আজ মকর সংক্রান্তি। সমস্ত ভারতবাসীকে জানাই এই শুভদিনে তাঁদের স্থানীয় উজ্জাপন উৎসব অনুসারে আন্তরিক প্রীতি এবং শুভেচ্ছা। এই সময়েই সূর্য উত্তরে যাত্রা শুরু করে, আমরা যাকে সূর্যের উত্তরায়ণ বলি এবং এর ফলে শীত কমতে থাকে। সারা বিশ্ব জুড়ে যেখানে যেখানে হিন্দু সভ্যতার প্ৰভাব ছড়িয়েছে, সেখানে সেখানেই মকর সংক্রান্তি উজ্জাপন করার প্রথা সৃষ্টি হয়েছে। এর যেমন শস্য এবং স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত ভৌতিক কারণ আছে, তেমনি জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনকে আবাহনের মাধ্যমে নিজেদের সর্বদা উন্নততর করার হিন্দু সভ্যতার যে প্রাচীন ধার্মিক পরম্পরা, এটি তারও দ্যতক বটে। মহাভারতে দেখি মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় প্রাণত্যাগ করেছিলেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব বিভিন্নভাবে পালিত হয় যেমন পশ্চিমবাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, গঙ্গাসাগরে স্নান ও জয়দেবের মেলা, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহ্রি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, অন্ধ্রপ্রদেশে ভোগী মোন্তালু, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই চলে, যদিও তার পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও মকর উৎসবের নানান রূপ আছে, যেমন বাংলাদেশে এর নাম সাকরাইন, নেপালে এটা পরিচিত মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান।
ঔপনিবেশিক সাহেব শাসকরা শিখিয়েছিলেন ভারত নাকি একটি সংগঠিত উন্নত রাষ্ট্র ছিলনা, আর্যরা এসে নাকি আমাদের মানুষ করেছিল। এই এক মকর সংক্রান্তি পালনের প্রথাই সেই মিথ্যেকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই সময়েই ওডিশার ভুঁইয়া জনজাতির মানুষ এবং বাংলার পশ্চিম প্রান্তের মানুষ টুসু উৎসব পালন করেন। মণিপুরে অনেকে তাঁদের পরম ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করেন, এমনকী সুদূর অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের কাছে ব্রহ্মকুণ্ডে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার আরাধনা করা হয়, এই দিনটিতে সেখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় লোকনৃত্যের আসর বসে। এমনকী এখনকার সবরীমালার প্রসিদ্ধ হিন্দু মন্দিরে বিরাজিতা এক সময়ের বৌদ্ধ দেব শাস্তা এই দিন লক্ষ লক্ষ ভক্তের পুজো পান, সেই ভক্তেরা বিস্তর কৃচ্ছ্রসাধন করে তাঁর কাছে পৌঁছন।
সূর্য যে এ দিনই ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে, সেটা আমাদের পূর্বপুরুষ অঙ্ক কষে বের করেছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তি শুধু যে ভারতের একীভূত সংস্কৃতির পরিচায়ক, তা নয়, প্রাচীন ভারতের উন্নত বিজ্ঞানচর্চা ও সমাজের সর্বপ্রান্তে সর্বস্তরে তার নির্যাস সাধারণের মধ্যে পৌঁছানোর সহজপন্থা উদ্ভাবনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণও বটে। কোথায় কাশ্মীর আর কোথায় সবরীমালা, কোথায় মূল ভারতীয় ভূখন্ড আর কোথায় লাওস - একই সংস্কৃতি যখন এত বৈচিত্রের মধ্যেও এই ধরণের মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়, তখন কোথাও না কোথাও নিঃশব্দে এক মহতী রাষ্ট্র নির্মিত হয়, যা আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দেশজুড়ে বিস্তৃত হলেও, মূলত আজও তার প্রাচীন আত্মিক অভিন্নতার কারণে নানা আক্রমণ হজম করেও অক্ষুন্ন আছে। ইনিই আমাদের জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী সমগ্র জাতির আত্মপরিচয়-সূচক হিন্দুরাষ্ট্র, যিনি প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির দিন নিজের অস্তিত্বকে আবার নতুন করে জাহির করেন।
No comments:
Post a Comment