Sunday, January 30, 2022

দৌড়ে লাভ নেই

যে কোনো সংসারী মানুষ দৈনন্দিন জীবনে achievement আর engagement শব্দ দুটির দ্যোতনা সঠিকভাবে যেদিন অনুধাবন করতে পারবেন, সেইদিনই তাঁর thought process-এ সর্বাঙ্গীন পরিবর্তন আসতে বাধ্য। কিন্তু আজকের এই cut throat দুনিয়ায় সেই রাস্তা শুরু থেকেই বন্ধ করে রাখা হয়। এখন আমাদের অধিকাংশকেই ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় you got to be an achiever, তাতে আখেরে শরীর এবং মনের যে কি দৈন্যদশা হবে সেটা নিজেরা ভুক্তভোগী হিসেবে বড়রা খুব ভালো করেই জানেন অথচ ইঁদুর দৌড়ের করুণ পরিণতির হুঁশিয়ারী তাঁরা ইচ্ছা করেই আমাদের দেন না, ওটা আমাদের ঠেকে শিখতে হয়।


দৌড়োতে দৌড়োতে একসময় হাই স্ট্রেস, হাই এংক্সাইটি, হাই ব্লাড প্রেসার, হাই সুগার, হাই ক্লোরোষ্ট্রল, হাই ইউরিক এসিড - তারপর একদিন বুকে যন্ত্রণা, স্টেন্ট, ওপেন হার্ট সার্জারি, তারপর আবার দৌড়, তারপর একদিন ব্রেন স্ট্রোক, পার্শীয়াল প্যারালাইসিস, কিছুদিন পর সবার অবহেলা, শেষে বলো হরি, হরিবোল। ব্যাস শেষ, achievement-এর খেল খতম। বাড়ি, গাড়ি, সম্মান, প্রতিপত্তি, সামাজিক স্বীকৃতি সব এখানেই পড়ে রইলো, আমি যে আসলে কে, আমার আসল কর্তব্য যে কি ছিল, কিছুই বুঝলাম না, পঞ্চভূতে মিশে গেলাম। 


পরের জন্মে হয়তো আমারই বানানো বাড়িতে, আমারই কেনা দামি দামি ফার্নিচার আমারই ছেলেমেয়েরা কাবাড়ি ডেকে জলের দরে বিক্রি করে দিচ্ছে আর আমিই হয়তো সেই কাবাড়ির শরীর নিয়ে তাদের সঙ্গে চূড়ান্ত দর কষাকষি করছি - এখন দুপয়সা বেশি কামাতে পারলে সেটাই আমার এই মুহূর্তের achievement - এই তো অঙ্ক, নাকি অন্য কিছু? আর যাঁরা পুনর্জন্ম মানেন না তাঁদের কঙ্কাল বাক্সবন্ধি হয়ে মাটির নিচে পড়ে থাকবে, কবে পৃথিবী ধ্বংশ হয়ে last judgement day আসবে, সেই আশায়। মোদ্দা কথা হলো, ঈশ্বর যে কারণে মানুষের শরীর, মানুষের ব্রেন আর সোজা শিরদাঁড়া দিয়েছিলেন, সেটার ঠিকঠাক ব্যবহার কি আমরা করতে পারলাম?


তার মানে কি জাগতিক বিদ্যার প্রয়োজন নেই, জাগতিক জ্ঞান প্রয়োগের প্রয়োজন নেই, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই, কাজে পারদর্শিতার প্রয়োজন নেই, সংসার প্রতিপালনের প্রয়োজন নেই, নাকি দেশের ও দশের যাতে উপকার হয় সেরকম কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রয়োজন নেই - সবকিছুরই প্রয়োজন আছে। শরীর যখন আছে তখন শরীরের চাহিদাও আছে আবার মনের চাহিদাও আছে, তাকে না মিটিয়ে উপায় নেই। আমাদের শাস্ত্রেই বলেছে 'ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ', in that order চতুর্বিদ সাধনা পদ্ধতি। কিন্তু এইখানেই নির্লিপ্ততার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটা সবচেয়ে বেশি, যে শিক্ষাটা আমাদের বড়রা আজকাল আর আমাদের দেন না কারণ তাঁরা নিজেরাই ধর্মহীন, পথভ্রষ্ট। 


এখানেই engagement-এর প্রশ্ন আসে। আমি কাজে লেগে থাকবো, অবশ্যই থাকবো। কিন্তু কাজ আমাতে লেগে থাকবে, সেটা হতে দেবো না। Pressure নেবো, অবশ্যই নেবো, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র হাতের কাজটিকে আরো সুষ্ঠভাবে করার জন্য, এই ভেবে যে তাতে কোনো না কোনো সময়ে কারো না কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকারই হবে। এই ভাব নিয়ে এগোলে কি হয়, 'আমি কিছুই achieve করলাম না, আমার ভেতরে যিনি বসে আছেন, তিনিই পরিস্থতি সৃষ্টি করে আমাকে দিয়ে করিয়ে নিলেন, ফলাফলের ভার বাবা তাঁর জিম্মায়' - এরপর আর কোনো after effect-এর বোঝা ঘাড়ে চেপে থাকেনা। যেহেতু গোটা প্রক্রিয়াতে আমার কোনো stake নেই, ফলে আমার পাওয়ারও কিছু নেই, হারাবারও কিছু নেই, আমি নিমিত্ত মাত্র। 


আমার নিজের আসল কাজ হলো নিজের স্বরূপকে খোঁজা। এই জীবনে ওই জায়গাটায় যদি একটুও এগোনো যায়, সেটাই সত্যিকারের achievement কারণ তার ফল জন্মের পর জন্ম ধরে আমার সঙ্গেই থাকবে। বাকি, যা থাকবে না তার জন্য প্রাণপাত করে লাভ কি? ঠাকুর গল্পচ্ছলে শিক্ষা দিচ্ছেন, "ভাঁড়ারে একজন আছে, তখন বাড়ির কর্তাকে যদি কেউ বলে, মহাশয় আপনি এসে জিনিস বার করে দিন। তখন কর্তাটি বলে, ভাঁড়ারে একজন রয়েছে, আমি আর গিয়ে কি করব! যে নিজে কর্তা হয়ে বসেছে তার হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর সহজে আসেন না"।

দাস আমি

 অহংকার বড় মারাত্মক বস্তু। একটু ভালো গান গাইলাম বা ভালো রাঁধলাম বা ভালো লিখলাম বা ভালো খেললাম বা একটু better than average কোনো গুণ আছে, লোকে একটু সুখ্যাতি করে, ব্যাস, অমনি মনের মধ্যে 'আমি' 'আমি' 'আমার' 'আমার' শুরু হয়ে গেল। আমাদের মতন যাঁরা সাধারণ সংসারী মানুষ, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয় - অহংবোধহীন হয়ে সুখ্যাতি handle করা বোধহয় পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। আর না করতে পারলেই bloated ego তৈরি হয়ে সজ্জন ব্যক্তিকেও একেবারে পাষন্ড বানিয়ে ছাড়ে। একে avoid করার কি উপায় নেই? সাধুরা বলছেন উপায় আছে। এক, ঠাকুর কৃপা করে আমাকে দিয়ে একটা ভালো কাজ করিয়ে নিলেন যা ঠাকুরেরই সন্তানদের তৃপ্তি দিলো - এটা মনে করে ঠাকুরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা, আর দুই, ঠাকুর নানাজনের মধ্যে দিয়ে ভোক্তারূপে আমার কাজের আস্বাদ গ্রহণ করে আমায় কৃপা করলেন - এই ভেবে অনন্দলাভ করা। মোদ্দা কথা হলো ঠাকুরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিরও নড়বার যো নেই জেনে আমার মধ্যে constructive যা কিছু আছে, মানুষকে তৃপ্তি দেওয়ার যেটুকুই শক্তি আছে, সব ভগবানের ইচ্ছা এবং তাঁর অহেতুকি কৃপাতেই তৈরি হয়েছে, এতে অহংকারযুক্ত বা উপাধিযুক্ত 'আমি'-র বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই - ক্রমাগত এটা নিজেকে মনে করিয়ে যাওয়া। 


শুকনো জ্ঞান এক জিনিষ আর আত্মিক উপলব্ধি একেবারে অন্য এক জিনিষ, bookish knowledge and deep intellectual understanding-এর মধ্যে বিস্তর ফারাক। জানি যে এই দেহ-মন অনিত্য অর্থাৎ অসত্য আর ঠাকুরই একমাত্র নিত্য অর্থাৎ একমাত্র সত্য, জানি যে এই দেহভিত্তিক identity-র মৃত্যু অবধারিত - আগেও বহুবার মরেছি আর ভবিষ্যতেও বহুবার মরবো, তবু 'আমি'ভাব যায় কই? কেউ হয়তো একটু কটুকথা বললো, গায়ে না মাখলেই হয়, সেখান থেকে চুপচাপ হেঁসে সরে আসলেই ল্যাটা চুকে যায়, তা না, তার সঙ্গে চেঁচামেচি জুড়ে দিলাম আর রাতে স্বপ্নে কোথায় ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের চাতালে ঘুরে ঘুরে দেবসান্নিধ্যে ধন্য হবো, না তার বদলে সকাল থেকে মাথায় সেই অপমানের ভারী বোঝাটা বয়ে বয়ে ঘাড়ে মাথায় ব্যাথা, ঘুমই আর আসতে চায় না! আমরা কি বুঝিনা যে নিজেকে কিভাবে conduct করলে আমাদের সবচেয়ে বেশি স্বস্তি হয়, সবধরনের equilibrium বজায় থাকে - সবই বুঝি কিন্তু অহংকার এসে অন্ধ করে দেয়। আসলে আমরা বেশিরভাগই খুব superfluous - তাই আমাদের সবটাই শুকনো জ্ঞান, আত্মিক উপলব্ধি আর ক'জনের?


ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব prescription দিচ্ছেন, “জ্ঞান কাকে বলে; আর আমি কে? ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা — এর নাম জ্ঞান। আমি অকর্তা। তাঁর হাতের যন্ত্র। তাই আমি বলি, মা, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; তুমি ঘরণী, আমি ঘর; তুমি ইঞ্জিনিয়ার; যেমন চালাও, তেমনি চলি; যেমন করাও, তেমনি করি; যেমন বলাও, তেমনি বলি; নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু”। বলছেন, "বিজ্ঞানী কেন ভক্তি লয়ে থাকে? এর উত্তর এই যে, ‘আমি’ যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের ‘অহং’ যায় না। অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁক্‌ড়ি বেরিয়েছে"। আর একদিন আরো সহজভাবে বিশিষ্ঠ অদ্বৈত আর অদ্বৈতের পার্থক্য বুঝিয়ে বলেছেন, “রাম জিজ্ঞাসা করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পুর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।

“সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।” 


আসলে আমাদের মতন জ্ঞানপাপীদের জন্য জ্ঞানের পথ বা যোগের পথ অত সহজ নয়। সেইজন্যই ঠাকুর ভক্তির ওপর ভয়ঙ্কর জোর দিতেন। বলতেন, "ভক্তের সাধ যে চিনি খায়, চিনি হতে ভালবাসে না।

“ভক্তের ভাব কিরূপ জানো? হে ভগবান, তুমি প্রভু, আমি তোমার দাস’, ‘তুমি মা, আমি তোমার সন্তান’ , আবার ‘তুমি আমার পিতা বা মাতা’। ‘তুমি পূর্ণ, আমি তোমার অংশ।’ ভক্ত এমন কথা বলতে ইচ্ছা করে না যে ‘আমি ব্রহ্ম'।”


আত্মবোধ বা ব্রহ্মজ্ঞান গভীর intellectual understanding এর বিষয়, ঠাকুরের অসীম কৃপা ছাড়া সম্ভবই নয়। কিন্তু 'আমি মায়ের সন্তান' - এটা ভাবতে তো আর কোনো কাঠখড় পোড়াতে হয়না। ইষ্টের সাথে সম্পর্ক পাতানোর তাই ভক্তি আর বিশ্বাসই বোধহয় সবচেয়ে সহজ উপায়। বিশ্বাস করতে হবে যে মায়ের কাছে ক্রমাগত আবদার করে গেলে মা একদিন না একদিন ঠিকই তা পূরণ করবেন। তাই ঠাকুর বলছেন, “তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, ‘যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়”। একজন সাধু বলেছিলেন যে রাতে শোয়ার সময় মনে মনে দৃঢ়ভাবে ভেবে নিতে যে বালিশে মায়ের চরণদুটি রয়েছে, আমি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে শুলাম। খুব কাজে দেয় কিন্তু।

Thursday, January 20, 2022

প্রত্যাহার

রূপ রস শব্দ স্পর্শ আর গন্ধ, এ সবকটিই আমাদের জাগতিক আহারের রকমফের। যেই আমরা বুঝে যাই যে যথেষ্ট আহার হয়েছে, এর চেয়ে বেশি খেলে শরীর খারাপ করবে, আর খেয়ে কাজ নেই বাপু, তখনই প্রত্যাহার হয়। আহার হতে প্রত্যাহার। যেই প্রত্যাহার হলো অমনি আর পঞ্চ ইন্দ্রিয়র খাই খাই রইলো না, মানে উপভোগের প্রবৃত্তিই রইলো না আর প্রবৃত্তি না থাকলে প্রত্যাখ্যানও নেই, অর্থাৎ প্রত্যাশাপূরণ হওয়ার আকাঙ্খা বা না হওয়ার বেদনা কোনোটাই নেই - ব্যস মনও সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে শান্ত হয়ে যায়। ঠাকুর বলছেন, “মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজ রঙে ছোপাও সবুজ। যে-রঙে ছোপাও সেই রঙেই ছুপবে।"


তবে মনকে কিছু না কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে যতক্ষণ না সে নিবৃত্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, ফলে বাইরের দরজা বন্ধ পেয়ে উপায়ন্তর না দেখে সে তখন internal exploration-এ নেমে পড়ে। এটা একমাত্র গুরুর আশীর্বাদে আর ভগবৎ কৃপায় হয়। ঠাকুর বলছেন, "বদ্ধজীব হয়তো বুঝেছে যে, সংসারে কিছুই সার নাই; আমড়ার কেবল আঁটি আর চামড়া। তবু ছাড়তে পারে না। তবুও ঈশ্বরের দিকে মন দিতে পারে না!" আবার বলছেন,“সাধারণ লোক সাধন করে, ঈশ্বরে ভক্তিও করে। আবার সংসারেও আসক্ত হয়, কামিনী-কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়। মাছি যেমন ফুলে বসে, সন্দেশে বসে, আবার বিষ্ঠাতেও বসে। (সকলে স্তব্ধ)

“নিত্যসিদ্ধ যেমন মৌমাছি, কেবল ফুলের উপর বসে মধুপান করে। নিত্যসিদ্ধ হরিরস পান করে, বিষয়রসের দিকে যায় না।” 

সেইজন্যই ভগবানের অহেতুকি কৃপা চাই, একমাত্র তিনিই নিরাশক্তির কাঁচি দিয়ে কুচ করে জীবের আসক্তির বন্ধনটি কেটে দিতে পারেন, সবই তো তাঁর খেলার বিষয়। তখন মন অন্তর্মুখী হয়।


যতক্ষণ surface-এ মন ঘোরাঘুরি করছিল ততক্ষণ সব ঠিক ছিল, সবটাই normal, relative আর superfluous ছিল, যেই সে অন্দরে ঝাঁপ দিলো, তখন সে আর তল খুঁজে পায়না। মন যেই বুঝতে পারে যে অচেনা terrain-এ সে dive মেরেছে, তখন বাঁচার জন্য হাতের কাছে যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে freefall আটকাতে চায়, নানা রকম উদ্ভট চিন্তা উৎপন্ন করে জীবকে distract করতে চায় কারণ যতক্ষণ খিদে ততক্ষণই রাঁধুনির প্রয়োজন। এখানেই আসল খেলা, মনকে নিজের বশে আনা। এর technique-টিও গুরু শিখিয়ে দেন। দীর্ঘদিনের অন্তর্মুখী হওয়ার অনভ্যাসবশতঃ প্রথম প্রথম খানিকটা distraction হয়ও, রোক করে লেগে থাকলে ঠিক কেটে যায়। একটা সময় গিয়ে মন বোঝে যে সে যাকে এতদিন আহার জোটাতো, তিনিই নিজেকে প্রত্যাহার করেছেন, এখন আর সে driving force নয়, সে তাঁর subservient। তখন সে finally চুপ করে।


তিনি ততক্ষণে এমন এক স্বাদের সন্ধান পেয়েছেন যা মায়ার আবরণে ঢাকা মন এতদিন এত কান্ড করেও তাঁকে দিতে পারেনি। তখন মন surrender করে। তখন সে শান্ত হয় আর উপাধি চাপিয়ে চাপিয়ে যে মিথ্যে অহংকারের মূর্তি তৈরি করেছিল, গুরুর কৃপায় সেটা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে। তখন ভিক্ষা দেওয়ার বদলে ভিক্ষা চাইতে ইচ্ছে করে, আর মনে হয় প্রত্যাখ্যাত হলে দারুন সুখ হবে, গুমোর ভাঙবে, মাথা নুইবে। নাম-রূপধারী 'আমি' যত ধাক্কা খাবে তত অন্তর আনন্দে পরিপূর্ন হবে। ঠাকুর বলছেন, "আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল"। তার মানে কি ভোগ শেষ হয়ে গেল? হয়তো না। তাহলে কিভাবে সংসারে থাকতে হবে? ঠাকুর বলছেন, "তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম। এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।"


যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধি - এই অষ্টযোগের মধ্যে প্রত্যাহারই হলো key element, তবে একজন সংসারীর পক্ষে তার জন্য আগে ধর্মপথে থেকে যথেষ্ট অর্থ আর কামনা উপভোগ করার experience থাকলে খেলা একটু বেশিই জমে, নইলে আর প্রত্যাহারের মজা কই? বাকি ধর্মপথে থাকার criterion ইত্যাদি হলো নার্সারী ক্লাসের সিলেবাস, ওসব করেটরেই মন এই অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠাকুর শ্রীমকে বলছেন,

“ব্রাহ্মণ ভোজনের সময় দেখ নাই? প্রথমটা খুব হইচই। পেট যত ভরে আসছে ততই হইচই কমে যাচ্ছে। যখন দধি মুণ্ডি পড়ল তখন কেবল সুপ-সাপ! আর কোনও শব্দ নাই। তারপরই নিদ্রা  - সমাধি। তখন হইচই আর আদৌ নাই।...

“ঈশ্বরের যত নিকটে এগিয়ে যাবে ততই শান্তি। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ প্রশান্তিঃ। গঙ্গার যত নিকটে যাবে ততই শীতল বোধ হবে। স্নান করলে আরও শান্তি।...

“মন আসক্তিশূন্য হলেই তাঁকে দর্শন হয়। শুদ্ধ মনে যা উঠবে সে তাঁরই বাণী। শুদ্ধ মনও যা শুদ্ধ বুদ্ধিও তা - শুদ্ধ আত্মাও তা। কেননা তিনি বই আর কেউ শুদ্ধ নাই।

“তাঁকে কিন্তু লাভ করলে ধর্মাধর্মের পার হওয়া যায়।”

এই বলিয়া ঠাকুর সেই দেবদুর্লভকন্ঠে রামপ্রসাদের গান ধরিলেন:

আয় মন বেড়াতে যাবি।

কালী-কল্পতরুমূলে রে, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ৷৷

প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।

বিবেক নামে তার বেটারে তত্ত্বকথা তায় শুধাবি ৷৷


ঠাকুর বলছেন, "মায়া দুই প্রকার - বিদ্যা এবং অবিদ্যা। তার মধ্যে বিদ্যা মায়া দুই প্রকার - বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিদ্যা মায়া আশ্রয় ক'রে জীব ভগবানের শরণাপন্ন হয়। আর অবিদ্যা মায়া ছয় প্রকার - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য। অবিদ্যা মায়া 'আমি' ও 'আমার' জ্ঞানে মনুষ্যদিগকে বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু বিদ্যা মায়ার প্রকাশে জীবের অবিদ্যা একেবারে নাশ হয়ে যায়।" যাঁকে বলছেন সেই শ্রীমর জীবনীকার লিখেছেন, 'তিনি ঘরেই থাকতেন - কিন্তু গবাক্ষপথে দেখতেন অনন্তকে। আশ্রয়ের মধ্যে নিরাশ্রয়ের সাধনা করতেন। তাই মাঝে মাঝে মধ্য রাত্রে যখন গোটা শহর ঘুমিয়ে পড়ত, চারদিকে নেমে আসত রহস্যময় নীরবতা তখন তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেন হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন সেনেট হলের খোলা বারান্দায়। সেখানে আশ্রয়হীন ভিক্ষুকদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। আবার ভাবতেন, আমি একা এই পৃথিবীতে। তিনি চলে যেতেন গঙ্গাতীরে, ঈশ্বর-জ্যোতি দেখার জন্য তাকিয়ে থাকতেন সাধুদের দিকে। আবার তীর্থযাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন, তাদের মুখে কোথায় লেখা আছে আনন্দের বার্তা।' এই হলো কালী-কল্পতরুমূলে বেড়াতে গিয়ে চারটি বেদের জ্ঞান কুড়িয়ে নেওয়া। দেখি প্রিয় কন্যার মৃত্যুসংবাদ বহনকারী টেলিগ্রাম পড়ে চুপচাপ মুড়ে পকেটে রেখে দিয়ে কাশীর অদ্বৈত আশ্রমে যথারীতি ভাগবতের ক্লাস নিচ্ছেন। আহা, কি দিব্য জীবন!

Wednesday, January 19, 2022

আফগানিস্তান ও অন্যান্য

পাকিস্তানের NSA ডঃ মঈদ ইউসুফের আজ আফগানিস্থান যাওয়ার কথা ছিল, যাত্রা পিছিয়ে গেছে। সরকারিভাবে জানানো হয়েছে যে কাবুলে আবহাওয়া খারাপ কিন্তু কাবুল এয়ারপোর্টে আমেরিকানরা একেবারে অত্যাধুনিক ILS লাগিয়ে গিয়েছিল, ফলে এই বাহানা ধোপে টেকে না, এটা নেহাতই মুখরক্ষার জন্য বলা হচ্ছে। আসল খবর ইরানের গোয়েন্দা সূত্র দিয়েছে। 


বাইডেনসাহেব অবশেষে বুঝেছেন যে হটাৎ করে সরে গিয়ে তিনি চীন এবং রুশের জন্য ফাঁকা মাঠ উপহার দিয়ে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের মধ্যে পাস আদানপ্রদান করতে করতে দিব্যি ফাঁকা গোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তালিবানকে চাপে রাখতে একদিকে রুশ আপাতত তালিবান বিরোধী পাঞ্জশের ঘাঁটির যোদ্ধাদের সৈনিক মদত দিচ্ছে, অন্যদিকে চীন পাকিস্তানকে commission agent বানিয়ে, ডুরান্ড লাইনের ঝামেলাকে backburner-এ রাখিয়ে, পয়সার বিনিময়ে আফগানিস্তানের লিথিয়াম মাইনগুলো হাতানোর ধান্দা করছে। এদিকে ইরান আবার তালিবান আর আহমেদ মাসুদদের মধ্যে একটা working relationship তৈরি করাবার চেষ্টা করছে আর গতবছর আগস্টের শেষে তেহেরানে দুইপক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছে। 


এই খেলায় সবকটা দেশের চাহিদা কিন্তু আলাদা আলাদা। ইরান চাইছে তালিবানের সাথে Northern Alliance-এর একটা সমঝোতা করিয়ে দিয়ে goodwill create করে যদি চাবাহার থেকে সেন্টাল এশিয়ার দেশগুলি অবধি অবাধ বাণিজ্য চালানো যায়, পাকিস্তান চাইছে চীনের সঙ্গে তালিবানের একটা বাণিজ্য চুক্তি করিয়ে দিয়ে চীনা ডলার পাইয়ে দেওয়ার বদলে যদি তালিবানকে দিয়ে ডুরান্ড লাইনের লড়াই postpone করানো যায়, রুশ চাইছে Northern Allienceকে তোল্লা দিয়ে আফগানিস্থানের ভেতরে হওয়া গরম করে তালিবানকে চীনের দিকে ঝুঁকিয়ে যদি ঋণদাতাকে মদত করা যায়, আর চীন চাইছে কিভাবে এর ওর তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজের কাজ সস্তায় হাসিল করা যায়। 


মঈদ ইউসুফ চীনের দালালি করতেই আফগানিস্তান যাচ্ছিলেন, তাহলে হটাৎ আটকে গেলেন কেন? আসলে অকস্মাৎ ১৫ই জানুয়ারি ইমরান খান আর পুতিনের টেলিফোনালাপের পরেই রুশি বিদেশমন্ত্রক পাঞ্জশেরে তাদের কোনো interest নেই বলে বয়ান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মনে হয়েছিল খেলা ঘুরছে। আজ বোঝা গেল পর্দার পেছনে আসলে কি হচ্ছিল। তালিবানের বিস্তর টাকা চাই, আর এখন যে তাদের ডলার দেবে, তালিবান তারই গুণ গাইবে। ইরানি এজেন্সি বলছে আমেরিকা তলায় তলায় তালিবানকে টাকা দিতে রাজি হয়ে গেছে, কারণ ISIS, চীন আর রুশকে আটকাতে আফগানিস্তান আবার তাদের কাছে important হয়ে উঠছে। আজ তেহেরিক এ তালিবান এ পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী ইসলামাবাদে ঢুকে পুলিস মেরেছে, কাল যদি অন্য এক faction জিন জিয়াং-এ ঢুকে উগুরদের তাতাতে থাকে, আশ্চর্য্যের কিছু নেই।


দোহাতে বহুদিন ধরেই তালিবান আর আমেরিকার মধ্যে কথাবার্তা চলছে, সেটা গতবছর ১৫ই আগস্টের আগেও অনেকদিন ধরে চলেছিল। এই যে ভারত ইরানের মাধ্যমে কখনো আফগানিস্তানে ওষুধ পাঠাচ্ছে, কখনো গম, কখনো ভ্যাক্সিন, সেও আগের মতোই আমেরিকার দেখানো রাস্তাতেই হেঁটে। এখন, ইরান কেন ভারতকে সাহায্য করছে? আমেরিকা আর ইরানের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গিয়ে sanctions withdrawn হয়ে গেলে দুদেশের মধ্যে তেল ও অন্যান্য বাণিজ্য সহজতর হয়, সেই কথা মাথায় রেখে ভারত দুইদেশেরই বন্ধু হিসেবে এক unofficial মধ্যস্থতাকারীর সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই আশায়। 


দুনিয়ার অন্যপারে রুশ যতই ইউক্রেনকে ভয় দেখাক, পুতিনের সাধ্য নেই attack করার। করলে পুতিনের অবস্থা হিটলারের চেয়েও খারাপ হবে আর ইউরোপে যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে চীন যদি তাইওয়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে, সেটা পুতিন খুব ভালো করেই জানেন। এই বোকামি উনি করবেন না, যদিও আমেরিকা আর NATO-কে multifront war-এ ফাঁসিয়ে দেওয়ার আবহাওয়া সৃষ্টি করে উনি একদিকে চীনের ভূরাজনৈতিক সুবিধা করে দিচ্ছেন আর অন্যদিকে NATO-কে রুশের সীমানা থেকে কিছুটা দূরে রাখার দরও কষছেন। আর সেই সাথে যদি ফ্রান্সের সাথে Nord Steam 2 গ্যাস পাইপলাইনটা এই ধাক্কায় operationalise করিয়ে নেওয়া যায় তো সোনায় সোহাগা।


এতসবের মধ্যে ভারত কি করবে? ভারত wicket to wicket খেলবে, কোনো চৌকা ছক্কা হাঁকাবে না। ভারতের পাখির চোখ $৫ ট্রিলিয়ন economy; যা করার আমেরিকা করবে, ভারত কেবল নিজের আখের গোছাবে। সাউথ চায়না সি জুড়ে চীনের শত্রুদের ব্রাহ্মস আর অন্যান্য মিসাইল সিস্টেম বেচে মুনাফাও কামাবে আবার চীনের সাথে $১২৫ বিলিয়নের trade-ও করবে - আমরা বানিয়া, আপত্তি আছে?

Tuesday, January 18, 2022

গুরুমন্ত্র জপের ফল

ঠাকুর যখন সূক্ষ্মশরীরে ইষ্ট হয়ে হৃদয়ে বাস করেন তখন তাঁর কৃপা ছাড়া তাঁকে হয়তো স্থূলচোখে দেখা যায়না। কিন্তু ঠাকুর যখন গুরুমহারাজরূপে ইষ্টমন্ত্র দান করেন আর আমরা মন প্রাণ দিয়ে তা ধারণ করার চেষ্টা করি, তখন গুরুরূপী সশরীরী ঠাকুরকে আমরা পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করি, তিনি আমাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন, তিনি তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে মন্ত্র দান করেন আর কানে কানে আমাদের মন্ত্র উচ্চারণ শোনেন, তাঁকে আমরা দর্শন, স্পর্শন, শ্রবণ, মনন সবকিছু করতে পারি, তাও স্থূল শরীরে। তাই ঠাকুর শুধুই ধ্যানগম্য, এই কথাটি বোধহয় সঠিক নয়। আর ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা যেহেতু অভিন্ন, ফলে সঙ্ঘগুরুর মধ্যে আমরা অদ্বৈত মহাশক্তির উপস্থিতি টের পাই।


আমরা যারা ঠাকুরের আশ্রিত সন্তান, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের দীক্ষাগুরু এবং সমস্ত সঙ্ঘগুরুর মধ্যেই শ্রীশ্রীমা ও ঠাকুরকে প্রত্যক্ষরূপে সামনে পাই এবং তাঁদের মাধ্যমেই ঠাকুর-মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করে আমাদের নিরন্তর দর্শন দেন। গুরুরূপে ঠাকুর যে বীজমন্ত্র দান করেন, তার মধ্যে এবং মাধ্যমেই তাঁর ইষ্টরূপে প্রকাশ। শ্রীম বলতেন, 'তপস্যা কি আর আমরা করি, গুরুই করেন, আমাদের মধ্য দিয়ে। এও তাঁর একটা লীলা'। মন্ত্র জপতে জপতে একসময় তিনি স্বরূপে ভক্তের অন্তরটিকে বোধে আলোকিত করে দেন, ফলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ঠাকুর স্বয়ং এবং তাঁর পুণ্য নাম এক এবং অভিন্ন। জপে মন বসে গেলে আমাদের যে আনন্দবোধ হয়, যার রেশ ধ্যান জপ শেষে উঠে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মাতিয়ে রাখে, সেই আনন্দ অন্তরে বসবাসকারী ওঁর কাছ থেকেই আসে কারণ আনন্দ, প্রেম, করুণা, বাৎসল্য ইত্যাদি কোনোটাই জাগতিক অনুভূতি নয়, ঐশ্বরিক। 


পরম পূজ্যপাদ স্বামী বিরজানন্দজী এই প্রসঙ্গে বলছেন, "জপের সময় নাম-নামী অভেদ ভেবে তাঁরই চিন্তা করতে হয়। যে নাম, সেই নামী, অর্থাৎ নাম করলেই যাঁর নাম তাঁকে বোঝায়। কোনো কাজের জন্য যদি কাউকে নাম ধরে ডাকো তো সঙ্গে সঙ্গে তার মুর্তিটাও মনের সামনে ভেসে ওঠে এবং সে সাড়াও দেয় বা আসে। জপও ঠিক তাই, যদি ঠিক হয়, তাতেই মন লেগে থাকে। আর এটুকু বিশ্বাস থাকা চাই যে, আমার ডাক তাঁর কাছে পৌঁছুচ্ছে, তাঁর সাড়া পাবোই।" (পরমার্থ প্রসঙ্গ, উপদেশ সংখ্যা ১৩৭)


জপের মুক্তিদায়িনী শক্তি সম্পর্কে জগজ্জননী শ্রীশ্রীমা তো একেবারে স্পষ্ট করে বলছেন, "অভ্যাসের কত শক্তি! জপ অভ্যাস করতে করতে মানুষ সিদ্ধ হয়। জপাৎ সিদ্ধি, জপাৎ সিদ্ধি, জপাৎ সিদ্ধি! সংখ্যার দিকে মন রেখে জপ করলে সংখ্যার দিকে মন থাকে, এমনি জপ করবে।"

"জপ ধ্যান করতে করতে দেখবে ঠাকুর কথা কবেন। মনে যে বাসনাটি হবে, তখুনি পূর্ণ করে দেবেন। কি শান্তি প্রাণে আসবে।"

(শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে)


আর শ্রীমর মাধ্যমে স্বয়ং ঠাকুর জপের ফল সম্পর্কে আমাদের মতন সংসারীদের সরাসরি উপদেশ দিচ্ছেন, "জপ করা কি - না নির্জনে নিঃশব্দে তাঁর (ভগবানের) নাম করা। একমনে নাম করতে করতে - জপ করতে করতে, তাঁর রূপ দর্শন হয় - তাঁর সাক্ষাৎকার হয়। শিকলে বাঁধা কড়িকাঠ গঙ্গার গর্ভে ডুবানো আছে - শিকলের আরেক দিক তীরে বাঁধা আছে। শিকলের এক একটি পাব ধরে ধরে গিয়ে ক্রমে ডুব মেরে শিকল ধরে যেতে যেতে ঐ কড়ি কাঠ স্পর্শ করা যায়। ঠিক সেই রূপ জপ করতে করতে মগ্ন হয়ে গেলে ক্রমে ভগবানের সাক্ষাৎকার হয়।.......জপ থেকে ঈশ্বর লাভ হয়। নির্জনে, গোপনে তাঁর নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শণ।"


রামপ্রসাদের একটি বিখ্যাত গান আছে, পরম পূজ্যপাদ স্বামী শিবানন্দজী মহারাজ এটি খুব বলতেন:

মন বলি ভজ কালী ইচ্ছা হয় তোর যে আচারে,

গুরুদত্ত মহামন্ত্র দিবানিশি জপ করো।।

শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান,

নগর ফের মনে কর প্রদক্ষিণ শ্যামা মারে।।

যত শোন কর্ণপূটে, সবই মায়ের মন্ত্র বটে,

কালী পঞ্চাশবৎবর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।।

চর্বচোষ্য লেহ্য পেয়, যত রস এ সংসারে

আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মারে।।

আনন্দে রামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজেন সর্বঘটে,

রূপে রূপে যতরূপ, মা আমার সে-রূপ ধরে।।


মহারাজ আরও বলতেন, "ঠাকুর নিজেই বলে গেছেন, 'হেলায়, শ্রদ্ধায় যে আমার নাম করবে, তাকে হাত ধরে আমি মুক্তিধামে নিয়ে যাবো'। তাঁর বাক্য কখনো মিথ্যা হয় না।"




Sunday, January 16, 2022

মায়া ও প্রেম

যমুনার দুই কূল - যেন অনুকূল আর প্রতিকূল। তার একদিকে শ্রীকৃষ্ণ সন্তান, সখা, সংসারী আর অন্যদিকে সহায়, সম্বল, সম্রাট। যা একসময় অনুকূল তাই পরে প্রতিকূল হয়ে যায় - তিনি সেই যে ব্রজভূমি ছেড়ে চলে যান আর ফেরেন না। যেন যমুনার একদিকে শ্রীরাধা, অন্যদিকে রুক্মিণী। একজন শ্রীকৃষ্ণে সমাগতা, অন্যজন শ্রীকৃষ্ণের সহায়িকা। দুজনেই প্রেমিকা, দুদিকেই সম্পুর্ন সমর্পণ, কিন্তু দুজনের আত্মনিবেদনের পথ একেবারে আলাদা - একদিকে মধুরভাব আর অন্যদিকে দাস্যভাব। 


যেন যমুনার এককূলে অনুরাগ, অন্য কূলে আনুগত্য। এ যেন দুইপাশে দুটি স্পম্পূর্ণ আলাদা জগৎ, তাদের ধ্যেয় এক হলেও ধ্যানালোক আলাদা, মাঝে মনরূপী যমুনা জন্মজন্মান্তর ধরে বহতি। আসলে সবটাই মায়া, আর সেই মায়ার চিদাকাশ জুড়ে মায়াতীত সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ। আসলে 'শূন্য' এবং 'পূর্ণ' যে একই বস্তু,  'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়মেকমেবাদ্বিতীয়ম্', এবং মায়া ছাড়া জগতের অস্তিত্ব নেই, ফলে ধর্মাধর্ম নেই আর মুক্তির অবকাশও নেই, সেই কথাই যেন যমুনার দুই তীরে প্রতীয়মান। এ যেন শুদ্ধ বাসনা আর অবাসনার মধ্যে সীমারেখা মিলিয়ে যাওয়ার খেলা। পরবর্তী অবতারে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর পার্ষদদের বারবার বলতেন “ছোট ছোট এক-আধটা বাসনা জোর করিয়া রাখিয়া তদবলম্বনে মনটাকে তোদের জন্য নিচে নামাইয়া রাখি! নতুবা উহার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অখণ্ডে মিলিত ও একীভূত হইয়া অবস্থানের দিকে।” (লীলাপ্রসঙ্গ, ত্রয়োদশ অধ্যায়: মধুরভাবের সারতত্ত্ব)


ঠাকুরের পার্ষদ মায়ের দ্বারী পূজ্যপাদ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ প্রেমে ঐশ্বর্যজ্ঞানের লোপসিদ্ধির বিষয়ে লিখেছেন, 'প্রেমের স্বভাব পর্যালোচনা করিয়া একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, উহা প্রেমিকদ্বয়ের ভিতরে ঐশ্বর্যজ্ঞানমূলক ভেদোপলব্ধি ক্রমশঃ তিরোহিত করিয়া দেয়। ভাব-সাধনায় নিযুক্ত সাধকের মন হইতেও উহা ক্রমে ঈশ্বরের অসীম ঐশ্বর্যজ্ঞান তিরোহিত করিয়া তাঁহাকে তাঁহার ভাবানুরূপ প্রেমাস্পদমাত্র বলিয়া গণনা করিতে সর্বথা নিযুক্ত করে। দেখা যায়, ঐজন্য এই পথের সাধক প্রেমে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণভাবে আপনার জ্ঞান করিয়া তাঁহার প্রতি নানা আবদার, অনুরোধ, অভিমান, তিরস্কারাদি করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না। সাধককে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যজ্ঞান ভুলাইয়া কেবলমাত্র তাঁহার প্রেম ও মাধুর্যের উপলব্ধি করাইতে পূর্বোক্ত ভাবপঞ্চকের মধ্যে যেটি যতদূর সক্ষম, সেটি ততদূর উচ্চভাব বলিয়া ঐ পথে পরিগণিত হয়।'


আর মায়ার বিষয়ে স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, “বেলের সার বলতে গেলে শাঁসই বুঝায়, তখন বীচি আর খোলা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু বেলটা কত ওজনে ছিল ব’লতে গেলে শুধু শাঁস ওজন করলে হবে না। ওজনের সময় শাঁস, বীচি, খোলা সব নিতে হবে। যারই শাঁস, তারই বিচি, তারই খোলা।


“যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।


“তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া ব’লে জগৎ সংসার উড়িয়ে দিই না। তা হ’লে যে ওজনে কম পড়বে।”

(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত : শ্রীম-কথিত : সমগ্র সংস্করণ। পৃ: ১৪৪)

নরেন্দ্র মোদি

 আসলে কারো কারো ওনাকে বুঝতে ভুল হচ্ছে, ফলে একটা মিষ্টি অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়ে কেউ কেউ অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যও করে ফেলছেন। দোষটা তাঁদের নয়। এতসব কান্ড হচ্ছে, কারণ উনি কোনো conventional 'ism' মেনে চলছেন না - না অর্থনীতিতে, না সমাজনীতিতে, না বিদেশনীতিতে আর না সুরক্ষানীতিতে। ফলে যাঁরা বাঁধাধরা ছকে শ্রী নরেন্দ্র মোদিকে evaluate করতে চাইছেন, তাঁদের সাথে দেশের অধিকাংশ মানুষের perception আর মিলছে না।


আগামী ৬ই জানুয়ারি উনি চতুর্থবার UAE যাচ্ছেন, ২০১৪তে ওনার প্রথমবার যাত্রার আগে শেষবারের মতো ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী আমিরশাহীতে গিয়েছিলেন ৩১ বছর আগে। একদিকে দুনিয়াভরের বাম মিডিয়ার তৈরি করা image - রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক, মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গাকারীদের সর্দার অর্থাৎ একজন ঘোর অসহিষ্ণু নৃশংস হিন্দুত্ববাদী, আর অন্যদিকে আরব দুনিয়ায় যে আমূল পরিবর্তনের হওয়া বইছে, Abraham Accord এর পেছনে পেছনে হেঁটে তিনিই আজ মক্কা-মদিনার দেশের পরম মিত্র - গোটা আরব দুনিয়া আজ ওনাকে নিজেদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে অলংকৃত করছেন - দুটো ছবি মিলছে কই?


আবার এমন একটি রাজনৈতিক দলের তিনি অবিসংবাদী নেতা যা ওই বামপন্থী মিডিয়া, academic ও বুদ্ধিজীবীদের মতে ঘোর right wing, অর্থাৎ পুঁজিপতিদের দালাল। অথচ জনধন একাউন্ট খোলা থেকে নিয়ে open defecation ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব রুখতে স্বচ্ছতা অভিযান, প্রধানমন্ত্রী আওয়াস যোজনায় সমস্ত গরিবের জন্য পাকা বাড়ি থেকে নিয়ে মুদ্রা যোজনায় গরিব ছোট ব্যবসায়ীকে বিনা collateral রেখে অল্প সুদে loan, করোনাকালে বিনি পয়সায় রেশন থেকে নিয়ে প্রত্যেক কৃষকের ব্যাংক খাতায় বছরে ৬০০০ করে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া, গরিব মহিলাদের অর্থনৈতিক সশক্তিকরণ থেকে নিয়ে তালাক-এ-বিদদতকে আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বানিয়ে দেওয়া, প্রত্যেক জেলায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা থেকে নিয়ে প্রত্যেক গরিবের জন্য ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা করে দেওয়া, চতুর্দিকে dedicated freight corridor তৈরি করা যাতে শহরের produce-এর সাথে সাথে গরিব কৃষকের গ্রামীন ফসল এবং অন্যান্য গ্রামীন উৎপাদন সহজে এবং সস্তায় সারা দেশে বাহিত হতে পারে, সারা দেশজুড়ে চওড়া চওড়া highway তৈরি করা, রেলকে বিশ্বস্তরে নিয়ে যাওয়া যাতে সাধারণ মানুষের চলাচলের গতি বাড়ে, বড় এবং মাঝারি শহরে মেট্রো সহ public transport এর খোল-নোলচে বদলে ফেলা, public asset creation আর public utility services তৈরি করাতে স্বাধীনতাযাবৎ সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা, গরিব শিশুর অপুষ্টি রোধ করা থেকে নিয়ে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু ওনার সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে - সবকটিই একটি Welfare State-এর আদর্শ মডেল, অর্থাৎ নিখাদ সমাজবাদী মডেল। 


অন্যদিকে, সত্যিকারের capitalist হলে তো ওনার আমেরিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধানদের মতন crony capitalistদের বন্ধু হওয়া উচিত ছিল - উনি তাও না। যেভাবে নোটবন্ধি করে direct tax base বহুগুণ বাড়িয়ে নিয়েছেন বা বেনামি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন এনেছেন, যেভাবে GST লাগু করে ট্যাক্স ফাঁকি অনেকটা রুখে দিয়েছেন, অথবা bankruptcy আইন এনে ব্যাঙ্ক লুট করার খুড়োর কল বন্ধ করে দিয়েছেন, তাতে ওনার ঠিক ঠিক capitalist হওয়া আর হলো কই, যতই বামপন্থীরা আদানি আম্বানি বলে নাচুন না কেন। আবার রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়ে উনি entrepreneurship আর innovation-এর পেছনে ঢালের মতন দাঁড়িয়ে, বেশ কিছু যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানা আর এয়ার ইন্ডিয়ার মতন অব্যবস্থার শিকার সরকারি সম্পত্তিকে ব্যক্তি মালিকানায় transfer করে অথবা এয়ারপোর্ট, সিপোর্ট, PPP মডেলে রাস্তা, কিছু ট্রেন ইত্যাদি কর্পোরেট ব্যবসাদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, efficiency বাড়িয়ে exchequer-এর ওপর বোঝা কমিয়ে একদম ideal ব্যবসায়িক আবহাওয়াও তৈরি করছেন, যা মূলত মার্গারেট থ্যচারকে মনে করিয়ে দেওয়া পুঁজিবাদী মডেল। 


বিদেশনীতিতে মুসলমান দেশগুলির সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে নিজের হিন্দু পরিচয়কে জলাঞ্জলি দিতে হবে, সেই ধারণাও উনি ভেঙে দিয়েছেন। নিজের দেশের প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের মধ্যে ভবিষ্যতের প্রগতির ইন্ধন লুকিয়ে আছে - যে সভ্যতা এই কথা ভুলে গেছে তাদের সভ্যতার অন্তরাত্মার নাশ হয়েছে - তা সে মায়া থেকে ব্যবিলনীয়, মিশরীয় থেকে পারশিক, যেদিকেই তাকানো যাক না কেন। আমাদের দেশও সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছিল - উনি এসে আটকালেন। তাই মা গঙ্গায় ডুব দিয়ে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় জলাভিষেক করার মধ্যে কেউ কেউ হয়তো রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু সোমনাথের মন্দিরচত্বরের সংস্কার থেকে নিয়ে কেদারনাথের কায়াকল্প, কাশীর বিশ্বনাথ করিডোর নির্মাণ থেকে নিয়ে অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপূজন - এইসবই কোটি কোটি ভারতীয়দের আস্থার সম্মানসূচক এবং সময়ের দাবি মেনে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অন্তরাত্মার প্রতীকগুলির বহু প্রতীক্ষিত আধুনিকীকরণও বটে। 


কারো বন্ধু হতে গেলে এবং সবার মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে গেলে সবসময় মুখোশ পরে থাকতে হবে, ক্রমাগত ভরাপেটে ইফতারের মতন ভণ্ডামি করে যেতে হবে - এই দুষ্প্রথা ভেঙে উনি শুধু নিজের আস্থা ও সংস্কারের প্রতি নয়, সমস্ত মতের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। ওনার আচার-ব্যবহার, মানসিকতা, confidence ও commitment দেখে সারা পৃথিবী বুঝতে পারছে যে ভারত তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পেয়েছে, ফলে বিশ্বের দরবারে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। একদিকে unprecedented scale-এ দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে আর অন্যদিকে massive scale-এ infrastructural development-এর সাথে সাথে আধুনিক Central Vista এবং প্রাচীন heritage-এর সংস্কারের মাধ্যমে নতুন ভারতের architectural footprint তৈরি হচ্ছে। সর্বোপরি, আত্মনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে আমদানি কমিয়ে Make in India-র দৌলতে নিজস্ব production বহুগুণ বাড়িয়ে রফতানির দিকেও দ্রুতগতিতে দেশের অর্থব্যবস্থা ছুটে চলেছে। নিজের আস্থার প্রতি unwavering আস্তা রেখে এবং কোনো ভনিতা না করেও কিভাবে যে মত-পন্থ-নির্বিশেষে সকলের মঙ্গলের জন্য একের পর এক অত্যাধুনিক AIIMS-এর উদ্বোধন করা যায় বা ২০৩০এ অন্তরীক্ষে space station পাঠানোর নির্ণয় নেওয়া যায়, এটাই অনেকে বুঝে উঠতে পারছেন না কারণ ওঁরা এমনটা যে আগে কখনো দেখেননি।


আসলে এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় কিন্তু তাতে লেখাটা বড্ড বড় হয়ে যাবে, পাঠকের অত সময় নষ্ট করে লাভ নেই। মোদ্দা কথা হলো এটাই সত্যিকারের হিন্দু way of life, সে কারো পছন্দ হোক বা নাই হোক। হিন্দু মানেই tolerent, হিন্দু মানেই maleable আর হিন্দু মানেই সংস্কারিত, শীল, সুজন। আবার হিন্দু মানে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার ধারক এবং বাহক - শত আঘাতেও যখন হিন্দুর হিন্দুত্বকে শেষ করে দেওয়া যায়নি তখন একথা মানতেই হবে যে হিন্দু অসম্ভব resilient, মানসিকভাবে অসম্ভব শক্তিমান আর মারাত্মক প্রত্যয়ীও বটে। তাই উনি আমেরিকার সাথে QUAD মিটিং করেন, চীনের সাথে বর্ডারে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করেও নির্বিঘ্নে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চালিয়ে যান আর রাশিয়ার থেকে S400 কিনেও কোনো মার্কিনি প্রতিবন্ধন face করেন না।


শ্রী নরেন্দ্র মোদি একজন প্রকৃত হিন্দু। আর হিন্দু বলেই নির্ভেজাল কম্যুনিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট, কাসটিস্ট, রিফরমিস্ট, কনজারভেটিভ, ডগমাটাইসড - পুরোপুরি কোনোটাই নন আবার সবকিছুরই ভালো অংশ কিছু থেকে থাকলে, তার আগ্রহী গ্রহীতা। ফলে ওনাকে ছকে ফেলা যাচ্ছে না, আর সেখানেই বাকি সকলের মহাসমস্যা কারণ তাঁদের সব agenda-ই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। হিন্দুর প্রধান শক্তি যে জাতিটি stereotyped নয় - সে উদার। হিন্দুকে যারা typecast করতে চাইবেন, তাঁদের এই ধরণের সমস্যায় পড়তেই হবে। কিছু করার নেই ভাই, অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে নিজেদের হিন্দুত্ব জাহির করতে পারা যাচ্ছে কিনা, তাই দেশটি এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নানা স্তরে নানা জায়গায় নানা সময়ে নানান ভোট আসবে যাবে, তাতে ওনার কিছু আসে যায়না। উনি ওনার পথেই এগিয়ে যাবেন কারণ দেশ আজ নিজেকে চায়।



মা

নিজের জন্মদাত্রী মাকে কি দেবীরূপে পূজা করা যায়, এমন একটি প্রশ্ন নানাভাবে এসেছে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে অবশ্যই যায়, নিশ্চয় যায়, একশবার যায়। সাধারণত প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভালো মন্দ মেশানো থাকে, যদি জন্মদাত্রীর মনুষ্যরূপী মন্দটিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র তাঁর পবিত্রতার প্রতিমূর্তি মাতৃরূপকে স্মরণ করা যায়, তাহলে তিনি এবং ধ্যানগম্যা দেবী অভিন্ন। আমরা যখন শ্রদ্ধা ভক্তি সমর্পন ও ভালোবাসার স্তবক দিয়ে নিজেদের মাকে প্রণাম করি, তখন তো কেবল একজন জাগতিক ব্যক্তিকে প্রণাম করিনা, মহাশক্তির সেই অংশকে প্রণাম করি, যিনি নিজের গর্ভে ব্রহ্মকে ধারণ করেছেন। কিন্তু catch এটুকুই - ধ্যানের সময় গর্ভধারিনী জননীর শুদ্ধ মাতৃরূপ ছাপিয়ে কখনো যেন তাঁর জাগতিক সংকীর্ণতার কোনো স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে না ওঠে। 

জীবনে অনেকরকমের মানুষ দেখতে পাওয়ার দৌলতে একসময় একজন পরম মমতাময়ী মানবী মায়ের ত্যাগের প্রতিমূর্তি অপূর্ব মাতৃরূপও দেখেছি আবার পরবর্তীতে তাঁর অধিকারবোধ যখন মাতৃত্বকে ছাপিয়ে গিয়ে তাঁকে চরম মোহগ্রস্ত করে তুলল, তখন তাঁর অদ্ভুত বিধ্বংসীরূপও দেখেছি। এর ফলে সন্তানের বৃত্ত থেকে তাঁর নিজের alienation ও তাঁর গোটা পরিবারের ভেতরের আস্থা ও ভালোবাসার বন্ধন ধীরে ধীরে কিভাবে নষ্ট হয়ে গেল, তাও দেখেছি। এই গর্ভধারিনী তাঁর নিজের সন্তানেরও যে একটি স্বতন্ত্র identity আছে - তিনি যে কারো স্বামী বা স্ত্রী, কারো সম্বন্ধী, কারো পিতা বা মাতা ইত্যাদি এবং এই সম্পর্কগুলো প্রত্যেকটিই যে সেই সন্তানের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, তার sanctity কিছুতেই মানতে চাইতেন না। এবং উপাধিজনিত ব্যক্তি-অধিকারসুলভ 'আমার সন্তান' এই ভাব থেকে সেই সম্পর্কগুলোকে শুধু যে ক্রমাগত হেয় করতেন তা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ভয়ানক অপমান করতেও ছাড়তেন না। এতে যে তাঁর মমতার হানি হয়, মাতৃত্বকে অহংকার দিয়ে ঢেকে দিলে কেবল যে আমিত্বকেই জাহির করা হয় আর ক্রমে ক্রমে মায়ের ভূমিকা সন্তানের জীবনে unacceptable হয়ে পড়ে, এটা বোঝার মতন দূরদর্শিতা তাঁর ছিল না। 

আমি এও দেখেছি প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত হয়ে বৃহত্তর পরিবারের কাছ থেকে alienate করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এককালের সেই পরম মমতাময়ী মা পরবর্তীকালে আত্মীয়স্বজনদের কাছে নিজের সন্তান ও তাঁর স্বজনদের নিন্দামন্দ করাকে প্রশ্রয় দিতেন। সন্তানের আর্থিক অনিশ্চিয়তা ও ক্লেশও ওইসময় তাঁর অপপ্রচারের পক্ষে বেশ সহায়ক হয়েছিল। আর এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সন্তানের spouce, যিনি বৈবাহিককারণে তাঁর পরিবারের সাথে যুক্ত হয়েছেন, invariably তাঁকেই অকারণে সমস্ত অশান্তির মুখ্য কারণ বা main culprit সাব্যস্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি গঞ্জনা ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়, যা ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে গিয়ে একসময় গোটা পারিবারিক বন্ধনকেই ভেঙে চুরমার করে দেয় - ওনার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। বোঝানোর অনেক চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু কুপরামর্শদাতাদের ওপর ওঁর বেশি আস্থা থাকায়, বিশেষ কাজ হয়নি।

তাহলে মোদ্দা কথা কি দাঁড়ালো? একজন মা, হন না তিনি জাগতিক মা, তিনি সন্তানকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করলেন, অত যন্ত্রনা সহ্য করে সন্তানের জন্ম দিলেন, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে প্রতিপালন করলেন, সারা জীবন প্রচুর ত্যাগস্বীকার করলেন, স্নেহ ভালোবাসা ভরসা আর মাতৃশক্তিতে তার জীবন ভরিয়ে দিলেন, অথচ সেই ঐশ্বরিক মাতৃত্বের যে কোনো জাগতিক প্রতিদান হতেই পারেনা, দুর্ভাগ্যবশত মায়ার বশে হয়তো সেই বোধই তাঁর ভেতর জাগলো না অথবা তিনি বিস্মৃত হলেন। গর্ভধারিণী যখন মায়ায় ভ্রমিত হয়ে নিজের ঈশ্বরীয় রূপকে ভুলে মাতৃত্বকে জাগতিক দান-প্রতিদানের নগন্য transactional অবর্তে নামিয়ে আনেন, তখন কি আর তা সন্তানের জন্য কল্যাণকর হতে পারে? এখানেই আধ্যাত্মিক জীবনে 'সত্যিকারের মা' বা দেহধারিণী সাক্ষাৎ জগন্মাতার প্রয়োজনীয়তা, যাঁর মধ্যে নিজের গর্ভধারিণীর অনন্দবর্ধক বিশুদ্ধ মাতৃরূপটিও স্বমহিমায় সমাগতা।

আমাদের সেই ধ্যানগম্যা জননীরূপী দেবীর রূপ একেবারে পূতপবিত্র হতে হবে, আশক্তিবিহীন হতে হবে, দুঃখহীন হতে হবে, আকাঙ্খাহীন হতে হবে, চির-আনন্দময়ী, চির-স্নেহময়ী, চির-বরাভয়দাত্রী, ত্যাগস্বরূপিণী, মহাশক্তিস্বরূপা জগৎপ্রশবিনী হতে হবে, তবে তো সেই মূর্তি হৃদয়ে চিরস্থায়ী হবে। সে মাতৃমূর্তি এমন, যাতে মাতৃত্বের যা কিছু ভালো সব কিছু আছে কিন্তু জাগতিক দৈন্য ও ক্ষুদ্রতার লেশমাত্র নেই, যাঁর কথা চিন্তা করলে উদ্দীপনা হয়, নিশ্চিন্তে আধাত্মপথে অগ্রসর হওয়া যায়, কোনো অবস্থায় কোনো জাগতিক সংকীর্ণতার কথা মনে পড়ে ধ্যানভঙ্গ হয়না। সন্তানরূপে ইষ্টকে চাওয়া হলো সবচেয়ে সহজ স্বাভাবিক আর শুদ্ধ চাওয়া। শ্রীশ্রীমা তাই নিজমুখেই বারবার বলেছেন, “আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।” 

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে জগতের ইতিহাসে এই প্রথম মানবদেহে অবস্থানরত একজন মাতৃরূপা ঈশ্বরীর ৩৩টি ফটোগ্রাফ আমাদের সামনে আছে - মধ্য থেকে নিয়ে বৃদ্ধ বয়স পর্য্যন্ত, নানা ভঙ্গিমায়, নানা পরিবেশে। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন তা আমাদের কষ্টকল্পনা করতে হয়না, আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। তিনি কি বলতেন, কিভাবে বলতেন, কি করতেন, কি খেতেন, কি পরতেন - সব আমরা বই থেকে সহজেই জানতে পারি। যে পরমাপ্রকৃতি পবিত্র মাতৃরূপা ইষ্টের সন্ধান আমরা করি, তিনি একেবারে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছেন, তাঁর ব্যবহৃত জিনিষপত্তর, বাড়িঘর সব রয়েছে, আর তাঁর আধ্যাত্মিক aura রয়েছে, যার স্পর্শ পাওয়া অসম্ভব নয়। তিনিই পরম সত্য কারণ তিনি নিত্য, অনন্ত, constant - আর কি চাই? হ্যাঁ, তবে একটা সংশয় থাকতে পারে - মা কি আমায় কৃপা করবেন কারণ মায়ের কৃপা ছাড়া যে তাঁর দিকে এক পাও এগোবার উপায় নেই? মা নিজেই সেই আশ্বাস আমাদের দিয়েছেন, “যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।”

মা - ছোট্ট একটি শব্দ কিন্তু তার মধ্যেই ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মান্ডের মহাবীজ লুকিয়ে আছেন। যে মহাশক্তির ইচ্ছা ব্যতিরেকে গাছের একটি পাতাও নড়তে পারেনা, আমরা প্রত্যেকে সেই অনাদি অনন্ত মহামায়ীর সন্তান। আমরা প্রত্যেক জীব তাঁরই তৈরি করা পঞ্চভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, মন আর বুদ্ধির সম্মিলিত সাময়িক ফল। আমাদের দেহে প্রাণ তাঁর দান, আমাদের বোধ তাঁর দান, তাঁর থেকেই আমাদের উৎপত্তি আবার তাঁতেই আমাদের বিলয় - কেবল মায়ার প্রপঞ্চে ভুলে অহঙ্কারজনিত দেহসর্বস্বতার অজ্ঞানতা আমাদের নিজস্ব জৈবিক বুদ্ধির বিকার। মাই পরমাশক্তি, পরমাজ্ঞান, পরমামুক্তি, পরমাপ্রেম, পরমানন্দ - সবকিছু। আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে তাঁর বাস। তিনিই সেই মহাদেবী যিনি অপার করুণাবশতঃ ত্রিজগৎপ্রসবিনী হয়েও এই অনিত্য জীবশরীররূপী হৃদপদ্মে নিত্য শুদ্ধ আত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই আমরা মায়ের সব সন্তান অমৃতের পুত্রই শুধু নই, অমৃতের সাক্ষাৎ প্রকাশও বটে। আমার জন্ম বিশ্বেশ্বরীর অংশে, আমার যাপন তাঁর ইচ্ছাধীন, আমার বিলয় তাঁতে, আমার পৃথক অস্তিত্ব বলে বস্তুতঃ কিছু নেই - যা আছে সবটুকু তাঁরই, কেবল এই মুহূর্তে এই শরীর-মনরূপে প্রতিভাত। আমি ভবানীর ছেলে - আমি তাঁরই প্রকাশ্য রূপ, তাঁর শুদ্ধত্ব বইছে আমার মধ্যে - তাই আমিও অবিনশ্বর, ঈশ্বরত্ব পেরিয়ে আমিই ব্রহ্ম। জয় মা।

Saturday, January 15, 2022

স্বামী প্রেমেশানন্দজী

শ্রীশ্রীমায়ের সন্তান স্বামী প্রেমেশানন্দজী মহারাজ দীর্ঘদিন সারগাছি আশ্রমের মোহন্ত হিসেবে কাজ করার পর অবসর জীবনটি কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে কাটান। অসুস্থ অবস্থায় পূজনীয় প্রেমেশ মহারাজের সেবক ছিলেন তৎকালীন ব্রহ্মচারী, পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের সহসঙ্ঘাধক্ষ, স্বামী সুহিতানন্দজী মহারাজ। উনি ওনার ‘সারগাছির স্মৃতি’ বইতে খুব সুন্দরভাবে মহারাজের পুণ্য স্মৃতিকথা ধরে রেখেছেন। বইটিতে সেবক নানান প্রশ্ন করছেন আর পূজনীয় মহারাজ তার উত্তর দিচ্ছেন। তার মধ্যে মনের অবস্থান সম্পর্কে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। মহারাজ বলছেন,


"খুব ভাল করে শুনে রাখো - আধ্যাত্মিক জীবন হলো সবটাই মনের ব্যাপার। 

অন্তর্জীবন লোক-দেখানো কোনো ব্যাপার নয় - টিকি রাখা, গেরুয়া পরা উদ্দেশ্য নয়; এগুলো উপায় মাত্র।"

সেবক: মন কী করে গুরু হয়?

মহারাজ: "যদি তোমার ইষ্টে অধিক টান হয়, তাহলে তোমার মন ইষ্টপ্রীতি ছাড়া অন্য কিছুতে যেতে চাইবে না।

অর্থাৎ মন ভাল জিনিসই নেবে।

তখনই মন গুরু হয়ে যায়।

তোমাদের বিশ্বাস থাকা চাই - আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে আশ্রয় করেছি, আমার আবার ভাবনা কী?

'ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব হচ্ছে, ঈশ্বর সব সেজেছেন' বলে নিজের কর্তব্য এড়িয়ে গেলে চলবে না। 

যতক্ষণ দেহের মধ্যে আছি ততক্ষণ ও কথা বলার জো নেই।"


আবার কাজ আর ধ্যানের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার বিষয়েও মহারাজ বড় সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। এ বিষয়ে ওনার বিভিন্ন বক্তব্যকে আমি নিজের মতন করে এখানে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দিচ্ছি। পূজনীয় মহারাজ বলছেন,

"যদি তোমার কাজের নেশা থাকে, তাহলে হিমালয়ে গিয়েও নিস্তার নেই, সেখানে আবার ঘর-বাড়ি করে হাঙ্গামা বাধাবে। 

কাজের নেশা এমনই।

"কিছুদিন কাজ করে একেবারে সরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়—

১. কতখানি আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি? 

২. কেবল দেখা - মন কীসে কীসে নাচে? 

৩. কোন্‌ জিনিসটা সে চায়? 

৪. বুকের ভেতর না গিয়ে কেন সে বাইরের রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ চায়? 

৫. কেন মন শ্রীরামকৃষ্ণকে চায় না? 

যখনি দেখবে মন স্থির নয়, তখনি বুঝবে মন উত্তেজিত হয়েছে - হয় কামে, নয় ক্রোধে, নয় লোভে, নয় মাৎসর্যে।

৬. ধ্যান করা মানে কী? 

মনকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করার অভ্যাস হলো ধ্যান। 

অর্থাৎ সারাদিনের কাজের মধ্যে অন্তত কিছু সময় এমন একটা জিনিস চিন্তা করব, যা প্রশান্ত অর্থাৎ সেটা আমার উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেবে।

আসল ব্যাপার হলো স্বাভাবিক হওয়া।

হাঁটা, চলা, খাওয়া - সব ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকা। 

"যারা রজোগুণী, তারা নিজেকে প্রকাশ করতে চায় মানযশের জন্য। 

দেখ, আমি statement of fact বলি, তোমাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিই। কিন্তু কাউকে ঘৃণা করি না - কাছে ডাকি, বসাই, সুখ-দুঃখের কথা বলি।

যে যা প্রশংসা করবে - সাবধানে নেবে। 

কারণ, সংসারে তোমার কিছু গ্রহণীয় নেই, সবই পরিত্যাজ্য।

কেউ যদি কখনো তোমাকে মহাপুরুষ বলে, সাবধান হবে

"কেউ কেউ ভাবে, যারা ধ্যান করে না তাদের হবে না।

কেউ হয়তো ধ্যান, পাঠ করে। 

কিন্তু দেখা গেল, যে ‘কাজ কাজ’ করে বেড়াত, মরার সময় সে ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলে চলে গেল। 

অর্থাৎ সে কাজে থাকত, সে জানত যে, আমি ধ্যান পারি না; কিন্তু তার দৃঢ় আস্থা ছিল যে, আমি ঠাকুরেরই কাজ করছি।

কথামৃতে পড়েছ তো - ঠাকুর মন দেখেন।"


"যদি (কেউ) ঠাকুরের ব্রতকার্যে সাহায্য করে সেও মুক্ত হবে।

সেবক : ঠাকুরের ব্রতকার্য কী ?

মহারাজ  : ভালবাসা,  সকলের কল্যাণচিন্তা করা - কীভাবে তাদের সেবা করা যায়। 

'শিবজ্ঞানে জীবসেবা'। 

আর, চার যোগ যে এক, সেটাও জানা। 

শুধু কর্ম করতে গিয়ে বহির্মুখ, (বাকি) ধ্যান করতে করতে আধপাগলা, জ্ঞানে পন্ডিত আর ভক্তিতে আবেগপ্রবণ - এই চারটের সমন্বয় প্রয়োজন। জ্ঞান না থাকলে এবং যোগ না থাকলে, মানুষের শরীরের প্রতি আসক্তি এসে যায়। নারায়ণ বুদ্ধি দূরে পড়ে থাকে।"


আরো অনেক মণিমুক্তা ছড়িয়ে আছে বইটিতে। ২৫.৩.৪৯ তারিখ রাতে সেবককে মহারাজ বলছেন, "যখন সময় পাবে জপে বসবে। একটা অভ্যাস করতে হবে। রাত্রে শোবার আগে অন্তত ১০ মিনিট চিন্তা করবে - চিন্তা করবে বালিশের ওপর ঠাকুর, মা, স্বামীজীর পা রয়েছে। আর তুমি শুয়ে আছ।"

সেবক : এই জগৎ কতখানি সত্য? 

মহারাজ : যতখানি আমার কাছে revealed হচ্ছে। চোখ না থাকলে জগতে আমার দ্রষ্টব্য কিছুই নেই। স্বপ্নে যখন কিছু দেখি, সেটা কি মিথ্যা বোধ হয়? তখন সেটা যতখানি সত্য, এই বাস্তব জগৎ নিদ্রোত্থিত অবস্থায় ততখানি সত্য; এর বেশি নয়।

এরই মধ্যে ছোট্ট করে শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতি - সেবক রাসবিহারী মহারাজের গায়ে পা লেগে যাওয়ায় মা নিজেরই সাধুরূপী আশ্রিত সন্তানকে নমস্কার করে বলছেন, "বাবা, তোমরা দেবের দুর্লভ ধন"!


[স্বামী প্রেমেশানন্দ ১৮৮৪ সনে সিলেটের দুলালী পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বনাম ইন্দ্রদয়াল ভট্টাচার্য। সিলেটে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম প্রতিষ্ঠার মূলেও তার প্রভাব স্মরণীয়। ১৯০৯ সনে উদ্বোধনে শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করে ১৯১৩ সনে তাঁর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সনে স্বামী শিবানন্দের নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ। প্রথমে ঢাকা মঠে এবং পরবর্তিকালে সারগাছি কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ছিলেন । তিনি গীতিকার, সুগায়ক ও অনেক গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন। তিন খন্ডে বিস্তৃত স্বামী প্রেমেশানন্দের পত্র-সংকলন পড়ে অনেক মানুষ আধাত্মজীবনে অগ্রসর হওয়ার রসদ পেয়েছেন। ১৯৬৭ সনে পূজনীয় মহারাজ রামকৃষ্ণলোকে গমন করেন ]

শ্রীসারদা মঠের 'নিবোধত' পত্রিকায় পূজনীয় প্রেমেশ মহারাজ সম্পর্কে একটি খুব সুন্দর স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হয়েছিল, তার PDF লিঙ্ক এখানে তুলে দিলাম।

http://srisaradamath.org/publication/nibodhata/320603.pdf

New security policy of Pakistan

One needs both intent and capability to achieve one's objective. Does Bharat have the capability to dissolve Pakistan? Yes ofcourse. But do we have the intent to do so? No, atleast not for now. Does Pakistan want to achieve their dream of Gazwa-e-Hind? You bet. They have all the intent in the world but they simply lack the required capability. All this aman-ki-asha type hype in Bharat about the new national security policy of Pakistan favouring good relations with Bharat and not engaging in conflict for the next 100 years, is a bunkum. The Pakistani political and military establishment has institutionally brainwashed the common gullible Pakistani to wage 'jihad' against a 'kafir' Bharat for more than seven decades. They know that they would face a public backlash now if they actually want to follow this so-called 'policy' of theirs. 


Actually, as far as Bharat is concerned, there is no greater falsehood than those contained in this bogus propaganda material produced by the Pakistani establishment, which is traditionally too clever by the half. They have written this document not as a part of any real policy initiative but as a means to brag and deceive and eventually beg for favour from the world community. Right now Pakistan is completely broke - they are incapable of creating favourable opinion and/or circumstances to achieve their Kashmiri dream, as nobody takes a begger seriously. US has stopped giving them money and arms, Europe does very little business with them, the Arabs have snubbed them and the Chinese are extremely cross with their double-speak and corruption. The Pakistani passport is ranked 4th from the bottom, performing even worse than a North Korean one.


Pakistan is desperately trying to get into a trio with Russia and China, leveraging their strategic location, just so that some dollars keep flowing in. The moment they get some alms again, they would start funding terrorists to continue to inflict a thousand cuts on us - let there be no illusion. We have already called their nuclear hoax out. We have gone in and bombed terrorist camps in their territory. We have squeezed their arms in FATF and IMF. We have militarised heavily over the past two years and have tilted the regional power balance hugely to our favour. Their dream of getting the Taliban on their side to fight against us has fallen flat. Their decision to stop trade with Bharat has ruined their economy, with zero impact on ours. They are in a serious situation of loosing their nuclear assets to debtors as they currently have no economic sovereignity whatsoever, as their NSA Dr. Moeed Yusuf has publicly admitted. 


Pakistani generals and politicians have made billions while 22% of the common population is living under the poverty line. Their inflation rate is double digit at 12.3%, literacy rate is the lowest in the South and overall Asia, resulting in the country being ranked 99 out of 132 in the Global Innovation Index and under the human capital and research indicator, Pakistan ranks 117th while Bharat ranks 46th. Pakistan's currency has tanked against the USD at 175.86 officially and their Debt to GDP ratio stands at a stagerring 87.56%. Let us be absolutely clear - Bharat does not need Pakistan, neither friendship nor enmity. It is Pakistan that needs Bharat for her own survival. However, this is one hybrid establishment that cannot be trusted. 


It would be better if we trash this so called policy of theirs' and call a spade a spade. However, I am pretty sure that the Indian Pidi media would soon start tomtomming this propaganda document as Divine communion, since their overseas friends have openly stated that good neighborly relations will have to wait. They do not wish to do business with a Modi-led government and unfortunately for them Modi isn't going anywhere anytime soon. Well, Mani Shankar Iyer did go to his dreamland and asked for their help in dislodging Modi - didn't he? So here is their return gift for the likes of him, equally trashy. 


By the way, while Pakistan shall continue to struggle with their paltry Forex reserve of $17.6Bn, Bharat shall comfortably pay back $256Bn long-term foreign debt in 2022 alone, that Mani Shankar's party led government had borrowed 15 years back. In the next 5-7 years, Bharat's vital defense modernisation would be to the tune of $130Bn, most of it from factories manufacturing in Bharat, while Pakistan will keep struggling to produce better handmade footballs perhaps. So much so for partition and for Pak-i-stan.

Thursday, January 13, 2022

মকরসংক্রান্তি

 আজ মকর সংক্রান্তি। সমস্ত ভারতবাসীকে জানাই এই শুভদিনে তাঁদের স্থানীয় উজ্জাপন উৎসব অনুসারে আন্তরিক প্রীতি এবং শুভেচ্ছা। এই সময়েই সূর্য উত্তরে যাত্রা শুরু করে, আমরা যাকে সূর্যের উত্তরায়ণ বলি এবং এর ফলে শীত কমতে থাকে। সারা বিশ্ব জুড়ে যেখানে যেখানে হিন্দু সভ্যতার প্ৰভাব ছড়িয়েছে, সেখানে সেখানেই মকর সংক্রান্তি উজ্জাপন করার প্রথা সৃষ্টি হয়েছে। এর যেমন শস্য এবং স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত ভৌতিক কারণ আছে, তেমনি জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনকে আবাহনের মাধ্যমে নিজেদের সর্বদা উন্নততর করার হিন্দু সভ্যতার যে প্রাচীন ধার্মিক পরম্পরা, এটি তারও দ্যতক বটে। মহাভারতে দেখি মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় প্রাণত্যাগ করেছিলেন।


দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব বিভিন্নভাবে পালিত হয় যেমন পশ্চিমবাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, গঙ্গাসাগরে স্নান ও জয়দেবের মেলা, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহ্রি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, অন্ধ্রপ্রদেশে ভোগী মোন্তালু, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই চলে, যদিও তার পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও মকর উৎসবের নানান রূপ আছে, যেমন বাংলাদেশে এর নাম সাকরাইন, নেপালে এটা পরিচিত মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান।


ঔপনিবেশিক সাহেব শাসকরা শিখিয়েছিলেন ভারত নাকি একটি সংগঠিত উন্নত রাষ্ট্র ছিলনা, আর্যরা এসে নাকি আমাদের মানুষ করেছিল। এই এক মকর সংক্রান্তি পালনের প্রথাই সেই মিথ্যেকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই সময়েই ওডিশার ভুঁইয়া জনজাতির মানুষ এবং বাংলার পশ্চিম প্রান্তের মানুষ টুসু উৎসব পালন করেন। মণিপুরে অনেকে তাঁদের পরম ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করেন, এমনকী সুদূর অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের কাছে ব্রহ্মকুণ্ডে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার আরাধনা করা হয়, এই দিনটিতে সেখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় লোকনৃত্যের আসর বসে। এমনকী এখনকার সবরীমালার প্রসিদ্ধ হিন্দু মন্দিরে বিরাজিতা এক সময়ের বৌদ্ধ দেব শাস্তা এই দিন লক্ষ লক্ষ ভক্তের পুজো পান, সেই ভক্তেরা বিস্তর কৃচ্ছ্রসাধন করে তাঁর কাছে পৌঁছন। 


সূর্য যে এ দিনই ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে, সেটা আমাদের পূর্বপুরুষ অঙ্ক কষে বের করেছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তি শুধু যে ভারতের একীভূত সংস্কৃতির পরিচায়ক, তা নয়, প্রাচীন ভারতের উন্নত বিজ্ঞানচর্চা ও সমাজের সর্বপ্রান্তে সর্বস্তরে তার নির্যাস সাধারণের মধ্যে পৌঁছানোর সহজপন্থা উদ্ভাবনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণও বটে। কোথায় কাশ্মীর আর কোথায় সবরীমালা, কোথায় মূল ভারতীয় ভূখন্ড আর কোথায় লাওস - একই সংস্কৃতি যখন এত বৈচিত্রের মধ্যেও এই ধরণের মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়, তখন কোথাও না কোথাও নিঃশব্দে এক মহতী রাষ্ট্র নির্মিত হয়, যা আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দেশজুড়ে বিস্তৃত হলেও, মূলত আজও তার প্রাচীন আত্মিক অভিন্নতার কারণে নানা আক্রমণ হজম করেও অক্ষুন্ন আছে। ইনিই আমাদের জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী সমগ্র জাতির আত্মপরিচয়-সূচক হিন্দুরাষ্ট্র, যিনি প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির দিন নিজের অস্তিত্বকে আবার নতুন করে জাহির করেন।

বিদ্যাসাগরের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণ

৫ই অগাস্ট ১৮৮২ সাল, শনিবার ছিল। সেদিন বিকেল ৪টের সময় শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজে যেচে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে দেখা করতে তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে, ছিলেন রাত ৯টা পর্য্যন্ত। পাঁচ ঘণ্টা বড় কম সময় নয়, নিশ্চয় অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। দশ বারো পাতায় সেই সাক্ষাৎকারের নির্যাসটুকু প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীম ধরে রেখেছেন কথামৃতে। এই বিদ্যাসাগরের religiosity কেমন? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে শ্রীম বর্ণনা করছেন, 'ধর্ম-বিষয়ে বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না। তিনি দর্শনাদি গ্রন্থ পড়িয়াছিলেন। মাস্টার একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আপনার হিন্দুদর্শন কিরূপ লাগে?” তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার তো বোধ হয়, ওরা যা বুঝতে গেছে, বুঝাতে পারে নাই।” ঈশ্বর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের ধারণা কেমন ছিল তাও উনি শ্রীমর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। শ্রীম জিজ্ঞেস করেছিলেন, "ঈশ্বর সম্বন্ধে কিরূপ ভাবেন"। বিদ্যাসাগর বলিয়াছিলেন, “তাঁকে তো জানবার জো নাই! এখন কর্তব্য কি? আমার মতে কর্তব্য, আমাদের নিজের এরূপ হওয়া উচিত যে, সকলে যদি সেরূপ হয়, পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে।" এই সেই বিদ্যাসাগর যিনি একসময় পাঠ্যক্রমে ভারতীয় দর্শনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে সাহেবদের বলেছিলেন, "That samkhya and vedanta are false statement of philosophy is no more in dispute. There is nothing substantial in them"।


দেখছি এই মানুষটাকে ঠাকুর যেন হাত ধরে ধীরে ধীরে confusion থেকে resolution-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তা দেখাচ্ছেন। বলছেন, “তাঁকে কি বিচার করে জানা যায়? তাঁর দাস হয়ে, তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁকে ডাক।

(বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে) — “আচ্ছা, তোমার কি ভাব?”

বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব।” (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — তাঁকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না। 

খানিকক্ষণ পর দেখছি কর্মযোগী ঈশ্বরচন্দ্রের ভেতরের ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার সহজ উপায় বাতলে দিচ্ছেন,

"তুমি যে-সব কর্ম করছ এতে তোমার নিজের উপকার। নিষ্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালবাসা এলেই তাঁকে লাভ করতে পারবে। জগতের উপকার মানুষ করে না, তিনিই করছেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য করেছেন, যিনি মা-বাপের স্নেহ, যিনি মহতের ভিতর দয়া, যিনি সাধু-ভক্তের ভিতর ভক্তি দিয়েছেন। যে-লোক কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করবে সে নিজেরই মঙ্গল করবে।


“অন্তরে সোনা আছে, এখনও খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে। যদি একবার সন্ধান পাও, অন্য কাজ কমে যাবে। গৃহস্থের বউ-এর ছেলে হলে ছেলেটিকেই নিয়ে থাকে; ওইটিকে নিয়েই নাড়াচাড়া; আর সংসারের কাজ শাশুড়ী করতে দেয় না। (সকলের হাস্য)


“আরও এগিয়ে যাও। কাঠুরে কাঠ কাটতে গিছিল; — ব্রহ্মচারী বললে, এগিয়ে যাও। এগিয়ে গিয়ে দেখে চন্দনগাছ। আবার কিছুদিন পরে ভাবলে, তিনি এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, চন্দনগাছ পর্যন্ত তো যেতে বলেন নাই। এগিয়ে গিয়ে দেখে রূপার খনি। আবার কিছুদিন পরে এগিয়ে গিয়ে দেখে, সোনার খনি। তারপর কেবল হীরা, মাণিক। এই সব লয়ে একেবারে আণ্ডিল হয়ে গেল।


“নিষ্কামকর্ম করতে পারলে ঈশ্বরে ভালবাসা হয়; ক্রমে তাঁর কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায়। ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া যায়, যেমন আমি তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি!” (সকলে নিঃশব্দ)


কথায় কথায় রাত ৯টা বেজে গেছে, ঠাকুর যখন উঠবো উঠবো করছেন, তখনও বিদ্যাসাগর ওঁকে ছাড়তে চাইছেন না। ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার নিমন্ত্রণে নিজেকে সরিয়ে রেখে রাসমণির বাগান দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যকেই তুলে ধরছেন তখন বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করছেন, "সে কি! এমন কথা বললেন কেন? আমায় বুঝিয়ে দিন।" এর থেকেই বোঝা যায় যে নিজের থেকে বয়সে ১৬/১৭ বছরের ছোট প্রায় নিরক্ষর এক গ্রাম্য পুরোহিতের সাথে ওই একটি সাক্ষাৎকারেই অত বড় একজন ভারতবিখ্যাত মানী মহাপন্ডিতের মনের মধ্যে কি ঝড় উঠেছিল। সেদিন যে শ্রীরামকৃষ্ণই কথক আর বাকিরা মূলত শ্রোতা সেটি সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে বিদ্যাসাগরের বাড়ির একতলার বাগানে অপেক্ষমান বলরাম বসুর কথাতেই স্পষ্ট। শ্রীম লিখছেন, 'ঠাকুর বলিলেন, “বলরাম! তুমি? এত রাত্রে?”

বলরাম (সহাস্যে) — আমি অনেক্ষণ এসেছি, এখানে দাঁড়িয়েছিলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভিতরে কেন যাও নাই?

বলরাম — আজ্ঞা, সকলে আপনার কথাবার্তা শুনছেন, মাঝে গিয়ে বিরক্ত করা।


শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাথে বিদ্যাসাগরমশাইয়ের কথোপকথন অথবা সেদিনের ঘটনাক্রমকে শ্রীম মোট ৭টি পরিচ্ছেদে, বিশটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন:

১. শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের পূজা ও সম্ভাষণ

২. বিদ্যাসাগরের সাত্ত্বিক কর্ম — “তুমিও সিদ্ধপুরুষ”

৩. ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানযোগ বা বেদান্ত বিচার

৪. Problem of Evil — ব্রহ্ম নির্লিপ্ত — জীবেরই সম্বন্ধে দুঃখাদি

৫. ব্রহ্ম অনির্বচনীয় অব্যপদেশ্যম্‌ — The Unknown and Unknowable

৬. ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ — নির্বিকল্পসমাধি ও ব্রহ্মজ্ঞান 

৭. জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ — এই তিনের সমন্বয় — Reconciliation of Non-Dualism, Qualified Non-Dualism and Dualism.

৮. বিভুরূপে এক — কিন্তু শক্তিবিশেষ

৯. শুধু পান্ডিত্য, পুঁথিগত বিদ্যা অসার — ভক্তিই সার

১০. ভক্তিযোগের রহস্য — The Secret of Dualism

১১. বিদ্যাসাগরকে শিক্ষা — “আমি ও আমার” অজ্ঞান

১২. উপায় — বিশ্বাস ও ভক্তি

১৩. ঈশ্বর অগম্য ও অপার

১৪. বিশ্বাসের জোর — ঈশ্বরে বিশ্বাস ও মহাপাতক ]

১৫. ঈশ্বরকে ভালবাসা জীবনের উদ্দেশ্য — The End of life

১৬. ঠাকুর সমাধি মন্দিরে

১৭. উপায় — আগে বিশ্বাস — তারপর ভক্তি

১৮. নিষ্কামকর্ম বা কর্মযোগ ও জগতের উপকার — Sri Ramakrishna and the European ideal of work

১৯. নিষ্কামকর্মের উদ্দেশ্য — ঈশ্বরদর্শন

২০. ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু

শ্রীম শেষ করছেন এইভাবে, 'বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য সকলে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। গাড়ি উত্তরাভিমুখে হাঁকাইয়া দিল। গাড়ি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে যাইবে। এখনও সকলে গাড়ির দিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বুঝি ভাবিতেছেন, এ মহাপুরুষ কে? যিনি ঈশ্বরকে ভালবাসেন, আর যিনি জীবের ঘরে ঘরে ফিরছেন, আর বলছেন, ঈশ্বরকে ভালবাসাই জীবনের উদ্দেশ্য।'


এই কুড়িটি ভাগ এবং ঘটনাকে যদি আমরা পরপর দেখি তাহলে এটি জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, ধ্যান, বস্তুত গোটা হিন্দু ধর্মসংস্কৃতি, যোগদর্শন এবং ব্রহ্মসূত্রের মাস্টারক্লাস - ঈশ্বর স্বয়ং একজন rationalist-কে বেদান্তের বিজ্ঞান বোঝাচ্ছেন। এরই মধ্যে তাঁর ভাব হচ্ছে, গান গাইছেন, গল্প বলছেন, সমাধিস্থ হচ্ছেন, মস্করা করছেন, মানীকে মান দিচ্ছেন আবার একজন শাস্ত্রজ্ঞ আত্মবিশ্বাসী কর্মযোগীকে আত্মবোধ এবং মুক্তির পথও দেখাচ্ছেন। এই সাক্ষাৎকারটি একটি অদ্ভুত সর্বাঙ্গসুন্দর complete-in-itself আত্মপলব্ধির রাস্তা খুঁজে পাওয়ার উপদেশ, যেখানে যিনি দিচ্ছেন তিনি আধার জেনেই অমৃত বর্ষণ করছেন আর যিনি সে সুধা পান করছেন তিনিও জানেন কি সারবস্তু তিনি পাচ্ছেন, যদিও আজন্মলালিত সংস্কার ত্যাগ করা তাঁর পক্ষে কঠিন। বিদ্যাসাগর জানেন না এমন কোনো কথাই কিন্তু ঠাকুর বলছেন না, খালি sequence অনুযায়ী সাজিয়ে দিয়ে একটা logical conclusion-এ পৌঁছে দিচ্ছেন। শ্রীমর মনে হচ্ছে  'সকলে অবাক ও নিস্তব্ধ হইয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন। যেমন সাক্ষাৎ বাগ্বাদিনী শ্রীরামকৃষ্ণের জিহ্বাতে অবতীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগরকে উপলক্ষ করিয়া জীবের মঙ্গলের জন্য কথা বলিতেছেন।' ওঠবার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে) বলছেন — এ-যা বললুম, বলা বাহুল্য আপনি সব জানেন — তবে খপর নাই। (সকলের হাস্য) বরুণের ভাণ্ডারে কত কি রত্ন আছে! বরুণ রাজার খপর নাই! বিদ্যাসাগর (সহাস্যে) জবাব দিচ্ছেন — "তা আপনি বলতে পারেন।" এটাই আসল কথা - ভেতরে কি আছে তার খবর নেই, অবতারপুরুষ এসে প্রদীপটি তুলে ধরেন, তখন ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়, যদি দেখার ইচ্ছা থাকে। সেদিন ঠাকুর যে গানটি গাইতে গাইতে সমাধিস্থ হয়েছিলেন, সেটি আসলে তাঁর সেদিনের উপদেশের সারাৎসার:


মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।

সে যে ভাবের বিষয় ভাব ব্যতীত, অভাবে কি ধরতে পারে ৷৷

অগ্রে শশী বশীভূত কর তব শক্তি-সারে ।

ওরে কোঠার ভিতর চোর-কুঠরি, ভোর হলে সে লুকাবে রে ৷৷

ষড় দর্শনে না পায় দরশন, আগম-নিগম তন্ত্রসারে ।

সে যে ভক্তিরসের রসিক, সদানন্দে বিরাজ করে পুরে ৷৷

সে ভাব লাগি পরম যোগী, যোগ করে যুগ-যুগান্তরে ।

হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন, লোহাকে চুম্বকে ধরে ৷৷

প্রসাদ বলে মাতৃভাবে আমি তত্ত্ব করি যাঁরে ।

সেটা চাতরে কি ভাঙব হাঁড়ি, বোঝ না রে মন ঠারে ঠোরে ৷৷


এরপরেও কিন্তু বিদ্যাসাগর দক্ষিণেশ্বরে যাননি কারণ তিনি কোনো ধর্মস্থানে যাওয়া উচিত মনে করতেন না। ঠাকুর বুঝতে পেরেই রাসমণির বাগানে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, মায়ের মন্দিরে নয়। বিদ্যাসাগর কথা দিয়েও কথা রাখেননি বলে ঠাকুরের মনে খেদ ছিল। শ্রীমকে পরে বলেছিলেন,‘‘বিদ্যাসাগর সত্য কয় না কেন? … সেদিন বললে, এখানে আসবে৷ কিন্তু এল না৷’’ বিদ্যাসাগরের মনে ধর্ম নিয়ে যে দ্বন্ধ ছিল তা নানা সময়ে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। একজায়গায় বলেছেন, ‘‘ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই৷ … আমার বোধ হয় যে, পৃথিবীর প্রারম্ভ হইতে এরূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ কাল পৃথিবী থাকিবে, তাবৎ এ তর্ক থাকিবে, কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না৷’’ (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, পৃ. ২৩১–২৩২)৷ ঠাকুর সব জেনেও সেধে ওঁকে পথ দেখাতে গিয়েছিলেন, এটাই আসল কথা। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যাখ্যাত হবেন জেনেই মাত্র পাঁচটি গ্রাম চাইতে গিয়েছিলেন। অবতারের মর্তলীলা বোঝা দায়।


বন্দে জগৎগুরু শ্রীরামকৃষ্ণ, বন্দে জগজ্জননী মহামায়ী।

Thursday, January 6, 2022

কর্মফল ও মুক্তি

 প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কর্মফল থেকে প্রারব্ধ তৈরি হয় আর সেই প্রারব্ধ তাকে ভুগতেই হবে। আব্রাহামিক মতসমূহে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন, প্রারব্ধকে এড়াবার কোনো উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, ঈশ্বরের কৃপা হলে ভোগান্তি খানিকটা কমতে পারে, অনেকটা ওই ভালো ব্যবহারের জন্য বাকি সাজা মকুব হয়ে যাওয়ার মতন, এটুকুই। আর কর্মফলকে এড়াবার যেমন উপায় নেই, তেমনি সৎ কর্মের মাধ্যমেই বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়। শ্রীশ্রীমা বলতেন, “সব সয়ে যেতে হবে কারণ কর্মানুসারে সৎ যোগাযোগ হয়, আবার কর্মের দ্বারা কর্মের খন্ডন হয়”। 


মা তো খুব practical ছিলেন, মানুষের জীবনের ওঠা-পড়া যে তাকে নাজেহাল করে দেয়, ভালো সময়ের পর পরই খারাপ সময়ের ঘূর্ণিঝড়ে পড়লে সে যে অস্থির হয়ে ওঠে, তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, সে desperate হয়ে আরো বেশি বেশি করে ভুল করতে শুরু করে, এটা একজন মায়ের চেয়ে ভালো আর কেই বা বুঝবেন? তাই মা বলতেন, “সংসারে কেমন করে থাকতে হয় জানো? যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন”; বলতেন, “যে অল্পেতে তুষ্ট থাকে, তার কাছে এই পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়”। 


সাধারণত নিজেদেরই কর্মফলের জের যখন নিজেদের জীবনকেই ঝাঁকিয়ে দেয় তখন আমরা নিজেদের ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবাইকে দোষ দিতে শুরু করি - তাতে যেন বুকের বোঝাটা সাময়িকভাবে একটু হাল্কা হয়। এটা চরম নিষ্ফলা একটা regressive ব্যাপার। তাই মা বলতেন সবসময় নিজের দিকে তাকাবে, নিজের কৃতকর্মের analysis করবে আর নিজেকে শুধরাতে চেষ্টা করবে, নিজের বাইরে দোষ খুঁজে বেড়াবে না। মায়ের একেবারে specific নির্দেশ ছিল, “যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার”। 


ওই সময় আমাদের খুব মনে হয় 'অমুকের জন্য আমার আজ এই দুর্দশা, ওর ক্ষতি হলে আমি খুব সুখী হই' - এটা আরো বড় ভুল, আরো কুকর্মফল জড়ো করা। মা সাবধান করে দিয়ে বলতেন, “কাউকেও হিংসা করাে না, ভগবানকেও বিচার করতে বলাে না। বরং যাতে অত্যাচারীর ভাল হয় তার সম্বন্ধে প্রার্থনা করাে। ভগবানের বিচার নিক্তি ধরা, একচুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। ...কিন্তু তাঁর দয়ারও আবার শেষ নেই”। খারাপ সময় যখন আসে তখন আমরা কি করবো কি না করবো কিছুই যেন ঠাওর করে উঠতে পারিনা। আসলে ওটা যে সত্যিকারের ভালো সময়, ওই সময় যে আমরা বেশি বেশি করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, উঠতে বসতে তাঁকে স্মরণ করি, এটার impact আমরা ঠিক তখনই হয়তো বুঝতে পারিনা। মা বলছেন, “যখন জীবনে সুসময় আসে, তখন ধ্যান চিন্তা আসে”। তাতে কি হবে? না, “ধ্যান, জপ ও ঈশ্বর চিন্তায় পাপ কাটে”। 


প্রারব্ধ ভোগাক আর নাই ভোগাক, মা বলতেন সারা জীবন ধরে “বিশ্বাস আর নিষ্ঠাই মূল, এই দুটো থাকলেই হলো” আর এই মনোভাবে যাতে কখনো ভাটা না পড়ে, সুখের সময় যেন আমরা ঈশ্বরকে ভুলে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে না দিই, তাই তাঁর নির্দেশ ছিল, “সৎসঙ্গে মেশো, ভালো হতে চেষ্টা করো। ক্রমে সব হবে”।  মা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতেন, “জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ঠাকুরকে স্মরণ রেখাে। তাহলে কোনও কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হবে না। জীবনে দুঃখ-কষ্ট কার বা নেই? ওসব তাে থাকবেই; তার নাম নিলে, তাকে আশ্রয় করলে তিনি শক্তি দেবেন। দুঃখ ও কষ্ট তখন আর তােমার ওপর ছাপ ফেলতে পারবে না।” 


প্রারব্ধ যে কেবলমাত্র শারীরিক বা আর্থিক বা সামাজিক বা পারিবারিক গন্ডির মধ্যেই সীমিত, তা তো নয়, তা মনের ওপরেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে, কখনো মনকে এত দুর্বল করে দেয় যে depression থেকে suicidal tendency পর্য্যন্ত সৃষ্টি হয়। ওটা মূলত আসে অহঙ্কার থেকে - 'আমার সাথে এমন হলো?' - যেন আমি God's gift to earth, how dare such bad times have descended upon me! তাই মানসিক দুর্বলতাকে একদম প্রশ্রয় দিতে নেই। এ বিষয়ে অন্য একটি context-এ মন বিচলিত হওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের নির্দেশ ছিল, “ওদিকে নজর দিও না, কার মনে দুর্বলতা না আসে এক ঠাকুর ছাড়া? আজ পর্যন্ত এমন কোনও মহাপুরুষ জন্মেছেন কি, যার মনে কখনাে কোনও দুর্বলতা ওঠে নি? যদি শুধরােবার চেষ্টা থাকে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, আমার মনে দুর্বলতা উঠেছে - তাহলে ঐ জিনিষটাই একটা মস্ত শিক্ষা, মহামায়া খুশি হয়ে তখন তাকে পথ ছেড়ে দেন। মানুষ কিছুদিন ভাল থাকলেই মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, আরও উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিবেকীর মনেও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দিয়েই ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখনাে সাধনা শেষ হয়নি, ভূত-প্রেত সব ওত পেতে ' চারপাশে বসে আছে, সুবিধে পেলেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এতে হয়কি অহঙ্কার নষ্ট হয়। যতদিন বাঁচবে সাবধানে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে থাকবে, অহঙ্কার হলেই ঐ সব হিজিবিজি মনে উপস্থিত হবে। শেষ পর্যন্ত শরণাগতির ভাব নিয়ে থাকতে হয়”। 


মনটাই তো সব, ওখানেই তো স্বর্গ নরক, ওখানেই তো শান্তি আর ভোগান্তি, তাই নিজের মনকে নিজে নিজেই কিভাবে train করতে হয়, তাও মা বুঝিয়ে দিয়েছেন, “দেখ, মনটাকে দুভাগ করতে হয়, একটা যেন বিবেকী, আর একটা যেন অবিবেকী—ছেলেমানুষের মতাে। বিবেকী মনটা বাপ-মার মতাে সর্বদা অবিবেকী মনটার পিছনে লেগে থাকবে। একটা কিছু আবোল তাবোল করলেই তাকে শাসন করবে, গালমন্দ করবে, দেখনি বাপ-মা যেমন দুষ্টু ছেলেটাকে বকে ঝকে। দেখবে, এইরকম কিছুদিন অভ্যাস করলেই মনটা শায়েস্তা হয়ে আসবে। কিন্তু অবিবেকী মনে যদি একটা বিষয়ে বহুদিনের অভ্যাসের ফলে দৃঢ় সংস্কার জন্মে যায়, তাহলে শত তিরস্কারেও সেটা যেতে চায়না। তখন ঐ দুর্বল মনের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে, নইলে আর কোনও উপায় নেই। তিনি ঈশ্বর—সব করতে পারেন। ঠাকুরের ইচ্ছের কাছে দেখেছি মানুষের মনগুলাে যেন কাঁচা মাটির তালের মতাে হয়ে যেতাে; আর তিনি যাকে যেমন ইচ্ছে তাকে তেমনি করে গড়ে তুলতেন।” 


আসল প্রারব্ধের effect তো মানুষের মনে। মায়ের কৃপা হলে প্রারব্ধ কেটে যায় অর্থাৎ দুঃখবোধ কেটে যায় আর যে কোনো পরিস্থিতিতে মন আনন্দময় থাকে - সেই জন্যই রোজ ইষ্টকে স্মরণ মনন করা প্রয়োজন, তাঁর কাছে কৃপা প্রার্থনা করা প্রয়োজন। ভুগতে তো হবেই, কিন্তু ভোগাটা যেন internalised না হয়ে যায়, বাইরে বাইরেই থাকে। মা বলেছিলেন, “শোন মা, যত বড় মহাপুরুষই হোক, দেহধারণ ক'রে এলে দেহের ভোগটি সবই নিতে হয়। তবে তফাৎ এই, সাধারণ লোক যায় কাঁদতে কাঁদতে, আর ওঁরা যান হেসে হেসে - মৃত্যুটা যেন খেলা”। কৃপাময়ীর কৃপার স্রোত নিরন্তর বইছে, একবার ডুব দিলেই ইহকাল পরকাল সব তরে যাবে, কোথাকার কর্মফল আর কোথাকার কি? তাই সবশেষে সবার জন্য মায়ের সেই চিরন্তন দৈবী আশ্বাসবাণী, “জানবে কেউ না থাক, তোমার একজন মা আছেন। আমি মা থাকতে ভয় কি?”