শ্রীশ্রীমায়ের সন্তান স্বামী প্রেমেশানন্দজী মহারাজ দীর্ঘদিন সারগাছি আশ্রমের মোহন্ত হিসেবে কাজ করার পর অবসর জীবনটি কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে কাটান। অসুস্থ অবস্থায় পূজনীয় প্রেমেশ মহারাজের সেবক ছিলেন তৎকালীন ব্রহ্মচারী, পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের সহসঙ্ঘাধক্ষ, স্বামী সুহিতানন্দজী মহারাজ। উনি ওনার ‘সারগাছির স্মৃতি’ বইতে খুব সুন্দরভাবে মহারাজের পুণ্য স্মৃতিকথা ধরে রেখেছেন। বইটিতে সেবক নানান প্রশ্ন করছেন আর পূজনীয় মহারাজ তার উত্তর দিচ্ছেন। তার মধ্যে মনের অবস্থান সম্পর্কে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। মহারাজ বলছেন,
"খুব ভাল করে শুনে রাখো - আধ্যাত্মিক জীবন হলো সবটাই মনের ব্যাপার।
অন্তর্জীবন লোক-দেখানো কোনো ব্যাপার নয় - টিকি রাখা, গেরুয়া পরা উদ্দেশ্য নয়; এগুলো উপায় মাত্র।"
সেবক: মন কী করে গুরু হয়?
মহারাজ: "যদি তোমার ইষ্টে অধিক টান হয়, তাহলে তোমার মন ইষ্টপ্রীতি ছাড়া অন্য কিছুতে যেতে চাইবে না।
অর্থাৎ মন ভাল জিনিসই নেবে।
তখনই মন গুরু হয়ে যায়।
তোমাদের বিশ্বাস থাকা চাই - আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে আশ্রয় করেছি, আমার আবার ভাবনা কী?
'ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব হচ্ছে, ঈশ্বর সব সেজেছেন' বলে নিজের কর্তব্য এড়িয়ে গেলে চলবে না।
যতক্ষণ দেহের মধ্যে আছি ততক্ষণ ও কথা বলার জো নেই।"
আবার কাজ আর ধ্যানের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার বিষয়েও মহারাজ বড় সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। এ বিষয়ে ওনার বিভিন্ন বক্তব্যকে আমি নিজের মতন করে এখানে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দিচ্ছি। পূজনীয় মহারাজ বলছেন,
"যদি তোমার কাজের নেশা থাকে, তাহলে হিমালয়ে গিয়েও নিস্তার নেই, সেখানে আবার ঘর-বাড়ি করে হাঙ্গামা বাধাবে।
কাজের নেশা এমনই।
"কিছুদিন কাজ করে একেবারে সরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়—
১. কতখানি আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি?
২. কেবল দেখা - মন কীসে কীসে নাচে?
৩. কোন্ জিনিসটা সে চায়?
৪. বুকের ভেতর না গিয়ে কেন সে বাইরের রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ চায়?
৫. কেন মন শ্রীরামকৃষ্ণকে চায় না?
যখনি দেখবে মন স্থির নয়, তখনি বুঝবে মন উত্তেজিত হয়েছে - হয় কামে, নয় ক্রোধে, নয় লোভে, নয় মাৎসর্যে।
৬. ধ্যান করা মানে কী?
মনকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করার অভ্যাস হলো ধ্যান।
অর্থাৎ সারাদিনের কাজের মধ্যে অন্তত কিছু সময় এমন একটা জিনিস চিন্তা করব, যা প্রশান্ত অর্থাৎ সেটা আমার উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেবে।
আসল ব্যাপার হলো স্বাভাবিক হওয়া।
হাঁটা, চলা, খাওয়া - সব ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকা।
"যারা রজোগুণী, তারা নিজেকে প্রকাশ করতে চায় মানযশের জন্য।
দেখ, আমি statement of fact বলি, তোমাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিই। কিন্তু কাউকে ঘৃণা করি না - কাছে ডাকি, বসাই, সুখ-দুঃখের কথা বলি।
যে যা প্রশংসা করবে - সাবধানে নেবে।
কারণ, সংসারে তোমার কিছু গ্রহণীয় নেই, সবই পরিত্যাজ্য।
কেউ যদি কখনো তোমাকে মহাপুরুষ বলে, সাবধান হবে
"কেউ কেউ ভাবে, যারা ধ্যান করে না তাদের হবে না।
কেউ হয়তো ধ্যান, পাঠ করে।
কিন্তু দেখা গেল, যে ‘কাজ কাজ’ করে বেড়াত, মরার সময় সে ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলে চলে গেল।
অর্থাৎ সে কাজে থাকত, সে জানত যে, আমি ধ্যান পারি না; কিন্তু তার দৃঢ় আস্থা ছিল যে, আমি ঠাকুরেরই কাজ করছি।
কথামৃতে পড়েছ তো - ঠাকুর মন দেখেন।"
"যদি (কেউ) ঠাকুরের ব্রতকার্যে সাহায্য করে সেও মুক্ত হবে।
সেবক : ঠাকুরের ব্রতকার্য কী ?
মহারাজ : ভালবাসা, সকলের কল্যাণচিন্তা করা - কীভাবে তাদের সেবা করা যায়।
'শিবজ্ঞানে জীবসেবা'।
আর, চার যোগ যে এক, সেটাও জানা।
শুধু কর্ম করতে গিয়ে বহির্মুখ, (বাকি) ধ্যান করতে করতে আধপাগলা, জ্ঞানে পন্ডিত আর ভক্তিতে আবেগপ্রবণ - এই চারটের সমন্বয় প্রয়োজন। জ্ঞান না থাকলে এবং যোগ না থাকলে, মানুষের শরীরের প্রতি আসক্তি এসে যায়। নারায়ণ বুদ্ধি দূরে পড়ে থাকে।"
আরো অনেক মণিমুক্তা ছড়িয়ে আছে বইটিতে। ২৫.৩.৪৯ তারিখ রাতে সেবককে মহারাজ বলছেন, "যখন সময় পাবে জপে বসবে। একটা অভ্যাস করতে হবে। রাত্রে শোবার আগে অন্তত ১০ মিনিট চিন্তা করবে - চিন্তা করবে বালিশের ওপর ঠাকুর, মা, স্বামীজীর পা রয়েছে। আর তুমি শুয়ে আছ।"
সেবক : এই জগৎ কতখানি সত্য?
মহারাজ : যতখানি আমার কাছে revealed হচ্ছে। চোখ না থাকলে জগতে আমার দ্রষ্টব্য কিছুই নেই। স্বপ্নে যখন কিছু দেখি, সেটা কি মিথ্যা বোধ হয়? তখন সেটা যতখানি সত্য, এই বাস্তব জগৎ নিদ্রোত্থিত অবস্থায় ততখানি সত্য; এর বেশি নয়।
এরই মধ্যে ছোট্ট করে শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতি - সেবক রাসবিহারী মহারাজের গায়ে পা লেগে যাওয়ায় মা নিজেরই সাধুরূপী আশ্রিত সন্তানকে নমস্কার করে বলছেন, "বাবা, তোমরা দেবের দুর্লভ ধন"!
[স্বামী প্রেমেশানন্দ ১৮৮৪ সনে সিলেটের দুলালী পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বনাম ইন্দ্রদয়াল ভট্টাচার্য। সিলেটে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম প্রতিষ্ঠার মূলেও তার প্রভাব স্মরণীয়। ১৯০৯ সনে উদ্বোধনে শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করে ১৯১৩ সনে তাঁর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সনে স্বামী শিবানন্দের নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ। প্রথমে ঢাকা মঠে এবং পরবর্তিকালে সারগাছি কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ছিলেন । তিনি গীতিকার, সুগায়ক ও অনেক গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন। তিন খন্ডে বিস্তৃত স্বামী প্রেমেশানন্দের পত্র-সংকলন পড়ে অনেক মানুষ আধাত্মজীবনে অগ্রসর হওয়ার রসদ পেয়েছেন। ১৯৬৭ সনে পূজনীয় মহারাজ রামকৃষ্ণলোকে গমন করেন ]
শ্রীসারদা মঠের 'নিবোধত' পত্রিকায় পূজনীয় প্রেমেশ মহারাজ সম্পর্কে একটি খুব সুন্দর স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হয়েছিল, তার PDF লিঙ্ক এখানে তুলে দিলাম।
No comments:
Post a Comment