অহংকার বড় মারাত্মক বস্তু। একটু ভালো গান গাইলাম বা ভালো রাঁধলাম বা ভালো লিখলাম বা ভালো খেললাম বা একটু better than average কোনো গুণ আছে, লোকে একটু সুখ্যাতি করে, ব্যাস, অমনি মনের মধ্যে 'আমি' 'আমি' 'আমার' 'আমার' শুরু হয়ে গেল। আমাদের মতন যাঁরা সাধারণ সংসারী মানুষ, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয় - অহংবোধহীন হয়ে সুখ্যাতি handle করা বোধহয় পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। আর না করতে পারলেই bloated ego তৈরি হয়ে সজ্জন ব্যক্তিকেও একেবারে পাষন্ড বানিয়ে ছাড়ে। একে avoid করার কি উপায় নেই? সাধুরা বলছেন উপায় আছে। এক, ঠাকুর কৃপা করে আমাকে দিয়ে একটা ভালো কাজ করিয়ে নিলেন যা ঠাকুরেরই সন্তানদের তৃপ্তি দিলো - এটা মনে করে ঠাকুরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা, আর দুই, ঠাকুর নানাজনের মধ্যে দিয়ে ভোক্তারূপে আমার কাজের আস্বাদ গ্রহণ করে আমায় কৃপা করলেন - এই ভেবে অনন্দলাভ করা। মোদ্দা কথা হলো ঠাকুরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিরও নড়বার যো নেই জেনে আমার মধ্যে constructive যা কিছু আছে, মানুষকে তৃপ্তি দেওয়ার যেটুকুই শক্তি আছে, সব ভগবানের ইচ্ছা এবং তাঁর অহেতুকি কৃপাতেই তৈরি হয়েছে, এতে অহংকারযুক্ত বা উপাধিযুক্ত 'আমি'-র বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই - ক্রমাগত এটা নিজেকে মনে করিয়ে যাওয়া।
শুকনো জ্ঞান এক জিনিষ আর আত্মিক উপলব্ধি একেবারে অন্য এক জিনিষ, bookish knowledge and deep intellectual understanding-এর মধ্যে বিস্তর ফারাক। জানি যে এই দেহ-মন অনিত্য অর্থাৎ অসত্য আর ঠাকুরই একমাত্র নিত্য অর্থাৎ একমাত্র সত্য, জানি যে এই দেহভিত্তিক identity-র মৃত্যু অবধারিত - আগেও বহুবার মরেছি আর ভবিষ্যতেও বহুবার মরবো, তবু 'আমি'ভাব যায় কই? কেউ হয়তো একটু কটুকথা বললো, গায়ে না মাখলেই হয়, সেখান থেকে চুপচাপ হেঁসে সরে আসলেই ল্যাটা চুকে যায়, তা না, তার সঙ্গে চেঁচামেচি জুড়ে দিলাম আর রাতে স্বপ্নে কোথায় ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের চাতালে ঘুরে ঘুরে দেবসান্নিধ্যে ধন্য হবো, না তার বদলে সকাল থেকে মাথায় সেই অপমানের ভারী বোঝাটা বয়ে বয়ে ঘাড়ে মাথায় ব্যাথা, ঘুমই আর আসতে চায় না! আমরা কি বুঝিনা যে নিজেকে কিভাবে conduct করলে আমাদের সবচেয়ে বেশি স্বস্তি হয়, সবধরনের equilibrium বজায় থাকে - সবই বুঝি কিন্তু অহংকার এসে অন্ধ করে দেয়। আসলে আমরা বেশিরভাগই খুব superfluous - তাই আমাদের সবটাই শুকনো জ্ঞান, আত্মিক উপলব্ধি আর ক'জনের?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব prescription দিচ্ছেন, “জ্ঞান কাকে বলে; আর আমি কে? ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা — এর নাম জ্ঞান। আমি অকর্তা। তাঁর হাতের যন্ত্র। তাই আমি বলি, মা, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; তুমি ঘরণী, আমি ঘর; তুমি ইঞ্জিনিয়ার; যেমন চালাও, তেমনি চলি; যেমন করাও, তেমনি করি; যেমন বলাও, তেমনি বলি; নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু”। বলছেন, "বিজ্ঞানী কেন ভক্তি লয়ে থাকে? এর উত্তর এই যে, ‘আমি’ যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের ‘অহং’ যায় না। অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁক্ড়ি বেরিয়েছে"। আর একদিন আরো সহজভাবে বিশিষ্ঠ অদ্বৈত আর অদ্বৈতের পার্থক্য বুঝিয়ে বলেছেন, “রাম জিজ্ঞাসা করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পুর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।
“সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”
আসলে আমাদের মতন জ্ঞানপাপীদের জন্য জ্ঞানের পথ বা যোগের পথ অত সহজ নয়। সেইজন্যই ঠাকুর ভক্তির ওপর ভয়ঙ্কর জোর দিতেন। বলতেন, "ভক্তের সাধ যে চিনি খায়, চিনি হতে ভালবাসে না।
“ভক্তের ভাব কিরূপ জানো? হে ভগবান, তুমি প্রভু, আমি তোমার দাস’, ‘তুমি মা, আমি তোমার সন্তান’ , আবার ‘তুমি আমার পিতা বা মাতা’। ‘তুমি পূর্ণ, আমি তোমার অংশ।’ ভক্ত এমন কথা বলতে ইচ্ছা করে না যে ‘আমি ব্রহ্ম'।”
আত্মবোধ বা ব্রহ্মজ্ঞান গভীর intellectual understanding এর বিষয়, ঠাকুরের অসীম কৃপা ছাড়া সম্ভবই নয়। কিন্তু 'আমি মায়ের সন্তান' - এটা ভাবতে তো আর কোনো কাঠখড় পোড়াতে হয়না। ইষ্টের সাথে সম্পর্ক পাতানোর তাই ভক্তি আর বিশ্বাসই বোধহয় সবচেয়ে সহজ উপায়। বিশ্বাস করতে হবে যে মায়ের কাছে ক্রমাগত আবদার করে গেলে মা একদিন না একদিন ঠিকই তা পূরণ করবেন। তাই ঠাকুর বলছেন, “তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, ‘যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়”। একজন সাধু বলেছিলেন যে রাতে শোয়ার সময় মনে মনে দৃঢ়ভাবে ভেবে নিতে যে বালিশে মায়ের চরণদুটি রয়েছে, আমি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে শুলাম। খুব কাজে দেয় কিন্তু।
No comments:
Post a Comment