পাকিস্তান
উর্দুতে একটি দারুন শব্দ আছে - ভিরাসত, বাংলায় যার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের সদর্থক সংমিশ্রণ। শব্দটি যতই দারুন হোক না কেন, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু, সেই পাকিস্তানের পক্ষে এই ভিরাসতই আজ এক নিদারুণ বোঝা। নির্বুদ্ধিতার বশবর্তী হয়ে একটি সদর্থক বিষয়কে নেতিবাচক করে ফেললে তা যে নিজেরই বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এর প্রেক্ষাপটটি বুঝতে পারলেই পাকিস্তানের আজকের অস্তিত্বসংকটের পেছনের ইতিহাসও স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমরা বলি এক জাতি, এক প্রাণ, একতা আর পাকিস্তান বলে দিনী এবং কাফের - যার মধ্যে আবার এক ফিরকের দৃষ্টিতে অন্য ফিরকে কাফের, যেমন সুন্নির কাছে আহমেদিয়া বা সিয়া কাফের। কেন যে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল সেটা এঁরা প্রথম দিন থেকেই ভুলে গেছেন, ফলে কেবল মন্দির বা গুরুদ্বয়ারা বা চার্চই নয়, এঁরা একেঅপরের মসজিদও ভেঙে দেন বা বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। পাকিস্তান যখন তৈরি হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল যে হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলমান সুরক্ষিত নয়। পঁচাত্তর বছর পর আজ প্রমান হয়ে গেছে যে একমাত্র ভারতেই মুসলমান সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত এবং পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত, এমনই বিধির বিধান। আসলে পাকিস্তান কোনোদিন তৈরিই হয়নি, পাকিস্তানের নামে কেবল এক প্রহসন দাঁড়িয়ে আছে।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আগ্রাসনের আগের ভারত আর তারপর থেকে ওই সন্ত্রাসী, বিপন্থবিদ্বেষী ও লুঠমারের মানসিকতাসম্পন্ন বর্বর দস্যুদের দ্বারা লুন্ঠিত, নির্যাতিত, ধর্ষিত ভারতের যাপন এক নয়, হতেও পারেনা। প্রাচীন ভারতের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, মধ্যযুগীয় ভারতের যে সমৃদ্ধি, বস্তুত অষ্টম শতাব্দী পর্য্যন্ত যে জয়যাত্রা, যে বিশ্বজনীনতা, যে সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং যে নৈতিক, ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চতা, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তার জুড়ি মেলা ভার। আরবের প্রথম আক্রমণে এবং পরবর্তীতে লাগাতার মরুদস্যুদের হামলার সময় এই সহিষ্ণু উচ্চমেধাসম্পন্ন, ন্যায়নিষ্ঠ সভ্যতাকে এমন বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা হজম করার সাহস সকলের ছিলনা। ফলে ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, ভুল বুঝে হোক, লোভে হোক, রাগে হোক অথবা নিছক ক্ষমতালিপ্সার স্রোতে ভেসে গিয়ে হোক, একশ্রেণীর ভারতীয় ওই বিজাতীয় অনাদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের ঐতিহ্য, ইতিহাস, উত্তরাধিকার এবং সভ্যতার সংস্কারকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই হলো মূল দ্বিজাতীয় তত্ব - এক দেশ কিন্তু দুই বিপরীতধর্মী ভাবধারা।
এই যে যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন - কেউ সুন্নি হয়েছিলেন, কেউ সিয়া হয়েছিলেন, কেউ আহমেদিয়া হয়েছিলেন, কেউ সুফি হয়েছিলেন ইত্যাদি, এঁরা প্রায় কেউই বিদেশ থেকে আসেননি, সবাই এদেশীয়, নিদেনপক্ষে তাঁদের জননী তো এদেশীয় বটেই এবং সবাই আগে কোনো না কোনো ভারতীয় পূজাপদ্ধতি বা মতবাদ মানতেন। পরে তাঁদের মধ্যে যিনি যাঁর প্রভাবে বা মাধ্যমে পন্থ পরিবর্তন করলেন, তিনি সেই ভাবধারার অনুগামী হয়ে গেলেন - আপাতদৃষ্টিতে মাত্র এটুকুই। এখানেই যদি ব্যাপারটা শেষ হয়ে যেত তাহলে ভারতভাগ হতো না। সমস্যা সৃষ্টি হলো মূল ভারতীয় ধর্মআধারিত জীবনদর্শনের সাথে আমদানিকৃত সংকীর্ণ জীবনবোধের সংঘাতের কারণে, ফলত সমাজ দুটুকরো হয়ে গেল।
আমাদের পড়শী সভ্যতা পারস্যের বাসিন্দারা ভারতকে হিন্দুস্থান নামে ডাকতো, যা ওঁদের ভৌগোলিক জ্ঞান অনুযায়ী শতদ্রু নদী বা শতলুজ থেকে নিয়ে বারাণসী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর সেই দেখাদেখি আরবরা আমাদের দেশের নাম দিয়েছিল আল হিন্দ, যেখান থেকে এই দেশের বাসিন্দাদের হিন্দু আর আমাদের সভ্যতাকে হিন্দু সভ্যতা বলার প্রচলন হয়েছিল। বিন্দপর্বত পেরিয়ে দক্ষিণাত্যের খবর আরবদের কাছে বহুদিন পর্য্যন্ত ছিলনা, ওদিকের কথা ওরা অনেক পরে জানতে পারে এবং তারপর থেকে সমুদ্রপথে মালাবারের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে কথিত আছে যে চেরা রাজাকে প্রভাবিত করে মক্কায় নিয়ে গিয়ে নবীর অনুসারী বানিয়ে, তাঁর দক্ষিণ্যে থিসুরে প্রথম ভারতীয় মসজিদ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু সে এক অন্য ইতিহাস।
যাইহোক, যেমন যেমন ভারতে ইসলামী শাসন কায়েম হতে লাগলো, তেমন তেমন সমাজে মুসলমানদের গুরুত্ব বাড়তে থাকল এবং তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন একধরনের মেকি প্রভুত্বস্বত্তা বিকশিত হতে শুরু করলো, অন্যদিকে নিজেদের ঐতিহ্য বা ভিরাসতকে অস্বীকার করার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাও তীব্রভাবে দেখা দিলো। অনেকেই মনে করেন ১৯০৮ সালে লন্ডনে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানের অবধারণার জন্ম স্যার সৈয়দ আমির আলীর হাত ধরে হয়েছিল। ভুল ধারণা। যেদিন একশ্রেণীর ভারতীয় ভারতের অন্তরাত্মাকে অস্বীকার করলেন, নিজেদের বাপ-ঠাকুর্দার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করলেন এবং সর্বোপরি সমাজের যে চুত্যিরেখা, সেটা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করে দিলেন, সেইদিনই তাত্ত্বিকরূপে পাকিস্তান তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কয়েক শতাব্দী পরে ইংরেজের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি কৃত্তিম দেশরূপে যা বিশ্বের মানচিত্রে গজিয়ে উঠেছিল মাত্র।
যে কারণে এতগুলো কথা বলার প্রয়োজন পড়লো তা হলো আজ যে পাকিস্তানের চরম দৈন্যদশা, মানুষ খেতে পাচ্ছেন না, চতুর্দিকে হানাহানি, রক্তারক্তি সংঘর্ষ, জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, রান্নার গ্যাস নেই, ইন্ধন নেই, যেটুকু টাকা আছে তার প্রায় পুরোটাই ফৌজ কেড়ে নিচ্ছে আর গোটা দেশজুড়ে অনগ্রসরতা এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রদেশে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে - এই সবকিছুর জন্য দ্বিজাতিতত্বই দায়ী। এককালে যে তুর্কিরা ইউরোপে পর্য্যন্ত নিজেদের ইসলামী ক্যালিফেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজকের দিনেও কিন্তু তাদের রাষ্ট্রপতির নাম রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান, কোনো মিয়া মহম্মদ আসলাম শেখ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইসলামী দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির নাম জোকো উইদোদো, কোনো শোয়েব মহম্মদ আখতার নয়। এগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যে বহু দেশ নিজেদের পূজাপদ্ধতির পরিবর্তন করেছে বৈকি, কিন্তু নিজেদের ভিরাসত বা মূল স্বত্তা বিসর্জন দেয়নি, পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিটি ঠিক ধরে রেখেছে। কিন্তু এদের চেয়ে বহুকদম এগিয়ে পাকিস্তানিরা নিজেদের মাতৃভাষাগুলিকে পর্য্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছেন, ওঁদের অনুকরণের স্পৃহা এমনই জোরদার।
এই যে আমি যা নই তা হয়ে ওঠার নিরলস প্রয়াস, যে মায়ের জঠর থেকে আমার জন্ম, সেই মাতৃত্বের ঋণকেই অস্বীকার করা এবং নিজের জাতি, নিজের আত্মীয়, নিজের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করার উপায় হিসেবে স্বজাতিকেই ঘৃণা করতে শেখা - মানে যে যে কাজ এতদিন ধরে পাকিস্তান করে এসেছে, তাতে ওঁদের নিজস্বতা নষ্ট হয়েছে তো বটেই, মানুষের পক্ষে হিতকারী কোনো বিশেষ উদ্ভাবন বা কোনো বিশেষীকরণ বা কোনো বিশেষ দক্ষতার জন্য একটি দেশের যে বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা জন্মায়, তার অভাবে সারা বিশ্বের কাছে ওই দেশটার প্রাসঙ্গিকতাও আজ হারিয়ে গেছে। আসলে পাকিস্তান চিরকাল অর্থের বিনিময়ে বিশ্বশক্তি বা কিছু বড়লোক ইসলামী মুলুকের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ করে এসেছে। আজ যুদ্ধ শেষ, সৈনিকের প্রয়োজনীয়তাও শেষ।
মজার ব্যাপার হলো যে আরবদের আদর্শ করে পাকিস্তান নিজের খোলনলচে বদলে ফেলার চেষ্টায় পঁচাত্তর বছর নষ্ট করলো, সেই আরবরাই এখন আমূল বদলে যাচ্ছেন। সাহেবরা আরবদের দেশে তেল খুঁজে দেওয়ার পর থেকে কিছুদিন আগে পর্য্যন্ত দেদার কাঁচা পয়সার গরমে ইসলামের রক্ষাকর্তা হয়ে যে আরবি শাসকশ্রেণী ভারতীয় উপমহাদেশ সহ আফ্রিকা এবং বিশ্বজুড়ে পন্থপরিবর্তন এবং শরীয়ার শাসন কায়েম করার জন্য কোটি কোটি ডলার ছড়াতো, তারাই এখন তালিবানিদের সাহায্য করতে অস্বীকার করছে আর কারণ দেখাচ্ছে gender justice! ওদিকে আরবদের বাতিল করে দেওয়া ভূতের লেজ ধরে পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলো কিন্তু সেই আগের মতোই তেহরিক এ তালিবান এ পাকিস্তান, তেহরিক এ লাব্বাইক, হিজবুল মুজাহিদ্দীন, লস্কর এ তোয়াবা, গৌরি, গজনবী, গাজওয়া এ হিন্দের প্রতি প্রীতি আর ইহুদি ও হিন্দুর প্রতি দ্বেষ পুরোদমে প্রসব করে চলেছে, যার কোনো ভবিষ্যৎ তো নেইই, উল্টে ওরাই এখন পাকিস্তানকে চোদ্দ'শ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে সত্যিকারের পাক-ঈ-স্তান বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ভারতের মাটিতে এখনো এক মূলতঃ রাজনীতিপ্রসূত শীর্ণকায় বৌদ্ধিক পাকিস্তান বিচরণ করে, যদিও তার বলয় ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। যত উন্নয়নের ধারা প্রসারিত হচ্ছে, যত মানুষ বুঝতে পারছেন যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈষম্য, ভেদাভেদ ইত্যাদির তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং সরকারি প্রকল্পগুলিতেও তার ছাপ সুস্পষ্ট, তত ভয় এবং অবিশ্বাসের মাত্রা কমছে আর মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়ে ওঠার প্ৰচেষ্টাও শুরু হয়েছে, বিশেষত সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে। যত দিন যাবে আর যত বেশি করে সহজলভ্য প্রযুক্তির দৌলতে দুনিয়ার হালহাকিকৎ মুঠোবন্ধি হবে, তত এই মূলধারার সাথে সম্পৃক্ততা বাড়বে এবং পাকিস্তান তত বেশি হারবে। পাকিস্তান কোনো দেশ নয়, পাকিস্তান একটি ধারণা, একটি কল্পনা যার সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্কই নেই। ইংরেজ পাকিস্তান নামক যে কৃত্তিম দেশ তৈরি করেছিল, সেটি ইতিমধ্যেই দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। এবার একবার ভারতকে শেষ মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করার পর পাকিস্তান খন্ড খন্ড হয়ে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য কারণ স্বজাতিবিদ্বেষ ছাড়া তার আর কোনো স্বতন্ত্র ভিত্তি নেই। ওটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো কত দ্রুত সভ্যতার সংকট কাটিয়ে উঠে ঘৃণাকে আমাদের জাতির জীবন থেকে নির্বাসিত করা যায়, যাতে প্রত্যেক ভারতবাসী আবার ভিরাসত সূত্রে পাওয়া প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে প্রকৃত অর্থে উদার, সংবেদনশীল, সর্বসমাবেশী, সমরসতাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় চেতনাসম্পন্ন হিন্দু হয়ে উঠতে পারেন।
No comments:
Post a Comment