আজকাল রোজ সকালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার মতন হাঁটি। বড়রাস্তা এড়িয়ে গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে যাতায়াতই আমার পছন্দ কারণ গাড়িঘোড়ার উৎপাত থাকে না। এইরকমই একটি সরু রাস্তার ধারে একটি ছোট একতলা বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভেতর থেকে আজ ভোরে ওঁকার ধ্বনি কানে এলো - একটি স্পিকারে ক্রমাগত সামবেদীয় সুরে ওম ওম ওম ওম ওম ধ্বনি বাজছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ ওঁদের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে শুনলাম, তারপর বাকিটা পথ মনের মধ্যে ক্রমাগত ওই মহামন্ত্র বাজতে লাগলো, এখনো চোখ বন্ধ করলেই যেন শুনতে পাচ্ছি।
'খুদ' অর্থাৎ 'মিথ্যে আমি'কে পেরিয়ে 'খুদা' অর্থাৎ 'সত্যি আমি' অবধি পৌঁছনোর রাস্তাই হলো আধ্যাত্মপথ। স্বর থেকে নাদ। আমরা সবাই জানি যে কন্ঠ থেকে বা কোন পদার্থে আঘাত করার ফলে যে একাধিক কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আওয়াজ বা ধ্বনি নির্গত হয়, তাকেই স্বর বলে। আবার, একটু অন্যভাবে দেখলে, অন্তরস্থিত 'ঈশ'র সাথে দেহযুক্ত 'স্বর'কে সম্পৃক্ত করাও আসলে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার একটা পথ - শব্দপথ। সেটাও অধ্যাত্মযাপন। শব্দ এবং সুর তো স্বরেরই ভিন্নমাত্রিক বৈশিষ্ট্য।
সামবেদ (সামন্ বা গান ও বেদ বা জ্ঞানের সমাস) হলো সুরারোপিত ঋগ্বেদ। সে আমলে এই বেদের স্তোত্রগুলি ‘উদ্গাতৃ’ বা গায়ক পুরোহিতরা গাইতেন। সামবেদে মূল পাঠের ঠিক উপরে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠের অভ্যন্তরে নিহিত স্বরলিপিভুক্ত সুর পাওয়া যায়। এগুলিই সম্ভবত বিশ্বের প্রাচীনতম স্বরলিপিভুক্ত সুর। যাইহোক, ঋকপ্রাতিশাখ্যে শৌণিক সামবেদের সঙ্গীতোপযোগী স্বরগুলিকে 'যম' বলে উল্লেখ করেছেন।
ভাবগত দিক থেকে সামবেদের যম শব্দটির সাথে যোগশাস্ত্রে উল্লেখিত যমের আশ্চর্য্যজনক মিল আছে। আমরা জানি যে মহর্ষি পতঞ্জলি রচিত যোগশাস্ত্রে অষ্টাঙ্গযোগের প্রথমটিই হল যম। বলা যায় যে এটি মূলত এক নৈতিক আচরণবিধি। অর্থাৎ ব্যক্তি তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ideally কেমন আচরণ করবেন, তার বিধিই হলো যম।
মূলত যম হলো সংযম বিধি। সহজ, সরল, অনাড়ম্বড় এবং লালসাহীন যাপনের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করা বা সংযমের মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার সাধনাই হলো যমের চর্চা। অন্যদিকে, যেহেতু ধ্বনিই সঙ্গীতকে নিয়ন্ত্রণ করে বা সংযত করে, তাই স্বরের অপর নামও যম রাখা হয়েছিল।
যম হলো যে কোনো স্বরের সাধারণ নাম। পরে প্রতিটি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের স্বরমালার পত্তন ঘটেছিল। ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধ্বনিমূল ধরে নামকরণ করার সূত্রে বর্ণ (অ, আ, ক, খ ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল। তেমনি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের বর্ণ সৃষ্টি হয়েছিল। একালের স র গ ম প ইত্যাদি হলো এইরকমই এক একটি সাঙ্গীতিক স্বরের নাম বা বর্ণ।
এমনই তিনটি স্বর অ+উ+ম্ নিয়ে একটি অনবদ্য ধ্বনি হলো ওঁকার বা প্রণবমন্ত্র। এতে মৌখিক এবং সাঙ্গীতিক দুটি স্বরেরই সমাহার এবং সনাতন দর্শনের মতে এতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যত স্বর আছে, সব অন্তর্ভুক্ত। তাই একদিক দিয়ে দেখলে তিন মাত্রার এই একটিমাত্র শব্দই সৃষ্টি স্থিতি এবং প্রলয়ের মূর্তরূপ, আবার অন্যদিক দিয়ে দেখলে ইনি সৃষ্টির আদিস্বর বা নাদব্রহ্মও বটে।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর The way to Blessedness ভাষণে একজায়গায় বলছেন, "He whom all the Vedas seek, to see whom men undergo all sorts of asceticism, I will tell you His name: It is Om. This eternal Om is the Brahman, this is the immortal One; he who knows the secret of this — whatever he desires is his." (CW, Vol.2)
আবার শিকাগো থেকে জন হেনরি রাইটকে লেখা ২রা অক্টোবর ১৮৯৩ সালের একটি চিঠিতে ন্যায়শাস্ত্রের (দ্বৈত) মহান দার্শনিক উদয়নাচার্যকে উদ্ধৃত করে স্বামীজী লিখছেন, "He who is the Brahman of the Vedântins, Ishvara of the Naiyâyikas, Purusha of the Sânkhyas, cause of the Mimâmsakas, law of the Buddhists, absolute zero of the Atheists, and love infinite unto those that love, may [He] take us all under His merciful protection". দ্বৈতমতের দৃষ্ঠিভঙ্গি থেকে এক ওঁকারে একেবারে সম্পূর্ণ সমর্পণ যাকে বলে আরকি।
এই যে স্বরকে ধরে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো, এ বড় কম কথা নয়। আমরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত জুড়ে নানা জায়গায় দেখতে পাই ঠাকুর প্রণবধ্বনি শুনে সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন, এই শব্দের এমনই দ্যোতনা। ওখানে একজায়গায় আছে যে ২৬শে নভেম্বর ১৮৮৩ সালে ঠাকুর সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজে গেছেন, সেখানে 'ওঁ সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। আনন্দরূপমমৃতংযদ্বিভাতি। শান্তং শিবমদ্বৈতম্ ...' ইত্যাদি মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে, ঠাকুর প্রণবসংযুক্ত এই ধ্বনি শুনে সমাধিস্থ হয়ে পড়েছেন। তারপর মাস্টারমশাইয়ের ভাষায়, 'সমাধির অব্যবহিত পরেই চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিতেছেন। দেখিলেন, সভাস্থ সকলেই নিমীলিত নেত্র। তখন ‘ব্রহ্ম’ ‘ব্রহ্ম’ বলিয়া হঠাৎ দণ্ডায়মান হইলেন। উপাসনান্তে ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল লইয়া সংকীর্তন করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমানন্দে মত্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আর নৃত্য করিতে লাগিলেন।' পড়লেই মনে হয়না যে ওঁকার আর আনন্দ, celebration, estacy সব যেন কেমন মিলেমিশে যাচ্ছে?
সঠিক পরিবেশে সঠিক উচ্চারণে সঠিক সুরে ওঁকার ধ্বনি শুনলে মনের ওপর কেমন এবং কতটা প্রভাব পড়ে, সেটা ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয়। একক বা সম্মিলিত কন্ঠস্বর আর একটি প্রাচীন সুর মিলে শ্রোতার মনকে হঠাৎই এমন এক পর্যায়ে নিয়ে চলে যেতে পারে, যেখানে বড় আনন্দ, বড় প্রশান্তি, বড় নির্লিপ্ততা, বড় নিশ্চিন্ততা - ওই feeling ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কি অদ্ভুত শক্তি ওই একটি ধ্বনির মধ্যে, কি অসীম ক্ষমতা - কল্পনাও করা সম্ভব না। এতক্ষণ যে এইসব হাবিজাবি লিখলাম, কেন লিখলাম জানিনা, সব থিওরি, বেকার। আসল জিনিস হলো the effect of Omkara on one's state of being.
ওঁ তৎ সৎ
হরি ওঁ রামকৃষ্ণ
No comments:
Post a Comment