Thursday, January 20, 2022

প্রত্যাহার

রূপ রস শব্দ স্পর্শ আর গন্ধ, এ সবকটিই আমাদের জাগতিক আহারের রকমফের। যেই আমরা বুঝে যাই যে যথেষ্ট আহার হয়েছে, এর চেয়ে বেশি খেলে শরীর খারাপ করবে, আর খেয়ে কাজ নেই বাপু, তখনই প্রত্যাহার হয়। আহার হতে প্রত্যাহার। যেই প্রত্যাহার হলো অমনি আর পঞ্চ ইন্দ্রিয়র খাই খাই রইলো না, মানে উপভোগের প্রবৃত্তিই রইলো না আর প্রবৃত্তি না থাকলে প্রত্যাখ্যানও নেই, অর্থাৎ প্রত্যাশাপূরণ হওয়ার আকাঙ্খা বা না হওয়ার বেদনা কোনোটাই নেই - ব্যস মনও সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে শান্ত হয়ে যায়। ঠাকুর বলছেন, “মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজ রঙে ছোপাও সবুজ। যে-রঙে ছোপাও সেই রঙেই ছুপবে।"


তবে মনকে কিছু না কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে যতক্ষণ না সে নিবৃত্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, ফলে বাইরের দরজা বন্ধ পেয়ে উপায়ন্তর না দেখে সে তখন internal exploration-এ নেমে পড়ে। এটা একমাত্র গুরুর আশীর্বাদে আর ভগবৎ কৃপায় হয়। ঠাকুর বলছেন, "বদ্ধজীব হয়তো বুঝেছে যে, সংসারে কিছুই সার নাই; আমড়ার কেবল আঁটি আর চামড়া। তবু ছাড়তে পারে না। তবুও ঈশ্বরের দিকে মন দিতে পারে না!" আবার বলছেন,“সাধারণ লোক সাধন করে, ঈশ্বরে ভক্তিও করে। আবার সংসারেও আসক্ত হয়, কামিনী-কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়। মাছি যেমন ফুলে বসে, সন্দেশে বসে, আবার বিষ্ঠাতেও বসে। (সকলে স্তব্ধ)

“নিত্যসিদ্ধ যেমন মৌমাছি, কেবল ফুলের উপর বসে মধুপান করে। নিত্যসিদ্ধ হরিরস পান করে, বিষয়রসের দিকে যায় না।” 

সেইজন্যই ভগবানের অহেতুকি কৃপা চাই, একমাত্র তিনিই নিরাশক্তির কাঁচি দিয়ে কুচ করে জীবের আসক্তির বন্ধনটি কেটে দিতে পারেন, সবই তো তাঁর খেলার বিষয়। তখন মন অন্তর্মুখী হয়।


যতক্ষণ surface-এ মন ঘোরাঘুরি করছিল ততক্ষণ সব ঠিক ছিল, সবটাই normal, relative আর superfluous ছিল, যেই সে অন্দরে ঝাঁপ দিলো, তখন সে আর তল খুঁজে পায়না। মন যেই বুঝতে পারে যে অচেনা terrain-এ সে dive মেরেছে, তখন বাঁচার জন্য হাতের কাছে যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে freefall আটকাতে চায়, নানা রকম উদ্ভট চিন্তা উৎপন্ন করে জীবকে distract করতে চায় কারণ যতক্ষণ খিদে ততক্ষণই রাঁধুনির প্রয়োজন। এখানেই আসল খেলা, মনকে নিজের বশে আনা। এর technique-টিও গুরু শিখিয়ে দেন। দীর্ঘদিনের অন্তর্মুখী হওয়ার অনভ্যাসবশতঃ প্রথম প্রথম খানিকটা distraction হয়ও, রোক করে লেগে থাকলে ঠিক কেটে যায়। একটা সময় গিয়ে মন বোঝে যে সে যাকে এতদিন আহার জোটাতো, তিনিই নিজেকে প্রত্যাহার করেছেন, এখন আর সে driving force নয়, সে তাঁর subservient। তখন সে finally চুপ করে।


তিনি ততক্ষণে এমন এক স্বাদের সন্ধান পেয়েছেন যা মায়ার আবরণে ঢাকা মন এতদিন এত কান্ড করেও তাঁকে দিতে পারেনি। তখন মন surrender করে। তখন সে শান্ত হয় আর উপাধি চাপিয়ে চাপিয়ে যে মিথ্যে অহংকারের মূর্তি তৈরি করেছিল, গুরুর কৃপায় সেটা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে। তখন ভিক্ষা দেওয়ার বদলে ভিক্ষা চাইতে ইচ্ছে করে, আর মনে হয় প্রত্যাখ্যাত হলে দারুন সুখ হবে, গুমোর ভাঙবে, মাথা নুইবে। নাম-রূপধারী 'আমি' যত ধাক্কা খাবে তত অন্তর আনন্দে পরিপূর্ন হবে। ঠাকুর বলছেন, "আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল"। তার মানে কি ভোগ শেষ হয়ে গেল? হয়তো না। তাহলে কিভাবে সংসারে থাকতে হবে? ঠাকুর বলছেন, "তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম। এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।"


যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধি - এই অষ্টযোগের মধ্যে প্রত্যাহারই হলো key element, তবে একজন সংসারীর পক্ষে তার জন্য আগে ধর্মপথে থেকে যথেষ্ট অর্থ আর কামনা উপভোগ করার experience থাকলে খেলা একটু বেশিই জমে, নইলে আর প্রত্যাহারের মজা কই? বাকি ধর্মপথে থাকার criterion ইত্যাদি হলো নার্সারী ক্লাসের সিলেবাস, ওসব করেটরেই মন এই অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠাকুর শ্রীমকে বলছেন,

“ব্রাহ্মণ ভোজনের সময় দেখ নাই? প্রথমটা খুব হইচই। পেট যত ভরে আসছে ততই হইচই কমে যাচ্ছে। যখন দধি মুণ্ডি পড়ল তখন কেবল সুপ-সাপ! আর কোনও শব্দ নাই। তারপরই নিদ্রা  - সমাধি। তখন হইচই আর আদৌ নাই।...

“ঈশ্বরের যত নিকটে এগিয়ে যাবে ততই শান্তি। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ প্রশান্তিঃ। গঙ্গার যত নিকটে যাবে ততই শীতল বোধ হবে। স্নান করলে আরও শান্তি।...

“মন আসক্তিশূন্য হলেই তাঁকে দর্শন হয়। শুদ্ধ মনে যা উঠবে সে তাঁরই বাণী। শুদ্ধ মনও যা শুদ্ধ বুদ্ধিও তা - শুদ্ধ আত্মাও তা। কেননা তিনি বই আর কেউ শুদ্ধ নাই।

“তাঁকে কিন্তু লাভ করলে ধর্মাধর্মের পার হওয়া যায়।”

এই বলিয়া ঠাকুর সেই দেবদুর্লভকন্ঠে রামপ্রসাদের গান ধরিলেন:

আয় মন বেড়াতে যাবি।

কালী-কল্পতরুমূলে রে, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ৷৷

প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।

বিবেক নামে তার বেটারে তত্ত্বকথা তায় শুধাবি ৷৷


ঠাকুর বলছেন, "মায়া দুই প্রকার - বিদ্যা এবং অবিদ্যা। তার মধ্যে বিদ্যা মায়া দুই প্রকার - বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিদ্যা মায়া আশ্রয় ক'রে জীব ভগবানের শরণাপন্ন হয়। আর অবিদ্যা মায়া ছয় প্রকার - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য। অবিদ্যা মায়া 'আমি' ও 'আমার' জ্ঞানে মনুষ্যদিগকে বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু বিদ্যা মায়ার প্রকাশে জীবের অবিদ্যা একেবারে নাশ হয়ে যায়।" যাঁকে বলছেন সেই শ্রীমর জীবনীকার লিখেছেন, 'তিনি ঘরেই থাকতেন - কিন্তু গবাক্ষপথে দেখতেন অনন্তকে। আশ্রয়ের মধ্যে নিরাশ্রয়ের সাধনা করতেন। তাই মাঝে মাঝে মধ্য রাত্রে যখন গোটা শহর ঘুমিয়ে পড়ত, চারদিকে নেমে আসত রহস্যময় নীরবতা তখন তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেন হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন সেনেট হলের খোলা বারান্দায়। সেখানে আশ্রয়হীন ভিক্ষুকদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। আবার ভাবতেন, আমি একা এই পৃথিবীতে। তিনি চলে যেতেন গঙ্গাতীরে, ঈশ্বর-জ্যোতি দেখার জন্য তাকিয়ে থাকতেন সাধুদের দিকে। আবার তীর্থযাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন, তাদের মুখে কোথায় লেখা আছে আনন্দের বার্তা।' এই হলো কালী-কল্পতরুমূলে বেড়াতে গিয়ে চারটি বেদের জ্ঞান কুড়িয়ে নেওয়া। দেখি প্রিয় কন্যার মৃত্যুসংবাদ বহনকারী টেলিগ্রাম পড়ে চুপচাপ মুড়ে পকেটে রেখে দিয়ে কাশীর অদ্বৈত আশ্রমে যথারীতি ভাগবতের ক্লাস নিচ্ছেন। আহা, কি দিব্য জীবন!

No comments:

Post a Comment