নিজের জন্মদাত্রী মাকে কি দেবীরূপে পূজা করা যায়, এমন একটি প্রশ্ন নানাভাবে এসেছে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে অবশ্যই যায়, নিশ্চয় যায়, একশবার যায়। সাধারণত প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভালো মন্দ মেশানো থাকে, যদি জন্মদাত্রীর মনুষ্যরূপী মন্দটিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র তাঁর পবিত্রতার প্রতিমূর্তি মাতৃরূপকে স্মরণ করা যায়, তাহলে তিনি এবং ধ্যানগম্যা দেবী অভিন্ন। আমরা যখন শ্রদ্ধা ভক্তি সমর্পন ও ভালোবাসার স্তবক দিয়ে নিজেদের মাকে প্রণাম করি, তখন তো কেবল একজন জাগতিক ব্যক্তিকে প্রণাম করিনা, মহাশক্তির সেই অংশকে প্রণাম করি, যিনি নিজের গর্ভে ব্রহ্মকে ধারণ করেছেন। কিন্তু catch এটুকুই - ধ্যানের সময় গর্ভধারিনী জননীর শুদ্ধ মাতৃরূপ ছাপিয়ে কখনো যেন তাঁর জাগতিক সংকীর্ণতার কোনো স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে না ওঠে।
জীবনে অনেকরকমের মানুষ দেখতে পাওয়ার দৌলতে একসময় একজন পরম মমতাময়ী মানবী মায়ের ত্যাগের প্রতিমূর্তি অপূর্ব মাতৃরূপও দেখেছি আবার পরবর্তীতে তাঁর অধিকারবোধ যখন মাতৃত্বকে ছাপিয়ে গিয়ে তাঁকে চরম মোহগ্রস্ত করে তুলল, তখন তাঁর অদ্ভুত বিধ্বংসীরূপও দেখেছি। এর ফলে সন্তানের বৃত্ত থেকে তাঁর নিজের alienation ও তাঁর গোটা পরিবারের ভেতরের আস্থা ও ভালোবাসার বন্ধন ধীরে ধীরে কিভাবে নষ্ট হয়ে গেল, তাও দেখেছি। এই গর্ভধারিনী তাঁর নিজের সন্তানেরও যে একটি স্বতন্ত্র identity আছে - তিনি যে কারো স্বামী বা স্ত্রী, কারো সম্বন্ধী, কারো পিতা বা মাতা ইত্যাদি এবং এই সম্পর্কগুলো প্রত্যেকটিই যে সেই সন্তানের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, তার sanctity কিছুতেই মানতে চাইতেন না। এবং উপাধিজনিত ব্যক্তি-অধিকারসুলভ 'আমার সন্তান' এই ভাব থেকে সেই সম্পর্কগুলোকে শুধু যে ক্রমাগত হেয় করতেন তা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ভয়ানক অপমান করতেও ছাড়তেন না। এতে যে তাঁর মমতার হানি হয়, মাতৃত্বকে অহংকার দিয়ে ঢেকে দিলে কেবল যে আমিত্বকেই জাহির করা হয় আর ক্রমে ক্রমে মায়ের ভূমিকা সন্তানের জীবনে unacceptable হয়ে পড়ে, এটা বোঝার মতন দূরদর্শিতা তাঁর ছিল না।
আমি এও দেখেছি প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত হয়ে বৃহত্তর পরিবারের কাছ থেকে alienate করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এককালের সেই পরম মমতাময়ী মা পরবর্তীকালে আত্মীয়স্বজনদের কাছে নিজের সন্তান ও তাঁর স্বজনদের নিন্দামন্দ করাকে প্রশ্রয় দিতেন। সন্তানের আর্থিক অনিশ্চিয়তা ও ক্লেশও ওইসময় তাঁর অপপ্রচারের পক্ষে বেশ সহায়ক হয়েছিল। আর এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সন্তানের spouce, যিনি বৈবাহিককারণে তাঁর পরিবারের সাথে যুক্ত হয়েছেন, invariably তাঁকেই অকারণে সমস্ত অশান্তির মুখ্য কারণ বা main culprit সাব্যস্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি গঞ্জনা ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়, যা ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে গিয়ে একসময় গোটা পারিবারিক বন্ধনকেই ভেঙে চুরমার করে দেয় - ওনার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। বোঝানোর অনেক চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু কুপরামর্শদাতাদের ওপর ওঁর বেশি আস্থা থাকায়, বিশেষ কাজ হয়নি।
তাহলে মোদ্দা কথা কি দাঁড়ালো? একজন মা, হন না তিনি জাগতিক মা, তিনি সন্তানকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করলেন, অত যন্ত্রনা সহ্য করে সন্তানের জন্ম দিলেন, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে প্রতিপালন করলেন, সারা জীবন প্রচুর ত্যাগস্বীকার করলেন, স্নেহ ভালোবাসা ভরসা আর মাতৃশক্তিতে তার জীবন ভরিয়ে দিলেন, অথচ সেই ঐশ্বরিক মাতৃত্বের যে কোনো জাগতিক প্রতিদান হতেই পারেনা, দুর্ভাগ্যবশত মায়ার বশে হয়তো সেই বোধই তাঁর ভেতর জাগলো না অথবা তিনি বিস্মৃত হলেন। গর্ভধারিণী যখন মায়ায় ভ্রমিত হয়ে নিজের ঈশ্বরীয় রূপকে ভুলে মাতৃত্বকে জাগতিক দান-প্রতিদানের নগন্য transactional অবর্তে নামিয়ে আনেন, তখন কি আর তা সন্তানের জন্য কল্যাণকর হতে পারে? এখানেই আধ্যাত্মিক জীবনে 'সত্যিকারের মা' বা দেহধারিণী সাক্ষাৎ জগন্মাতার প্রয়োজনীয়তা, যাঁর মধ্যে নিজের গর্ভধারিণীর অনন্দবর্ধক বিশুদ্ধ মাতৃরূপটিও স্বমহিমায় সমাগতা।
আমাদের সেই ধ্যানগম্যা জননীরূপী দেবীর রূপ একেবারে পূতপবিত্র হতে হবে, আশক্তিবিহীন হতে হবে, দুঃখহীন হতে হবে, আকাঙ্খাহীন হতে হবে, চির-আনন্দময়ী, চির-স্নেহময়ী, চির-বরাভয়দাত্রী, ত্যাগস্বরূপিণী, মহাশক্তিস্বরূপা জগৎপ্রশবিনী হতে হবে, তবে তো সেই মূর্তি হৃদয়ে চিরস্থায়ী হবে। সে মাতৃমূর্তি এমন, যাতে মাতৃত্বের যা কিছু ভালো সব কিছু আছে কিন্তু জাগতিক দৈন্য ও ক্ষুদ্রতার লেশমাত্র নেই, যাঁর কথা চিন্তা করলে উদ্দীপনা হয়, নিশ্চিন্তে আধাত্মপথে অগ্রসর হওয়া যায়, কোনো অবস্থায় কোনো জাগতিক সংকীর্ণতার কথা মনে পড়ে ধ্যানভঙ্গ হয়না। সন্তানরূপে ইষ্টকে চাওয়া হলো সবচেয়ে সহজ স্বাভাবিক আর শুদ্ধ চাওয়া। শ্রীশ্রীমা তাই নিজমুখেই বারবার বলেছেন, “আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।”
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে জগতের ইতিহাসে এই প্রথম মানবদেহে অবস্থানরত একজন মাতৃরূপা ঈশ্বরীর ৩৩টি ফটোগ্রাফ আমাদের সামনে আছে - মধ্য থেকে নিয়ে বৃদ্ধ বয়স পর্য্যন্ত, নানা ভঙ্গিমায়, নানা পরিবেশে। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন তা আমাদের কষ্টকল্পনা করতে হয়না, আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। তিনি কি বলতেন, কিভাবে বলতেন, কি করতেন, কি খেতেন, কি পরতেন - সব আমরা বই থেকে সহজেই জানতে পারি। যে পরমাপ্রকৃতি পবিত্র মাতৃরূপা ইষ্টের সন্ধান আমরা করি, তিনি একেবারে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছেন, তাঁর ব্যবহৃত জিনিষপত্তর, বাড়িঘর সব রয়েছে, আর তাঁর আধ্যাত্মিক aura রয়েছে, যার স্পর্শ পাওয়া অসম্ভব নয়। তিনিই পরম সত্য কারণ তিনি নিত্য, অনন্ত, constant - আর কি চাই? হ্যাঁ, তবে একটা সংশয় থাকতে পারে - মা কি আমায় কৃপা করবেন কারণ মায়ের কৃপা ছাড়া যে তাঁর দিকে এক পাও এগোবার উপায় নেই? মা নিজেই সেই আশ্বাস আমাদের দিয়েছেন, “যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।”
মা - ছোট্ট একটি শব্দ কিন্তু তার মধ্যেই ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মান্ডের মহাবীজ লুকিয়ে আছেন। যে মহাশক্তির ইচ্ছা ব্যতিরেকে গাছের একটি পাতাও নড়তে পারেনা, আমরা প্রত্যেকে সেই অনাদি অনন্ত মহামায়ীর সন্তান। আমরা প্রত্যেক জীব তাঁরই তৈরি করা পঞ্চভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, মন আর বুদ্ধির সম্মিলিত সাময়িক ফল। আমাদের দেহে প্রাণ তাঁর দান, আমাদের বোধ তাঁর দান, তাঁর থেকেই আমাদের উৎপত্তি আবার তাঁতেই আমাদের বিলয় - কেবল মায়ার প্রপঞ্চে ভুলে অহঙ্কারজনিত দেহসর্বস্বতার অজ্ঞানতা আমাদের নিজস্ব জৈবিক বুদ্ধির বিকার। মাই পরমাশক্তি, পরমাজ্ঞান, পরমামুক্তি, পরমাপ্রেম, পরমানন্দ - সবকিছু। আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে তাঁর বাস। তিনিই সেই মহাদেবী যিনি অপার করুণাবশতঃ ত্রিজগৎপ্রসবিনী হয়েও এই অনিত্য জীবশরীররূপী হৃদপদ্মে নিত্য শুদ্ধ আত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই আমরা মায়ের সব সন্তান অমৃতের পুত্রই শুধু নই, অমৃতের সাক্ষাৎ প্রকাশও বটে। আমার জন্ম বিশ্বেশ্বরীর অংশে, আমার যাপন তাঁর ইচ্ছাধীন, আমার বিলয় তাঁতে, আমার পৃথক অস্তিত্ব বলে বস্তুতঃ কিছু নেই - যা আছে সবটুকু তাঁরই, কেবল এই মুহূর্তে এই শরীর-মনরূপে প্রতিভাত। আমি ভবানীর ছেলে - আমি তাঁরই প্রকাশ্য রূপ, তাঁর শুদ্ধত্ব বইছে আমার মধ্যে - তাই আমিও অবিনশ্বর, ঈশ্বরত্ব পেরিয়ে আমিই ব্রহ্ম। জয় মা।
No comments:
Post a Comment