৫ই অগাস্ট ১৮৮২ সাল, শনিবার ছিল। সেদিন বিকেল ৪টের সময় শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজে যেচে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে দেখা করতে তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে, ছিলেন রাত ৯টা পর্য্যন্ত। পাঁচ ঘণ্টা বড় কম সময় নয়, নিশ্চয় অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। দশ বারো পাতায় সেই সাক্ষাৎকারের নির্যাসটুকু প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীম ধরে রেখেছেন কথামৃতে। এই বিদ্যাসাগরের religiosity কেমন? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে শ্রীম বর্ণনা করছেন, 'ধর্ম-বিষয়ে বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না। তিনি দর্শনাদি গ্রন্থ পড়িয়াছিলেন। মাস্টার একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আপনার হিন্দুদর্শন কিরূপ লাগে?” তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার তো বোধ হয়, ওরা যা বুঝতে গেছে, বুঝাতে পারে নাই।” ঈশ্বর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের ধারণা কেমন ছিল তাও উনি শ্রীমর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। শ্রীম জিজ্ঞেস করেছিলেন, "ঈশ্বর সম্বন্ধে কিরূপ ভাবেন"। বিদ্যাসাগর বলিয়াছিলেন, “তাঁকে তো জানবার জো নাই! এখন কর্তব্য কি? আমার মতে কর্তব্য, আমাদের নিজের এরূপ হওয়া উচিত যে, সকলে যদি সেরূপ হয়, পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে।" এই সেই বিদ্যাসাগর যিনি একসময় পাঠ্যক্রমে ভারতীয় দর্শনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে সাহেবদের বলেছিলেন, "That samkhya and vedanta are false statement of philosophy is no more in dispute. There is nothing substantial in them"।
দেখছি এই মানুষটাকে ঠাকুর যেন হাত ধরে ধীরে ধীরে confusion থেকে resolution-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তা দেখাচ্ছেন। বলছেন, “তাঁকে কি বিচার করে জানা যায়? তাঁর দাস হয়ে, তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁকে ডাক।
(বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে) — “আচ্ছা, তোমার কি ভাব?”
বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব।” (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — তাঁকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।
খানিকক্ষণ পর দেখছি কর্মযোগী ঈশ্বরচন্দ্রের ভেতরের ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার সহজ উপায় বাতলে দিচ্ছেন,
"তুমি যে-সব কর্ম করছ এতে তোমার নিজের উপকার। নিষ্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালবাসা এলেই তাঁকে লাভ করতে পারবে। জগতের উপকার মানুষ করে না, তিনিই করছেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য করেছেন, যিনি মা-বাপের স্নেহ, যিনি মহতের ভিতর দয়া, যিনি সাধু-ভক্তের ভিতর ভক্তি দিয়েছেন। যে-লোক কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করবে সে নিজেরই মঙ্গল করবে।
“অন্তরে সোনা আছে, এখনও খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে। যদি একবার সন্ধান পাও, অন্য কাজ কমে যাবে। গৃহস্থের বউ-এর ছেলে হলে ছেলেটিকেই নিয়ে থাকে; ওইটিকে নিয়েই নাড়াচাড়া; আর সংসারের কাজ শাশুড়ী করতে দেয় না। (সকলের হাস্য)
“আরও এগিয়ে যাও। কাঠুরে কাঠ কাটতে গিছিল; — ব্রহ্মচারী বললে, এগিয়ে যাও। এগিয়ে গিয়ে দেখে চন্দনগাছ। আবার কিছুদিন পরে ভাবলে, তিনি এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, চন্দনগাছ পর্যন্ত তো যেতে বলেন নাই। এগিয়ে গিয়ে দেখে রূপার খনি। আবার কিছুদিন পরে এগিয়ে গিয়ে দেখে, সোনার খনি। তারপর কেবল হীরা, মাণিক। এই সব লয়ে একেবারে আণ্ডিল হয়ে গেল।
“নিষ্কামকর্ম করতে পারলে ঈশ্বরে ভালবাসা হয়; ক্রমে তাঁর কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায়। ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া যায়, যেমন আমি তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি!” (সকলে নিঃশব্দ)
কথায় কথায় রাত ৯টা বেজে গেছে, ঠাকুর যখন উঠবো উঠবো করছেন, তখনও বিদ্যাসাগর ওঁকে ছাড়তে চাইছেন না। ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার নিমন্ত্রণে নিজেকে সরিয়ে রেখে রাসমণির বাগান দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যকেই তুলে ধরছেন তখন বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করছেন, "সে কি! এমন কথা বললেন কেন? আমায় বুঝিয়ে দিন।" এর থেকেই বোঝা যায় যে নিজের থেকে বয়সে ১৬/১৭ বছরের ছোট প্রায় নিরক্ষর এক গ্রাম্য পুরোহিতের সাথে ওই একটি সাক্ষাৎকারেই অত বড় একজন ভারতবিখ্যাত মানী মহাপন্ডিতের মনের মধ্যে কি ঝড় উঠেছিল। সেদিন যে শ্রীরামকৃষ্ণই কথক আর বাকিরা মূলত শ্রোতা সেটি সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে বিদ্যাসাগরের বাড়ির একতলার বাগানে অপেক্ষমান বলরাম বসুর কথাতেই স্পষ্ট। শ্রীম লিখছেন, 'ঠাকুর বলিলেন, “বলরাম! তুমি? এত রাত্রে?”
বলরাম (সহাস্যে) — আমি অনেক্ষণ এসেছি, এখানে দাঁড়িয়েছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভিতরে কেন যাও নাই?
বলরাম — আজ্ঞা, সকলে আপনার কথাবার্তা শুনছেন, মাঝে গিয়ে বিরক্ত করা।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাথে বিদ্যাসাগরমশাইয়ের কথোপকথন অথবা সেদিনের ঘটনাক্রমকে শ্রীম মোট ৭টি পরিচ্ছেদে, বিশটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন:
১. শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের পূজা ও সম্ভাষণ
২. বিদ্যাসাগরের সাত্ত্বিক কর্ম — “তুমিও সিদ্ধপুরুষ”
৩. ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানযোগ বা বেদান্ত বিচার
৪. Problem of Evil — ব্রহ্ম নির্লিপ্ত — জীবেরই সম্বন্ধে দুঃখাদি
৫. ব্রহ্ম অনির্বচনীয় অব্যপদেশ্যম্ — The Unknown and Unknowable
৬. ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ — নির্বিকল্পসমাধি ও ব্রহ্মজ্ঞান
৭. জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ — এই তিনের সমন্বয় — Reconciliation of Non-Dualism, Qualified Non-Dualism and Dualism.
৮. বিভুরূপে এক — কিন্তু শক্তিবিশেষ
৯. শুধু পান্ডিত্য, পুঁথিগত বিদ্যা অসার — ভক্তিই সার
১০. ভক্তিযোগের রহস্য — The Secret of Dualism
১১. বিদ্যাসাগরকে শিক্ষা — “আমি ও আমার” অজ্ঞান
১২. উপায় — বিশ্বাস ও ভক্তি
১৩. ঈশ্বর অগম্য ও অপার
১৪. বিশ্বাসের জোর — ঈশ্বরে বিশ্বাস ও মহাপাতক ]
১৫. ঈশ্বরকে ভালবাসা জীবনের উদ্দেশ্য — The End of life
১৬. ঠাকুর সমাধি মন্দিরে
১৭. উপায় — আগে বিশ্বাস — তারপর ভক্তি
১৮. নিষ্কামকর্ম বা কর্মযোগ ও জগতের উপকার — Sri Ramakrishna and the European ideal of work
১৯. নিষ্কামকর্মের উদ্দেশ্য — ঈশ্বরদর্শন
২০. ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু
শ্রীম শেষ করছেন এইভাবে, 'বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য সকলে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। গাড়ি উত্তরাভিমুখে হাঁকাইয়া দিল। গাড়ি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে যাইবে। এখনও সকলে গাড়ির দিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বুঝি ভাবিতেছেন, এ মহাপুরুষ কে? যিনি ঈশ্বরকে ভালবাসেন, আর যিনি জীবের ঘরে ঘরে ফিরছেন, আর বলছেন, ঈশ্বরকে ভালবাসাই জীবনের উদ্দেশ্য।'
এই কুড়িটি ভাগ এবং ঘটনাকে যদি আমরা পরপর দেখি তাহলে এটি জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, ধ্যান, বস্তুত গোটা হিন্দু ধর্মসংস্কৃতি, যোগদর্শন এবং ব্রহ্মসূত্রের মাস্টারক্লাস - ঈশ্বর স্বয়ং একজন rationalist-কে বেদান্তের বিজ্ঞান বোঝাচ্ছেন। এরই মধ্যে তাঁর ভাব হচ্ছে, গান গাইছেন, গল্প বলছেন, সমাধিস্থ হচ্ছেন, মস্করা করছেন, মানীকে মান দিচ্ছেন আবার একজন শাস্ত্রজ্ঞ আত্মবিশ্বাসী কর্মযোগীকে আত্মবোধ এবং মুক্তির পথও দেখাচ্ছেন। এই সাক্ষাৎকারটি একটি অদ্ভুত সর্বাঙ্গসুন্দর complete-in-itself আত্মপলব্ধির রাস্তা খুঁজে পাওয়ার উপদেশ, যেখানে যিনি দিচ্ছেন তিনি আধার জেনেই অমৃত বর্ষণ করছেন আর যিনি সে সুধা পান করছেন তিনিও জানেন কি সারবস্তু তিনি পাচ্ছেন, যদিও আজন্মলালিত সংস্কার ত্যাগ করা তাঁর পক্ষে কঠিন। বিদ্যাসাগর জানেন না এমন কোনো কথাই কিন্তু ঠাকুর বলছেন না, খালি sequence অনুযায়ী সাজিয়ে দিয়ে একটা logical conclusion-এ পৌঁছে দিচ্ছেন। শ্রীমর মনে হচ্ছে 'সকলে অবাক ও নিস্তব্ধ হইয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন। যেমন সাক্ষাৎ বাগ্বাদিনী শ্রীরামকৃষ্ণের জিহ্বাতে অবতীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগরকে উপলক্ষ করিয়া জীবের মঙ্গলের জন্য কথা বলিতেছেন।' ওঠবার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে) বলছেন — এ-যা বললুম, বলা বাহুল্য আপনি সব জানেন — তবে খপর নাই। (সকলের হাস্য) বরুণের ভাণ্ডারে কত কি রত্ন আছে! বরুণ রাজার খপর নাই! বিদ্যাসাগর (সহাস্যে) জবাব দিচ্ছেন — "তা আপনি বলতে পারেন।" এটাই আসল কথা - ভেতরে কি আছে তার খবর নেই, অবতারপুরুষ এসে প্রদীপটি তুলে ধরেন, তখন ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়, যদি দেখার ইচ্ছা থাকে। সেদিন ঠাকুর যে গানটি গাইতে গাইতে সমাধিস্থ হয়েছিলেন, সেটি আসলে তাঁর সেদিনের উপদেশের সারাৎসার:
মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।
সে যে ভাবের বিষয় ভাব ব্যতীত, অভাবে কি ধরতে পারে ৷৷
অগ্রে শশী বশীভূত কর তব শক্তি-সারে ।
ওরে কোঠার ভিতর চোর-কুঠরি, ভোর হলে সে লুকাবে রে ৷৷
ষড় দর্শনে না পায় দরশন, আগম-নিগম তন্ত্রসারে ।
সে যে ভক্তিরসের রসিক, সদানন্দে বিরাজ করে পুরে ৷৷
সে ভাব লাগি পরম যোগী, যোগ করে যুগ-যুগান্তরে ।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন, লোহাকে চুম্বকে ধরে ৷৷
প্রসাদ বলে মাতৃভাবে আমি তত্ত্ব করি যাঁরে ।
সেটা চাতরে কি ভাঙব হাঁড়ি, বোঝ না রে মন ঠারে ঠোরে ৷৷
এরপরেও কিন্তু বিদ্যাসাগর দক্ষিণেশ্বরে যাননি কারণ তিনি কোনো ধর্মস্থানে যাওয়া উচিত মনে করতেন না। ঠাকুর বুঝতে পেরেই রাসমণির বাগানে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, মায়ের মন্দিরে নয়। বিদ্যাসাগর কথা দিয়েও কথা রাখেননি বলে ঠাকুরের মনে খেদ ছিল। শ্রীমকে পরে বলেছিলেন,‘‘বিদ্যাসাগর সত্য কয় না কেন? … সেদিন বললে, এখানে আসবে৷ কিন্তু এল না৷’’ বিদ্যাসাগরের মনে ধর্ম নিয়ে যে দ্বন্ধ ছিল তা নানা সময়ে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। একজায়গায় বলেছেন, ‘‘ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই৷ … আমার বোধ হয় যে, পৃথিবীর প্রারম্ভ হইতে এরূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ কাল পৃথিবী থাকিবে, তাবৎ এ তর্ক থাকিবে, কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না৷’’ (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, পৃ. ২৩১–২৩২)৷ ঠাকুর সব জেনেও সেধে ওঁকে পথ দেখাতে গিয়েছিলেন, এটাই আসল কথা। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যাখ্যাত হবেন জেনেই মাত্র পাঁচটি গ্রাম চাইতে গিয়েছিলেন। অবতারের মর্তলীলা বোঝা দায়।
বন্দে জগৎগুরু শ্রীরামকৃষ্ণ, বন্দে জগজ্জননী মহামায়ী।