যমুনার দুই কূল - যেন অনুকূল আর প্রতিকূল। তার একদিকে শ্রীকৃষ্ণ সন্তান, সখা, সংসারী আর অন্যদিকে সহায়, সম্বল, সম্রাট। যা একসময় অনুকূল তাই পরে প্রতিকূল হয়ে যায় - তিনি সেই যে ব্রজভূমি ছেড়ে চলে যান আর ফেরেন না। যেন যমুনার একদিকে শ্রীরাধা, অন্যদিকে রুক্মিণী। একজন শ্রীকৃষ্ণে সমাগতা, অন্যজন শ্রীকৃষ্ণের সহায়িকা। দুজনেই প্রেমিকা, দুদিকেই সম্পুর্ন সমর্পণ, কিন্তু দুজনের আত্মনিবেদনের পথ একেবারে আলাদা - একদিকে মধুরভাব আর অন্যদিকে দাস্যভাব।
যেন যমুনার এককূলে অনুরাগ, অন্য কূলে আনুগত্য। এ যেন দুইপাশে দুটি স্পম্পূর্ণ আলাদা জগৎ, তাদের ধ্যেয় এক হলেও ধ্যানালোক আলাদা, মাঝে মনরূপী যমুনা জন্মজন্মান্তর ধরে বহতি। আসলে সবটাই মায়া, আর সেই মায়ার চিদাকাশ জুড়ে মায়াতীত সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ। আসলে 'শূন্য' এবং 'পূর্ণ' যে একই বস্তু, 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়মেকমেবাদ্বিতীয়ম্', এবং মায়া ছাড়া জগতের অস্তিত্ব নেই, ফলে ধর্মাধর্ম নেই আর মুক্তির অবকাশও নেই, সেই কথাই যেন যমুনার দুই তীরে প্রতীয়মান। এ যেন শুদ্ধ বাসনা আর অবাসনার মধ্যে সীমারেখা মিলিয়ে যাওয়ার খেলা। পরবর্তী অবতারে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর পার্ষদদের বারবার বলতেন “ছোট ছোট এক-আধটা বাসনা জোর করিয়া রাখিয়া তদবলম্বনে মনটাকে তোদের জন্য নিচে নামাইয়া রাখি! নতুবা উহার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অখণ্ডে মিলিত ও একীভূত হইয়া অবস্থানের দিকে।” (লীলাপ্রসঙ্গ, ত্রয়োদশ অধ্যায়: মধুরভাবের সারতত্ত্ব)
ঠাকুরের পার্ষদ মায়ের দ্বারী পূজ্যপাদ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ প্রেমে ঐশ্বর্যজ্ঞানের লোপসিদ্ধির বিষয়ে লিখেছেন, 'প্রেমের স্বভাব পর্যালোচনা করিয়া একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, উহা প্রেমিকদ্বয়ের ভিতরে ঐশ্বর্যজ্ঞানমূলক ভেদোপলব্ধি ক্রমশঃ তিরোহিত করিয়া দেয়। ভাব-সাধনায় নিযুক্ত সাধকের মন হইতেও উহা ক্রমে ঈশ্বরের অসীম ঐশ্বর্যজ্ঞান তিরোহিত করিয়া তাঁহাকে তাঁহার ভাবানুরূপ প্রেমাস্পদমাত্র বলিয়া গণনা করিতে সর্বথা নিযুক্ত করে। দেখা যায়, ঐজন্য এই পথের সাধক প্রেমে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণভাবে আপনার জ্ঞান করিয়া তাঁহার প্রতি নানা আবদার, অনুরোধ, অভিমান, তিরস্কারাদি করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না। সাধককে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যজ্ঞান ভুলাইয়া কেবলমাত্র তাঁহার প্রেম ও মাধুর্যের উপলব্ধি করাইতে পূর্বোক্ত ভাবপঞ্চকের মধ্যে যেটি যতদূর সক্ষম, সেটি ততদূর উচ্চভাব বলিয়া ঐ পথে পরিগণিত হয়।'
আর মায়ার বিষয়ে স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, “বেলের সার বলতে গেলে শাঁসই বুঝায়, তখন বীচি আর খোলা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু বেলটা কত ওজনে ছিল ব’লতে গেলে শুধু শাঁস ওজন করলে হবে না। ওজনের সময় শাঁস, বীচি, খোলা সব নিতে হবে। যারই শাঁস, তারই বিচি, তারই খোলা।
“যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।
“তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া ব’লে জগৎ সংসার উড়িয়ে দিই না। তা হ’লে যে ওজনে কম পড়বে।”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত : শ্রীম-কথিত : সমগ্র সংস্করণ। পৃ: ১৪৪)
No comments:
Post a Comment