Monday, January 9, 2023

নির্বাসনা

দিনকয়েক আগে একজনের বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য গুগুলে একজোড়া smart watch খুঁজেছিলাম, AI সেটা ধরে নিয়ে এখন আমায় রোজই নানারকমের option পাঠিয়ে যাচ্ছে। গতকাল তো আমি প্রায় প্রলভিত হয়েই পড়েছিলাম, পরে সম্বিৎ ফিরতে মনে হলো এত যে গুচ্ছের ঘড়ি পরে আছে, যার অধিকাংশই অব্যাবহারের ফলে ব্যাটারি ফুরিয়ে মৃত, তার ওপর আবার আরো একটা ঘড়ির প্রয়োজনটা কোথায়? মিনিটে মিনিটে পাল্স বিপি ইত্যাদি না দেখেও তো জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে, সেধে চিন্তা বাড়ানো কেন রে বাবা? সত্যি, বাসনা যেন আর কিছুতেই যেতে চায় না, ফাঁক পেলেই টুপ করে মাথাটা তুলে ধরে।  

আমি সার সত্য এই বুঝেছি যে ঈশ্বরের কাছে যদি কিছু চাইতেই হয়, সেটি হলো নির্বাসনা। বিবেক, বৈরাগ্য, ভক্তি ইত্যাদি সব খুব কঠিন কঠিন ব্যাপার, ও সবের মানে বুঝতে বুঝতেই জীবন কেটে যাবে। তবে যেটা বুঝতে কোনো কষ্ট নেই, যা আমাদের দৈনন্দিন অনুভূতি, তা হলো বাসনা বা desire। আমি কোনো কিছু চাইছি কিন্তু পাচ্ছি না - তার থেকে বিরক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, যাদের আছে তাদের সম্পর্কে ঈর্ষা উৎপন্ন হচ্ছে, নিজের ওপর রাগ হচ্ছে আর সেই বেদনা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য না পাওয়ার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে এর-ওর কাছে তাদের নিন্দা করে বেড়াচ্ছি, সবসময় tension, stress, অন্তর্বেদনা, অশান্তি - এগুলো আমাদের প্রাত্যহিক অনুভব।

তাহলে root cause of অশান্তি কি - না বাসনা। বাসনা না থাকলেই নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি - না রাহেগী বাঁশ না বাজেগি বাঁশুরি। তাই ঈশ্বরের কাছে কোনো meaningful বাসনাপূর্তির আবেদন যদি জানাতেই হয়, সেটা কেবলমাত্র নির্বাসনার - desirelessness। উল্টোটাও করা যায় - যা যা কিছু এখানেই রেখে দিয়ে হুশ করে একদিন কেটে পড়তে হবে, খুব করে প্রার্থনা করে সে সবও চাওয়া যায়। ওটা অনেকটা ঘুষখোরের বৌয়ের ঢাঁই পরিমান জামা কাপড় কেনার শখের মতন - আলমারি উপচে পড়ছে, রাখার জায়গা নেই, অতগুলো পরার মতন occassion-ও নেই, তবু সমানে কিনে যাচ্ছে - কি, না অভ্যেস। শেষে থেকে থেকে পোকায় কাটবে অথবা পি‌ঁজে যাবে, নিজেরও কোনো কাজে কোনোদিন লাগবে না। 

একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে যে আসলে দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য আমাদের প্রয়োজন অত্যন্ত অল্প। এই কোভিডের সময় আমরা সকলেই কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইনি? যেটুকু দরকার, শরণাগত হলে সেটুকু মা ঠিকই জুটিয়ে দেবেন, ওটাই প্রকৃতির নিয়ম। এত যে কোটি কোটি কীট পতঙ্গ পশু পাখি, ওদের কি আর আমরা খাওয়াই না ওদের বাসস্থান আমরা বানিয়ে দিই - ওরা কি সব না খেয়ে মরে? অভাব আর অভাববোধ এক জিনিস নয়। আমাদের সত্যিকারের কোনো অভাব নেই, অভাববোধ আছে, যা পশুপাখিদের নেই। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেতে চাই, স্বাভাবিকভাবে না পেলে ছিনিয়ে নিতে চাই, তাও না পারলে লজ্জায় ঘেন্নায় ঈর্ষায় stress এ জ্বলেপুড়ে মরি - কেন রে বাবা? একজায়গায় আমি নিজের চোখে দেখেছি ভিখারিরা territory ভাগাভাগি নিয়ে ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল আর ট্যাম খাওয়া ঘটিবাটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে - ভিক্ষা করবে, সেখানেও অধিকারবোধ!

শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে বইটিতে মায়ের সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা বর্ণিত আছে, যা এখানে উধৃত করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 'একজন বাছাই করা দুটি সেরা আম নিয়ে এসেছেন। মা চাইছিলেন আমি (ভগিনী দেবমাতা) ঐ আম দুটি নিয়ে যাই। কিন্তু আমি রাজি হলাম না, কারণ জানতাম, সেগুলি শেষ মরশুমের আম, আর মা আম খুব ভালবাসেন। বললাল, “আম দুটি আপনি নিজে রাখলে আমার বেশী আনন্দ হবে।” মা চকিতে বললেন, “আমি রাখলে তােমার আনন্দ, আর তুমি নিলে আমার আনন্দ, কার আনন্দ বেশী হবে তুমি মনে কর?” আমার মুখে তখনই কথা জুগিয়ে গেল, “মা, আপনার আনন্দই বেশী হবে, কারণ আপনার অনেক বড় মন।” জবাব শুনে মা খুশি হলেন।' অধিকারবোধ যদি থাকতেই হয়, তাহলে তা কেমন হবে সেটি মায়ের গোটা জীবন ধরে এরকমের নানান ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সহজে শেখা যায়।

আমার পরম পূজনীয় গুরুদেব শ্রীশ্রীমায়ের সন্তান ছিলেন, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। দিব্যজীবনের অধিকারী এক মাতৃভক্ত রামকৃষ্ণময় সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, কোনো পাপের সাধ্য নেই তাঁকে স্পর্শ করে, অথচ শেষ বয়সে তাঁকে দেখেছিলাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীন এক শারীরিক অবস্থায়, যা কর্মফল অনুযায়ী মোটেও তাঁর প্রাপ্য নয়। তাহলে তিনি এত ভুগলেন কেন? কারণ সদগুরু জেনেশুনে শিষ্যের negative কর্মফল শুষে নেন আর তার effect তাঁদের দিব্যশরীরের ওপর দিয়েই বয়ে যায়। গুরু এই অযাচিত কৃপা এই কারণে করেন যাতে শিষ্য নিশ্চিন্তে তার ভাগের সাধনভজনটুকু করতে পারে, তাকে জাগতিক বিষয়ে আর বেশি গেঁথে না থাকতে হয়। প্রয়োজনের ভার তো মা নিয়েই আছেন, গুরু যাপনটুকুও কত সহজ করে দেন, তবু আমরা আমাদের ভাগের কাজটুকু আর করি কৈ? ওই এক বাসনা অসুর, ওটাকে যে কিছুতেই control করতে পারিনা, ফলে গুরু ইষ্ট মিলে পথ এত সহজ করে দেওয়া স্বত্তেও আমরা আসল ফেলে নকলের পেছনে দৌড়ে মরি। মা তাঁর এক অল্পবয়স্ক বিধবা শিষ্যাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, "মা, আমার নাম ডােবাসনি। শিষ্যের পাপ গুরুতে লাগে। খুব সাবধানে থাকবি।" এই বিপথ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র রাস্তা নির্বাসনা, পেলেই কেল্লা ফতে।

তবে মানুষের মন তো, দুর্বলতা আসবেই, একেবারে বাসনাহীন হওয়া কি আর যায়? শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে বইটি থেকে আর একদিনের কথোপকথন follow করলে কিভাবে এই রাস্তায় হাঁটতে হবে, তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। 'একদিন উদ্বোধনে চন্দন ঘষছি, মা উত্তরদিকের দরজার ধারে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে মুখ করে মালা জপ করতে বসেছেন। কেউ নেই দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়ে পড়ে কেন?” তিনি শুনেই মালা রেখে বললেন, “ওদিকে নজর দিও না, কার মনে দুর্বলতা না আসে এক ঠাকুর ছাড়া? আজ পর্যন্ত এমন কোনও মহাপুরুষ জন্মেছেন কি, যার মনে কখনাে কোনও দুর্বলতা ওঠে নি? যদি শুধরােবার চেষ্টা থাকে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, আমার মনে দুর্বলতা উঠেছে—তাহলে ঐ জিনিষটাই একটা মস্ত শিক্ষা, মহামায়া খুশি হয়ে তখন তাকে পথ ছেড়ে দেন। মানুষ কিছুদিন ভাল থাকলেই মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, আরও উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিবেকীর মনেও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দিয়েই ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখনাে সাধনা শেষ হয়নি, ভূত-প্রেত সব ওত পেতে চারপাশে বসে আছে, সুবিধে পেলেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এতে হয়কি, অহঙ্কার নষ্ট হয়। যতদিন বাঁচবে সাবধানে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে থাকবে, অহঙ্কার হলেই ঐ সব হিজিবিজি মনে উপস্থিত হবে। শেষ পর্যন্ত শরণাগতির ভাব নিয়ে থাকতে হয়। ঠাকুর একবার নিজের শরীরে কামের বেগ ধারণ করে দেখালেন, জীবের অহঙ্কার করবার কিছুই নেই।”

No comments:

Post a Comment