প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কর্মফল থেকে প্রারব্ধ তৈরি হয় আর সেই প্রারব্ধ তাকে ভুগতেই হবে। আব্রাহামিক মতসমূহে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন, প্রারব্ধকে এড়াবার কোনো উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, ঈশ্বরের কৃপা হলে ভোগান্তি খানিকটা কমতে পারে, অনেকটা ওই ভালো ব্যবহারের জন্য বাকি সাজা মকুব হয়ে যাওয়ার মতন, এটুকুই। আর কর্মফলকে এড়াবার যেমন উপায় নেই, তেমনি সৎ কর্মের মাধ্যমেই বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়। শ্রীশ্রীমা বলতেন, “সব সয়ে যেতে হবে কারণ কর্মানুসারে সৎ যোগাযোগ হয়, আবার কর্মের দ্বারা কর্মের খন্ডন হয়”।
মা তো খুব practical ছিলেন, মানুষের জীবনের ওঠা-পড়া যে তাকে নাজেহাল করে দেয়, ভালো সময়ের পর পরই খারাপ সময়ের ঘূর্ণিঝড়ে পড়লে সে যে অস্থির হয়ে ওঠে, তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, সে desperate হয়ে আরো বেশি বেশি করে ভুল করতে শুরু করে, এটা একজন মায়ের চেয়ে ভালো আর কেই বা বুঝবেন? তাই মা বলতেন, “সংসারে কেমন করে থাকতে হয় জানো? যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন”; বলতেন, “যে অল্পেতে তুষ্ট থাকে, তার কাছে এই পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়”।
সাধারণত নিজেদেরই কর্মফলের জের যখন নিজেদের জীবনকেই ঝাঁকিয়ে দেয় তখন আমরা নিজেদের ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবাইকে দোষ দিতে শুরু করি - তাতে যেন বুকের বোঝাটা সাময়িকভাবে একটু হাল্কা হয়। এটা চরম নিষ্ফলা একটা regressive ব্যাপার। তাই মা বলতেন সবসময় নিজের দিকে তাকাবে, নিজের কৃতকর্মের analysis করবে আর নিজেকে শুধরাতে চেষ্টা করবে, নিজের বাইরে দোষ খুঁজে বেড়াবে না। মায়ের একেবারে specific নির্দেশ ছিল, “যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার”।
ওই সময় আমাদের খুব মনে হয় 'অমুকের জন্য আমার আজ এই দুর্দশা, ওর ক্ষতি হলে আমি খুব সুখী হই' - এটা আরো বড় ভুল, আরো কুকর্মফল জড়ো করা। মা সাবধান করে দিয়ে বলতেন, “কাউকেও হিংসা করাে না, ভগবানকেও বিচার করতে বলাে না। বরং যাতে অত্যাচারীর ভাল হয় তার সম্বন্ধে প্রার্থনা করাে। ভগবানের বিচার নিক্তি ধরা, একচুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। ...কিন্তু তাঁর দয়ারও আবার শেষ নেই”। খারাপ সময় যখন আসে তখন আমরা কি করবো কি না করবো কিছুই যেন ঠাওর করে উঠতে পারিনা। আসলে ওটা যে সত্যিকারের ভালো সময়, ওই সময় যে আমরা বেশি বেশি করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, উঠতে বসতে তাঁকে স্মরণ করি, এটার impact আমরা ঠিক তখনই হয়তো বুঝতে পারিনা। মা বলছেন, “যখন জীবনে সুসময় আসে, তখন ধ্যান চিন্তা আসে”। তাতে কি হবে? না, “ধ্যান, জপ ও ঈশ্বর চিন্তায় পাপ কাটে”।
প্রারব্ধ ভোগাক আর নাই ভোগাক, মা বলতেন সারা জীবন ধরে “বিশ্বাস আর নিষ্ঠাই মূল, এই দুটো থাকলেই হলো” আর এই মনোভাবে যাতে কখনো ভাটা না পড়ে, সুখের সময় যেন আমরা ঈশ্বরকে ভুলে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে না দিই, তাই তাঁর নির্দেশ ছিল, “সৎসঙ্গে মেশো, ভালো হতে চেষ্টা করো। ক্রমে সব হবে”। মা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতেন, “জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ঠাকুরকে স্মরণ রেখাে। তাহলে কোনও কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হবে না। জীবনে দুঃখ-কষ্ট কার বা নেই? ওসব তাে থাকবেই; তার নাম নিলে, তাকে আশ্রয় করলে তিনি শক্তি দেবেন। দুঃখ ও কষ্ট তখন আর তােমার ওপর ছাপ ফেলতে পারবে না।”
প্রারব্ধ যে কেবলমাত্র শারীরিক বা আর্থিক বা সামাজিক বা পারিবারিক গন্ডির মধ্যেই সীমিত, তা তো নয়, তা মনের ওপরেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে, কখনো মনকে এত দুর্বল করে দেয় যে depression থেকে suicidal tendency পর্য্যন্ত সৃষ্টি হয়। ওটা মূলত আসে অহঙ্কার থেকে - 'আমার সাথে এমন হলো?' - যেন আমি God's gift to earth, how dare such bad times have descended upon me! তাই মানসিক দুর্বলতাকে একদম প্রশ্রয় দিতে নেই। এ বিষয়ে অন্য একটি context-এ মন বিচলিত হওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের নির্দেশ ছিল, “ওদিকে নজর দিও না, কার মনে দুর্বলতা না আসে এক ঠাকুর ছাড়া? আজ পর্যন্ত এমন কোনও মহাপুরুষ জন্মেছেন কি, যার মনে কখনাে কোনও দুর্বলতা ওঠে নি? যদি শুধরােবার চেষ্টা থাকে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, আমার মনে দুর্বলতা উঠেছে - তাহলে ঐ জিনিষটাই একটা মস্ত শিক্ষা, মহামায়া খুশি হয়ে তখন তাকে পথ ছেড়ে দেন। মানুষ কিছুদিন ভাল থাকলেই মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, আরও উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিবেকীর মনেও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দিয়েই ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখনাে সাধনা শেষ হয়নি, ভূত-প্রেত সব ওত পেতে ' চারপাশে বসে আছে, সুবিধে পেলেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এতে হয়কি অহঙ্কার নষ্ট হয়। যতদিন বাঁচবে সাবধানে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে থাকবে, অহঙ্কার হলেই ঐ সব হিজিবিজি মনে উপস্থিত হবে। শেষ পর্যন্ত শরণাগতির ভাব নিয়ে থাকতে হয়”।
মনটাই তো সব, ওখানেই তো স্বর্গ নরক, ওখানেই তো শান্তি আর ভোগান্তি, তাই নিজের মনকে নিজে নিজেই কিভাবে train করতে হয়, তাও মা বুঝিয়ে দিয়েছেন, “দেখ, মনটাকে দুভাগ করতে হয়, একটা যেন বিবেকী, আর একটা যেন অবিবেকী—ছেলেমানুষের মতাে। বিবেকী মনটা বাপ-মার মতাে সর্বদা অবিবেকী মনটার পিছনে লেগে থাকবে। একটা কিছু আবোল তাবোল করলেই তাকে শাসন করবে, গালমন্দ করবে, দেখনি বাপ-মা যেমন দুষ্টু ছেলেটাকে বকে ঝকে। দেখবে, এইরকম কিছুদিন অভ্যাস করলেই মনটা শায়েস্তা হয়ে আসবে। কিন্তু অবিবেকী মনে যদি একটা বিষয়ে বহুদিনের অভ্যাসের ফলে দৃঢ় সংস্কার জন্মে যায়, তাহলে শত তিরস্কারেও সেটা যেতে চায়না। তখন ঐ দুর্বল মনের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে, নইলে আর কোনও উপায় নেই। তিনি ঈশ্বর—সব করতে পারেন। ঠাকুরের ইচ্ছের কাছে দেখেছি মানুষের মনগুলাে যেন কাঁচা মাটির তালের মতাে হয়ে যেতাে; আর তিনি যাকে যেমন ইচ্ছে তাকে তেমনি করে গড়ে তুলতেন।”
আসল প্রারব্ধের effect তো মানুষের মনে। মায়ের কৃপা হলে প্রারব্ধ কেটে যায় অর্থাৎ দুঃখবোধ কেটে যায় আর যে কোনো পরিস্থিতিতে মন আনন্দময় থাকে - সেই জন্যই রোজ ইষ্টকে স্মরণ মনন করা প্রয়োজন, তাঁর কাছে কৃপা প্রার্থনা করা প্রয়োজন। ভুগতে তো হবেই, কিন্তু ভোগাটা যেন internalised না হয়ে যায়, বাইরে বাইরেই থাকে। মা বলেছিলেন, “শোন মা, যত বড় মহাপুরুষই হোক, দেহধারণ ক'রে এলে দেহের ভোগটি সবই নিতে হয়। তবে তফাৎ এই, সাধারণ লোক যায় কাঁদতে কাঁদতে, আর ওঁরা যান হেসে হেসে - মৃত্যুটা যেন খেলা”। কৃপাময়ীর কৃপার স্রোত নিরন্তর বইছে, একবার ডুব দিলেই ইহকাল পরকাল সব তরে যাবে, কোথাকার কর্মফল আর কোথাকার কি? তাই সবশেষে সবার জন্য মায়ের সেই চিরন্তন দৈবী আশ্বাসবাণী, “জানবে কেউ না থাক, তোমার একজন মা আছেন। আমি মা থাকতে ভয় কি?”
No comments:
Post a Comment