বেদান্তে তিন রকমের মুক্তির কথা বলা হয়েছে - আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক আর আধিভৌতিক অর্থাৎ নিজের মনের প্রভাব থেকে মুক্তি, সমাজের প্রভাব থেকে মুক্তি আর প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্তি। আমি ঠিক জানিনা একেবারে জীবনচক্র থেকেই মুক্তির ইচ্ছেটা ঠিক কোন সময় আমাদের bucketlist এ ঢুকে পড়েছে, কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে যে আসল মুক্তি তখনই হয় যখন ব্যক্তিস্বত্তা সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে - বাইরের সম্পদের বদলে ধীরে ধীরে অন্তরের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হওয়াই তো শ্রেয় কারণ বাইরেরটা temporary, শরীরভিত্তিক, আর অন্তরেরটা permanent।
পাপ-পুণ্যের ফর্মুলা তো সেই কোন আদ্যিকালে ব্যাসদেব নিজেই বলে দিয়ে গিয়েছেন - 'পূণ্যায় পরোপকরায়, পাপায় পরপীড়নম্', অর্থাৎ পরোপকার করলে পূণ্য হয় আর পরকে উৎপীড়ন করা হলো পাপ। যেহেতু পাপ আর পুণ্যের সাথে প্রারব্ধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে, ফলে মুক্তির perspective থেকেও এদুটিকে ignore করার উপায় নেই। এখন, কারো পুণ্যলাভের মাধ্যমে যদি জগতের কল্যাণ হয় তাহলে তো পুণ্যাত্মারা বারেবারে শরীর ধারণ করতেই চাইবেন, মাঝপথে সব মজা ছেড়ে-ছুঁড়ে খামোখা পালাতে চাইবেন কেন?
এ ব্যাপারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমায়ের একদিনের কথোপকথন মা নিজমুখে একবার বলেছিলেন। "ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, "দেখো, এরপর ঘরে ঘরে এর (ঠাকুরের) পুজো হবে। পরে দেখবে - একেই সবাই মানবে, তুমি কোনো চিন্তা করো না। মাইরি বলছি - বাপান্ত দিব্যি।" তাঁর অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আসবে, যেমন এখন সব খ্রিস্টানরা আসছে না। ঠাকুর বলেছিলেন যে একশো বছর পরে আবার আসবেন। এই একশো বছর সূক্ষ্মশরীরে ভক্ত-হৃদয়ে থাকবেন। গোলবারান্দা হতে বালি উত্তরপাড়ার দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন। আমি বললুম, "আমি আর আসতে পারব না।" লক্ষী বলেছিল, "আমাকে তামাক-কাটা করলেও আর আসব না।" ঠাকুর হেসে বললেন, "যাবে কোথা? কলমির দল একজায়গায় বসে টানলেই সব এসে পড়বে।" এর ওপরে তো আর কথা হয় না, তাই না?
এখন, পাপ-পূণ্যর থিওরি থেকে মাটিতে নেমে এসে দৈনন্দিন জীবনে ভালো আর মন্দের বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক। এক্ষেত্রেও underlying theme ওটাই - যাতে কারো মঙ্গল হয় তা ভালো আর যাতে কারো ক্ষতি হয় তা খারাপ। আজকেই দেখলাম একটা লোক মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে ফুটপাথে পড়ে আছে। ভর সন্ধ্যেবেলায় নেশা করে out - কি খারাপ কাজ, তাই না? যদি ধরে নিই যে ঐ মানুষটির কোনো পিছটান নেই তাহলে সে তো আর অন্য কারো ক্ষতি করেনি, নিজে বুঁদ হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছে। হ্যাঁ, সে যদি নেশার চোটে মারামারি করতো, বা কাউকে কটু কথা বলতো বা মদের পয়সা জোটাবার জন্য চুরিচামারি করতো, তাহলে অবশ্যই সে অন্যের ক্ষতি করতো এবং সেক্ষেত্রে কাজটা একেবারেই ভালো হতো না।
তার মানে কি নেশা করা উচিত? মোটেই না, কারণ তা শরীর ও মনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা পারম্পরিকভাবে যেগুলোকে ভালো বা খারাপ কাজ বলে জানি সেগুলো যে আদপেই পাপ বা পুণ্যের সাথে aligned নয়, হবে যে তারও কোনো স্থিরতা নেই, সেটাই বোঝাবার চেষ্টা করছি মাত্র। অমুক মটরসাইকেল ছেড়ে নতুন গাড়ি কিনেছে শুনলে প্ৰথমেই যে জিনিসটা মাথায় আসে তা হলো, 'ভালো করেছে'। এটা কি মাথায় আসে যে সেই গাড়িটি অসৎ পথে রোজগার করা টাকা থেকেও কেনা হয়ে থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সেটা মোটেই ভালো কাজ হয়নি, বরং গর্হিত অপরাধ? বোধহয় না, কারণ আমাদের ভালো-মন্দ বিচারের মানক সবসময় morality নির্ভর নয়, ধর্মবোধ আধারিত নয়, পাপ-পুণ্যের বোধ থেকে অনেকসময়ই আলাদা।
এবার মূল বক্তব্যে আসি। রামকৃষ্ণ মিশনের লোগো আঁকার সময় স্বামীজী তার তলায় লিখেছিলেন, 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' - নিজের মোক্ষ এবং জগতের কল্যাণের জন্য। তার মানে জগতের কল্যাণের মাধ্যমেই নিজের মুক্তি বা মোক্ষলাভ সম্ভব - সেই বেদব্যসের পুণ্যের পুরানো ফর্মুলা যাকে ঠাকুর অনেকধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে 'শিবজ্ঞানে জীবসেবা'র সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। আমি গুহার মুখে পাথর এঁটে ভেতরে পড়ে আছি আর বাইরে অসহায় অসুস্থ মানুষ সেবা ও সাহায্যের অভাবে কাতরাচ্ছে - কোন যুক্তিতে এইরকম একজন স্বার্থপরের মুক্তিলাভ হবে? তারা কি আমার থেকে আলাদা, তাদের মধ্যে কি সেই একই অনন্ত চেতনা কাজ করছে না, তাহলে? এই যে মানুষের শরীর পাওয়া, এর দ্বারা যদি মানুষের উপকারই না হলো, তাহলে এ শরীরের স্বার্থকতাই বা কি আর এই মানবজীবনের উদ্দেশ্যসাধনেরই বা কি?
গাজীপুর থেকে স্বামীজীর প্রমদাবাবুকে ৩রা মার্চ, ১৮৯০ সালে লেখা চিঠিতে দেখছি তিনি শুরুতেই লিখছেন, 'আপনি জানেন না—কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই, কত চেষ্টা করি যে, খালি আপনার ভাবনা ভাবি। কিন্তু বারংবার পরের ভাবনা ভাবিয়া ফেলি। এবার বড় কঠোর হইয়া নিজের চেষ্টার জন্য বাহির হইয়াছিলাম—এলাহাবাদে এক ভ্রাতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া অমনি ছুটিতে হইল।' এই তো এক আদর্শ মহাজীবন, যিনি মায়া মায়া নেতি নেতি করে কাঁদুনি না গেয়ে মানুষের সেবায় নিজের প্রাণপাত করে আধুনিক যুগের আদর্শ ব্রহ্মজ্ঞ মহাতাপস হয়েছেন এবং জীবের কল্যাণের জন্য হাজার বার জন্ম নিতেও পিছপা নন, বরং আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
মোক্ষ তো আর গাছ থেকে পড়বে না, ওই বোধ ধীরে ধীরে নিজের ভেতর থেকেই উৎসারিত হবে - it is an internal transformation emanating from within. আমার যদি অহংবোধ এবং স্বার্থবোধ প্রবল হয়, আমি যদি নিজের শরীরের বাইরে একই মহাশক্তির প্রকাশ জগৎ সংসারকে আপন না ভাবতে পারি, তাদের দুঃখে কাঁদতে না পারি, তাদের আনন্দে নাচতে না পারি, তাহলে আমার আধ্যাত্মিক journey শুরু করবো কোন বিন্দু থেকে?
আমরা, ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত অশিক্ষিতরা, আব্রাহামিক মতবাদগুলির প্রভাবে একটা সম্পূর্ণ ভুল notion এর বশে সাধারণত ভেবে থাকি যে ঈশ্বর এখানে নেই স্বর্গে আছেন, এখনই নয়, তাঁর সাথে শেষ বিচারের দিন দেখা হবে এবং তিনি আর আমি দুটি ভিন্ন স্বত্তা। আমাদের নিজেদের বেদান্ত কিন্তু এর ঠিক উল্টো কথাটা বলে, যা যুক্তিগ্রাহ্য inference, blind faith এর কোনো ব্যাপার নেই। বলে তিনি এখানেই আছেন, এখনই আছেন এবং আমি তিনিই এবং সেটা আমাদেরই দৈনন্দিন অনুভূতির ভিত্তিতে আবার প্রমাণও করে দেয়। তাই ঠাকুরের পথ ধরে স্বামীজী বলেছেন ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য - নির্গুণ স্বগুণ সবই এক - একম্ সৎ। আমিই যদি সব হয়েছি তাহলে কার থেকে পালাবো রে বাবা?
পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী প্রেমেশানন্দজী মহারাজ একটি চিঠিতে একজায়গায় লিখছেন,
'ঠাকুর পরাবিজ্ঞানের সব রহস্যই এবার বিশ্বসভায় উদ্ঘাটিত করিয়াছেন৷ তিনি সর্বজীবের ভিতরে, জগতের সর্বত্র এক চিদবস্তুকে দেখিতেছেন৷ চিৎ ছাড়া যে অন্য কোন বস্তু থাকিতেই পারে না৷ অন্য কোন বস্তু আছে, বোধ করাই ব্রহ্মকে সীমাবদ্ধ করা৷ ইহা চরমজ্ঞান, চরম অনুভূতি৷ ঠাকুর ছাড়া কেহ ইহা এত সুস্পষ্ট করিয়া মানবজাতিকে কখনও দেখান নাই।' সত্যিই তো, ঠাকুরের চেয়ে সহজবোধ্য করে 'জগজ্জননী জগন্মাতা মহামায়ার লীলাপোষ্টাই'কে কেই বা আর আমাদের মতন নিরেট জীবসেবার বদলে জিবসেবারত অর্বাচীনদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন?
No comments:
Post a Comment