আমি আর গিন্নি রোজই সকালে উঠে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিমি পথ হাঁটতে বেরোই এবং চেষ্টায় থাকি রোজই বাড়ির কাছাকাছি কোনো না কোনো unexplored অঞ্চলে, কোনো নতুন রাস্তা দিয়ে বা অজানা পাড়ায় ঢুকে নতুন নতুন স্বাদ গন্ধ বর্ণ দৃশ্য শুষে নিতে নিতে হাঁটতে, যাতে হাঁটাটা routine বোরিং না হয়ে যায় আরকি। এবং বলা যেতে পারে যে আমরা এই ব্যাপারে এখন বেশ সিদ্ধহস্তই হয়ে উঠেছি। ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারছি যে বেহালার গলিঘুঁজি, মেজ সেজ ছোট রাস্তার একটা বিশেষত্ব আছে - আঁকে বাঁকে ছোট বড় কত না মন্দির - মানুষের আস্থার জায়গা, এবং দেখলেই বোঝা যায় যে সর্বত্রই নিত্যপূজা হয়। পাড়ায় পাড়ায় এত মন্দির, এত ভক্ত অথচ নিজের true identity নিয়ে হিন্দু বাঙালি দ্বিধাগ্রস্থ - সত্যিই অদ্ভুত জাত একটা!
যাইহোক, এই হাঁটার দৌলতে কতরকমের যে শিবমূর্তির পুণ্যদর্শন হচ্ছে, মা কালীর কতরকমের রূপ, কত বৈচিত্র্যময় রাধামাধব আর কত অন্যান্য দেবমূর্তির দর্শনলাভ হয়, সে আর বলার কথা নয়। আমরা সাধারণত মন্দিরের সামনে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে প্রণাম করি, তারপর আবার হাঁটতে থাকি। আজ একজায়গায় এমনই একটি মন্দির দেখলাম, রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়ার ফলে একটি নিচু তোরণ, ভেতরে একটুখানি নিচু খালি জমি, তারপর বনেদিবাড়ির নাটমন্দিরের শৈলীতে তৈরি সুন্দর বাঁধানো মন্দির। এটিকে কয়েকবার আগেও রাস্তা থেকে দেখেছি কিন্তু তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি। আজ কি মনে হলো, দাঁড়ালাম, তারপর ঢুকলাম।
প্রথমে কয়েকধাপ লাল সিমেন্টের সিঁড়ি, তারপর লাল সিমেন্টের চাতাল, তারপর সাদা কালো পাথরের চকমেলানো গর্ভগৃহে হলদে চাঁদোয়ার তলায় কাঠের আসনে অপূর্ব সুন্দর শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমতি রাধারানী, তার নিচে শ্বেতপাথরের ধাপে ধাপে মা কালী সহ নানা দেবদেবীর পট, আর সবচেয়ে নিচে শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরজির একটি ছবি। গর্ভগৃহের দুপাশে দুটি ঘর। বাঁ দিকের ঘরে একটি চৌকির কোন দেখা যাচ্ছে, আড়াআড়ি পেছনদিকে একটা খোলা দরজা আর ডানদিকের ঘরটি প্রয়োন্ধকার। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে জুতো খুলতে খুলতেই দেখেছিলাম যে গ্রিল দিয়ে ঘেরা চাতালে, ওই ডানদিকের ঘরের মুখোমুখি, মেঝেতে একটা সুজনী বিছিয়ে একজন বৃদ্ধা শুয়ে আছেন, আমাদের দেখে উঠে বসলেন, দেখলাম কণ্ঠীধারিণী।
আমি গর্ভগৃহের সামনে গিয়ে, যেমন আমার স্বভাব, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিগ্রহ, ছবি, পূজার সাজ সরঞ্জাম, ঠাকুরের সাজসজ্জা, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি থেকে নিয়ে রাধারাণীর পায়ের মল অবধি সব দুচোখ ভরে দেখলাম, প্রণাম করলাম, তারপর ওই বৃদ্ধা মাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে জগদ্বন্ধু বাবাজির ছবি রাখা আছে, এটি কি মহানাম সম্প্রদায়ের মন্দির? উনি উত্তর দিলেন বটে কিন্তু আমি ঠিক মানে বুঝে উঠতে পারলাম না কারণ মনে হলো পক্ষাঘাতের কারণে ওঁর speech impaired হয়ে গেছে, আমি আগে বুঝিনি। আমার কেন জানিনা মনে হলো আজ বোধহয় ওঁর খাওয়া জুটবে না। ওঁর হাতে কিছু প্রনামি তুলে দিয়ে নেমে এসে জুতো পরার পর মাথা তুলতেই উনি ইঙ্গিত করে আমায় দূরে দেয়ালের গায়ে জলের কলটি দেখিয়ে দিলেন।
ওমা, কল ঘুরিয়ে দেখি জল তো নেইই, উপরন্তু কলের মুন্ডিটা হাতে খুলে বেরিয়ে এসেছে! ততক্ষনে উনি পা টেনে টেনে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। উনি নিজেই মুন্ডিটা আমার হাত থেকে নিয়ে কলে লাগিয়ে দিয়ে আমায় ওঁর সঙ্গে ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলেন, আমি কেবল এটুকুই বুঝলাম যে যেতে যেতে বারেবারে বলছেন, "আয়, আয়, ভয় নেই, ভয় নেই"। আড়চোখে দেখলাম গিন্নি ততক্ষণে মন্দিরের সিঁড়ির ওপর থেবরে বসে পড়েছেন। মা ওই অন্ধকার ঘরটা পেরিয়ে পেছনের উঠোনে নিয়ে গিয়ে একটি ছোট্ট চৌবাচ্চা দেখিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে ইশারা করলেন, আমিও আঁজলা করে জল তুলে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বেরোবার সময় লক্ষ্য করলাম যে এটি রান্না, ভাঁড়ার কাম ভোগের ঘর।
এবারে যে চমকটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, সত্যি বলছি, তার জন্য আমি একেবারেই তৈরি ছিলাম না। বেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়াতেই মা আমাদের পাশের বাড়ির তিনতলার কার্নিশে বসা একটি কাকের দিকে দেখতে ইশারা করলেন। আমার এই দুর্বল চোখে দেখলাম কাকটা কোথাও থেকে সাদারঙের কিছু একটা খাবার নিয়ে এসেছে, পাউরুটির টুকরোও হতে পারে, আর নিশ্চিন্তে বসে ঠোঁট দিয়ে সেটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কাকটার ঠিক নিচেই মন্দিরের জমিতে প্রায় তিনতলা সমান একটা হলুদ পৌ গাছ, একটু অন্যমনষ্ক হলেই কাকটাকে যে কেউ মিস করে যাবেন। উনি আঙ্গুল তুলে কাকটিকে দেখাচ্ছেন, দুর্বোধ্য অনেক কিছু বলছেন আর খিলখিল করে হাসছেন। হাতের মুঠোয় তখনো টাকাটা ধরা, কাকটার দিকে দেখিয়েই নিজের দিকে আঙ্গুলটা ঘুরিয়ে বললেন "এক", তারপর একবার মুঠিটা আলতো করে খুলে দেখালেন। কয়েকটা মুহূর্ত লাগলো আমার বুঝতে। তারপর আমি হাতজোড় করে ওঁদের সবাইকে প্রণাম করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম, পেছনে পেছনে গিন্নিও।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে গিন্নি হটাৎ realise করেছেন যে আমি একেবারে চুপ মেরে গেছি। উনি বারেবারে জিজ্ঞেস করছেন হলোটা কি, আমি আর কিই বা উত্তর দেবো! কোনোমতে বললাম 'মহাত্মা, অদ্বৈত'। বুকের ভেতরে তো তখন তোলপাড় হচ্ছে - কি হলো সে কেবল আমি জানি আর আমার অন্তর্যামী জানেন। ওনার হাতে টাকাটা দিয়ে মনে হয়েছিল যাক, ওনার আজকের খাবারের যোগানটুকু অন্ততঃ করে দেওয়া গেল। শ্রীশ্রীমা যে কখন কি রূপে মনের ভুল ভেঙে দেন, মাই জানেন। মা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে অন্নপূর্ণার সংসারে অন্ন মা স্বয়ংই যোগান, বাকিরা নিমিত্ত মাত্র। ওই যে এতটুকু আত্মশ্লাঘা হয়েছিল, মনে ভুল বৃত্তি জেগেছিল, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল 'আমি দিলাম' - একেবারে সমূলে ভেঙে চুরমার করে দিলেন।
একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে মা আজ দেখিয়ে দিলেন কাককে যিনি খাওয়ান, তিনিই মন্দিরের মাকেও খাওয়ান, আর আমাকেও। কাকও যা, ওই মাও তা, আমিও তাই - এক, দ্বিতীয় নেই। তাই যে লোকটা সচরাচর মানিব্যাগ নিয়ে সকালে হাঁটতে বেরোয় না, সে হটাৎ আজই ওটি পকেটে পুরে ফেললো, যে লোকটা ওই মন্দিরের সামনে দিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার গেছে কিন্তু এতদিন ঢোকেনি, তার আজই হটাৎ মনে হলো ওখানে ঢুকে দেখা দরকার কি আছে, আর অবশেষে যে হাত দিয়ে 'দান করা' হয়েছে বলে লোকটা মনে করেছিল, সেটা ধুইয়ে, দানের অহঙ্কারকে মুছিয়ে দিয়ে, মা লোকটাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিলেন। সেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা, সেই হাতছানি আর সেই খিলখিল করে হাঁসি - এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! এখনো কানে বাজছে, "ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই"।
প্রসীদ প্রসীদ মাতঃ জগতঃ অখিলস্য।
No comments:
Post a Comment