প্ল্যেটো বলছেন যে দুঃখের অভাবকেই আমরা সুখ বা আনন্দ বলে মনে করি। আসলে সুখ এবং দুঃখ থেকে সমদূরত্বের যে বিন্দু, যাকে neutral point বলা যেতে পারে, ভেবে দেখলে সেটা আসলে দুঃখ থেকে দুঃখাভাব পেরিয়ে এসে যে মানসিক অবস্থা - সেটা। আসল সুখ বা আনন্দ পেতে গেলে সেই জায়গা থেকে এগিয়ে যেতে হবে অনেকটাই, যা আমাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয়তো সারা জীবনে অনুভব করা সম্ভবই হয়ে ওঠে না। তাজা উদাহরণ আছে। আমাদের বড় ছেলে অনেক দূরে থাকে, তাকে ইচ্ছে করলেই আমরা দেখতে পাইনা, তাই সবসময় একটা ক্ষিণ না পাওয়ার বেদনা কাজ করে মনের ভেতর। গত পরশু সে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসেছে - কি আনন্দ! আসলে ঘটনাটা কি ঘটলো? দূরে ছিল - দুঃখ ছিল, কাছে এলো - সেই দুঃখবোধ চলে গেল, এরপর বেশিদিন কাছে থাকলে আবার সব ব্যাপারে সর্দারি ফলাতে শুরু করবে, তখন সহ্য করা কঠিন আর তখন মনে হবে অনেকদিন তো হলো, কবে যাবে রে বাবা - এই তো। তাহলে সত্যিকারের সুখ হলো কই?
এবার প্রশ্ন উঠবে, সুখ তাহলে কি? তৈত্তিরীয় উপনিষদে আমরা পাই যে আমাদের উৎপত্তি আনন্দ থেকে, যাপন আনন্দে এবং নিষ্পত্তিও আনন্দেই।
আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি, ভূতানি, জায়ন্তে,
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি,
আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। (তৈঃ উঃ ৩/৬/১)
'সেই সর্বব্যাপী আনন্দ হইতেই এই সমস্ত প্রাণী জন্মিতেছে, সেই সর্বব্যাপী আনন্দের দ্বারাই এই সমস্ত প্রাণী জীবিত আছে, সেই সর্বব্যাপী আনন্দের মধ্যেই ইহারা গমন করে, প্রবেশ করে।' তা, এত আনন্দসাগরের মধ্যে থেকেও আমরা তাকে ছুঁতে পারিনা কেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ধর্মের সরল আদর্শ' প্রবন্ধে বিষয়টি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছেন।
'যাহা ধারণা করিতে পারি, তাহাতে আমাদের তৃপ্তির অবসান হইয়া যায়, যাহা ধারণা করি, তাহাতে প্রতিক্ষণে বিকার ঘটিতে থাকে। সুখের আশাতেই আমরা সমস্তকিছু ধারণা করিতে যাই, কিন্তু যাহা ধারণা করি, তাহাতে আমাদের সুখের অবসান হয়। এইজন্য উপনিষদে আছে—
যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নাল্পে সুখমস্তি।
যাহা ভূমা তাহাই সুখ, যাহা অল্প তাহাতে সুখ নাই।
সেই ভূমাকে যদি আমরা ধারণাযোগ্য করিবার জন্য অল্প করিয়া লই, তবে তাহা দুঃখসৃষ্টি করিবে,—দুঃখ হইতে রক্ষা করিবে কী করিয়া? অতএব সংসারে থাকিয়া ভূমাকে উপলব্ধি করিতে হইবে, কিন্তু সংসারের দ্বারা সেই ভূমাকে খণ্ডিত-জড়িত করিলে চলিবে না।
'একটি উদাহরণ দিই। গৃহ আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয়, তাহা আমাদের বাসযোগ্য। মুক্ত আকাশ আমাদের পক্ষে সেরূপ বাসযোগ্য নহে, কিন্তু এই মুক্ত আকাশকে মুক্ত রাখাই আমাদের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। মুক্ত আকাশের সহিত আমাদের গৃহস্থিত আকাশের অবাধ যোগ রাখিলেই তবেই আমাদের গৃহ আমাদের পক্ষে কারাগার, আমাদের পক্ষে কবরস্বরূপ হয় না। কিন্তু যদি বলি, আকাশকে গৃহেরই মতো আমার আপনার করিয়া লইব—যদি আকাশের মধ্যে কেবলই প্রাচীর তুলিতে থাকি, তবে তাহাতে আমাদের গৃহেরই বিস্তার ঘটিতে থাকে, মুক্ত আকাশ দূর হইতে সুদূরে চলিয়া যায়। আমরা যদি বৃহৎ ছাদ পত্তন করিয়া সমস্ত আকাশকে আমার আপনার করিয়া লইলাম বলিয়া কল্পনা করি, তবে আলোকের জন্মভূমি, ভূর্ভুবঃস্বর্লোকের অনন্ত ক্রীড়াক্ষেত্র আকাশ হইতে নিজেকে বঞ্চিত করি।
'যাহা নিতান্ত সহজেই পাওয়া যায়, সহজে ব্যতীত আর-কোনো উপায়ে যাহা পাওয়া যায় না, নিজের প্রভূত চেষ্টার দ্বারাতেই তাহাকে একেবারে দুর্লভ করিয়া তোলা হয়। বেষ্টন করিয়া লইয়া সংসারের আর-সমস্ত পাওয়াকে আমরা পাইতে পারি,—কেবল ধর্মকে, ধর্মের অধীশ্বরকে বেষ্টন ভাঙিয়া দিয়া আমরা পাই। সংসারের লাভের পদ্ধতিদ্বারা সংসারের অতীতকে পাওয়া যায় না। বস্তুত যেখানে আমরা না পাইবার আনন্দের অধিকারী, সেখানে পাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া আমরা হারাই মাত্র। সেইজন্য ঋষি বলিয়াছেন—
যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কুতশ্চন॥
মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া নিবৃত্ত হয়, সেই ব্রহ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় পান না।'
Note: ভূমা মানে পূর্ণ; ওই যে 'পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।' - সেই পূর্ণ, পরব্রহ্ম।
No comments:
Post a Comment