ঠাকুর বলেছেন শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি আর শুদ্ধ আত্মা একই জিনিস। প্রতিটিকে আলাদা আলাদা করে বিচার করতে করতে শেষে কেন সেই একই জায়গায় পৌঁছতে হয়, সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। তার আগে আধ্যাত্ম মানে কি সেটা বুঝে নেওয়া দরকার। আত্মা শব্দের একটি অর্থ আমি। আর আত্মার অধ্যয়নই অধ্যাত্ম। আত্ম মানে আমার। তাই একে আত্মবিজ্ঞানও বলা যায়। বাহ্যিক অর্থে 'আমি' মানে দেহে অবস্থিত মন বুদ্ধি আর অহংকারের সমষ্টিগত রূপ। আর স্বরূপ অর্থে 'আমি' মানে আত্মা অর্থাৎ আমার চিরকালীন eternal existential form বা তুরীয় বা চতুর্থম্। ফলে আধ্যাত্মিক পথে চলতে গেলে আমার মন বুদ্ধি আর আত্মার মধ্যে যে interconnection, তাকে বুঝে নেওয়াটা প্রয়োজন বৈকি। অহংকারকে আমরা এই আলোচনা থেকে বাদ রাখবো কারণ যতক্ষণ কর্ম থাকবে ততক্ষণ দেহবোধও থাকবে আর ততক্ষণ অল্প হলেও 'আমি'ভাবও থাকবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ।
য়স্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ॥
অর্থাৎ, অবশ্যই দেহধারী জীবের পক্ষে সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু যিনি সমস্ত কর্মফল পরিত্যাগী, তিনিই বাস্তবিক ত্যাগী বলে অভিহিত হন। (১৮/১১)
মন
The Basic Theory of Mind বইতে মন সম্পর্কে বলা হচ্ছে, 'The mind is one thing that has always fascinated and puzzled us. It is the only thing that we can be certain of existing, yet, apparently, we do not know exactly what it is, how it occurs, and why it occurs. This is in contrast to things outside the mind.' আর বিখ্যাত Merriam-Webstar অভিধানের মতে মনের সাধারণ অর্থ হলো memory বা স্মৃতি আর বিস্তৃত অর্থ হলো 'the element or complex of elements in an individual that feels, perceives, thinks, wills, and especially reasons.' অন্যদিকে বঙ্গীয় শব্দকোষকার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে মনঃ মানে ১. চিত্ত, হৃদয়, মানস, অন্তঃকরণ; ২. মনীষা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা; ৩. মানসশক্তি; ৪. মনঃসাধ্য গায়ত্রীজপাদি; ৫. সংকল্পবিকল্পাত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তি; ৬. ইন্দ্রিয়ের প্রেরক ও আত্মায় ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানের সমর্পক - ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ - ইন্দ্রিয়ানাং মনশ্চামি (গীতা ১০.২২); ৭. ইচ্ছা, কাম; ৮. অন্তঃকরণবৃত্তি, ভাব, অভিপ্রায়। অভিধানকারেরা এই যে মনের এতগুলো অর্থ বের করেছেন, তাতে তিনটি জিনিস common - ১. মন অন্তঃকরণবৃত্তি, ২. মন বহুমুখী, আর ৩. মনের সঙ্গে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং conciousness বা চেতনার সরাসরি যোগ আছে।
বুদ্ধি
Daeyeol Lee তাঁর Birth of Intelligence বই সংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, "Intelligence can be defined as the ability to solve complex problems or make decisions with outcomes benefiting the actor, and has evolved in lifeforms to adapt to diverse environments for their survival and reproduction. For animals, problem-solving and decision-making are functions of their nervous systems, including the brain, so intelligence is closely related to the nervous system." আর বুদ্ধিকে একদম দৈহিকস্তরে সীমাবদ্ধসূচক এইসব কথা বলার ঠিক পরেই তিনি বলছেন, "Intelligence is hard to define, and can mean different things to different people." বোঝা গেল যে ওঁরা artificial intelligence নিয়ে কাজ তো করছেন কিন্তু মনের মতোই intelligence বা বুদ্ধির আসল রহস্যটি এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। আবার হরিচরণের সাহায্য নেওয়া যাক। ওনার মতে বুদ্ধি মানে ১. 'বোধসাধন', মতি, প্রজ্ঞা; ২. নিশ্চয়াত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তি; ৩. প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উপস্থিতবুদ্ধি; ৪. তত্ববিশেষ (সাংখ্য মতে); ৫. আত্মবিষয়প্রজ্ঞা; ৬. বিচারশক্তি, বিবেকশক্তি; ৭. বোধ, জ্ঞান; ৮. প্রত্যয়, বিশ্বাস; ৯. কর্তব্যবিষয়ে উপদেশ; ১০. উপায়; ১১. উপায়োদ্ভাবনের শক্তি; ১২. যুক্তি। এতসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে আবার তিনটি common thread বেরিয়ে আসে: ১. বুদ্ধি অন্তঃকরণবৃত্তি, ২. বুদ্ধি বহুমুখী, আর ৩. বুদ্ধির সাথে মন, বিচারশক্তি, জ্ঞান আর বোধের সরাসরি যোগ আছে।
আত্মা
সাহেবরা যতই ইদানিং hard problem of conciousness নিয়ে মাতামাতি করুন না কেন, আত্মা বা তুরীয় বা চতুর্থম্ (4th One) সম্পর্কে একমাত্র আমাদের বেদান্ত দর্শনই ভরসা। আত্মা হলেন অবস্থাত্রয়ী অর্থাৎ জাগরণ, স্বপ্ন আর সুষুপ্তির অবস্থায় যে অন্তঃস্থিত চতুর্থ স্বতন্ত্র স্বত্তা সবকিছুর আসল দ্রষ্টা বা common factor বা স্বাক্ষী হিসেবে সদাজাগ্রত থাকেন, যিনি মৃত শরীর থেকে নতুন শরীরে transferred হন এবং নিজের সাথে পূর্বজন্মের কর্মফল বহন করে নিয়ে যান, তিনি। আত্মার সবচেয়ে প্রমুখ আভিধানিক অর্থ হলো স্ব, আপনি (Oneself), নিজস্বরূপ, স্বীয়রূপ। আর কি? হরিচরণের লেখনীতে আত্মা মানে ব্যবসয়াত্মিকা অর্থাৎ বুদ্ধি (বুদ্ধিরাত্মা -বেদান্তসার) আর মনঃ অর্থাৎ মন (মনঃ আত্মা -বেদান্তসার)। তার মানে বহুমুখী মন আর বুদ্ধি কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তঃস্থিত একম্ অদ্বিতীয়ম্ আত্মার সমার্থক হয়ে গেল!
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে বেদান্তসার আর গীতার মধ্যে তাহলে কি contradiction তৈরি হয়ে যাচ্ছে না, কারণ গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৪২নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসসন্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।।
অর্থাৎ, স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর আত্মা সেই বুদ্ধির থেকেও শ্রেয়।
এইখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের ওই একটি বিশেষণ বা qualifying factor গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে - 'শুদ্ধ'। এইজন্যই বলে এইযুগে বেদান্তের সার হলো রামকৃষ্ণ কথামৃত। ঠাকুর বলছেন,
(মাস্টারের প্রতি) - "যিনি শুদ্ধ আত্মা, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁতে মায়া বা অবিদ্যা আছে। এই মায়ার ভিতরে তিন গুণ আছে - সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। যিনি শুদ্ধ আত্মা তাঁতে এই তিনগুণ রয়েছে, অথচ তিনি নির্লিপ্ত। আগুনে যদি নীল বড়ি ফেলে দাও, নীল শিখা দেখা যায়; রাঙা বড়ি ফেলে দাও, লাল শিখা দেখা যায়। কিন্তু আগুনের আপনার কোন রঙ নাই।
"জলে নীল রঙ ফেলে দাও, নীল জল হবে। আবার ফটকিরি ফেলে দিলে সেই জলেরই রঙ।
"মাংসের ভার লয়ে যাচ্চে চণ্ডালে - সে শঙ্করকে ছুঁয়েছিল। শঙ্কর যেই বলেছেন, আমায় ছুঁলি! - চণ্ডাল বললে, ঠাকুর, আমিও তোমায় ছুঁই নাই, - তুমিও আমায় ছোঁও নাই! তুমি শুদ্ধ আত্মা - নির্লিপ্ত।
"জড়ভরতও ওই সকল কথা রাজা রহুগণকে বলেছিল।
"শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত। আর শুদ্ধ আত্মাকে দেখা যায় না। জলে লবণ মিশ্রিত থাকলে লবণকে চক্ষের দ্বারা দেখা যায় না।
"যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনিই মহাকারণ - কারণের কারণ। স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ মহাকারণ। পঞ্চভূত স্থূল। মন বুদ্ধি অহংকার, সূক্ষ্ম। প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তি সকলের কারণ। ব্রহ্ম বা শুদ্ধ আত্মা কারণের কারণ।
"এই শুদ্ধ আত্মাই আমাদের স্বরূপ।
"জ্ঞান কাকে বলে? এই স্ব-স্বরূপকে জানা আর তাঁতে মন রাখা! এই শুদ্ধ আত্মাকে জানা।"
শুদ্ধতা
শুদ্ধতা মানে কি? দিনে পাঁচবার স্নান করা, মাথায় গঙ্গাজল ছেটানো, শগরী এঁটো হেগো মুতো - সারাক্ষন এই সব করা না সবসময় ঘর ঝাড়পোঁচ করে কাচা জামাকাপড় পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকা? ওগুলো সবই বাহ্যিক, আসল শুদ্ধতা হলো অন্তরের পরিচ্ছন্নতা আর তা হলো মনকে জাগতিক বস্তুর চাহিদা থেকে সরিয়ে এনে আধ্যাত্মিক চাহিদার দিকে চালিত করা, যাতে আত্মার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়। যে মন এটা করতে পারে সেই শুদ্ধ মন। ঠাকুর বলছেন, "... যোগের বিঘ্ন - কামিনী-কাঞ্চন। এই মন শুদ্ধ হলে যোগ হয়। মনের বাস কপালে (আজ্ঞা চক্রে) কিন্তু দৃষ্টি লিঙ্গ, গুহ্য, নাভিতে - অর্থাৎ কামিনী-কাঞ্চনে! সাধন করলে ওই মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়।" আর এক জায়গায় বলছেন, "কথাটা এই - মন স্থির না হলে যোগ হয় না, যে পথেই যাও। মন যোগীর বশ, যোগী মনের বশ নয়।" এই কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে যে বাহ্যিকভাবে মাথায় গঙ্গাজল ছেটালে যেমন শরীর শুদ্ধ হয় তেমনই মনকে স্থির করতে পারলে মন শুদ্ধ হয় আর ঊর্ধ্বমুখী হয়।
আর শুদ্ধ বুদ্ধি কাকে বলে? যে বুদ্ধি ঠিক বেঠিক, সৎ অসৎ আর ভালো মন্দ বিচার করে মনকে কেবল ঠিক সৎ আর ভালো decision নিতে বাধ্য করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমায়ের একটি কথোপকথন। ঠাকুর একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিয়ে যেতে এসেছ?" মা উত্তর দিয়েছিলেন, "তা কেন, আমি তোমার ইষ্টপথে সহায়তা করতে এসেছি।" এই হলো শুদ্ধ বুদ্ধি, যা মনকে ঊর্ধ্বমুখী হতে প্রেরণা দেয়, জাগতিক temporary অকাজ থেকে focusটা পারমার্থিক দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এখন, ভেবে দেখলে যেহেতু মন বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত, সেহেতু শুদ্ধ মন হতে হলে শুদ্ধ বুদ্ধি হতেই হবে - they are integral to each other and therefore inseparable.
শেষে হলো আত্মা। আত্মা সততই শুদ্ধ কারণ আত্মা হলো সিনেমা হলের সেই পর্দার মতন - তার ওপর কমেডি ছবিই চলুক আর ট্র্যাজেডি, অভিনেতারা প্রেমই করুন বা মারামারি, পর্দার ওসবে কিছুই আসে যায় না - ছবি শেষ আর পর্দাও জিঁউ কে তিঁউ বিলকুল সাফ। ফলে যে শুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত শুদ্ধ মন আধ্যাত্মিক রাস্তায় এগোচ্ছে, সে আখেরে এগোচ্ছেটা কার দিকে? ওই আত্মার দিকে। অর্থাৎ স্ব-এর দিকে, নিজের অক্ষয় স্বীয়রূপের দিকে। যেই যোগ সফল হলো অমনি তো মন বুদ্ধি আর আত্মা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তাই ঠাকুর বলেছেন, "যোগীরা যে স্মরণ মনন করেন তার নাম মনোযোগ। আবার ভাবি কালীঘরে গিয়ে, মা মনও ত তুমি ! তাই শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ আত্মা একই জিনিস"।
মন এবং বুদ্ধি শুদ্ধ হলে বাহ্যিক ভেদাভেদজ্ঞান ঘুচে গিয়ে সাধকের কি আনন্দময় অবস্থা হয় তার বিবরণ ঠাকুর নিজের মুখেই দিয়ে গিয়েছেন, কথামৃত থেকে সেই ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের এই প্রসঙ্গের ইতি টানা যাক।
"শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) - আমার এই অবস্থার পর কেবল ঈশ্বরের কথা শুনিবার জন্য ব্যাকুলতা হত। কোথায় ভাগবত, কোথায় অধ্যাত্ম, কোথায় মহাভারত খুঁজে বেড়াতাম। এঁড়েদার কৃষ্ণকিশোরের কাছে অধ্যাত্ম শুনতে যেতাম। কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বৃন্দাবনে গিছিল, সেখানে একদিন জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। কুয়ার কাছে গিয়ে দেখে, একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করাতে সে বললে, ‘আমি নীচ জাতি, আপনি ব্রাহ্মণ; কেমন করে আপনার জল তুলে দেব?’ কৃষ্ণকিশোর বললে, ‘তুই বল শিব। শিব শিব, বললেই তুই শুদ্ধ হয়ে যাবি।’ সে ‘শিব’ ‘শিব’ বলে জল তুলে দিলে। অমন আচারী ব্রাহ্মণ সেই জল খেলে! কি বিশ্বাস!"
শ্রীরামকৃষ্ণার্পণমস্তু।
No comments:
Post a Comment