সবাইকে ৭৪তম গণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। আজ কর্তব্যপথের বুকে ভারতরাষ্ট্রের যে সুন্দর পরম্পরাশ্রয়ী ছবিটা আঁকা হলো সেটা আমাদের দেশীয় সামরিক শক্তিপ্রদর্শনের সাথে সাথে রাষ্ট্রের ইতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী বিবিধের মাঝে ঐক্যের বার্তাবহনকারী। এটাই আমাদের পুণ্যভূমি থেকে উঠে আসা জাতীয় উত্তরাধিকার আর এটাই আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয়।
আজ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নতুন করে We the people এর সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিন। কোন people? যারা ভারতীয় গণ। কারা ভারতীয় গণ? যারা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, সমন্বিত সংস্কৃতি ও ধর্মসংস্কারের ধারক ও বাহক বলে গৌরবান্বিত বোধ করেন।
বাকিরা resident হতে পারেন কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতিতে সম্পুর্নরূপে লীন না হতে পারার কারণে রাষ্টের তো বটেই, নেশনের citizen হবার যোগ্যতাও এখনো অর্জন করেননি - হয়তো তাঁদের মনে এখনো বিপরীত কোনো বিজাতীয় ধারাকে প্রাধান্য দেবার দ্বন্দ্ব গেঁথে আছে। ফলে ভারতের গণতন্ত্র দিবস যাদের জন্য, তাঁরা বাকিদের ভারতীয়ত্বের যোগ্য হয়ে ওঠার ব্যাপারে আরো প্রচেষ্ট হবেন, গণতন্ত্র দিবসের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
গভীর সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক স্বাতন্ত্রবোধ সম্পন্ন যে কোনো বিশেষ জনসমাজই হলো জাতি। আর এরকম অনেক জনসমাজের সমষ্টি হলো নেশন। নেশন শব্দটি জেনেশুনেই ব্যবহার করলাম কারণ নেশনের বাংলা অনুবাদস্বরূপ জাতি লেখা হলেও, জাতি মোটেও নেশন নয় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নেশন শব্দটিই ব্যবহার করতেন, জাতি শব্দটি নয়।
এতগুলো কথা বলার কারণ এই, যে নেশন এবং রাষ্ট্রের অবধারণা বুঝতে গেলে উপজাতি, জাতি, নেশন বা দেশ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার। ভারতীয় নেশন হলো বিভিন্ন অঙ্গপ্ৰতঙ্গ মিলিয়ে একটা শরীর, একটা big melting pot আর হিন্দুত্ব বা Hinduness হলো তার প্রাণ। হিন্দু মানে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার উত্তরাধিকারি citizen, যার প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে।
ইংরেজিতে Nation বলতে বোঝায় 'a large body of people united by common descent, history, culture, or language, inhabiting a particular country or territory'. এই পরিভাষা অনুযায়ী তো দক্ষিণ-রাঢ়ি, মিজো, তামিল, কোঙ্কানি, বিদর্ভি, মৈথিলি ইত্যাদি সব আলাদা আলাদা জাতি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা তো নয়, এগুলো কেবল উপজাতিগত পরিচয়। রাষ্ট্র একটা magical word, জাতির চশমা পরে দেখলে যাকে বোঝা মুস্কিল।
হিন্দুত্বের নানাদিকের একটা দিক হলো তার বিশিষ্ট রাষ্ট্রচেতনা - তার প্রাচীন ইতিহাস, তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, তার ধর্মবোধ, সব মিলেমিশে হিন্দু হয়ে ওঠা যেমন রোমান, গ্রিক, মিশরীয় ইত্যাদিদেরও সভ্যতাভিত্তিক বিশিষ্ট পরিচয় আছে। এই সভ্যতার legacyকে অস্বীকার করে চার্চিল India সম্পর্কে তাঁর ভ্ৰান্তধারণা অনুযায়ী বলেছিলেন যে, ‘India is a geographical expression…. No more a single country than the Equator.’ কিছু ভারতীয় এখনো এই কথাতেই বিশ্বাস করেন, ফলে তারা এখনো ভারতীয় citizen বা হিন্দু হয়ে উঠতে পারেননি, Indian হয়েই রয়ে গেছেন।
চার্চিল একটা unitarian উপজাতির কথা বলছেন, নেশনেরও নয়, রাষ্ট্রের নয়। আর ভারত কেবল একটা নেশন নয়, একটি মহান রাষ্ট্র, হিন্দুরাষ্ট্র, যার ভূগোল আজ বিভক্ত হলেও, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এক। তাই সাভারকার সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে, 'Hindu is one who considers India to be his motherland (matrbhumi), the land of his ancestors (pitrbhumi), and his holy land (punya bhumi)', যা চার্চিলের অবধারণার চেয়ে একেবারে উল্টো।
আমরা হলাম গণতন্ত্রের মাতৃভূমি। এর বিস্তারিত ইতিহাসে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই, কিন্তু গণতন্ত্র সেই বৈদিক যুগ থেকেই মূল ভারতীয় হিন্দু জীবনশৈলীর অবিচ্ছেদ্য সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গ। ফলে, আজ যখন নতুন করে গণতন্ত্র দিবস পালিত হয়, তখন একে হিন্দু সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে কারণ পরবর্তীকালে বাইরে থেকে যে authoritarianism আমদানিকৃত হয়েছে, তা আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির basic tenet-এর বিরোধী। আমাদের বালি আর কংসকে বধ করা থেকে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে হারিয়ে দেওয়া পর্য্যন্ত একটা বহু হাজার বছরের ইতিহাস আছে।
ভারত এখন বিশ্বগুরু হিসেবে নতুন করে আবার নিজের পুরানো ভূমিকা পালন করার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সাংস্কৃতিকভাবে অখন্ড ভারত কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এইসময়, যারা দেশে থাকেন, তাদের সবাইকেই যদি আমরা এক ছাতার তলায় আনতে না পারি তাহলে যারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের একত্রিত করবো কি করে? তাই প্রত্যেক ভারতবাসীর উচিত প্রজা থেকে রাজা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজেরা তো সামিল হবেনই, বাকিদেরও হাত ধরে সেই রথে টেনে তুলবেন। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস লেগে থাকলে একদিন না একদিন এই লক্ষ্য ঠিকই হাসিল হবে।
No comments:
Post a Comment