে যিনি যাঁর প্রভাবে বা মাধ্যমে পন্থ পরিবর্তন করলেন, তিনি সেই ভাবধারার অনুগামী হয়ে গেলেন - আপাতদৃষ্টিতে মাত্র এটুকুই। এখানেই যদি ব্যাপারটা শেষ হয়ে যেত তাহলে ভারতভাগ হতো না। সমস্যা সৃষ্টি হলো মূল ভারতীয় ধর্মআধারিত জীবনদর্শনের সাথে আমদানিকৃত সংকীর্ণ জীবনবোধের সংঘাতের কারণে, ফলত সমাজ দুটুকরো হয়ে গেল।

আমাদের পড়শী সভ্যতা পারস্যের বাসিন্দারা ভারতকে হিন্দুস্থান নামে ডাকতো, যা ওঁদের ভৌগোলিক জ্ঞান অনুযায়ী শতদ্রু নদী বা শতলুজ থেকে নিয়ে বারাণসী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর সেই দেখাদেখি আরবরা আমাদের দেশের নাম দিয়েছিল আল হিন্দ, যেখান থেকে এই দেশের বাসিন্দাদের হিন্দু আর আমাদের সভ্যতাকে হিন্দু সভ্যতা বলার প্রচলন হয়েছিল। বিন্দপর্বত পেরিয়ে দক্ষিণাত্যের খবর আরবদের কাছে বহুদিন পর্য্যন্ত ছিলনা, ওদিকের কথা ওরা অনেক পরে জানতে পারে এবং তারপর থেকে সমুদ্রপথে মালাবারের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে কথিত আছে যে চেরা রাজাকে প্রভাবিত করে মক্কায় নিয়ে গিয়ে নবীর অনুসারী বানিয়ে, তাঁর দক্ষিণ্যে থিসুরে প্রথম ভারতীয় মসজিদ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু সে এক অন্য ইতিহাস।

যাইহোক, যেমন যেমন ভারতে ইসলামী শাসন কায়েম হতে লাগলো, তেমন তেমন সমাজে মুসলমানদের গুরুত্ব বাড়তে থাকল এবং তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন একধরনের মেকি প্রভুত্বস্বত্তা বিকশিত হতে শুরু করলো, অন্যদিকে নিজেদের ঐতিহ্য বা ভিরাসতকে অস্বীকার করার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাও তীব্রভাবে দেখা দিলো। অনেকেই মনে করেন ১৯০৮ সালে লন্ডনে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানের অবধারণার জন্ম স্যার সৈয়দ আমির আলীর হাত ধরে হয়েছিল। ভুল ধারণা। যেদিন একশ্রেণীর ভারতীয় ভারতের অন্তরাত্মাকে অস্বীকার করলেন, নিজেদের বাপ-ঠাকুর্দার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করলেন এবং সর্বোপরি সমাজের যে চুত্যিরেখা, সেটা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করে দিলেন, সেইদিনই তাত্ত্বিকরূপে পাকিস্তান তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কয়েক শতাব্দী পরে ইংরেজের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি কৃত্তিম দেশরূপে যা বিশ্বের মানচিত্রে গজিয়ে উঠেছিল মাত্র।

যে কারণে এতগুলো কথা বলার প্রয়োজন পড়লো তা হলো আজ যে পাকিস্তানের চরম দৈন্যদশা, মানুষ খেতে পাচ্ছেন না, চতুর্দিকে হানাহানি, রক্তারক্তি সংঘর্ষ, জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, রান্নার গ্যাস নেই, ইন্ধন নেই, যেটুকু টাকা আছে তার প্রায় পুরোটাই ফৌজ কেড়ে নিচ্ছে আর গোটা দেশজুড়ে অনগ্রসরতা এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রদেশে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে - এই সবকিছুর জন্য দ্বিজাতিতত্বই দায়ী। এককালে যে তুর্কিরা ইউরোপে পর্য্যন্ত নিজেদের ইসলামী ক্যালিফেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজকের দিনেও কিন্তু তাদের রাষ্ট্রপতির নাম রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান, কোনো মিয়া মহম্মদ আসলাম শেখ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইসলামী দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির নাম জোকো উইদোদো, কোনো শোয়েব মহম্মদ আখতার নয়। এগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যে বহু দেশ নিজেদের পূজাপদ্ধতির পরিবর্তন করেছে বৈকি, কিন্তু নিজেদের ভিরাসত বা মূল স্বত্তা বিসর্জন দেয়নি, পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিটি ঠিক ধরে রেখেছে। কিন্তু এদের চেয়ে বহুকদম এগিয়ে পাকিস্তানিরা নিজেদের মাতৃভাষাগুলিকে পর্য্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছেন, ওঁদের অনুকরণের স্পৃহা এমনই জোরদার।

এই যে আমি যা নই তা হয়ে ওঠার নিরলস প্রয়াস, যে মায়ের জঠর থেকে আমার জন্ম, সেই মাতৃত্বের ঋণকেই অস্বীকার করা এবং নিজের জাতি, নিজের আত্মীয়, নিজের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করার উপায় হিসেবে স্বজাতিকেই ঘৃণা করতে শেখা - মানে যে যে কাজ এতদিন ধরে পাকিস্তান করে এসেছে, তাতে ওঁদের নিজস্বতা নষ্ট হয়েছে তো বটেই, মানুষের পক্ষে হিতকারী কোনো বিশেষ উদ্ভাবন বা কোনো বিশেষীকরণ বা কোনো বিশেষ দক্ষতার জন্য একটি দেশের যে বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা জন্মায়, তার অভাবে সারা বিশ্বের কাছে ওই দেশটার প্রাসঙ্গিকতাও আজ হারিয়ে গেছে। আসলে পাকিস্তান চিরকাল অর্থের বিনিময়ে বিশ্বশক্তি বা কিছু বড়লোক ইসলামী মুলুকের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ করে এসেছে। আজ যুদ্ধ শেষ, সৈনিকের প্রয়োজনীয়তাও শেষ।

মজার ব্যাপার হলো যে আরবদের আদর্শ করে পাকিস্তান নিজের খোলনলচে বদলে ফেলার চেষ্টায় পঁচাত্তর বছর নষ্ট করলো, সেই আরবরাই এখন আমূল বদলে যাচ্ছেন। সাহেবরা আরবদের দেশে তেল খুঁজে দেওয়ার পর থেকে কিছুদিন আগে পর্য্যন্ত দেদার কাঁচা পয়সার গরমে ইসলামের রক্ষাকর্তা হয়ে যে আরবি শাসকশ্রেণী ভারতীয় উপমহাদেশ সহ আফ্রিকা এবং বিশ্বজুড়ে পন্থপরিবর্তন এবং শরীয়ার শাসন কায়েম করার জন্য কোটি কোটি ডলার ছড়াতো, তারাই এখন তালিবানিদের সাহায্য করতে অস্বীকার করছে আর কারণ দেখাচ্ছে gender justice! ওদিকে আরবদের বাতিল করে দেওয়া ভূতের লেজ ধরে পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলো কিন্তু সেই আগের মতোই তেহরিক এ তালিবান এ পাকিস্তান, তেহরিক এ লাব্বাইক, হিজবুল মুজাহিদ্দীন, লস্কর এ তোয়াবা, গৌরি, গজনবী, গাজওয়া এ হিন্দের প্রতি প্রীতি আর ইহুদি ও হিন্দুর প্রতি দ্বেষ পুরোদমে প্রসব করে চলেছে, যার কোনো ভবিষ্যৎ তো নেইই, উল্টে ওরাই এখন পাকিস্তানকে চোদ্দ'শ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে সত্যিকারের পাক-ঈ-স্তান বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ভারতের মাটিতে এখনো এক মূলতঃ রাজনীতিপ্রসূত শীর্ণকায় বৌদ্ধিক পাকিস্তান বিচরণ করে, যদিও তার বলয় ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। যত উন্নয়নের ধারা প্রসারিত হচ্ছে, যত মানুষ বুঝতে পারছেন যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈষম্য, ভেদাভেদ ইত্যাদির তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং সরকারি প্রকল্পগুলিতেও তার ছাপ সুস্পষ্ট, তত ভয় এবং অবিশ্বাসের মাত্রা কমছে আর মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়ে ওঠার প্ৰচেষ্টাও শুরু হয়েছে, বিশেষত সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে। যত দিন যাবে আর যত বেশি করে সহজলভ্য প্রযুক্তির দৌলতে দুনিয়ার হালহাকিকৎ মুঠোবন্ধি হবে, তত এই মূলধারার সাথে সম্পৃক্ততা বাড়বে এবং পাকিস্তান তত বেশি হারবে। পাকিস্তান কোনো দেশ নয়, পাকিস্তান একটি ধারণা, একটি কল্পনা যার সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্কই নেই। ইংরেজ পাকিস্তান নামক যে কৃত্তিম দেশ তৈরি করেছিল, সেটি ইতিমধ্যেই দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। এবার একবার ভারতকে শেষ মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করার পর পাকিস্তান খন্ড খন্ড হয়ে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য কারণ স্বজাতিবিদ্বেষ ছাড়া তার আর কোনো স্বতন্ত্র ভিত্তি নেই। ওটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো কত দ্রুত সভ্যতার সংকট কাটিয়ে উঠে ঘৃণাকে আমাদের জাতির জীবন থেকে নির্বাসিত করা যায়, যাতে প্রত্যেক ভারতবাসী আবার ভিরাসত সূত্রে পাওয়া প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে প্রকৃত অর্থে উদার, সংবেদনশীল, সর্বসমাবেশী, সমরসতাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় চেতনাসম্পন্ন হিন্দু হয়ে উঠতে পারেন।

Tuesday, February 7, 2023

ব্যারিস্টার গান্ধী

আমি অযথা বিতর্কের মধ্যে ঢুকতে চাইনা কিন্তু কেউ যখন কিছুই না জেনে জ্ঞান দিতে আসে, তখন সত্যিটা তুলে ধরা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ সরকারি বাবুরাই এঁড়ে তর্ক করেন, বিশেষত বামমনষ্ক আর্মচেয়ার বিপ্লবী হলে তো কথাই নেই। এঁরা এত baggageধারী এবং opinionated হন না, মাঝেমাঝে মনে হয় আমাদের ট্যাক্সের পয়সা নষ্ট করে এঁদের মধ্যে এঁড়েগুলোর পেছনে মাইনে না উড়িয়ে সরকার যদি সিঙ্গাপুরের মতন কেবল open-minded professionalদেরই সরকারি চাকরিতে বহাল করতেন, রাজ্যটা বোধহয় অনেক দ্রুতগতিতে এগোতো। আমি চিরকালই elite civil service এর ঘোর বিরোধী এবং আমি মনে করি কেবল মুখস্ত করার ক্ষমতা থাকলেই কেউ বিরাট বুদ্ধিমান হয়ে যান না। 

যাইহোক, আমি লিখেছিলাম যে জিন্না আর গান্ধী একই পদ্ধতিতে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, তাতে এমনই এক বিপ্লবী বাবুর খুব গোঁসা হয়েছে - আমি নাকি জিন্না আর গান্ধীকে এক আসনে বসিয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। তারপরেই সেই বাঁধা গৎ - চাড্ডি, ভক্ত, অশিক্ষিত, uncultured ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা কি মুস্কিল বলুন তো! জিন্না আর গান্ধী দুজনেই Victorian eraর ব্যারিস্টার, যখন ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি থাক বা না থাক, Bar এর একটা এলেবেলে পরীক্ষায় পাস করে আর কোনো practicing ব্যারিস্টারের এপরেন্টিসশিপ করে তাঁর সুপারিশ জোগাড় করতে পারলেই কেল্লা ফতে হয়ে যেত - এবং এই পদ্ধতি follow করেই তো দুজনে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, তাতে আমার বা আপনার কি করার থাকতে পারে? 

সে আমলে ব্যারিস্টার হতে গেলে দুরকম approach ছিল। প্রথমটা হলো আইনের serious ছাত্রদের জন্য - কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের LL.B (Hons) কোর্স পাশ করে (যা পন্ডিত নেহেরু এবং সর্দার প্যাটেল করেছিলেন) তারপর কোনো একটি Inns of Court join করা। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে পড়ার পূর্বশর্ত ছিল কলেজের ডিগ্রি, যা কলেজ dropout গান্ধী আর school dropout জিন্না, কারোরই ছিল না। দ্বিতীয় উপায় ছিল সরাসরি চারটের মধ্যে যে কোনো একটি Inns of Court join করা, যার পর তাঁদের দুবছর P.C.LL নামক একটা course করতে হতো ও ওই Barএর এলেবেলে পরীক্ষাটা পাস করতে হতো এবং তারপর কোনো practicing ব্যারিস্টারের কাছে অন্তত একবছর apprenticeship এবং প্রচুর buttering করতে হতো। 

আচ্ছা, এই Inns of Court কি লন্ডন বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়? না। যেমন আমাদের CA ইনস্টিটিউট আছে, তাদের পরীক্ষা পাস করলে যেমন আমরা তার মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি, তেমনি Inner Temple, যা চারটি Inns of Court এর umbrella body, সেটা জজ এবং ব্যারিস্টারদের একটি association - ব্যারিস্টার হিসেবে approved হলে তার সদস্য হয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে প্র্যাক্টিস করা যায় - একে বলে called to the bar। জিন্না এবং গান্ধী দুজনেই এই পন্থা অবলম্বন করে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। 

আরো একটা কথা। গান্ধীর এক বিদেশি online biographer বলেছেন যে গান্ধী University College of London থেকে তিন বছরের ল ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন অথচ mkgandhi.org বলছে, 'Mahatma Gandhi sailed for England on 4th September, 1888 to study law and become a barrister. He kept terms at the Inner Temple and after nine months' intensive study he took all his subjects in one examination which he passed. He was called to the Bar on 10th June, 1891 and was enrolled in the High Court of England the next day. A day later, he sailed home. After his return to India he started practice as a lawyer at first in the High Court at Bombay and a little later in Rajkot but did not make much headway in the profession' - তাহলে কোনটা ঠিক? 

তার থেকেও বড় কথা, Encyclopedia Britannica অনুযায়ী নিজের দেশে বম্বে উনিভার্সিটি থেকে কোনোমতে টেনেটুনে matriculation পাস করা গান্ধী ইংল্যান্ডে গিয়ে 'took his studies seriously and tried to brush up on his English and Latin by taking the University of London matriculation examination.' তাহলে, উনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ডিগ্রির ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো কি? ম্যাট্রিক - সেই যে সুকুমার রায়ের 'উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে' - সেই ম্যাট্রিক। হ্যাঁ, সে আমলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানেই হতো। বাকি, সমস্ত প্রমান নিচের স্ক্রিনশটগুলিতে পেয়ে যাবেন। মনে রাখবেন জিন্না এবং গান্ধী, দুজনেই কিন্তু মাত্র তিনবছরে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, ফলে তাঁদের পক্ষে ইউনিভার্সিটির তিন বছরের ফুলটাইম ল ডিগ্রি এবং তারপর দুবছরের Inn, তারপর ন্যূনতম একবছরের Pupillage - মোট ছয় বছরের ধাক্কা খাওয়া সম্ভবই নয় - এবং সেটা যে তাঁরা করেননি, তা বলাই বাহুল্য।

Sunday, February 5, 2023

অখন্ড ভারত

সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব লিখেছিলেন, 'আলেকজান্ডারের গ্রিক সৈন্যরা যখন সেখানে (জালালাবাদে) থাকার ফলে বৌদ্ধ হয়ে গেল তখন তারাই সর্বপ্রথম গ্রিক দেবদেবীর অনুকরণে বুদ্ধের মূর্তি করে তার পুজো করতে লাগলো। ভারতবর্ষের আর সর্বত্র তখনও বুদ্ধের মূর্তি গড়া করা মানা, এমনকি বুদ্ধকে অলৌকিক শক্তির আধার রূপে ধারণা করে তাকে আল্লাহর আসনে বসানো বৌদ্ধদের কল্পনার বাইরে। সেই গ্রিক বুদ্ধমূর্তি হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়বার পর, পরবর্তী যুগে সেই আর্টের নাম হলো গান্ধার আর্ট।'

এই জালালাবাদেই সমাহিত আছেন বাদশা খান, যাঁকে একসময় ফ্রন্টিয়ার গান্ধীও বলা হতো এবং দেশভাগের সময় কংগ্রেসের একাংশের তীব্র ক্ষমতালিপ্সার শিকার হয়ে আসল গান্ধীজিকে যিনি ভগ্নহৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেছিলেন যে তাঁদের নেকড়ের মুখে ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হলো। সেই সময় ডুরান্ড লাইন বরাবর যে জায়গাটিকে North West Frontier Province বলা হতো, যেখানে বিভিন্ন 'কাবিলা' অর্থাৎ tribalদের বাস, তাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে সত্যি সত্যিই ওই সরল মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। 

মজার ব্যাপার হলো, যে ব্যারিস্টার জিন্না আদতে ক্লাস ৯ পাশ, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জীবনে একটা letter to the editorও লেখেননি, তিনি হটাৎ করে পাকিস্তানের জনক হয়ে গেলেন এবং যে বাদশা খান দেশকে স্বাধীন করানোর জন্য ইংরেজদের সাথে সারাজীবন লড়ে গেলেন, তাঁকে সেই জিন্নাই 'গদ্দার' দেগে দিয়ে পাকিস্তানি জেলে পুড়ে দিলেন! সে আমলে যেহেতু কোনো নামকরা এটর্নি ফার্ম বা ব্যারিস্টারের এপ্রেন্টিসশিপ করে একসময় তাঁদের সুপারিশ পেলেই 'called to the Bar' হয়ে যেত, তাই সমসাময়িক জিন্না গান্ধী সবাই ঐভাবেই ব্যারিস্টার হয়েছিলেন।

বাদশা খান কোনোদিন পাকিস্তান মেনে নিতে পারেননি কারণ তিনি জানতেন যে এত সহজে এক প্রাচীন চলমান সভ্যতাকে অস্বীকার করে একটা মেকি identity assume করে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি চাননি তাঁর দেহ পাকিস্তানে সমাহিত হোক, সেই জন্যই মৃত্যুর পর তাঁকে আফগানিস্তানের জালালাবাদে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া হয়। কেন জালালাবাদ বা পূর্বের আদিনাপুর, যা গাজনীরা এসে তছনছ করে দিয়েছিল? 

কারণ অখন্ড ভারতের প্রতীক যদি কোনো একটি জনবসতি থেকে থাকে তা হলো হিন্দুকুশ পর্বতের প্রান্তে কাবুল আর কুনার নদীর সংযোগস্থলে স্থিত এই মালভূমি, যা কুশান সাম্রাজ্যের সময় বৌদ্ধ আহনপোষ স্তুপের জন্য বিশ্ববিখ্যাত ছিল এবং যেখানে চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু জুয়ান ঝ্যাং এসেছিলেন। এই জালালাবাদ হয়েই পশ্চিমদিকে রাস্তা চলে গেছে এককালে হিন্দুশাহীর শাসনে থাকা কাবুলের দিকে আর পূর্বদিকে তোরখাম আর খাইবার পাস হয়ে রাস্তা চলে গেছে এখনকার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারের দিকে। 

অনেকে অখন্ড ভারত বলতে বোঝেন এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন অনেকগুলো দেশকে মিলিয়ে একটা কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন যুক্তরাষ্ট্র - আদপেই তা কিন্তু নয়। ভৌগোলিক সাম্রাজ্য বিস্তার এক জনিস আর সাংস্কৃতিক commonwealth বিস্তার অন্য জিনিস, যার সঙ্গে political map বা governance এর কোনো সম্পর্কই নেই। অখন্ড ভারত হলো একটা cultural construct, যেখানে ভারতের বসুধৈব কুটুম্বকম্ নানাধরনের পন্থজনিত বা জাতিজনিত fake supremacyর ধারণাকে খণ্ডন করে দেবে।

অখন্ড ভারত গড়ে তুলতে এখন আর hard powerএর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা হয়তো থাকবে না কিন্তু যেমন যেমন rationality বাড়বে তেমন তেমন ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে আর তেমন তেমন আমাদের soft powerও বাড়বে, অর্থাৎ আমাদের প্রাচীন সভ্যতার প্রভাব ভৌগোলিকভাবে আবার বিশ্বজুড়ে নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে, যেমনটা মধ্যযুগে হয়েছিল। এই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে - পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেলগুলি দেখলে আকছার শোনা যায় শিক্ষিত পাকিস্তানি যুবশক্তি নিজেদের প্রশ্ন করছেন যে পাকিস্তান তৈরি করা কি আদৌ প্রয়োজন ছিল, এবং যদি ছিলই তাহলে তার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি কি ছিল?

পরিস্থিতির চাপে পড়ে যে মুহূর্তে প্রতিবেশীরা 'আমরা কি ছিলাম, কি হয়েছি আর কি হতে পারি' - এই বিচার করতে বসবেন, অমনি তাঁরা ইতিহাসাশ্রয়ী হবেন, নিজেদের পূর্বপুরুষের অতুল কীর্তিকে নতুন করে বোঝবার চেষ্টা করবেন এবং সেই প্রাচীন সংস্কৃতিকে এখনো যাঁরা আগলে রেখেছেন, তাঁদের সুখবর্ধক বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নিজেদের দুঃখজনক বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করতে শুরু করবেন। একটু তলিয়ে ভাবলেই তাঁরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন কি কারণে ওঁদের এই দুর্দশা। ওঁরা নিজেদের অসন্তোষকে কি করে সন্তোষে পরিবর্তিত করা যায় তার রাস্তা তখন কাদের কাছে খুঁজতে যাবেন? 

পারস্যে এই প্রশ্নটি ইদানিং বেশ জোরদারভাবেই উঠতে শুরু করেছে কারণ ওঁদেরও এক প্রাচীন সভ্যতা ছিল, যাকে এতদিন artificially দাবিয়ে রাখা হয়েছিল, মানুষ বিদ্রোহ করছেন। আমাদের মহাদেশেও এটাই হবে, দুদিন আগে আর দুদিন পরে। জনগণের চাপে পড়ে ওইসব দেশের সরকার তখন বৈরিতা ছেড়ে ভারতের দিকে সহযোগিতা এবং সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে বাধ্য হবেন এবং সেটাই হবে আবার নতুন করে সাংস্কৃতিক হিন্দু রাষ্ট্রগঠনের সঠিক সময়। অখন্ড ভারত অবশ্যম্ভাবী। আমরা নিজেরা নিজেদের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলে কত দ্রুত তার পথ প্রশস্ত করতে পারি, সেটাই কেবল দেখার।

পারভেজ

লোকটা মুহাজির ছিল। ওর বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষ দিল্লির বাসিন্দা তো ছিলেনই, নিজেও এমন দুর্ভাগা, যে কয়েকবছর পর পাকিস্তানে না জন্মে নিজেও স্বাধীনতার আগেই দিল্লির চাঁদনী চকে জন্মেছিল। তারপর মাত্র চার বছর বয়সে পরিবারের সাথে স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে চলে তো গেল কিন্তু পরবর্তীকালে দেশের সেনাপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতিত্বের আড়ালে ডিক্টেটর হওয়া স্বত্তেও, মারা যাওয়ার পর সেই দেশের রাজধানীতে কয়েকহাত মাটিও কপালে জুটলো না তার - কারণ লোকটা মুহাজির ছিল। 

অথচ এই লোকটা নিজেকে ভূমিপুত্রদের চেয়েও বেশি দেশভক্ত পাকিস্তানি প্রমান করার তাগিদে কত কিই না করেছে! নিজের দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যখন পড়শীদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে পাকিস্তানে বসে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে খোশগল্প করছেন, তখন এই লোকটা ফৌজকে আদেশ দিচ্ছে চুপিচুপি কার্গিলের পাহাড়ে চড়, যদি এই ফাঁকে, যখন বাস ডিপ্লোমাসির আবহে কেউ ফৌজি আক্রমণ মোটেও আশা করবে না, তখন কাশ্মীরে ভারতীয় ফৌজকে যদি একটু পিছিয়ে দেওয়া যায়! 

অন্যভাবেও নিজের জন্মভূমির চরম ক্ষতি করার কম চেষ্টা করেনি লোকটা, যাতে পাকিস্তানিরা একটু খুশি হয়। এই মুহাজির একসময় বালোচ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কচুকাটা করিয়েছে, পাশতুন এবং অন্যান্য ট্রাইবালদের প্লেন থেকে বম্বিং করে মারিয়েছে, সিন্ধুদেশের কত শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুমখুন করিয়েছে আর গোরাদের কাছে টেরোরিস্ট বলে তাদের লাশ পেশ করে পুরস্কার হিসেবে কন্টেনার ভরে ভরে ডলার নিয়ে এসে পাকিস্তানি পাঞ্জাবীদের খাইয়ে পরিয়ে মোটা হাতি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। একটা সময় লোকটা আমেরিকাকে চমকাতো, আমেরিকা হুমকি দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারতো না - আখেরে সেই টাকার বস্তা, অস্ত্র, নানারকমের সুবিধা ইত্যাদি ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তবে রেহাই পেত। 

এই লুটের বেশিরভাগটাই ফৌজের জন্য বরাদ্দ ছিল, বাকিটা পাঞ্জাবের জন্য। আজ সেই ফৌজ, সেই পাঞ্জাবীদের ফৌজ, লোকটাকে একটা শেষ সালাম পর্য্যন্ত ঠুকতে রাজি নয় - কারণ লোকটা মুহাজির ছিল। এটাই যদি আগে বুঝতেন কত্তা, আজ দুবাইয়ে মরতেও হতো না, করাচীতে কবরে যেতেও হতো না। নিজের মাটি নিজেরই মাটি হয়, বাকিদের কাছে ওই মুহাজির হয়েই থেকে যেতে হয় চিরকাল। লোকটার ধক ছিল, একথা মানতেই হবে। নিজের মাটিতে থাকলে বটবৃক্ষ হয়ে উঠতে পারতো, দুর্ভাগ্য যে ওদের পাল্লায় পড়ে বিষবৃক্ষ হয়ে রয়ে গেল।

লাটু মহারাজ

আজ মাঘী পূর্ণিমা। আজ পরম পূজনীয় লাটু মহারাজের জন্মতিথি বলে ধরে নেওয়া হয়। আমার জন্ম যদি আরো পঞ্চাশ বছর আগে হতো এবং ঠাকুরের পার্ষদদের মধ্যে কেবল একজনেরই পায়ে মাথা ঠেকানোর যদি অনুমতি পেতাম, আমি লাটু মহারাজের পাদুটোকেই চেপে ধরতাম। লাটু মহারাজের কোনো formal education ছিল না, উনি নিরক্ষরও ছিলেন, ফলে ওঁর যে শিক্ষা, ওঁর বোধ, ওঁর আধ্যাত্মিক চেতনা এবং ওঁর ব্যক্তিত্ব শুধুই রামকৃষ্ণময়, সেখানে বাইরের বিন্দুমাত্র কোনো influence নেই। ঠাকুরের সমস্ত পার্ষদদের কথাই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, প্রত্যেকেই এক একটি institution বিশেষ, এক একজন বিরলতম সিদ্ধপুরুষ, ব্রহ্মজ্ঞ, ঠাকুরের personalityর এক একটি দিকের প্রতিচ্ছবি যেন। কিন্তু ওঁদের সবার রামকৃষ্ণময়তার আড়ালে একজন স্বাধীন চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিও লুকিয়ে আছেন, লাটু মহারাজের মধ্যে কেবল গুরু ছাড়া আর কিছুমাত্র নেই। আমি যখন লাটুমহারাজের স্মৃতিকথা পড়ি তখন আমার মনে হয় আমি যেন সাক্ষাৎ ঠাকুরের শ্রীমুখের কথা শুনছি, মাঝখানে কোনো কান্ট নেই, কোনো হেগেল নেই, কোনো রুশো নেই, কোনো ব্রাহ্মসমাজ নেই - কিচ্ছু নেই। কেবল একজন ঈশ্বর আছেন আর একজন পরমভক্ত আছেন এবং ওঁদের মধ্যে সনাতনী অধ্যাত্মযোগটি যেন পবিত্র হোমাগ্নির মতন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আমার কাছে লাটু মহারাজ ঠাকুরের অদ্ভুত সুন্দর একটি construct, ফলে স্বামীজীর দেওয়া ওঁর অদ্ভুতানন্দ নামটি আমার কাছে wonder অর্থে নয়, unparalled অর্থে প্রতিভাত হয়। আমার কাছে বিশেষ খেদের বিষয় এই যে ঠাকুরের এই হুবহু প্রতিচ্ছবিকে চাক্ষুস দর্শন করার এবং তাঁর শ্রীচরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার সৌভাগ্য আমার জোটেনি, আগের শরীরে জুটে থাকলেও আমার মনে নেই। তবে লাটু মহারাজের কথা আমি মনেমনে খুব চিন্তা করি, ওনার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে। ওই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গোঁফ, ওই ছোট ছোট চুল, ওই বসার ধরণ, ওই তাপসের নিরাসক্ত মুখমন্ডল - একেবারে যেন শ্রীগুরুমহারাজজীর ছায়ারূপ! মুখের কথাও তাই - কেবলই গুরুবাক্য। ঠাকুরই ওঁকে জগজ্জননী জগন্মাতার নহবতের সংসারে ফাইফরমাস খাটতে পাঠিয়েছিলেন, তাই মায়ের কাছে ওঁর ছিল অবারিতদ্বার। ওঁর সাথে মা যতটা সহজ আচরণ করতেন, ততটা খুব কম পার্ষদদের সাথেই ছিল। আজ ওঁর পুণ্য জন্মতিথি উপলক্ষে পরম পূজনীয় মহারাজের শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম জানাই এবং মহারাজের কাছে প্রার্থনা করি যেন ওঁর আশীর্বাদের হাত উনি আমাদের মাথার ওপর রাখেন আর সেই জোরে আমরা যেন মায়ের শরণাগত হতে পারি।
জয় শ্রীগুরু মহারাজের জয়
জয় মহামাঈর জয়
জয় স্বামীজী মহারাজের জয়
জয় স্বামী অদ্ভুতানন্দজী মহারাজের জয়

Friday, February 3, 2023

অহঙ্কার

আমি আর গিন্নি রোজই সকালে উঠে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিমি পথ হাঁটতে বেরোই এবং চেষ্টায় থাকি রোজই বাড়ির কাছাকাছি কোনো না কোনো unexplored অঞ্চলে, কোনো নতুন রাস্তা দিয়ে বা অজানা পাড়ায় ঢুকে নতুন নতুন স্বাদ গন্ধ বর্ণ দৃশ্য শুষে নিতে নিতে হাঁটতে, যাতে হাঁটাটা routine বোরিং না হয়ে যায় আরকি। এবং বলা যেতে পারে যে আমরা এই ব্যাপারে এখন বেশ সিদ্ধহস্তই হয়ে উঠেছি। ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারছি যে বেহালার গলিঘুঁজি, মেজ সেজ ছোট রাস্তার একটা বিশেষত্ব আছে - আঁকে বাঁকে ছোট বড় কত না মন্দির - মানুষের আস্থার জায়গা, এবং দেখলেই বোঝা যায় যে সর্বত্রই নিত্যপূজা হয়। পাড়ায় পাড়ায় এত মন্দির, এত ভক্ত অথচ নিজের true identity নিয়ে হিন্দু বাঙালি দ্বিধাগ্রস্থ - সত্যিই অদ্ভুত জাত একটা!

যাইহোক, এই হাঁটার দৌলতে কতরকমের যে শিবমূর্তির পুণ্যদর্শন হচ্ছে, মা কালীর কতরকমের রূপ, কত বৈচিত্র্যময় রাধামাধব আর কত অন্যান্য দেবমূর্তির দর্শনলাভ হয়, সে আর বলার কথা নয়। আমরা সাধারণত মন্দিরের সামনে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে প্রণাম করি, তারপর আবার হাঁটতে থাকি। আজ একজায়গায় এমনই একটি মন্দির দেখলাম, রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়ার ফলে একটি নিচু তোরণ, ভেতরে একটুখানি নিচু খালি জমি, তারপর বনেদিবাড়ির নাটমন্দিরের শৈলীতে তৈরি সুন্দর বাঁধানো মন্দির। এটিকে কয়েকবার  আগেও রাস্তা থেকে দেখেছি কিন্তু তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি। আজ কি মনে হলো, দাঁড়ালাম, তারপর ঢুকলাম। 

প্রথমে কয়েকধাপ লাল সিমেন্টের সিঁড়ি, তারপর লাল সিমেন্টের চাতাল, তারপর সাদা কালো পাথরের চকমেলানো গর্ভগৃহে হলদে চাঁদোয়ার তলায় কাঠের আসনে অপূর্ব সুন্দর শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমতি রাধারানী, তার নিচে শ্বেতপাথরের ধাপে ধাপে মা কালী সহ নানা দেবদেবীর পট, আর সবচেয়ে নিচে শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরজির একটি ছবি। গর্ভগৃহের দুপাশে দুটি ঘর। বাঁ দিকের ঘরে একটি চৌকির কোন দেখা যাচ্ছে, আড়াআড়ি পেছনদিকে একটা খোলা দরজা আর ডানদিকের ঘরটি প্রয়োন্ধকার। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে জুতো খুলতে খুলতেই দেখেছিলাম যে গ্রিল দিয়ে ঘেরা চাতালে, ওই ডানদিকের ঘরের মুখোমুখি, মেঝেতে একটা সুজনী বিছিয়ে একজন বৃদ্ধা শুয়ে আছেন, আমাদের দেখে উঠে বসলেন, দেখলাম কণ্ঠীধারিণী। 

আমি গর্ভগৃহের সামনে গিয়ে, যেমন আমার স্বভাব, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিগ্রহ, ছবি, পূজার সাজ সরঞ্জাম, ঠাকুরের সাজসজ্জা, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি থেকে নিয়ে রাধারাণীর পায়ের মল অবধি সব দুচোখ ভরে দেখলাম, প্রণাম করলাম, তারপর ওই বৃদ্ধা মাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে জগদ্বন্ধু বাবাজির ছবি রাখা আছে, এটি কি মহানাম সম্প্রদায়ের মন্দির? উনি উত্তর দিলেন বটে কিন্তু আমি ঠিক মানে বুঝে উঠতে পারলাম না কারণ মনে হলো পক্ষাঘাতের কারণে ওঁর speech impaired হয়ে গেছে, আমি আগে বুঝিনি। আমার কেন জানিনা মনে হলো আজ বোধহয় ওঁর খাওয়া জুটবে না। ওঁর হাতে কিছু প্রনামি তুলে দিয়ে নেমে এসে জুতো পরার পর মাথা তুলতেই উনি ইঙ্গিত করে আমায় দূরে দেয়ালের গায়ে জলের কলটি দেখিয়ে দিলেন। 

ওমা, কল ঘুরিয়ে দেখি জল তো নেইই, উপরন্তু কলের মুন্ডিটা হাতে খুলে বেরিয়ে এসেছে! ততক্ষনে উনি পা টেনে টেনে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। উনি নিজেই মুন্ডিটা আমার হাত থেকে নিয়ে কলে লাগিয়ে দিয়ে আমায় ওঁর সঙ্গে ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলেন, আমি কেবল এটুকুই বুঝলাম যে যেতে যেতে বারেবারে বলছেন, "আয়, আয়, ভয় নেই, ভয় নেই"। আড়চোখে দেখলাম গিন্নি ততক্ষণে মন্দিরের সিঁড়ির ওপর থেবরে বসে পড়েছেন। মা ওই অন্ধকার ঘরটা পেরিয়ে পেছনের উঠোনে নিয়ে গিয়ে একটি ছোট্ট চৌবাচ্চা দেখিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে ইশারা করলেন, আমিও আঁজলা করে জল তুলে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বেরোবার সময় লক্ষ্য করলাম যে এটি রান্না, ভাঁড়ার কাম ভোগের ঘর। 

এবারে যে চমকটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, সত্যি বলছি, তার জন্য আমি একেবারেই তৈরি ছিলাম না। বেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়াতেই মা আমাদের পাশের বাড়ির তিনতলার কার্নিশে বসা একটি কাকের দিকে দেখতে ইশারা করলেন। আমার এই দুর্বল চোখে দেখলাম কাকটা কোথাও থেকে সাদারঙের কিছু একটা খাবার নিয়ে এসেছে, পাউরুটির টুকরোও হতে পারে, আর নিশ্চিন্তে বসে ঠোঁট দিয়ে সেটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কাকটার ঠিক নিচেই মন্দিরের জমিতে প্রায় তিনতলা সমান একটা হলুদ পৌ গাছ, একটু অন্যমনষ্ক হলেই কাকটাকে যে কেউ মিস করে যাবেন। উনি আঙ্গুল তুলে কাকটিকে দেখাচ্ছেন, দুর্বোধ্য অনেক কিছু বলছেন আর খিলখিল করে হাসছেন। হাতের মুঠোয় তখনো টাকাটা ধরা, কাকটার দিকে দেখিয়েই নিজের দিকে আঙ্গুলটা ঘুরিয়ে বললেন "এক", তারপর একবার মুঠিটা আলতো করে খুলে দেখালেন। কয়েকটা মুহূর্ত লাগলো আমার বুঝতে। তারপর আমি হাতজোড় করে ওঁদের সবাইকে প্রণাম করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম, পেছনে পেছনে গিন্নিও।

কিছুক্ষণ হাঁটার পরে গিন্নি হটাৎ realise করেছেন যে আমি একেবারে চুপ মেরে গেছি। উনি বারেবারে জিজ্ঞেস করছেন হলোটা কি, আমি আর কিই বা উত্তর দেবো! কোনোমতে বললাম 'মহাত্মা, অদ্বৈত'। বুকের ভেতরে তো তখন তোলপাড় হচ্ছে - কি হলো সে কেবল আমি জানি আর আমার অন্তর্যামী জানেন। ওনার হাতে টাকাটা দিয়ে মনে হয়েছিল যাক, ওনার আজকের খাবারের যোগানটুকু অন্ততঃ করে দেওয়া গেল। শ্রীশ্রীমা যে কখন কি রূপে মনের ভুল ভেঙে দেন, মাই জানেন। মা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে অন্নপূর্ণার সংসারে অন্ন মা স্বয়ংই যোগান, বাকিরা নিমিত্ত মাত্র। ওই যে এতটুকু আত্মশ্লাঘা হয়েছিল, মনে ভুল বৃত্তি জেগেছিল, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল 'আমি দিলাম' - একেবারে সমূলে ভেঙে চুরমার করে দিলেন।

একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে মা আজ দেখিয়ে দিলেন কাককে যিনি খাওয়ান, তিনিই মন্দিরের মাকেও খাওয়ান, আর আমাকেও। কাকও যা, ওই মাও তা, আমিও তাই - এক, দ্বিতীয় নেই। তাই যে লোকটা সচরাচর মানিব্যাগ নিয়ে সকালে হাঁটতে বেরোয় না, সে হটাৎ আজই ওটি পকেটে পুরে ফেললো, যে লোকটা ওই মন্দিরের সামনে দিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার গেছে কিন্তু এতদিন ঢোকেনি, তার আজই হটাৎ মনে হলো ওখানে ঢুকে দেখা দরকার কি আছে, আর অবশেষে যে হাত দিয়ে 'দান করা' হয়েছে বলে লোকটা মনে করেছিল, সেটা ধুইয়ে, দানের অহঙ্কারকে মুছিয়ে দিয়ে, মা লোকটাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিলেন। সেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা, সেই হাতছানি আর সেই খিলখিল করে হাঁসি - এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! এখনো কানে বাজছে, "ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই"।

প্রসীদ প্রসীদ মাতঃ জগতঃ অখিলস্য।

Wednesday, February 1, 2023

মেকি কম্যুনিস্ট

আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের পরিবারের কনিষ্ঠতম সন্তানটিও পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে চলে যাবে, কারণ সেই আদি অকৃত্তিম lack of career growth opportunities in West Bengal. আমাকেও প্রায় চার দশক আগে ঘরবাড়ি পরিবার পরিজন ছেড়ে এই একই কাজ করতে হয়েছিল, পার্থক্য কেবল তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন 'সর্বহারার নেতা' জ্যোতিবাবু। সেই যে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবে আমাদের অনেকেরই মনের কথা বলে গিয়েছিলেন না:
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!

যাইহোক, এসব তো আমরা মেনেই নিয়েছি - brain drain আমাদের পোড়া রাজ্যের ভবিতব্য। ও প্রথমে ট্রেনের টিকিট খুঁজে দেখলো কারণ সঙ্গে কিছু মালপত্তর যাবে। ট্রেনের টিকিট যথারীতি ওয়েটলিস্টেড, কনফার্মড হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাধ্য হয়ে প্লেন - এবং সেখানেই আসল চমক। প্লেনের টিকিটের দাম ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের তুলনায় প্রায় ৭০০ টাকা কম এবং বলাই বাহুল্য, মাত্র কয়েকঘন্টায় পৌঁছে দেবে। এমতবস্থায় কিছু মাল সার্ফেস কুরিয়ার দিয়ে পাঠিয়ে দিলেও আখেরে লাভজনক। 

এই যে কথায় কথায় ছাগলের তৃতীয় সন্তানগুলো লাফিয়ে মরে না যে সরকার দেশ বেচে দিলো, আদানি দেশ বেচে দিলো, আম্বানি দেশ বেচে দিলো - তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে আজকের এই সাশ্রয়ী এয়ারলাইন্সটিকেই কিছুদিন আগেই টাটাকে বেচে দেওয়া হয়েছিল এবং যে internet ব্যবহার করে সেই টিকিটটা বুকিং করা হলো সেটাও আম্বানিদেরই কোম্পানির, যার data charges are lowest in the world. সত্যিটা হজম হবে না, তাই না?

আমি মাঝেমাঝে ভাবি যে এই দামড়া kidগুলো এমনই দুর্ভাগা যে এদের চোখের সামনেই তো দেশটা হুড়হুড় করে বদলে যাচ্ছে, রোজ রোজ নতুন নতুন opportunities, নতুন নতুন growth options খুলে যাচ্ছে, optics and living experience-ও বদলে যাচ্ছে - এরা সবকিছুই গোলগোল চোখ করে দেখছে কিন্তু কিছুতেই উন্নতিটা উপভোগ করতে পারছে না, celebrate করতে পারছে না! এদিক ওদিকের কিছু খুচরো dynast ছেড়ে দিলে, এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই urban নকশাল আর armchair বিপ্লবী, তার মধ্যেও অধিকাংশই আবার মাত্র এক জেনারেশন আগে পেছনে লাথি খেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে এপারে আসা হিন্দু বাঙালি, যারা আবার নিজেদের হিন্দু identity flaunt করতে ভীষণ কুন্ঠাবোধ করে! আমি সত্যিই এই অদ্ভুত জীবগুলিকে বুঝিনা। এককালে রাগ হতো, এখন এদের প্রতি করুণা হয়।

আরে আমার দেশ উন্নতি করছে, রোজ নতুন নতুন ঝাঁ চকচকে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন জায়গায় রেল পৌঁছচ্ছে, নতুন নতুন এয়ারপোর্ট তৈরি হচ্ছে, deep sea port তৈরি হচ্ছে, মেট্রোরেল তৈরি হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলব্রিজ, সবচেয়ে বড় টানেল, indigenous যুদ্ধবিমান, কামান, indigenous হেলিকপ্টার, indigenous aircraft carrier তৈরি হচ্ছে, দ্রুতহারে poverty কমছে, পাসপোর্টের কদর বাড়ছে, কত কিই না হচ্ছে, আমরা খুশি হবো না, celebrate করবো না? নাকি ব্রিটেনের মতো নিজেদের দেশের বিরোধিতা নিজেরাই করলে ভালো হয় - দেশ recessionএ ভুগছে আর বামপন্থী লেবার পার্টি পাঁচ লক্ষ workerকে হরতাল করতে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে যাতে বাকিটাও রসাতলে যায়!

উঁহু, কিছু বলা যাবে না নইলে বাবুদের গোঁসা হবে কারণ এটা যে ওদেরই দেশ, ওদের নিজেদের দেশ, সেই বোধটাই যে ওদের নেই। ওদের Holy-land চিনে এভার্গ্র্যান্ডে হয়েছে, সুতরাং এখানেও হতে হবে - চলো, বাইরের লোক বাদ দাও, আমরাই জিন পিং সেজে সবাই মিলে একজনের পেছনে লেগে যাই আর একটা first generation ভারতীয় বহুজাতিক সংস্থার 'রাম নাম সত্য হ্যায়' করে দিই! এরা এমন বিরুদ্ধপ্রচার করতে শুরু করেছে যে FPO fully subscribed হয়ে যাওয়ার পরও আদানিরা সব ক্যান্সেল করে বিশ হাজার কোটি টাকা investorদের ফেরত দিয়ে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। এর বেশিরভাগই কিন্তু সৌদিদের, FII আর HNIদের টাকা ছিল, দেশের কাজে লাগতো। এই অপগন্ডগুলো কি কোনো mass মানসিক অবসাদের শিকার? ঠিক জানি না।

আমি এটাও বুঝি না যে যেখানে সত্যি সত্যি দুঃখ পাওয়ার কথা, সেখানে এই দুঃখবিলাসিরা হটাৎ এত নৈবর্তিক হয়ে যায় কেন? আমাদের এই পোড়া শহরে সেই কোন মান্ধাতার আমলে প্রতিভা পাটিল রাষ্ট্রপতি থাকার সময় জোকা-এস্প্ল্যানেড মেট্রোর শিলা পোঁতা হয়েছিল, বর্তমান রাজ্য সরকারের অসহযোগিতার কারণে জমিজটে আটকে সেটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোমতে সবেমাত্র অজন্তা অবধি এসে পৌঁছিয়েছে, তাও শুধু showpiece, এস্প্ল্যানেড এখনো বহুদূর। কই এর সমালোচনার ব্যাপারে এদের কোনো উৎসাহ দেখিনা তো, কেন?

কই, জোর জবরদস্তি ভারতীয় রেলকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর route alignment বদলাতে বাধ্য করে যখন উত্তর কলকাতার aquifer ধ্বংস করে বাড়ি ধসিয়ে দেওয়া হয়, তখন আসল অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও তো এদের বলতে শুনি না, কেন? যেখানে উত্তরপ্রদেশে হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে আট-লেন আর বারো-লেনের অতগুলো গ্রিনফিল্ড ন্যাশনাল হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে সেখানে আমাদের রাজ্যে বাংলাদেশের সাথে সংযোগকারী সামান্য একটা existing highwayকে চওড়া করতে গিয়েই কেন্দ্রীয় সরকার হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন, কই সে ব্যাপারে তো এদের নো ট্যাঁফুঁ, কেন রে ভাই?

গণতন্ত্রে সকলেরই বাকস্বাধীনতা আছে, ফলে এদের দুঃখ দুঃখ ভাব সহ্য করতেই হয়। আহা রে, কত মনকষ্ট বাবুসোনাদের! যে দেশের অপগন্ড জনতা বারবার একটা হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে, সেই দেশের মূর্খ, দেহাতি, regressive, গোভক্ত, গঙ্গাসাগরের গায়ে বোঁটকা গন্ধওলা ধর্মান্ধ হিন্দুগুলোর সাথে কি করে যে কোনো শিক্ষিত, মার্জিত, গুয়েভারার ভক্ত progressive ভদ্রলোক থাকতে পারে, এরা বুঝে উঠতেই পারছে না! পঁচাত্তর বছর ধরে দেশ নাকি বিক্রি হয়েই যাচ্ছে, প্রতিবছর একই রাবিশ শুনে শুনে কান পচে গেল - কিন্তু দেশ তো যেমন ছিল তেমনই আছে দেখি। আমেরিকা নাকি মোদিকে কিনে নিয়েছে অথচ বাইডেনকে মুখের ওপর না বলে দিয়ে তার চরম শত্রু রাশিয়া থেকে আমাদের তেল কেনা চলছে তো চলছেই - কি কিউট না? 

খালি মুখ ব্যাজার করে গুচ্ছের criticism, কেবল দুনিয়াভরের conspiracy theory আর অদ্ভুত অদ্ভুত victim card খেলা - কেন যে এতটা negative thinkingএর শিকার এরা, কিসের এত গোঁসা আর আক্রোশ, কে জানে বাপু। যাকগে, মরুক গে যাকগে যাক, এদের নিয়ে বেশি না ভাবাই ভালো। আমার দেশ চোখের সামনে ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে, শক্তিশালী হয়ে উঠছে, আমি দেখবো আর আনন্দে ধেই ধেই করে নাচবো - বেশ করবো। শকুনের অভিশাপে গরু মরে না, আগেও মরেনি, ভবিষ্যতেও মরবে না। ২০২৪এ মোদিজীর সরকার আবার জিতবেন, আরো বেশি মার্জিনে জিতবেন, এরা চাইলেও জিতবেন, না চাইলেও জিতবেন - এটাই আসল কথা। কারণ that is the mood of the Nation. Always Positive.

ওঁ

আজকাল রোজ সকালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার মতন হাঁটি। বড়রাস্তা এড়িয়ে গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে যাতায়াতই আমার পছন্দ কারণ গাড়িঘোড়ার উৎপাত থাকে না। এইরকমই একটি সরু রাস্তার ধারে একটি ছোট একতলা বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভেতর থেকে আজ ভোরে ওঁকার ধ্বনি কানে এলো - একটি স্পিকারে ক্রমাগত সামবেদীয় সুরে ওম ওম ওম ওম ওম ধ্বনি বাজছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ ওঁদের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে শুনলাম, তারপর বাকিটা পথ মনের মধ্যে ক্রমাগত ওই মহামন্ত্র বাজতে লাগলো, এখনো চোখ বন্ধ করলেই যেন শুনতে পাচ্ছি। 

'খুদ' অর্থাৎ 'মিথ্যে আমি'কে পেরিয়ে 'খুদা' অর্থাৎ 'সত্যি আমি' অবধি পৌঁছনোর রাস্তাই হলো আধ্যাত্মপথ। স্বর থেকে নাদ। আমরা সবাই জানি যে কন্ঠ থেকে বা কোন পদার্থে আঘাত করার ফলে যে একাধিক কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আওয়াজ বা ধ্বনি নির্গত হয়, তাকেই স্বর বলে। আবার, একটু অন্যভাবে দেখলে, অন্তরস্থিত 'ঈশ'র সাথে দেহযুক্ত 'স্বর'কে সম্পৃক্ত করাও আসলে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার একটা পথ - শব্দপথ। সেটাও অধ্যাত্মযাপন। শব্দ এবং সুর তো স্বরেরই ভিন্নমাত্রিক বৈশিষ্ট্য। 

সামবেদ (সামন্‌ বা গান ও বেদ বা জ্ঞানের সমাস) হলো সুরারোপিত ঋগ্বেদ। সে আমলে এই বেদের স্তোত্রগুলি ‘উদ্‌গাতৃ’ বা গায়ক পুরোহিতরা গাইতেন। সামবেদে মূল পাঠের ঠিক উপরে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠের অভ্যন্তরে নিহিত স্বরলিপিভুক্ত সুর পাওয়া যায়। এগুলিই সম্ভবত বিশ্বের প্রাচীনতম স্বরলিপিভুক্ত সুর। যাইহোক, ঋকপ্রাতিশাখ্যে শৌণিক সামবেদের সঙ্গীতোপযোগী স্বরগুলিকে 'যম' বলে উল্লেখ করেছেন।

ভাবগত দিক থেকে সামবেদের যম শব্দটির সাথে যোগশাস্ত্রে উল্লেখিত যমের আশ্চর্য্যজনক মিল আছে। আমরা জানি যে মহর্ষি পতঞ্জলি রচিত যোগশাস্ত্রে অষ্টাঙ্গযোগের প্রথমটিই হল যম। বলা যায় যে এটি মূলত এক নৈতিক আচরণবিধি। অর্থাৎ ব্যক্তি তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ideally কেমন আচরণ করবেন, তার বিধিই হলো যম। 

মূলত যম হলো সংযম বিধি। সহজ, সরল, অনাড়ম্বড়  এবং লালসাহীন যাপনের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করা বা সংযমের মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার সাধনাই হলো যমের চর্চা। অন্যদিকে, যেহেতু ধ্বনিই সঙ্গীতকে নিয়ন্ত্রণ করে বা সংযত করে, তাই স্বরের অপর নামও যম রাখা হয়েছিল।

যম হলো যে কোনো স্বরের সাধারণ নাম। পরে প্রতিটি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের স্বরমালার পত্তন ঘটেছিল। ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধ্বনিমূল ধরে নামকরণ করার সূত্রে বর্ণ (অ, আ, ক, খ ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল। তেমনি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের বর্ণ সৃষ্টি হয়েছিল। একালের স র গ ম প ইত্যাদি হলো এইরকমই এক একটি সাঙ্গীতিক স্বরের নাম বা বর্ণ।

এমনই তিনটি স্বর অ+উ+ম্ নিয়ে একটি অনবদ্য ধ্বনি হলো ওঁকার বা প্রণবমন্ত্র। এতে মৌখিক এবং সাঙ্গীতিক দুটি স্বরেরই সমাহার এবং সনাতন দর্শনের মতে এতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যত স্বর আছে, সব অন্তর্ভুক্ত। তাই একদিক দিয়ে দেখলে তিন মাত্রার এই একটিমাত্র শব্দই সৃষ্টি স্থিতি এবং প্রলয়ের মূর্তরূপ, আবার অন্যদিক দিয়ে দেখলে ইনি সৃষ্টির আদিস্বর বা নাদব্রহ্মও বটে।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর The way to Blessedness ভাষণে একজায়গায় বলছেন, "He whom all the Vedas seek, to see whom men undergo all sorts of asceticism, I will tell you His name: It is Om. This eternal Om is the Brahman, this is the immortal One; he who knows the secret of this — whatever he desires is his." (CW, Vol.2)

আবার শিকাগো থেকে জন হেনরি রাইটকে লেখা ২রা অক্টোবর ১৮৯৩ সালের একটি চিঠিতে ন্যায়শাস্ত্রের (দ্বৈত) মহান দার্শনিক উদয়নাচার্যকে উদ্ধৃত করে স্বামীজী লিখছেন, "He who is the Brahman of the Vedântins, Ishvara of the Naiyâyikas, Purusha of the Sânkhyas, cause of the Mimâmsakas, law of the Buddhists, absolute zero of the Atheists, and love infinite unto those that love, may [He] take us all under His merciful protection". দ্বৈতমতের দৃষ্ঠিভঙ্গি থেকে এক ওঁকারে একেবারে সম্পূর্ণ সমর্পণ যাকে বলে আরকি। 

এই যে স্বরকে ধরে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো, এ বড় কম কথা নয়। আমরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত জুড়ে নানা জায়গায় দেখতে পাই ঠাকুর প্রণবধ্বনি শুনে সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন, এই শব্দের এমনই দ্যোতনা। ওখানে একজায়গায় আছে যে ২৬শে নভেম্বর ১৮৮৩ সালে ঠাকুর সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজে গেছেন, সেখানে 'ওঁ সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। আনন্দরূপমমৃতংযদ্বিভাতি। শান্তং শিবমদ্বৈতম্‌ ...' ইত্যাদি মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে, ঠাকুর প্রণবসংযুক্ত এই ধ্বনি শুনে সমাধিস্থ হয়ে পড়েছেন। তারপর মাস্টারমশাইয়ের ভাষায়, 'সমাধির অব্যবহিত পরেই চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিতেছেন। দেখিলেন, সভাস্থ সকলেই নিমীলিত নেত্র। তখন ‘ব্রহ্ম’ ‘ব্রহ্ম’ বলিয়া হঠাৎ দণ্ডায়মান হইলেন। উপাসনান্তে ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল লইয়া সংকীর্তন করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমানন্দে মত্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আর নৃত্য করিতে লাগিলেন।' পড়লেই মনে হয়না যে ওঁকার আর আনন্দ, celebration, estacy সব যেন কেমন মিলেমিশে যাচ্ছে?

সঠিক পরিবেশে সঠিক উচ্চারণে সঠিক সুরে ওঁকার ধ্বনি শুনলে মনের ওপর কেমন এবং কতটা প্রভাব পড়ে, সেটা ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয়। একক বা সম্মিলিত কন্ঠস্বর আর একটি প্রাচীন সুর মিলে শ্রোতার মনকে হঠাৎই এমন এক পর্যায়ে নিয়ে চলে যেতে পারে, যেখানে বড় আনন্দ, বড় প্রশান্তি, বড় নির্লিপ্ততা, বড় নিশ্চিন্ততা - ওই feeling ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কি অদ্ভুত শক্তি ওই একটি ধ্বনির মধ্যে, কি অসীম ক্ষমতা - কল্পনাও করা সম্ভব না। এতক্ষণ যে এইসব হাবিজাবি লিখলাম, কেন লিখলাম জানিনা, সব থিওরি, বেকার। আসল জিনিস হলো the effect of Omkara on one's state of being. 

ওঁ তৎ সৎ
হরি ওঁ রামকৃষ্ণ