Sunday, January 29, 2023

শুদ্ধাত্মা



ঠাকুর বলেছেন শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি আর শুদ্ধ আত্মা একই জিনিস। প্রতিটিকে আলাদা আলাদা করে বিচার করতে করতে শেষে কেন সেই একই জায়গায় পৌঁছতে হয়, সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। তার আগে আধ্যাত্ম মানে কি সেটা বুঝে নেওয়া দরকার। আত্মা শব্দের একটি অর্থ আমি। আর আত্মার অধ্যয়নই অধ্যাত্ম। আত্ম মানে আমার। তাই একে আত্মবিজ্ঞানও বলা যায়। বাহ্যিক অর্থে 'আমি' মানে দেহে অবস্থিত মন বুদ্ধি আর অহংকারের সমষ্টিগত রূপ। আর স্বরূপ অর্থে 'আমি' মানে আত্মা অর্থাৎ আমার চিরকালীন eternal existential form বা তুরীয় বা চতুর্থম্। ফলে আধ্যাত্মিক পথে চলতে গেলে আমার মন বুদ্ধি আর আত্মার মধ্যে যে interconnection, তাকে বুঝে নেওয়াটা প্রয়োজন বৈকি। অহংকারকে আমরা এই আলোচনা থেকে বাদ রাখবো কারণ যতক্ষণ কর্ম থাকবে ততক্ষণ দেহবোধও থাকবে আর ততক্ষণ অল্প হলেও 'আমি'ভাবও থাকবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 
ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ।
য়স্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ॥    
অর্থাৎ, অবশ্যই দেহধারী জীবের পক্ষে সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু যিনি সমস্ত কর্মফল পরিত্যাগী, তিনিই বাস্তবিক ত্যাগী বলে অভিহিত হন। (১৮/১১)

মন
The Basic Theory of Mind বইতে মন সম্পর্কে বলা হচ্ছে, 'The mind is one thing that has always fascinated and puzzled us. It is the only thing that we can be certain of existing, yet, apparently, we do not know exactly what it is, how it occurs, and why it occurs. This is in contrast to things outside the mind.' আর বিখ্যাত Merriam-Webstar অভিধানের মতে মনের সাধারণ অর্থ হলো memory বা স্মৃতি আর বিস্তৃত অর্থ হলো 'the element or complex of elements in an individual that feels, perceives, thinks, wills, and especially reasons.' অন্যদিকে বঙ্গীয় শব্দকোষকার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে মনঃ মানে ১. চিত্ত, হৃদয়, মানস, অন্তঃকরণ; ২. মনীষা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা; ৩. মানসশক্তি; ৪. মনঃসাধ্য গায়ত্রীজপাদি; ৫. সংকল্পবিকল্পাত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তি; ৬. ইন্দ্রিয়ের প্রেরক ও আত্মায় ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানের সমর্পক - ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ - ইন্দ্রিয়ানাং মনশ্চামি (গীতা ১০.২২); ৭. ইচ্ছা, কাম; ৮. অন্তঃকরণবৃত্তি, ভাব, অভিপ্রায়। অভিধানকারেরা এই যে মনের এতগুলো অর্থ বের করেছেন, তাতে তিনটি জিনিস common - ১. মন অন্তঃকরণবৃত্তি, ২. মন বহুমুখী, আর ৩. মনের সঙ্গে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং conciousness বা চেতনার সরাসরি যোগ আছে। 

বুদ্ধি
Daeyeol Lee তাঁর Birth of Intelligence বই সংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, "Intelligence can be defined as the ability to solve complex problems or make decisions with outcomes benefiting the actor, and has evolved in lifeforms to adapt to diverse environments for their survival and reproduction. For animals, problem-solving and decision-making are functions of their nervous systems, including the brain, so intelligence is closely related to the nervous system." আর বুদ্ধিকে একদম দৈহিকস্তরে সীমাবদ্ধসূচক এইসব কথা বলার ঠিক পরেই তিনি বলছেন, "Intelligence is hard to define, and can mean different things to different people." বোঝা গেল যে ওঁরা artificial intelligence নিয়ে কাজ তো করছেন কিন্তু মনের মতোই intelligence বা বুদ্ধির আসল রহস্যটি এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। আবার হরিচরণের সাহায্য নেওয়া যাক। ওনার মতে বুদ্ধি মানে ১. 'বোধসাধন', মতি, প্রজ্ঞা; ২. নিশ্চয়াত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তি; ৩. প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উপস্থিতবুদ্ধি; ৪. তত্ববিশেষ (সাংখ্য মতে); ৫. আত্মবিষয়প্রজ্ঞা; ৬. বিচারশক্তি, বিবেকশক্তি; ৭. বোধ, জ্ঞান; ৮. প্রত্যয়, বিশ্বাস; ৯. কর্তব্যবিষয়ে উপদেশ; ১০. উপায়; ১১. উপায়োদ্ভাবনের শক্তি; ১২. যুক্তি। এতসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে আবার তিনটি common thread বেরিয়ে আসে: ১. বুদ্ধি অন্তঃকরণবৃত্তি, ২. বুদ্ধি বহুমুখী, আর ৩. বুদ্ধির সাথে মন, বিচারশক্তি, জ্ঞান আর বোধের সরাসরি যোগ আছে। 

আত্মা
সাহেবরা যতই ইদানিং hard problem of conciousness নিয়ে মাতামাতি করুন না কেন, আত্মা বা তুরীয় বা চতুর্থম্ (4th One) সম্পর্কে একমাত্র আমাদের বেদান্ত দর্শনই ভরসা। আত্মা হলেন অবস্থাত্রয়ী অর্থাৎ জাগরণ, স্বপ্ন আর সুষুপ্তির অবস্থায় যে অন্তঃস্থিত চতুর্থ স্বতন্ত্র স্বত্তা সবকিছুর আসল দ্রষ্টা বা common factor বা স্বাক্ষী হিসেবে সদাজাগ্রত থাকেন, যিনি মৃত শরীর থেকে নতুন শরীরে transferred হন এবং নিজের সাথে পূর্বজন্মের কর্মফল বহন করে নিয়ে যান, তিনি। আত্মার সবচেয়ে প্রমুখ আভিধানিক অর্থ হলো স্ব, আপনি (Oneself), নিজস্বরূপ, স্বীয়রূপ। আর কি? হরিচরণের লেখনীতে আত্মা মানে ব্যবসয়াত্মিকা অর্থাৎ বুদ্ধি (বুদ্ধিরাত্মা -বেদান্তসার) আর মনঃ অর্থাৎ মন (মনঃ আত্মা -বেদান্তসার)। তার মানে বহুমুখী মন আর বুদ্ধি কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তঃস্থিত একম্ অদ্বিতীয়ম্ আত্মার সমার্থক হয়ে গেল!

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে বেদান্তসার আর গীতার মধ্যে তাহলে কি contradiction তৈরি হয়ে যাচ্ছে না, কারণ গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৪২নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। 
মনসসন্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।।
অর্থাৎ, স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর আত্মা সেই বুদ্ধির থেকেও শ্রেয়।
এইখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের ওই একটি বিশেষণ বা qualifying factor গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে - 'শুদ্ধ'। এইজন্যই বলে এইযুগে বেদান্তের সার হলো রামকৃষ্ণ কথামৃত। ঠাকুর বলছেন,
(মাস্টারের প্রতি) - "যিনি শুদ্ধ আত্মা, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁতে মায়া বা অবিদ্যা আছে। এই মায়ার ভিতরে তিন গুণ আছে - সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। যিনি শুদ্ধ আত্মা তাঁতে এই তিনগুণ রয়েছে, অথচ তিনি নির্লিপ্ত। আগুনে যদি নীল বড়ি ফেলে দাও, নীল শিখা দেখা যায়; রাঙা বড়ি ফেলে দাও, লাল শিখা দেখা যায়। কিন্তু আগুনের আপনার কোন রঙ নাই।
"জলে নীল রঙ ফেলে দাও, নীল জল হবে। আবার ফটকিরি ফেলে দিলে সেই জলেরই রঙ।
"মাংসের ভার লয়ে যাচ্চে চণ্ডালে - সে শঙ্করকে ছুঁয়েছিল। শঙ্কর যেই বলেছেন, আমায় ছুঁলি! - চণ্ডাল বললে, ঠাকুর, আমিও তোমায় ছুঁই নাই, - তুমিও আমায় ছোঁও নাই! তুমি শুদ্ধ আত্মা - নির্লিপ্ত।
"জড়ভরতও ওই সকল কথা রাজা রহুগণকে বলেছিল।
"শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত। আর শুদ্ধ আত্মাকে দেখা যায় না। জলে লবণ মিশ্রিত থাকলে লবণকে চক্ষের দ্বারা দেখা যায় না।
"যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনিই মহাকারণ - কারণের কারণ। স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ মহাকারণ। পঞ্চভূত স্থূল। মন বুদ্ধি অহংকার, সূক্ষ্ম। প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তি সকলের কারণ। ব্রহ্ম বা শুদ্ধ আত্মা কারণের কারণ।
"এই শুদ্ধ আত্মাই আমাদের স্বরূপ।
"জ্ঞান কাকে বলে? এই স্ব-স্বরূপকে জানা আর তাঁতে মন রাখা! এই শুদ্ধ আত্মাকে জানা।"

শুদ্ধতা
শুদ্ধতা মানে কি? দিনে পাঁচবার স্নান করা, মাথায় গঙ্গাজল ছেটানো, শগরী এঁটো হেগো মুতো - সারাক্ষন এই সব করা না সবসময় ঘর ঝাড়পোঁচ করে কাচা জামাকাপড় পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকা? ওগুলো সবই বাহ্যিক, আসল শুদ্ধতা হলো অন্তরের পরিচ্ছন্নতা আর তা হলো মনকে জাগতিক বস্তুর চাহিদা থেকে সরিয়ে এনে আধ্যাত্মিক চাহিদার দিকে চালিত করা, যাতে আত্মার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়। যে মন এটা করতে পারে সেই শুদ্ধ মন। ঠাকুর বলছেন, "... যোগের বিঘ্ন - কামিনী-কাঞ্চন। এই মন শুদ্ধ হলে যোগ হয়। মনের বাস কপালে (আজ্ঞা চক্রে) কিন্তু দৃষ্টি লিঙ্গ, গুহ্য, নাভিতে - অর্থাৎ কামিনী-কাঞ্চনে! সাধন করলে ওই মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়।" আর এক জায়গায় বলছেন, "কথাটা এই - মন স্থির না হলে যোগ হয় না, যে পথেই যাও। মন যোগীর বশ, যোগী মনের বশ নয়।" এই কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে যে বাহ্যিকভাবে মাথায় গঙ্গাজল ছেটালে যেমন শরীর শুদ্ধ হয় তেমনই মনকে স্থির করতে পারলে মন শুদ্ধ হয় আর ঊর্ধ্বমুখী হয়।

আর শুদ্ধ বুদ্ধি কাকে বলে? যে বুদ্ধি ঠিক বেঠিক, সৎ অসৎ আর ভালো মন্দ বিচার করে মনকে কেবল ঠিক সৎ আর ভালো decision নিতে বাধ্য করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমায়ের একটি কথোপকথন। ঠাকুর একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিয়ে যেতে এসেছ?" মা উত্তর দিয়েছিলেন, "তা কেন, আমি তোমার ইষ্টপথে সহায়তা করতে এসেছি।" এই হলো শুদ্ধ বুদ্ধি, যা মনকে ঊর্ধ্বমুখী হতে প্রেরণা দেয়, জাগতিক temporary অকাজ থেকে focusটা পারমার্থিক দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এখন, ভেবে দেখলে যেহেতু মন বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত, সেহেতু শুদ্ধ মন হতে হলে শুদ্ধ বুদ্ধি হতেই হবে - they are integral to each other and therefore inseparable.

শেষে হলো আত্মা। আত্মা সততই শুদ্ধ কারণ আত্মা হলো সিনেমা হলের সেই পর্দার মতন - তার ওপর কমেডি ছবিই চলুক আর ট্র্যাজেডি, অভিনেতারা প্রেমই করুন বা মারামারি, পর্দার ওসবে কিছুই আসে যায় না - ছবি শেষ আর পর্দাও জিঁউ কে তিঁউ বিলকুল সাফ। ফলে যে শুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত শুদ্ধ মন আধ্যাত্মিক রাস্তায় এগোচ্ছে, সে আখেরে এগোচ্ছেটা কার দিকে? ওই আত্মার দিকে। অর্থাৎ স্ব-এর দিকে, নিজের অক্ষয় স্বীয়রূপের দিকে। যেই যোগ সফল হলো অমনি তো মন বুদ্ধি আর আত্মা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তাই ঠাকুর বলেছেন, "যোগীরা যে স্মরণ মনন করেন তার নাম মনোযোগ। আবার ভাবি কালীঘরে গিয়ে, মা মনও ত তুমি ! তাই শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ আত্মা একই জিনিস"।

মন এবং বুদ্ধি শুদ্ধ হলে বাহ্যিক ভেদাভেদজ্ঞান ঘুচে গিয়ে সাধকের কি আনন্দময় অবস্থা হয় তার বিবরণ ঠাকুর নিজের মুখেই দিয়ে গিয়েছেন, কথামৃত থেকে সেই ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের এই প্রসঙ্গের ইতি টানা যাক।
"শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) - আমার এই অবস্থার পর কেবল ঈশ্বরের কথা শুনিবার জন্য ব্যাকুলতা হত। কোথায় ভাগবত, কোথায় অধ্যাত্ম, কোথায় মহাভারত খুঁজে বেড়াতাম। এঁড়েদার কৃষ্ণকিশোরের কাছে অধ্যাত্ম শুনতে যেতাম। কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বৃন্দাবনে গিছিল, সেখানে একদিন জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। কুয়ার কাছে গিয়ে দেখে, একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করাতে সে বললে, ‘আমি নীচ জাতি, আপনি ব্রাহ্মণ; কেমন করে আপনার জল তুলে দেব?’ কৃষ্ণকিশোর বললে, ‘তুই বল শিব। শিব শিব, বললেই তুই শুদ্ধ হয়ে যাবি।’ সে ‘শিব’ ‘শিব’ বলে জল তুলে দিলে। অমন আচারী ব্রাহ্মণ সেই জল খেলে! কি বিশ্বাস!"

শ্রীরামকৃষ্ণার্পণমস্তু।

Friday, January 27, 2023

আনন্দ



শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজীর একটি বক্তৃতায় তিনটি শব্দ শুনলাম - Faith, Hope and Love - বিশ্বাস, আশা আর ভালোবাসা। শুনে মনে হলো যে এগুলি একেবারে তিনটি essential element of living, যেগুলি না থাকলে মানুষের জীবনটাই অর্থহীন। কি বিশ্বাস? না নিজের অধ্যবসায়ের ওপর বিশ্বাস, নিজের গুরুবাক্যের ওপর বিশ্বাস আর এই জীবনেই ইষ্টদর্শন হবে সেই বিশ্বাস। কিসের আশা? গুরু আমায় কৃপা করবেন, ইষ্ট আমায় কৃপা করবেন, মা আমায় শরণাগতি দেবেন - সেই আশা। 

আর ভালোবাসা। ঠাকুর বলেছেন এই কালে মনের পাপ পাপ নয়। পূর্ব জন্মের সংস্কারের ফলে হয়তো মনের মধ্যে কখনো কখনো বৃত্তি খেলে যাচ্ছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি পাপী, আমার কেবল সুকর্ম আছে। I am essentially Divine. সেইজন্য আমার গুরু আমায় এত ভালোবেসে আমার ভার নিয়েছেন, আমার ইষ্ট আমায় এত ভালোবেসে তাঁর নামরূপ দিয়েছেন আর মা তো আমায় অসম্ভব ভালোবাসেনই, যার প্রমান আমি প্রতিটি পদে পদে পাই। আমিও আমার গুরুকে, আমার ইষ্টকে আর আমার চিরকালের মাকে ভীষণ ভালোবাসি, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তাই আমার প্রতিদিনের মানসিক যাপন একটা ভালোবাসার অনন্দঘন আবহে ঘেরা আর সেই আনন্দ-অনুভূতিই আমি সমস্ত ধরণের পরিবেশের মধ্যে পেতে চাই। 

কিরকম? ওই রবীন্দ্রনাথ একটি গানে বলেছেন না,
'তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ।
তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,
ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
তারে মোহনমন্ত্র দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ
তারে দোলা দিয়ে দুলিয়ে গেছে কত ঢেউয়ের ছন্দ,
ও তার  অন্ত নাই গো নাই।
আছে কত সুরের সোহাগ যে তার স্তরে স্তরে লগ্ন,
সে যে কত রঙের রসধারায় কতই হল মগ্ন,
ও তার  অন্ত নাই গো নাই।'

তাই যেখানে বিশ্বাস নেই কেবল সন্দেহ আছে, সেখানে আমি নেই। যেখানে আশা নেই, কেবল নিরাশা আছে, সেখানে আমি নেই। আর যেখানে ভালোবাসা নেই, আনন্দ নেই, শান্তি নেই, কেবল পরনিন্দা আছে, ঈর্ষা আছে, অন্যকে ব্যবহার করা আছে, অহেতুক চেঁচামেচি আর বিতর্ক আছে, সেখানে আমি নেই। একদম ধারেকাছেও নেই। তার মানে কি আমি escapist? মোটেও না। 

আমি নেই বলতে ওখানে আমার মন নেই, ওখানে আমার concentration নেই, ওর ওপর আমার focus নেই, কেবল motion আছে। আমায় যদি কোনো dispute resolution করতে কোর্টে যেতে হয় আমি যাবো, আমার তরফ থেকে যা defense তা পেশ করবো কিন্তু বিপক্ষ কি প্যাঁচ কষছে বা রায় কি হতে পারে তা নিয়ে সারাক্ষন মাথা ঘামাবো না, infact একেবারেই মাথা ঘামাবো না। I will go through the motion with sincerity but neither get affected nor involved at an emotional level. আমি জানি ওতে আনন্দ তো নেইই, ওতে permanent কোনোকিছুও নেই।

তাই যে মুহূর্তে কোর্ট থেকে বেরোবো সেই মুহূর্তেই আমি আমার যে নিজস্ব বিশ্বাস আশা আর ভালোবাসার bubbleটা আছে, যার দেওয়ালগুলো আমি জপ-ধ্যান দিয়ে একটু একটু করে গেঁথে তুলেছি, টুক করে তার মধ্যে নিশ্চন্তে ঢুকে পড়বো কারণ আমার জীবনের উদ্দেশ্য মামলা লড়া নয়, সৃষ্টির আনন্দকে অনুভব করা, উপলব্ধি করা আর ভোগ করা। আসলে পূর্বজন্মের বহু সুকৃতির ফলে এই যে হিন্দু শরীরটা পেয়েছি, এটা আমাকে আমার নিজের মনের মতো পথ বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই exhilarating অনুভূতিটা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যেই নেই। 

আমার ওপর মায়ের এমন কৃপা যে কোনো পন্থীয় dictation মানার বাধ্যবাধকতাই আমার নেই। আমাকে না তো বাধ্যতামূলকভাবে বিশেষ কোনো Personal Godকে মানতে হয়, না তাঁর কোনো একজন বিশেষ অবতারকে আর না তাঁর কোনো একটি বিশেষ নির্দেশনাবলীসূচক গ্রন্থকে। আমি মুক্ত, স্বেচ্ছাধীন। অনেক পথ, অনেক অবতার আর অনেক গ্রন্থের মধ্য থেকে আমার যা ভালোলাগে, যাঁকে ভালোলাগে আর যে রাস্তা ধরে এগোতে আমি যখন comfortable, হিন্দু হওয়ার কারণে সবসময় সেটাই বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা আমার আছে and I must preserve this independence at any cost. 

হিন্দুজীবন হলো সম্পূর্ণভাবে cerebral, হিন্দু শরীর পেলে temporary অকাজে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। তবে শরীর থাকলে তবে তো মন থাকে আর মন থাকলে তবে তো উচ্চচিন্তা করা সম্ভব হয়, ফলে শরীর রক্ষা করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু তো করতেই হবে, সেটা জরুরিও। রোজগার নেই অথচ অর্থ বা সামগ্রী দিয়ে সাধুসেবা করবো - absurd ব্যাপার, utopian. তাই রোজগার করাটা অকাজ নয় কিন্তু এসব আমার রোজগার, আমি মালিক, আমার টাকা, আমি যা ইচ্ছে করবো, কার বাপের কি - এই ভাবনাটা অকাজ। ফলে জাগতিক বিষয়ে involvement ততটুকুই রাখতে হয় যতটুকু না হলেই নয়।

আসল কথা হলো জীবনকে সম্যকরূপে উপভোগ করা। আমি শুদ্ধ, আমি শরণাগত, আমি কৃপাপ্রাপ্ত, মা আমার হাত ধরে আছেন, আমার এ শরীর মন বোধ বুদ্ধি সবই অনন্দময়ীর সদানন্দময় আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের ভাব তরঙ্গে তরঙ্গায়িত; আমার উৎপত্তি আনন্দ থেকে, আমার স্থিতি আনন্দে এবং লয়ও আনন্দেই হবে - এই অনুভূতিটা খুবই calming, খুবই ভরসার। 
মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ করো না,
তোমার ও দুটি চরণ বিনে আমার মন
অন্য কিছু আর জানে না।
মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ করো না।।

Wednesday, January 25, 2023

৭৪তম গণতন্ত্র দিবস


সবাইকে ৭৪তম গণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। আজ কর্তব্যপথের বুকে ভারতরাষ্ট্রের যে সুন্দর পরম্পরাশ্রয়ী ছবিটা আঁকা হলো সেটা আমাদের দেশীয় সামরিক শক্তিপ্রদর্শনের সাথে সাথে রাষ্ট্রের ইতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী বিবিধের মাঝে ঐক্যের বার্তাবহনকারী। এটাই আমাদের পুণ্যভূমি থেকে উঠে আসা জাতীয় উত্তরাধিকার আর এটাই আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয়। 

আজ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নতুন করে We the people এর সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিন। কোন people? যারা ভারতীয় গণ। কারা ভারতীয় গণ? যারা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, সমন্বিত সংস্কৃতি ও ধর্মসংস্কারের ধারক ও বাহক বলে গৌরবান্বিত বোধ করেন। 

বাকিরা resident হতে পারেন কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতিতে সম্পুর্নরূপে লীন না হতে পারার কারণে রাষ্টের তো বটেই, নেশনের citizen হবার যোগ্যতাও এখনো অর্জন করেননি - হয়তো তাঁদের মনে এখনো বিপরীত কোনো বিজাতীয় ধারাকে প্রাধান্য দেবার দ্বন্দ্ব গেঁথে আছে। ফলে ভারতের গণতন্ত্র দিবস যাদের জন্য, তাঁরা বাকিদের ভারতীয়ত্বের যোগ্য হয়ে ওঠার ব্যাপারে আরো প্রচেষ্ট হবেন, গণতন্ত্র দিবসের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। 

গভীর সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক স্বাতন্ত্রবোধ সম্পন্ন যে কোনো বিশেষ জনসমাজই হলো জাতি। আর এরকম অনেক জনসমাজের সমষ্টি হলো নেশন। নেশন শব্দটি জেনেশুনেই ব্যবহার করলাম কারণ নেশনের বাংলা অনুবাদস্বরূপ জাতি লেখা হলেও, জাতি মোটেও নেশন নয় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নেশন শব্দটিই ব্যবহার করতেন, জাতি শব্দটি নয়। 

এতগুলো কথা বলার কারণ এই, যে নেশন এবং রাষ্ট্রের অবধারণা বুঝতে গেলে উপজাতি, জাতি, নেশন বা দেশ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার। ভারতীয় নেশন হলো বিভিন্ন অঙ্গপ্ৰতঙ্গ মিলিয়ে একটা শরীর, একটা big melting pot আর হিন্দুত্ব বা Hinduness হলো তার প্রাণ। হিন্দু মানে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার উত্তরাধিকারি citizen, যার প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে।

ইংরেজিতে Nation বলতে বোঝায় 'a large body of people united by common descent, history, culture, or language, inhabiting a particular country or territory'. এই পরিভাষা অনুযায়ী তো দক্ষিণ-রাঢ়ি, মিজো, তামিল, কোঙ্কানি, বিদর্ভি, মৈথিলি ইত্যাদি সব আলাদা আলাদা জাতি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা তো নয়, এগুলো কেবল উপজাতিগত পরিচয়। রাষ্ট্র একটা magical word, জাতির চশমা পরে দেখলে যাকে বোঝা মুস্কিল।

হিন্দুত্বের নানাদিকের একটা দিক হলো তার বিশিষ্ট রাষ্ট্রচেতনা - তার প্রাচীন ইতিহাস, তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, তার ধর্মবোধ, সব মিলেমিশে হিন্দু হয়ে ওঠা যেমন রোমান, গ্রিক, মিশরীয় ইত্যাদিদেরও সভ্যতাভিত্তিক বিশিষ্ট পরিচয় আছে। এই সভ্যতার legacyকে অস্বীকার করে চার্চিল India সম্পর্কে তাঁর ভ্ৰান্তধারণা অনুযায়ী বলেছিলেন যে, ‘India is a geographical expression…. No more a single country than the Equator.’ কিছু ভারতীয় এখনো এই কথাতেই বিশ্বাস করেন, ফলে তারা এখনো ভারতীয় citizen বা হিন্দু হয়ে উঠতে পারেননি, Indian হয়েই রয়ে গেছেন।

চার্চিল একটা unitarian উপজাতির কথা বলছেন, নেশনেরও নয়, রাষ্ট্রের নয়। আর ভারত কেবল একটা নেশন নয়, একটি মহান রাষ্ট্র, হিন্দুরাষ্ট্র, যার ভূগোল আজ বিভক্ত হলেও, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এক। তাই সাভারকার সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে, 'Hindu is one who considers India to be his motherland (matrbhumi), the land of his ancestors (pitrbhumi), and his holy land (punya bhumi)', যা চার্চিলের অবধারণার চেয়ে একেবারে উল্টো।

আমরা হলাম গণতন্ত্রের মাতৃভূমি। এর বিস্তারিত ইতিহাসে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই, কিন্তু গণতন্ত্র সেই বৈদিক যুগ থেকেই মূল ভারতীয় হিন্দু জীবনশৈলীর অবিচ্ছেদ্য সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গ। ফলে, আজ যখন নতুন করে গণতন্ত্র দিবস পালিত হয়, তখন একে হিন্দু সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে কারণ পরবর্তীকালে বাইরে থেকে যে authoritarianism আমদানিকৃত হয়েছে, তা আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির basic tenet-এর বিরোধী। আমাদের বালি আর কংসকে বধ করা থেকে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে হারিয়ে দেওয়া পর্য্যন্ত একটা বহু হাজার বছরের ইতিহাস আছে।

ভারত এখন বিশ্বগুরু হিসেবে নতুন করে আবার নিজের পুরানো ভূমিকা পালন করার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সাংস্কৃতিকভাবে অখন্ড ভারত কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এইসময়, যারা দেশে থাকেন, তাদের সবাইকেই যদি আমরা এক ছাতার তলায় আনতে না পারি তাহলে যারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের একত্রিত করবো কি করে? তাই প্রত্যেক ভারতবাসীর উচিত প্রজা থেকে রাজা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজেরা তো সামিল হবেনই, বাকিদেরও হাত ধরে সেই রথে টেনে তুলবেন। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস লেগে থাকলে একদিন না একদিন এই লক্ষ্য ঠিকই হাসিল হবে।

The rise of Bharat

A Colonial-Merchantile economy reigned for 200 years, followed by Socialism for 75 years, followed by Globalisation for 25 years. All of these are dead and buried now and a transition is in progress. Coming is the era of a Bharatiya economic order, which is unique, just and equitable. 

Britain's economy rose because she enjoyed peace dividend while the rest of Europe were fighting among themselves. US rose after the World Wars as she too enjoyed peace dividend till the fag end of the war while all the colonial and neocolonial powers were fighting with each other. Post WW II Germany, Japan and China's rise at the behest of US can also be attributed to peace dividend enjoyed by them while the two major poles of the era i.e. USA and USSR were at loggerheads with each other.

Now, Europe is at war again, albeit in a proxy mode, US is at loggerheads with China and Russia, Japan is probably going nuclear, the Middle East is confused regarding which pole to join, Iran is threatening the Arabs, Israel is threatening Iran, Syria is a global headache, Turkey is trying to punch above her weight while Greece, Armenia and Egypt are closing in on her from all sides, NATO is chaos personified and war can erupt between North and South Korea anytime at China's prodding, to act as a smokescreen for her adventurism in Taiwan. 

Amidst all this turmoil and a sure shot world war looming large in the horizon within five years, which nation would now reap peace dividend to the hilt? Goes without saying. And therefore, after the dust settles, a new economic order shall emerge very soon, which would be a beautiful combination of ancient wisdom and new aspirations, an order based on Dharma and humaneness. Wait and watch folks. 

Our era has just begun. The rise of a strong nationalist in the form of Narendra Modi (and incidentally of BJP) is not without reason. As his agenda of promoting our age-old National Identity above everything else gains ground, Bharat is steadily moving away from her colonial legacy of casteist, linguistic and regional divides and getting more and more united while the European, American and Chinese societies are getting increasingly fragmented.

Also look at what fate has befallen on our enemies - they are steadily moving towards bankruptcy and disintegration from within. These are clear indications of the future. Our future role is preordained by the Divine Power. It is to ensure peace and harmony across the globe as the world's conscience keeper. We will get there very soon, come what may.

Tuesday, January 24, 2023

কংগ্রেস

অনেকদিন রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখিনি কিন্তু বিবিসির একটা বেআইনি কাজকে সমর্থন করে কিছু অপগন্ডের আশা জেগে উঠছে দেখে ভাবলাম মনের কথাটা বলেই ফেলি। অবশ্য একই কথা সুপ্রিম কোর্টের কলিজিয়ামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যেখানে জজ সাহেবরা নিজেরা নিজেরাই সংবিধান সংশোধন করে নিয়েছেন আর রাজনৈতিক কারণেই কেউ কেউ সেটাকে সমর্থনও করছেন!

কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির রাজনীতিতে আমার বিন্দুমাত্র কৌতুহল নেই কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে 'হামাম মে সব নাঙ্গে হ্যায়'। কিন্তু আমার দেশের ব্যাপারে আমার যথেষ্ট চিন্তা আছে এবং একটা credible opposition এর অভাবে শাসকদলের লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ও আছে। 

প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে নেহেরুর কংগ্রেস আর ইন্দিরার কংগ্রেস এক নয়, যেমন নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেস আর এখনকার সোনিয়া-রাহুলের কংগ্রেসও এক নয়। নেহেরু বিচারধারায় প্রায়-বামপন্থী ছিলেন, ইন্দিরা ক্ষমতার জন্য দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরের বামপন্থী শক্তিকে চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন মাত্র।

তারপর নরসিংহ রাও যদিও কংগ্রেসকে বামপন্থার বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো থেকে প্রায় বের করে এনেছিলেন, সোনিয়া কংগ্রেসকে রাওমুক্ত করার জন্যই নিজের আধিপত্য বজায় রেখেই শাশুড়ির মতোই বামপন্থাকে ব্যবহার করেছিলেন। মনমোহন সিংয়ের সময় বিচারব্যবস্থা নিয়ে কংগ্রেসি মন্ত্রীরা সংসদে যে ধরণের সমালোচনা করেছিলেন এবং সে সময়ের বিরোধী দলনেতা অরুন জেটলির সমর্থন পেয়েছিলেন, আজ নিজেরা শুনলে হয়তো অবাক হবেন।

রাহুল গান্ধীর ব্যাপারটা একদম অন্যরকম কারণ তাঁর নিজের কোনো স্বাধীন চিন্তা নেই, বৌদ্ধিকস্তরে তিনি সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভর অথচ পাহাড়প্রমাণ অহংকারের অধিকারী। তাই কাজের লোকেরা সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অকেজো বামপন্থীরা তাঁকে ঘিরে ফেলে নিশ্চিন্তে নিজেদের এজেন্ডা চালাতে পারছে আর তিনি কাঠপুতুলের মতো তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কংগ্রেসকে দিনে দিনে আরো অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। 

আচ্ছা, ভারতের কতজন নাগরিক নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্ট বা দ্য ওয়ের পড়েন অথবা বিবিসি বা আল জাজিরা দেখেন? পয়সা দিয়ে ওখানে মিথ্যে ন্যারেটিভ ছাপিয়ে বা মিথ্যে প্রোপাগান্ডামূলক ডকুমেন্টরি চালিয়ে কি দেশের অগুনিত সাধারণ নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনের সদর্থক অভিজ্ঞতাকে নস্যাৎ করে দেওয়া যাবে? এতে একমাত্র বিদেশি ভারতবিরোধী শক্তির হাতে কিছু প্রোপাগান্ডার অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়, আর কিছুই না।

বেছে বেছে সেনাদিবসের দিনেই যদি দিগ্বিজয় সিং বালাকোট হামলার সত্যতা নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলে বসেন, যখন কিনা সেই অপারেশনের প্রধান কান্ডারীকেই কংগ্রেস নিজেদের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করে কিছুদিন আগেই প্রচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছে, জয়রাম রমেশের ঠাকুর্দার সাধ্য আছে সেই দেশবিরোধী কংগ্রেসকে অবনমনের হাত থেকে বাঁচানোর? 

নিছক রাজনৈতিক কারণে হটাৎ করে গণবেশ পরে ময়দানে হাজির হয়ে গেলেই যেমন কেউ স্বয়ংসেবক হয়ে যান না, ঠিক তেমনই বামপন্থীদের দ্বারা চালিত হলেই কেউ বামমনস্ক হয়ে যান না এবং সেটা তাঁর দামি পোশাকআশাক আর অসংলগ্ন কথাবার্তায় ফুটেও ওঠে। দুটোই সমান মেকি এবং ভারতে সুস্থ, স্বচ্ছ, মতবাদভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক। 

কংগ্রেসের উচিত তারা যা নন সেটা সাজার বৃথা চেষ্টা ত্যাগ করা, ঠিক যেমন বিজেপির উচিত তারা যা নন, অন্যের দেখাদেখি তাই হয়ে ওঠার চেষ্টা না করা। গণতন্ত্রে বিভিন্ন বিচারধারা থাকবে, খোলাখুলি মতের আদানপ্রদান হবে, দেশের স্বার্থ কেবল ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয়স্বার্থের উর্দ্ধে হবে তাই নয়, সর্বোপরি হবে - তবে না দেশের মানুষের উপকার হবে। 

কংগ্রেস ভেবে দেখুক সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক অপপ্রচারকারী, শত্রুর বন্ধু আর নিন্দুকের ভূমিকা পালন করবে না রাষ্ট্রের উন্নতি ও বৈভবের কারণ হয়ে উঠবে। কংগ্রেসে কি চায় তা গৌণ, দেশের মানুষ কি চান সেটাই মুখ্য। দেশের মানুষ যদি কোনো রাজ্যে বিজেপিকে না চান, কংগ্রেস বা অন্য কোনো দল যদি নির্বাচিত হয়, ক্ষতি কি? তেমনিই দেশের মানুষ যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এইমুহূর্তে কেবলমাত্র মোদিজীকেই চান, অন্য কাউকে নয়, তাঁদের মতামতকে অসম্মান করার অধিকার কারো আছে কি?

বামপন্থীরা মনুষ্যত্বের শত্রু, এদের চেয়ে দোগলা, হিংস্র আর মিথ্যেবাদী রাজনৈতিক মতাবলম্বী সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। শ্রেণীর নামে সারা বিশ্ব জুড়ে কত কোটি কোটি মানুষকে যে এরা খুন করেছে, তার ইয়ত্তা নেই, হিটলার এদের এক একটি রত্নের তুলনায় দুগ্ধপোষ্য শিশু। এদেরকে ব্যবহার করা এক জিনিস আর এদের দ্বারা চালিত হওয়া অন্য জিনিস। এদের রাস্তা যদি সঠিক হতো তাহলে মাত্র সত্তর বছরের মধ্যে সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতেন না। 

এদের খপ্পরে পড়ে কংগ্রেস যা করছে ভুল করছে, ভবিষ্যতে যা করবে তাও ভুল করবে। এতদিনে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেছে - রাহুলমুক্ত হতে না পারলে দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের কোনো সদর্থক ভূমিকা থাকবে না। ব্যাপারটা দুঃখের হলেও সত্যি। ততদিন মিথ্যের বেসাতি চলতে থাকবে, যা দেখে ঘোড়াতেও হাসছে। আমি আশা করবো যে অদূর ভবিষ্যতে সারা দেশজুড়ে একটা মস্ত বড় রাজনৈতিক মন্থন হবে আর across the spectrum যা কিছু মেকি, যা কিছু অসৎ, যা কিছু মিথ্যা সব মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে আস্তাকুঁড়ে স্থান পাবে।

Sunday, January 22, 2023

একটা ঘর

একটা ঘর 

ঘরটা অগোছালো
লেপ এলোমেলো
খোলা ল্যাপটপের পাশে খোলা জলের বোতল
মাঝেমাঝেই বেজে ওঠা ফোন
আর বহুদিনের পিছটান -
হটাৎ চুপচাপ।

সবকিছু গুছানো
বিছানাটা টানটান
খালি টেবিলে কোণে খালি ফুলদানি
পর্দাগুলোও টানা
ছায়া ছায়া ঘুমন্ত ঘরে
এখনো কোলোনের আভাস।

কেউ ছিল, এখন নেই,
এটুকুই।
২২.১.২৩
(বিশালের আজ ভোরে বোম্বে ফিরে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় লেখা)

Saturday, January 21, 2023

কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সৌভিককে কাল নিল না জীবনের ঝাল নিল, নাকি যেসব আলবালছালরা ওর মাতলামোকে তোল্লা দিত - তারা নিল জানিনা, কিন্তু বাংলা কবিতার ছাদে এমন একটা বিরাট ছেঁদা হয়ে গেল যে এখন ঐ ঘরে গেলেই সেই ফুটো দিয়ে অজাত কুজাতদের ডাঁই করা রাবিশ হুড়মুড়িয়ে গায়ে পড়তে পারে। বলে নাকি মরা মানুষের নিন্দে করতে নেই। করবো না তো কি করবো? ঈশ্বর ট্যালেন্ট একেবারে ভরে ভরে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, ছোকরা সম্পুর্ন নিজের দোষে তাকে নয়ছয় করে দিয়ে হটাৎ ফুটে গেল। কতদিন অফিস কেটে ভরদুপুরে ক্যাফেলায় এসে কোণের ওই বড় ফ্রেঞ্চ উইন্ডটার পাশে বসে বসে কবিতা লিখতো, টাটকা কবিতা পড়ে শোনাতো, শোনাতে শোনাতে হোঁচট খেলে কাটাকুটি করতো, আবার প্রথম থেকে শোনাতো, সেসব আজ হটাৎ হুশ হয়ে গেল। প্রচুর ঝগড়া হয়েছে সৌভিকের সঙ্গে আমার, প্রচুর বকেছি ওকে অপরিমিত মদ খাওয়ার জন্য, দুএকবার মনে হয়েছে গালে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিই। পিপির সঙ্গে বিচ্ছেদটা ওর নরম কবিমন মেনে নিতে পারেনি এটা যেমন সত্যি, ওর সঙ্গে ২৪ঘন্টা থাকাটাও যে একটা দুরূহ যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার, সেটাও তেমনিই সত্যি। ছেলেটা জীবনে সুখ পেল না, এই খেদ অবশ্যই রয়ে যাবে। আর সেই পরিস্থিতিটা শুধরানোর যে আর কোনো সুযোগ নেই, সেই খেদটা আমাদের মতন ওর বড় দাদাদের পক্ষে আরো অনেক বেশি বেদনাদায়ক হয়ে রয়ে গেল। ওর মা আগেই চলে গেছেন, বেঁচে গেছেন, কিন্তু বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা যে রয়ে গেলেন, কি যে দুঃখের সে আর বলার নয়। নিচে সৌভিকের লেখা একটা কবিতা দিলাম, যারা ওকে চিনতেন না, তাদের জন্য।

এখন, দিনরাত

বিবর্ণ বিকেলের কালচে রাজপথ
যেন অলস, পুরনো অজগর
সময়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
আমরাও পুরনো হয়ে চলি

সরু গলি, কবেকার মরচে অ্যান্টেনা
সেইসব বাড়ীতে আর কেউ থাকেনা এখন
সাদাকালো ফটো-অ্যালবামে
শুধু পড়ে আছে কিছু
যুবতী বনভোজন, আর হুটোপাটি হাসিগান ছবি

কলকাতায় বসন্ত নেই বহুকাল
একটা গভীর, নীলচে শীতকাল
নিঝঝুম বসে আছে জানলায়

কোন আতসবাজী নেই একশো বছর
ইতিহাসনির্ভর আলতো টিকে থাকা -

বন্ধুদের কথা ভাবতে ভাবতে
একটা ধূসর, ঠান্ডা জামা পরে
আমি নিয়মমাফিক ভেসে যাচ্ছি দিনরাত.....

Friday, January 20, 2023

মোদি

যে যা ইচ্ছে ফালতু বকার বকতে থাকুক, ওঁর যা করার উনি মুখ বুজে ঠিকই করে যাবেন কারণ ওনার এই শরীরধারণের উদ্দেশ্য কি, কেন এ দেশে, এই সময়ে ওঁর জন্ম হয়েছে, উনি তা সম্যকরূপে জানেন। এই জানাটা একমাত্র গভীর সাধনা এবং মহাকালকৃপা ও গুরুকৃপা থেকে আসে, যা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্যও নয়। যেদিন উনি থাকবেন না সেদিন আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে লোকে ওনার মূর্তি বসিয়ে মালা দেবে, এখন যারা পেছনে লাগছে তাদের কথা তখন কেউ মনেও রাখবে না। এটাই ধ্রুব সত্য। উনি যে ভূমিকা পালন করছেন এবং যে বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে থেকে যে ধরণের লোকদের নিয়ে ওঁকে কাজ করতে হচ্ছে, তাতে খানিকটা চাতুরী, খানিকটা নার্সিসিসম দেখানো হয়তো জরুরি, নইলে ওঁর উদ্দেশ্যসাধন হবে না। ওঁর ওই বাইরের রূপটা দেখে এখন অবুঝ বোদ্ধারা যত পারে নেগেটিভ ন্যারেটিভ বানিয়ে যাক, শেষমেশ ওনার কাজই ওনার হয়ে কথা বলবে। ওঁর ভূমিকা ভারতের অন্তরাত্মার পুনরুত্থানের জন্য দৈবনির্ধারিত, যার ইঙ্গিত রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চদশ সংঘাধ্যক্ষ পরম পূজ্যপাদ স্বামী আত্মাস্থানন্দজী মহারাজ বহুদশক আগেই ওঁকে দিয়েছিলেন। ওঁর মূল্যায়ন করার সঠিক সময় এখনো আসেনি। ওটা সেইদিনই হবে যেদিন ওঁর গড়া সুদৃশ্য জয়স্তম্ভটি সবাইকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওঁর অতুল কীর্তির সাক্ষ্য দেবে আর বিশ্বশুদ্ধু লোকে বিস্ফারিত নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বিস্মিত হয়ে ভাববে, এমনও হয়?

Wednesday, January 18, 2023

কেমন মুক্তি চাই?

বেদান্তে তিন রকমের মুক্তির কথা বলা হয়েছে - আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক আর আধিভৌতিক অর্থাৎ নিজের মনের প্রভাব থেকে মুক্তি, সমাজের প্রভাব থেকে মুক্তি আর প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্তি। আমি ঠিক জানিনা একেবারে জীবনচক্র থেকেই মুক্তির ইচ্ছেটা ঠিক কোন সময় আমাদের bucketlist এ ঢুকে পড়েছে, কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে যে আসল মুক্তি তখনই হয় যখন ব্যক্তিস্বত্তা সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে - বাইরের সম্পদের বদলে ধীরে ধীরে অন্তরের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হওয়াই তো শ্রেয় কারণ বাইরেরটা temporary, শরীরভিত্তিক, আর অন্তরেরটা permanent। 

পাপ-পুণ্যের ফর্মুলা তো সেই কোন আদ্যিকালে ব্যাসদেব নিজেই বলে দিয়ে গিয়েছেন - 'পূণ্যায় পরোপকরায়, পাপায় পরপীড়নম্', অর্থাৎ পরোপকার করলে পূণ্য হয় আর পরকে উৎপীড়ন করা হলো পাপ। যেহেতু পাপ আর পুণ্যের সাথে প্রারব্ধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে, ফলে মুক্তির perspective থেকেও এদুটিকে ignore করার উপায় নেই। এখন, কারো পুণ্যলাভের মাধ্যমে যদি জগতের কল্যাণ হয় তাহলে তো পুণ্যাত্মারা বারেবারে শরীর ধারণ করতেই চাইবেন, মাঝপথে সব মজা ছেড়ে-ছুঁড়ে খামোখা পালাতে চাইবেন কেন? 

এ ব্যাপারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমায়ের একদিনের কথোপকথন মা নিজমুখে একবার বলেছিলেন। "ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, "দেখো, এরপর ঘরে ঘরে এর (ঠাকুরের) পুজো হবে। পরে দেখবে - একেই সবাই মানবে, তুমি কোনো চিন্তা করো না। মাইরি বলছি - বাপান্ত দিব্যি।" তাঁর অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আসবে, যেমন এখন সব খ্রিস্টানরা আসছে না। ঠাকুর বলেছিলেন যে একশো বছর পরে আবার আসবেন। এই একশো বছর সূক্ষ্মশরীরে ভক্ত-হৃদয়ে থাকবেন। গোলবারান্দা হতে বালি উত্তরপাড়ার দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন। আমি বললুম, "আমি আর আসতে পারব না।" লক্ষী বলেছিল, "আমাকে তামাক-কাটা করলেও আর আসব না।" ঠাকুর হেসে বললেন, "যাবে কোথা? কলমির দল একজায়গায় বসে টানলেই সব এসে পড়বে।" এর ওপরে তো আর কথা হয় না, তাই না?

এখন, পাপ-পূণ্যর থিওরি থেকে মাটিতে নেমে এসে দৈনন্দিন জীবনে ভালো আর মন্দের বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক। এক্ষেত্রেও underlying theme ওটাই - যাতে কারো মঙ্গল হয় তা ভালো আর যাতে কারো ক্ষতি হয় তা খারাপ। আজকেই দেখলাম একটা লোক মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে ফুটপাথে পড়ে আছে। ভর সন্ধ্যেবেলায় নেশা করে out - কি খারাপ কাজ, তাই না? যদি ধরে নিই যে ঐ মানুষটির কোনো পিছটান নেই তাহলে সে তো আর অন্য কারো ক্ষতি করেনি, নিজে বুঁদ হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছে। হ্যাঁ, সে যদি নেশার চোটে মারামারি করতো, বা কাউকে কটু কথা বলতো বা মদের পয়সা জোটাবার জন্য চুরিচামারি করতো, তাহলে অবশ্যই সে অন্যের ক্ষতি করতো এবং সেক্ষেত্রে কাজটা একেবারেই ভালো হতো না। 

তার মানে কি নেশা করা উচিত? মোটেই না, কারণ তা শরীর ও মনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা পারম্পরিকভাবে যেগুলোকে ভালো বা খারাপ কাজ বলে জানি সেগুলো যে আদপেই পাপ বা পুণ্যের সাথে aligned নয়, হবে যে তারও কোনো স্থিরতা নেই, সেটাই বোঝাবার চেষ্টা করছি মাত্র। অমুক মটরসাইকেল ছেড়ে নতুন গাড়ি কিনেছে শুনলে প্ৰথমেই যে জিনিসটা মাথায় আসে তা হলো, 'ভালো করেছে'। এটা কি মাথায় আসে যে সেই গাড়িটি অসৎ পথে রোজগার করা টাকা থেকেও কেনা হয়ে থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সেটা মোটেই ভালো কাজ হয়নি, বরং গর্হিত অপরাধ? বোধহয় না, কারণ আমাদের ভালো-মন্দ বিচারের মানক সবসময় morality নির্ভর নয়, ধর্মবোধ আধারিত নয়, পাপ-পুণ্যের বোধ থেকে অনেকসময়ই আলাদা।

এবার মূল বক্তব্যে আসি। রামকৃষ্ণ মিশনের লোগো আঁকার সময় স্বামীজী তার তলায় লিখেছিলেন, 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' - নিজের মোক্ষ এবং জগতের কল্যাণের জন্য। তার মানে জগতের কল্যাণের মাধ্যমেই নিজের মুক্তি বা মোক্ষলাভ সম্ভব - সেই বেদব্যসের পুণ্যের পুরানো ফর্মুলা যাকে ঠাকুর অনেকধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে 'শিবজ্ঞানে জীবসেবা'র সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। আমি গুহার মুখে পাথর এঁটে ভেতরে পড়ে আছি আর বাইরে অসহায় অসুস্থ মানুষ সেবা ও সাহায্যের অভাবে কাতরাচ্ছে - কোন যুক্তিতে এইরকম একজন স্বার্থপরের মুক্তিলাভ হবে? তারা কি আমার থেকে আলাদা, তাদের মধ্যে কি সেই একই অনন্ত চেতনা কাজ করছে না, তাহলে? এই যে মানুষের শরীর পাওয়া, এর দ্বারা যদি মানুষের উপকারই না হলো, তাহলে এ শরীরের স্বার্থকতাই বা কি আর এই মানবজীবনের উদ্দেশ্যসাধনেরই বা কি?

গাজীপুর থেকে স্বামীজীর প্রমদাবাবুকে ৩রা মার্চ, ১৮৯০ সালে লেখা চিঠিতে দেখছি তিনি শুরুতেই লিখছেন, 'আপনি জানেন না—কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই, কত চেষ্টা করি যে, খালি আপনার ভাবনা ভাবি। কিন্তু বারংবার পরের ভাবনা ভাবিয়া ফেলি। এবার বড় কঠোর হইয়া নিজের চেষ্টার জন্য বাহির হইয়াছিলাম—এলাহাবাদে এক ভ্রাতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া অমনি ছুটিতে হইল।' এই তো এক আদর্শ মহাজীবন, যিনি মায়া মায়া নেতি নেতি করে কাঁদুনি না গেয়ে মানুষের সেবায় নিজের প্রাণপাত করে আধুনিক যুগের আদর্শ ব্রহ্মজ্ঞ মহাতাপস হয়েছেন এবং জীবের কল্যাণের জন্য হাজার বার জন্ম নিতেও পিছপা নন, বরং আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 

মোক্ষ তো আর গাছ থেকে পড়বে না, ওই বোধ ধীরে ধীরে নিজের ভেতর থেকেই উৎসারিত হবে - it is an internal transformation emanating from within. আমার যদি অহংবোধ এবং স্বার্থবোধ প্রবল হয়, আমি যদি নিজের শরীরের বাইরে একই মহাশক্তির প্রকাশ জগৎ সংসারকে আপন না ভাবতে পারি, তাদের দুঃখে কাঁদতে না পারি, তাদের আনন্দে নাচতে না পারি, তাহলে আমার আধ্যাত্মিক journey শুরু করবো কোন বিন্দু থেকে? 

আমরা, ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত অশিক্ষিতরা, আব্রাহামিক মতবাদগুলির প্রভাবে একটা সম্পূর্ণ ভুল notion এর বশে সাধারণত ভেবে থাকি যে ঈশ্বর এখানে নেই স্বর্গে আছেন, এখনই নয়, তাঁর সাথে শেষ বিচারের দিন দেখা হবে এবং তিনি আর আমি দুটি ভিন্ন স্বত্তা। আমাদের নিজেদের বেদান্ত কিন্তু এর ঠিক উল্টো কথাটা বলে, যা যুক্তিগ্রাহ্য inference, blind faith এর কোনো ব্যাপার নেই। বলে তিনি এখানেই আছেন, এখনই আছেন এবং আমি তিনিই এবং সেটা আমাদেরই দৈনন্দিন অনুভূতির ভিত্তিতে আবার প্রমাণও করে দেয়। তাই ঠাকুরের পথ ধরে স্বামীজী বলেছেন ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য - নির্গুণ স্বগুণ সবই এক - একম্ সৎ। আমিই যদি সব হয়েছি তাহলে কার থেকে পালাবো রে বাবা?

পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী প্রেমেশানন্দজী মহারাজ একটি চিঠিতে একজায়গায় লিখছেন, 
'ঠাকুর পরাবিজ্ঞানের সব রহস্যই এবার বিশ্বসভায় উদ্ঘাটিত করিয়াছেন৷ তিনি সর্বজীবের ভিতরে, জগতের সর্বত্র এক চিদবস্তুকে দেখিতেছেন৷ চিৎ ছাড়া যে অন্য কোন বস্তু থাকিতেই পারে না৷ অন্য কোন বস্তু আছে, বোধ করাই ব্রহ্মকে সীমাবদ্ধ করা৷ ইহা চরমজ্ঞান, চরম অনুভূতি৷ ঠাকুর ছাড়া কেহ ইহা এত সুস্পষ্ট করিয়া মানবজাতিকে কখনও দেখান নাই।' সত্যিই তো, ঠাকুরের চেয়ে সহজবোধ্য করে 'জগজ্জননী জগন্মাতা মহামায়ার লীলাপোষ্টাই'কে কেই বা আর আমাদের মতন নিরেট জীবসেবার বদলে জিবসেবারত অর্বাচীনদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন?

Friday, January 13, 2023

দুঃখের অভাবই কি আনন্দ?

প্ল্যেটো বলছেন যে দুঃখের অভাবকেই আমরা সুখ বা আনন্দ বলে মনে করি। আসলে সুখ এবং দুঃখ থেকে সমদূরত্বের যে বিন্দু, যাকে neutral point বলা যেতে পারে, ভেবে দেখলে সেটা আসলে দুঃখ থেকে দুঃখাভাব পেরিয়ে এসে যে মানসিক অবস্থা - সেটা। আসল সুখ বা আনন্দ পেতে গেলে সেই জায়গা থেকে এগিয়ে যেতে হবে অনেকটাই, যা আমাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয়তো সারা জীবনে অনুভব করা সম্ভবই হয়ে ওঠে না। তাজা উদাহরণ আছে। আমাদের বড় ছেলে অনেক দূরে থাকে, তাকে ইচ্ছে করলেই আমরা দেখতে পাইনা, তাই সবসময় একটা ক্ষিণ না পাওয়ার বেদনা কাজ করে মনের ভেতর। গত পরশু সে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসেছে - কি আনন্দ! আসলে ঘটনাটা কি ঘটলো? দূরে ছিল - দুঃখ ছিল, কাছে এলো - সেই দুঃখবোধ চলে গেল, এরপর বেশিদিন কাছে থাকলে আবার সব ব্যাপারে সর্দারি ফলাতে শুরু করবে, তখন সহ্য করা কঠিন আর তখন মনে হবে অনেকদিন তো হলো, কবে যাবে রে বাবা - এই তো। তাহলে সত্যিকারের সুখ হলো কই? 

এবার প্রশ্ন উঠবে, সুখ তাহলে কি? তৈত্তিরীয় উপনিষদে আমরা পাই যে আমাদের উৎপত্তি আনন্দ থেকে, যাপন আনন্দে এবং নিষ্পত্তিও আনন্দেই। 
আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি, ভূতানি, জায়ন্তে,
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি,
আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। (তৈঃ উঃ ৩/৬/১)
'সেই সর্বব্যাপী আনন্দ হইতেই এই সমস্ত প্রাণী জন্মিতেছে, সেই সর্বব্যাপী আনন্দের দ্বারাই এই সমস্ত প্রাণী জীবিত আছে, সেই সর্বব্যাপী আনন্দের মধ্যেই ইহারা গমন করে, প্রবেশ করে।' তা, এত আনন্দসাগরের মধ্যে থেকেও আমরা তাকে ছুঁতে পারিনা কেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ধর্মের সরল আদর্শ' প্রবন্ধে বিষয়টি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছেন। 

'যাহা ধারণা করিতে পারি, তাহাতে আমাদের তৃপ্তির অবসান হইয়া যায়, যাহা ধারণা করি, তাহাতে প্রতিক্ষণে বিকার ঘটিতে থাকে। সুখের আশাতেই আমরা সমস্তকিছু ধারণা করিতে যাই, কিন্তু যাহা ধারণা করি, তাহাতে আমাদের সুখের অবসান হয়। এইজন্য উপনিষদে আছে—
যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নাল্পে সুখমস্তি।
যাহা ভূমা তাহাই সুখ, যাহা অল্প তাহাতে সুখ নাই।
সেই ভূমাকে যদি আমরা ধারণাযোগ্য করিবার জন্য অল্প করিয়া লই, তবে তাহা দুঃখসৃষ্টি করিবে,—দুঃখ হইতে রক্ষা করিবে কী করিয়া? অতএব সংসারে থাকিয়া ভূমাকে উপলব্ধি করিতে হইবে, কিন্তু সংসারের দ্বারা সেই ভূমাকে খণ্ডিত-জড়িত করিলে চলিবে না।

'একটি উদাহরণ দিই। গৃহ আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয়, তাহা আমাদের বাসযোগ্য। মুক্ত আকাশ আমাদের পক্ষে সেরূপ বাসযোগ্য নহে, কিন্তু এই মুক্ত আকাশকে মুক্ত রাখাই আমাদের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। মুক্ত আকাশের সহিত আমাদের গৃহস্থিত আকাশের অবাধ যোগ রাখিলেই তবেই আমাদের গৃহ আমাদের পক্ষে কারাগার, আমাদের পক্ষে কবরস্বরূপ হয় না। কিন্তু যদি বলি, আকাশকে গৃহেরই মতো আমার আপনার করিয়া লইব—যদি আকাশের মধ্যে কেবলই প্রাচীর তুলিতে থাকি, তবে তাহাতে আমাদের গৃহেরই বিস্তার ঘটিতে থাকে, মুক্ত আকাশ দূর হইতে সুদূরে চলিয়া যায়। আমরা যদি বৃহৎ ছাদ পত্তন করিয়া সমস্ত আকাশকে আমার আপনার করিয়া লইলাম বলিয়া কল্পনা করি, তবে আলোকের জন্মভূমি, ভূর্ভুবঃস্বর্লোকের অনন্ত ক্রীড়াক্ষেত্র আকাশ হইতে নিজেকে বঞ্চিত করি। 

'যাহা নিতান্ত সহজেই পাওয়া যায়, সহজে ব্যতীত আর-কোনো উপায়ে যাহা পাওয়া যায় না, নিজের প্রভূত চেষ্টার দ্বারাতেই তাহাকে একেবারে দুর্লভ করিয়া তোলা হয়। বেষ্টন করিয়া লইয়া সংসারের আর-সমস্ত পাওয়াকে আমরা পাইতে পারি,—কেবল ধর্মকে, ধর্মের অধীশ্বরকে বেষ্টন ভাঙিয়া দিয়া আমরা পাই। সংসারের লাভের পদ্ধতিদ্বারা সংসারের অতীতকে পাওয়া যায় না। বস্তুত যেখানে আমরা না পাইবার আনন্দের অধিকারী, সেখানে পাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া আমরা হারাই মাত্র। সেইজন্য ঋষি বলিয়াছেন—
যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন॥
মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া নিবৃত্ত হয়, সেই ব্রহ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় পান না।'

Note: ভূমা মানে পূর্ণ; ওই যে 'পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।' - সেই পূর্ণ, পরব্রহ্ম। 

Monday, January 9, 2023

নির্বাসনা

দিনকয়েক আগে একজনের বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য গুগুলে একজোড়া smart watch খুঁজেছিলাম, AI সেটা ধরে নিয়ে এখন আমায় রোজই নানারকমের option পাঠিয়ে যাচ্ছে। গতকাল তো আমি প্রায় প্রলভিত হয়েই পড়েছিলাম, পরে সম্বিৎ ফিরতে মনে হলো এত যে গুচ্ছের ঘড়ি পরে আছে, যার অধিকাংশই অব্যাবহারের ফলে ব্যাটারি ফুরিয়ে মৃত, তার ওপর আবার আরো একটা ঘড়ির প্রয়োজনটা কোথায়? মিনিটে মিনিটে পাল্স বিপি ইত্যাদি না দেখেও তো জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে, সেধে চিন্তা বাড়ানো কেন রে বাবা? সত্যি, বাসনা যেন আর কিছুতেই যেতে চায় না, ফাঁক পেলেই টুপ করে মাথাটা তুলে ধরে।  

আমি সার সত্য এই বুঝেছি যে ঈশ্বরের কাছে যদি কিছু চাইতেই হয়, সেটি হলো নির্বাসনা। বিবেক, বৈরাগ্য, ভক্তি ইত্যাদি সব খুব কঠিন কঠিন ব্যাপার, ও সবের মানে বুঝতে বুঝতেই জীবন কেটে যাবে। তবে যেটা বুঝতে কোনো কষ্ট নেই, যা আমাদের দৈনন্দিন অনুভূতি, তা হলো বাসনা বা desire। আমি কোনো কিছু চাইছি কিন্তু পাচ্ছি না - তার থেকে বিরক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, যাদের আছে তাদের সম্পর্কে ঈর্ষা উৎপন্ন হচ্ছে, নিজের ওপর রাগ হচ্ছে আর সেই বেদনা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য না পাওয়ার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে এর-ওর কাছে তাদের নিন্দা করে বেড়াচ্ছি, সবসময় tension, stress, অন্তর্বেদনা, অশান্তি - এগুলো আমাদের প্রাত্যহিক অনুভব।

তাহলে root cause of অশান্তি কি - না বাসনা। বাসনা না থাকলেই নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি - না রাহেগী বাঁশ না বাজেগি বাঁশুরি। তাই ঈশ্বরের কাছে কোনো meaningful বাসনাপূর্তির আবেদন যদি জানাতেই হয়, সেটা কেবলমাত্র নির্বাসনার - desirelessness। উল্টোটাও করা যায় - যা যা কিছু এখানেই রেখে দিয়ে হুশ করে একদিন কেটে পড়তে হবে, খুব করে প্রার্থনা করে সে সবও চাওয়া যায়। ওটা অনেকটা ঘুষখোরের বৌয়ের ঢাঁই পরিমান জামা কাপড় কেনার শখের মতন - আলমারি উপচে পড়ছে, রাখার জায়গা নেই, অতগুলো পরার মতন occassion-ও নেই, তবু সমানে কিনে যাচ্ছে - কি, না অভ্যেস। শেষে থেকে থেকে পোকায় কাটবে অথবা পি‌ঁজে যাবে, নিজেরও কোনো কাজে কোনোদিন লাগবে না। 

একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে যে আসলে দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য আমাদের প্রয়োজন অত্যন্ত অল্প। এই কোভিডের সময় আমরা সকলেই কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইনি? যেটুকু দরকার, শরণাগত হলে সেটুকু মা ঠিকই জুটিয়ে দেবেন, ওটাই প্রকৃতির নিয়ম। এত যে কোটি কোটি কীট পতঙ্গ পশু পাখি, ওদের কি আর আমরা খাওয়াই না ওদের বাসস্থান আমরা বানিয়ে দিই - ওরা কি সব না খেয়ে মরে? অভাব আর অভাববোধ এক জিনিস নয়। আমাদের সত্যিকারের কোনো অভাব নেই, অভাববোধ আছে, যা পশুপাখিদের নেই। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেতে চাই, স্বাভাবিকভাবে না পেলে ছিনিয়ে নিতে চাই, তাও না পারলে লজ্জায় ঘেন্নায় ঈর্ষায় stress এ জ্বলেপুড়ে মরি - কেন রে বাবা? একজায়গায় আমি নিজের চোখে দেখেছি ভিখারিরা territory ভাগাভাগি নিয়ে ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল আর ট্যাম খাওয়া ঘটিবাটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে - ভিক্ষা করবে, সেখানেও অধিকারবোধ!

শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে বইটিতে মায়ের সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা বর্ণিত আছে, যা এখানে উধৃত করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 'একজন বাছাই করা দুটি সেরা আম নিয়ে এসেছেন। মা চাইছিলেন আমি (ভগিনী দেবমাতা) ঐ আম দুটি নিয়ে যাই। কিন্তু আমি রাজি হলাম না, কারণ জানতাম, সেগুলি শেষ মরশুমের আম, আর মা আম খুব ভালবাসেন। বললাল, “আম দুটি আপনি নিজে রাখলে আমার বেশী আনন্দ হবে।” মা চকিতে বললেন, “আমি রাখলে তােমার আনন্দ, আর তুমি নিলে আমার আনন্দ, কার আনন্দ বেশী হবে তুমি মনে কর?” আমার মুখে তখনই কথা জুগিয়ে গেল, “মা, আপনার আনন্দই বেশী হবে, কারণ আপনার অনেক বড় মন।” জবাব শুনে মা খুশি হলেন।' অধিকারবোধ যদি থাকতেই হয়, তাহলে তা কেমন হবে সেটি মায়ের গোটা জীবন ধরে এরকমের নানান ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সহজে শেখা যায়।

আমার পরম পূজনীয় গুরুদেব শ্রীশ্রীমায়ের সন্তান ছিলেন, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। দিব্যজীবনের অধিকারী এক মাতৃভক্ত রামকৃষ্ণময় সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, কোনো পাপের সাধ্য নেই তাঁকে স্পর্শ করে, অথচ শেষ বয়সে তাঁকে দেখেছিলাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীন এক শারীরিক অবস্থায়, যা কর্মফল অনুযায়ী মোটেও তাঁর প্রাপ্য নয়। তাহলে তিনি এত ভুগলেন কেন? কারণ সদগুরু জেনেশুনে শিষ্যের negative কর্মফল শুষে নেন আর তার effect তাঁদের দিব্যশরীরের ওপর দিয়েই বয়ে যায়। গুরু এই অযাচিত কৃপা এই কারণে করেন যাতে শিষ্য নিশ্চিন্তে তার ভাগের সাধনভজনটুকু করতে পারে, তাকে জাগতিক বিষয়ে আর বেশি গেঁথে না থাকতে হয়। প্রয়োজনের ভার তো মা নিয়েই আছেন, গুরু যাপনটুকুও কত সহজ করে দেন, তবু আমরা আমাদের ভাগের কাজটুকু আর করি কৈ? ওই এক বাসনা অসুর, ওটাকে যে কিছুতেই control করতে পারিনা, ফলে গুরু ইষ্ট মিলে পথ এত সহজ করে দেওয়া স্বত্তেও আমরা আসল ফেলে নকলের পেছনে দৌড়ে মরি। মা তাঁর এক অল্পবয়স্ক বিধবা শিষ্যাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, "মা, আমার নাম ডােবাসনি। শিষ্যের পাপ গুরুতে লাগে। খুব সাবধানে থাকবি।" এই বিপথ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র রাস্তা নির্বাসনা, পেলেই কেল্লা ফতে।

তবে মানুষের মন তো, দুর্বলতা আসবেই, একেবারে বাসনাহীন হওয়া কি আর যায়? শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে বইটি থেকে আর একদিনের কথোপকথন follow করলে কিভাবে এই রাস্তায় হাঁটতে হবে, তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। 'একদিন উদ্বোধনে চন্দন ঘষছি, মা উত্তরদিকের দরজার ধারে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে মুখ করে মালা জপ করতে বসেছেন। কেউ নেই দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়ে পড়ে কেন?” তিনি শুনেই মালা রেখে বললেন, “ওদিকে নজর দিও না, কার মনে দুর্বলতা না আসে এক ঠাকুর ছাড়া? আজ পর্যন্ত এমন কোনও মহাপুরুষ জন্মেছেন কি, যার মনে কখনাে কোনও দুর্বলতা ওঠে নি? যদি শুধরােবার চেষ্টা থাকে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, আমার মনে দুর্বলতা উঠেছে—তাহলে ঐ জিনিষটাই একটা মস্ত শিক্ষা, মহামায়া খুশি হয়ে তখন তাকে পথ ছেড়ে দেন। মানুষ কিছুদিন ভাল থাকলেই মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, আরও উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিবেকীর মনেও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দিয়েই ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখনাে সাধনা শেষ হয়নি, ভূত-প্রেত সব ওত পেতে চারপাশে বসে আছে, সুবিধে পেলেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এতে হয়কি, অহঙ্কার নষ্ট হয়। যতদিন বাঁচবে সাবধানে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে থাকবে, অহঙ্কার হলেই ঐ সব হিজিবিজি মনে উপস্থিত হবে। শেষ পর্যন্ত শরণাগতির ভাব নিয়ে থাকতে হয়। ঠাকুর একবার নিজের শরীরে কামের বেগ ধারণ করে দেখালেন, জীবের অহঙ্কার করবার কিছুই নেই।”

Wednesday, January 4, 2023

মা-টি



মাটির পরে জন্ম আমার মাটির গুণে চাষ
মাটির বাড়ি মাটির হাঁড়ি মাটির ওপর বাস ।
মাটির সূত্রে বেদ বেদান্ত মাটির কৃপায় শ্বাস
মাটির প্রাণে মায়ের দরদ মাটির ঘ্রাণে আশ ।।
মাটির শ্যামলবরণ রূপে মাটির জলোচ্ছ্বাস
মাটির ঢ্যালা শ্যামার খেলা মাটিই চিদাকাশ ।
মাটির সাথে সহজ যাপন মাটির সাথে পাশ 
মাটির তরেই আনাগোনা মাটির নিচে খাস ।।

মাটির সাথে আড়ি আমার বুকের বোঝা ভারি ।
মাটির পরশ এড়িয়ে যেন নিজের কাছেই হারি ।।

(আজ শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী তুরীয়ানন্দজীর আবির্ভাব তিথিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বোরো ধান চাষের শুভারম্ভ উপলক্ষে লেখা)

Monday, January 2, 2023

বন্দে ভারত

ইঁট কাঠ পাথর কংক্রিট মিশিয়ে একটা বাড়ি তৈরি হতে পারে কিন্তু সুখী গৃহকোন বা ঘরকন্না তৈরি হয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য, মায়ের স্নেহ ভালোবাসা আর অপরিসীম ত্যাগ, বাপের কর্তব্যবোধ আর ছেলেমেয়েদের নির্ভরশীলতা ও ভক্তি শ্রদ্ধা মিশিয়ে। প্রত্যেক বাড়িরই একটা নিজস্ব পারিবারিক ধারা, একটা বিশিষ্ট সংস্কৃতি আছে, যা পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে জীবনে চলার পথে সদর্থক দৃষ্টিকোণ জোগায় আর একে অপরের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গোটা পরিবার একটা complete composite unit হিসেবে যাতে অনায়াসে function করতে পারে, তার foundation গড়ে দেয়। এই যে sense of belonging, এই যে নিজেদের পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা, এই যে একটাই unit হিসেবে নিজেদের ভাবা, এসব ছাড়া-ছাড়া ভাব থাকলে আসে না, আসতে পারেনা - যে কোনো broken familyর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।

ঠিক সেইরকমই আমাদের দেশ। যেদিন পরিবারের একটা অংশ নিজেদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চায়, সেইদিনই তাদের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব দেখা দিতে শুরু করে, তারা পরিবারের ভালোর মধ্যে আর নিজেদের ভালো দেখতে পায়না। 'পরিবার' শব্দটির বদলে 'দেশ' শব্দটি ব্যবহার করলেও ঠিক এই একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যাবে - দেশীয় মূল্যবোধহীন কিছু লোক একটা অদ্ভুত negative দেশবিরোধী ক্ষতিকারক মানসিক অবস্থানের কারণে নতুন বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গায়ে পাথর ছুঁড়ে ক্ষতি করে অল্হাদিত হয়, যেমন পাগলের গো-বধে আনন্দ। এই একই মানসিকতা আমরা দেখেছিলাম সিএএ নিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ওপর অকারণ বিধ্বংসী রোষবর্ষণের সময়ও। সে সময় না হয় ইচ্ছাকৃতভাবে অশিক্ষিতদের ভুল বুঝিয়ে তাতানো হয়েছিল, তাও যাহোক একটা justification পাওয়া যায়, কিন্তু এবারে?

আমাদের দেশটি কেবলমাত্র একটি বাসভূমি নয়, ইনি আমাদের মা। ঠিক যেমন একটা বাড়ি কেবল বাড়ি নয়, সেটি একটি শান্তিপূর্ণ আশ্রয়স্থল। মা যেমন আমাদের প্রতিপালন করেন, আমাদের দেশ মাতৃকাও ঠিক সেভাবেই আমাদের খাওয়ান, পরান, দুহাত দিয়ে আগলে রাখেন। ভারতবর্ষ কোনো inanimate object নয়। ভারত হলো আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রাণশক্তির ধারকক্ষেত্র, আমাদের জন্মভূমি, আমাদের ধাত্রীভূমি, আমাদের কর্মভূমি, পুণ্যভূমি। আর সেজন্যই সনাতন পরম্পরায় তিনি জীবন্ত, মহাশক্তির অংশ, সাক্ষাৎ জননী। এই যে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার ভারতীয় পরম্পরা, এটা সনাতন পারিবারিক সংস্কৃতি এবং ধর্মবোধ থেকেই তৈরি হয়েছে এবং সেই চিরন্তন মাতৃরূপ আমরা দেশমাতৃকার মধ্যেও দেখি।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রের সামাজিক পরিচয় কি? না কৌশল্যানন্দন আর জানকীবল্লভ। লক্ষণের কি? সুমিত্রানন্দন। শ্রীকৃষ্ণের কি? দেবকিনন্দন ও যশোদানন্দন। কর্ণের কি? রাধাসুত। পাণ্ডব কারা? কুন্তিপুত্র। এটাই শাশ্বত ভারতবর্ষ, যেখানে নারীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়া এককালে পুরুষের সৌভাগ্য বলে গণ্য করা হতো। তাই বিরজা হোম করে সংসার ত্যাগ করার পরেও সন্ন্যাসী নিজের ইষ্ট, গুরু আর অন্যান্য সন্ন্যাসী ছাড়া পূর্বাশ্রমের মধ্যে একমাত্র জন্মদাত্রী মাজননীকেই প্রণাম করতে পারেন। চতুর্দিকে কেবল শক্তির প্রকাশ - শক্তি ছাড়া আর কোথাও কিছুই নেই। পঞ্চকোষেও সেই শক্তির প্রকাশ, আবার আমার দেশমাতৃকাও সেই শক্তিরই রূপ, তাই এক অবিচ্ছেদ্য অনন্ত শক্তির manifestation হিসেবে আমি আর আমার জন্মভূমি এক এবং অবিচ্ছেদ্য, ঠিক যেমন সারা বিশ্ব আমার কুটুম্ব। এই identity relationship construct একমাত্র সনাতন সংস্কৃতিরই অংশ, যা আর কারো মধ্যে নেই। যাদের ধর্মবোধ নেই তাদের মাতৃবোধও নেই, তাই মায়ের জাতের ওপর অত্যাচার করতে তাদের বুক কাঁপে না। ফলে মায়ের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে বেচে দিতেও তাদের দ্বিধা হয় না, যেমন বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গায়ে ঢিল ছুঁড়ে তার ক্ষতি করতে তাদের মনে একটুও বাঁধে না, বরং পৈশাচিক উল্লাস হয়।

প্রশাসন কি ব্যবস্থা নেবেন আমি জানি না, হয়তো নেবেন, হয়তো নেবেন না। তবে মালদার কুমারগঞ্জ থেকে গোটাকতক দুষ্কৃতিকে ধরে জেলে পুড়ে বা তাদের সম্পত্তি ক্রোক করে বা বুলডোজার চালিয়ে হয়তো সাময়িকভাবে ভয় দেখানো যেতে পারে, তাদের মনে প্রাণে 'বন্দে মাতরম' মন্ত্র প্রোথিত হবে না। ওটাই কিন্তু একমাত্র permanent solution - অসীম বলশালিনী মাতৃশক্তিকে পুরুষের চেয়ে হীনমন্য, subservient, dependent, obedient প্রাণী হিসেবে নয়, মা হিসেবে ভাবতে শেখানো আর মা হিসেবে বিনত অবনত অনুগত হয়ে শ্রদ্ধা করতে শেখানো। বাধ্য যদি করতেই হয়, এইখানটায় করতে হবে, আর না বদলাতে চাইলে এমন exemplary punishment দিতে হবে যাতে আচ্ছা-সে-আচ্ছা ক্রিমিনালেরও প্রাণ কেঁপে উঠে। নতুন যে ভারতবর্ষ জেগে উঠছে তার একটাই মহামন্ত্র - 'বন্দে মাতরম'। বন্দে ভারত, বন্দে মাতরম।