Sunday, February 5, 2023

অখন্ড ভারত

সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব লিখেছিলেন, 'আলেকজান্ডারের গ্রিক সৈন্যরা যখন সেখানে (জালালাবাদে) থাকার ফলে বৌদ্ধ হয়ে গেল তখন তারাই সর্বপ্রথম গ্রিক দেবদেবীর অনুকরণে বুদ্ধের মূর্তি করে তার পুজো করতে লাগলো। ভারতবর্ষের আর সর্বত্র তখনও বুদ্ধের মূর্তি গড়া করা মানা, এমনকি বুদ্ধকে অলৌকিক শক্তির আধার রূপে ধারণা করে তাকে আল্লাহর আসনে বসানো বৌদ্ধদের কল্পনার বাইরে। সেই গ্রিক বুদ্ধমূর্তি হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়বার পর, পরবর্তী যুগে সেই আর্টের নাম হলো গান্ধার আর্ট।'

এই জালালাবাদেই সমাহিত আছেন বাদশা খান, যাঁকে একসময় ফ্রন্টিয়ার গান্ধীও বলা হতো এবং দেশভাগের সময় কংগ্রেসের একাংশের তীব্র ক্ষমতালিপ্সার শিকার হয়ে আসল গান্ধীজিকে যিনি ভগ্নহৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেছিলেন যে তাঁদের নেকড়ের মুখে ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হলো। সেই সময় ডুরান্ড লাইন বরাবর যে জায়গাটিকে North West Frontier Province বলা হতো, যেখানে বিভিন্ন 'কাবিলা' অর্থাৎ tribalদের বাস, তাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে সত্যি সত্যিই ওই সরল মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। 

মজার ব্যাপার হলো, যে ব্যারিস্টার জিন্না আদতে ক্লাস ৯ পাশ, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জীবনে একটা letter to the editorও লেখেননি, তিনি হটাৎ করে পাকিস্তানের জনক হয়ে গেলেন এবং যে বাদশা খান দেশকে স্বাধীন করানোর জন্য ইংরেজদের সাথে সারাজীবন লড়ে গেলেন, তাঁকে সেই জিন্নাই 'গদ্দার' দেগে দিয়ে পাকিস্তানি জেলে পুড়ে দিলেন! সে আমলে যেহেতু কোনো নামকরা এটর্নি ফার্ম বা ব্যারিস্টারের এপ্রেন্টিসশিপ করে একসময় তাঁদের সুপারিশ পেলেই 'called to the Bar' হয়ে যেত, তাই সমসাময়িক জিন্না গান্ধী সবাই ঐভাবেই ব্যারিস্টার হয়েছিলেন।

বাদশা খান কোনোদিন পাকিস্তান মেনে নিতে পারেননি কারণ তিনি জানতেন যে এত সহজে এক প্রাচীন চলমান সভ্যতাকে অস্বীকার করে একটা মেকি identity assume করে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি চাননি তাঁর দেহ পাকিস্তানে সমাহিত হোক, সেই জন্যই মৃত্যুর পর তাঁকে আফগানিস্তানের জালালাবাদে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া হয়। কেন জালালাবাদ বা পূর্বের আদিনাপুর, যা গাজনীরা এসে তছনছ করে দিয়েছিল? 

কারণ অখন্ড ভারতের প্রতীক যদি কোনো একটি জনবসতি থেকে থাকে তা হলো হিন্দুকুশ পর্বতের প্রান্তে কাবুল আর কুনার নদীর সংযোগস্থলে স্থিত এই মালভূমি, যা কুশান সাম্রাজ্যের সময় বৌদ্ধ আহনপোষ স্তুপের জন্য বিশ্ববিখ্যাত ছিল এবং যেখানে চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু জুয়ান ঝ্যাং এসেছিলেন। এই জালালাবাদ হয়েই পশ্চিমদিকে রাস্তা চলে গেছে এককালে হিন্দুশাহীর শাসনে থাকা কাবুলের দিকে আর পূর্বদিকে তোরখাম আর খাইবার পাস হয়ে রাস্তা চলে গেছে এখনকার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারের দিকে। 

অনেকে অখন্ড ভারত বলতে বোঝেন এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন অনেকগুলো দেশকে মিলিয়ে একটা কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন যুক্তরাষ্ট্র - আদপেই তা কিন্তু নয়। ভৌগোলিক সাম্রাজ্য বিস্তার এক জনিস আর সাংস্কৃতিক commonwealth বিস্তার অন্য জিনিস, যার সঙ্গে political map বা governance এর কোনো সম্পর্কই নেই। অখন্ড ভারত হলো একটা cultural construct, যেখানে ভারতের বসুধৈব কুটুম্বকম্ নানাধরনের পন্থজনিত বা জাতিজনিত fake supremacyর ধারণাকে খণ্ডন করে দেবে।

অখন্ড ভারত গড়ে তুলতে এখন আর hard powerএর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা হয়তো থাকবে না কিন্তু যেমন যেমন rationality বাড়বে তেমন তেমন ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে আর তেমন তেমন আমাদের soft powerও বাড়বে, অর্থাৎ আমাদের প্রাচীন সভ্যতার প্রভাব ভৌগোলিকভাবে আবার বিশ্বজুড়ে নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে, যেমনটা মধ্যযুগে হয়েছিল। এই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে - পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেলগুলি দেখলে আকছার শোনা যায় শিক্ষিত পাকিস্তানি যুবশক্তি নিজেদের প্রশ্ন করছেন যে পাকিস্তান তৈরি করা কি আদৌ প্রয়োজন ছিল, এবং যদি ছিলই তাহলে তার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি কি ছিল?

পরিস্থিতির চাপে পড়ে যে মুহূর্তে প্রতিবেশীরা 'আমরা কি ছিলাম, কি হয়েছি আর কি হতে পারি' - এই বিচার করতে বসবেন, অমনি তাঁরা ইতিহাসাশ্রয়ী হবেন, নিজেদের পূর্বপুরুষের অতুল কীর্তিকে নতুন করে বোঝবার চেষ্টা করবেন এবং সেই প্রাচীন সংস্কৃতিকে এখনো যাঁরা আগলে রেখেছেন, তাঁদের সুখবর্ধক বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নিজেদের দুঃখজনক বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করতে শুরু করবেন। একটু তলিয়ে ভাবলেই তাঁরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন কি কারণে ওঁদের এই দুর্দশা। ওঁরা নিজেদের অসন্তোষকে কি করে সন্তোষে পরিবর্তিত করা যায় তার রাস্তা তখন কাদের কাছে খুঁজতে যাবেন? 

পারস্যে এই প্রশ্নটি ইদানিং বেশ জোরদারভাবেই উঠতে শুরু করেছে কারণ ওঁদেরও এক প্রাচীন সভ্যতা ছিল, যাকে এতদিন artificially দাবিয়ে রাখা হয়েছিল, মানুষ বিদ্রোহ করছেন। আমাদের মহাদেশেও এটাই হবে, দুদিন আগে আর দুদিন পরে। জনগণের চাপে পড়ে ওইসব দেশের সরকার তখন বৈরিতা ছেড়ে ভারতের দিকে সহযোগিতা এবং সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে বাধ্য হবেন এবং সেটাই হবে আবার নতুন করে সাংস্কৃতিক হিন্দু রাষ্ট্রগঠনের সঠিক সময়। অখন্ড ভারত অবশ্যম্ভাবী। আমরা নিজেরা নিজেদের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলে কত দ্রুত তার পথ প্রশস্ত করতে পারি, সেটাই কেবল দেখার।

No comments:

Post a Comment