ঠাকুর যখন সূক্ষ্মশরীরে ইষ্ট হয়ে হৃদয়ে বাস করেন তখন তাঁর কৃপা ছাড়া তাঁকে হয়তো স্থূলচোখে দেখা যায়না। কিন্তু ঠাকুর যখন গুরুমহারাজরূপে ইষ্টমন্ত্র দান করেন আর আমরা মন প্রাণ দিয়ে তা ধারণ করার চেষ্টা করি, তখন গুরুরূপী সশরীরী ঠাকুরকে আমরা পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করি, তিনি আমাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন, তিনি তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে মন্ত্র দান করেন আর কানে কানে আমাদের মন্ত্র উচ্চারণ শোনেন, তাঁকে আমরা দর্শন, স্পর্শন, শ্রবণ, মনন সবকিছু করতে পারি, তাও স্থূল শরীরে। তাই ঠাকুর শুধুই ধ্যানগম্য, এই কথাটি বোধহয় সঠিক নয়। আর ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা যেহেতু অভিন্ন, ফলে সঙ্ঘগুরুর মধ্যে আমরা অদ্বৈত মহাশক্তির উপস্থিতি টের পাই।
আমরা যারা ঠাকুরের আশ্রিত সন্তান, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের দীক্ষাগুরু এবং সমস্ত সঙ্ঘগুরুর মধ্যেই শ্রীশ্রীমা ও ঠাকুরকে প্রত্যক্ষরূপে সামনে পাই এবং তাঁদের মাধ্যমেই ঠাকুর-মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করে আমাদের নিরন্তর দর্শন দেন। গুরুরূপে ঠাকুর যে বীজমন্ত্র দান করেন, তার মধ্যে এবং মাধ্যমেই তাঁর ইষ্টরূপে প্রকাশ। শ্রীম বলতেন, 'তপস্যা কি আর আমরা করি, গুরুই করেন, আমাদের মধ্য দিয়ে। এও তাঁর একটা লীলা'। মন্ত্র জপতে জপতে একসময় তিনি স্বরূপে ভক্তের অন্তরটিকে বোধে আলোকিত করে দেন, ফলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ঠাকুর স্বয়ং এবং তাঁর পুণ্য নাম এক এবং অভিন্ন। জপে মন বসে গেলে আমাদের যে আনন্দবোধ হয়, যার রেশ ধ্যান জপ শেষে উঠে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মাতিয়ে রাখে, সেই আনন্দ অন্তরে বসবাসকারী ওঁর কাছ থেকেই আসে কারণ আনন্দ, প্রেম, করুণা, বাৎসল্য ইত্যাদি কোনোটাই জাগতিক অনুভূতি নয়, ঐশ্বরিক।
পরম পূজ্যপাদ স্বামী বিরজানন্দজী এই প্রসঙ্গে বলছেন, "জপের সময় নাম-নামী অভেদ ভেবে তাঁরই চিন্তা করতে হয়। যে নাম, সেই নামী, অর্থাৎ নাম করলেই যাঁর নাম তাঁকে বোঝায়। কোনো কাজের জন্য যদি কাউকে নাম ধরে ডাকো তো সঙ্গে সঙ্গে তার মুর্তিটাও মনের সামনে ভেসে ওঠে এবং সে সাড়াও দেয় বা আসে। জপও ঠিক তাই, যদি ঠিক হয়, তাতেই মন লেগে থাকে। আর এটুকু বিশ্বাস থাকা চাই যে, আমার ডাক তাঁর কাছে পৌঁছুচ্ছে, তাঁর সাড়া পাবোই।" (পরমার্থ প্রসঙ্গ, উপদেশ সংখ্যা ১৩৭)
জপের মুক্তিদায়িনী শক্তি সম্পর্কে জগজ্জননী শ্রীশ্রীমা তো একেবারে স্পষ্ট করে বলছেন, "অভ্যাসের কত শক্তি! জপ অভ্যাস করতে করতে মানুষ সিদ্ধ হয়। জপাৎ সিদ্ধি, জপাৎ সিদ্ধি, জপাৎ সিদ্ধি! সংখ্যার দিকে মন রেখে জপ করলে সংখ্যার দিকে মন থাকে, এমনি জপ করবে।"
"জপ ধ্যান করতে করতে দেখবে ঠাকুর কথা কবেন। মনে যে বাসনাটি হবে, তখুনি পূর্ণ করে দেবেন। কি শান্তি প্রাণে আসবে।"
(শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে)
আর শ্রীমর মাধ্যমে স্বয়ং ঠাকুর জপের ফল সম্পর্কে আমাদের মতন সংসারীদের সরাসরি উপদেশ দিচ্ছেন, "জপ করা কি - না নির্জনে নিঃশব্দে তাঁর (ভগবানের) নাম করা। একমনে নাম করতে করতে - জপ করতে করতে, তাঁর রূপ দর্শন হয় - তাঁর সাক্ষাৎকার হয়। শিকলে বাঁধা কড়িকাঠ গঙ্গার গর্ভে ডুবানো আছে - শিকলের আরেক দিক তীরে বাঁধা আছে। শিকলের এক একটি পাব ধরে ধরে গিয়ে ক্রমে ডুব মেরে শিকল ধরে যেতে যেতে ঐ কড়ি কাঠ স্পর্শ করা যায়। ঠিক সেই রূপ জপ করতে করতে মগ্ন হয়ে গেলে ক্রমে ভগবানের সাক্ষাৎকার হয়।.......জপ থেকে ঈশ্বর লাভ হয়। নির্জনে, গোপনে তাঁর নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শণ।"
রামপ্রসাদের একটি বিখ্যাত গান আছে, পরম পূজ্যপাদ স্বামী শিবানন্দজী মহারাজ এটি খুব বলতেন:
মন বলি ভজ কালী ইচ্ছা হয় তোর যে আচারে,
গুরুদত্ত মহামন্ত্র দিবানিশি জপ করো।।
শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান,
নগর ফের মনে কর প্রদক্ষিণ শ্যামা মারে।।
যত শোন কর্ণপূটে, সবই মায়ের মন্ত্র বটে,
কালী পঞ্চাশবৎবর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।।
চর্বচোষ্য লেহ্য পেয়, যত রস এ সংসারে
আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মারে।।
আনন্দে রামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজেন সর্বঘটে,
রূপে রূপে যতরূপ, মা আমার সে-রূপ ধরে।।
মহারাজ আরও বলতেন, "ঠাকুর নিজেই বলে গেছেন, 'হেলায়, শ্রদ্ধায় যে আমার নাম করবে, তাকে হাত ধরে আমি মুক্তিধামে নিয়ে যাবো'। তাঁর বাক্য কখনো মিথ্যা হয় না।"
No comments:
Post a Comment