Monday, March 28, 2022

বিশ্বাস বনাম বিচার

 মোটামুটি সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিটি প্রশ্নবিমুখ বিশ্বাসভিত্তিক গোঁড়া পন্থই এই তিনটি place, time, separation and causetion-এর কথা বলে:

১. ঈশ্বর স্বর্গে থাকেন;

২. ঈশ্বর আর জীব আলাদা;

৩. ঈশ্বরের কথামতো কাজ করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হয়।

এই ধারণা শুধুমাত্র বিদেশি আব্রাহাম-সম্বন্ধীয় পন্থ বা মতবাদ সমূহে সীমিত নয়, আমাদের দেশেও এমন বিশ্বাসভিত্তিক বহু পন্থ এবং পন্থীয় সংগঠন আছে। এখানে মূল বিষয় হলো বিশ্বাস। কেউ একজন বলে দিয়েছেন যে ঈশ্বর আছেন, এই তাঁর নাম, তিনি ওমুক জায়গায় থাকেন, ওমুক তাঁর বার্তাবাহক, তিনি এই এইসব অবশ্যকর্তব্য ধার্য করে দিয়েছেন আর সেইমতো চললে মৃত্যুর পর তাঁর সাথে দেখা হবে - এই সমস্তটা চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিয়ে সেটিকে কেন্দ্র করেই সারা জীবনটা কাটাতে হবে। কেউ কেউ তো আবার বিশ্বাসে এতটাই অন্ধ হন যে অন্য কেউ যদি সেই মতে বিশ্বাসী না হন, তাঁকে বাধ্য করতেও পিছপা হন না কারণ সেটাও তিনি তাঁর ঈশ্বর নির্দিষ্ট কর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন। পাশ্চাত্যে তাই পন্থকে religion ছাড়াও faith বলে - faith মানে বিশ্বাস। 


বিশ্বাসের একটা মজা হলো, এতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজন নেই, বস্তুতঃ স্থানও নেই। যেহেতু ঈশ্বর আর আমি আলাদা আর যেহেতু যা কিছু ঈশ্বরীয় অভিজ্ঞতা হবে সব মৃত্যুর পর, ফলে এই জীবনে কেবলমাত্র পূর্বনির্দিষ্ট কিছু routine বা code মেনে চলতে পারলেই নিজেকে যথেষ্ট religious বলে মনে করা যায়। পুরো বিষয়টাই যেহেতু কারো না কারো কল্পনাপ্রসূত (কারণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকলে তো আর যুক্তিহীন বিশ্বাসকে establish করার প্রয়োজন হতো না), ফলে জাগতিক যা কিছু সুখদায়ী, যা কিছু লোভনীয়, সবকিছু স্বর্গে সহজলভ্য বলে বর্ণিত। এককথায় বলতে গেলে, মানুষকে প্রলুব্ধ করে তাকে একটি অলীক কল্পনায় বিশ্বাস করানোই হলো faith বা organised religion-এর প্রভাববিস্তারের ভিত্তি।


বিশ্বাস আর ভক্তি কিন্তু এক জিনিস নয়। আমার বাবা-মাকে আমি ভক্তি করি কারণ তাঁদের অপত্যস্নেহ এবং আমার খুশির জন্য তাঁদের sacrifice আমি প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি যে। ধরে নেওয়া যাক তাঁরা আমার জৈবিক বাবা-মা নন, তাতেও তাঁদের প্রতি আমার feelings একটুও কমবে না। এটা ভক্তি। আবার ধরে নেওয়া যাক আমার যাঁরা জৈবিক বাবা-মা, তাঁরা জন্মের পরেই আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, বহুদিন পর হটাৎ পরিচয় হলো। কেবল বিশ্বাস নয়, DNA পরীক্ষা করে একেবারে নিশ্চিতও নাহয় হওয়া গেল। কেবলমাত্র বাবা-মা, এই পরিচয়ের জন্যই কি তাঁদের প্রতি আমার ভক্তি একেবারে উথলে উঠবে? সম্ভবত না। বিশ্বাস irrational হতে পারে, ভক্তি কিন্তু অনুভূতিভিত্তিক, ফলে rational - অপাত্রে হতে পারে, কিন্তু অমূলক কখনো নয়।


ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য:

১. যাঁকে ভক্তি করবো তাঁর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক থাকা চাই অর্থাৎ ভক্তি সম্পূর্ণরূপে অনুরাগভিত্তিক;

২. ভক্তির মূলে হচ্ছে প্রেম - এক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম;

৩. জাগতিক বস্তুর প্রতি বৈরাগ্য বা নির্লিপ্ততা ভক্তির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।

লক্ষ্যনীয় যে ভক্তির এই পুরো ধারণাটা কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের চেয়ে একদমই আলাদা। এর শুরুও আলাদা, শেষটাও আলাদা। মীরাবাই যখন শ্রীকৃষ্ণকে স্বামীরূপে বরণ করে নিচ্ছেন, তখন তিনি তাঁর একান্ত অনুরাগিনী পরম নিবেদিতপ্রাণা প্রেমিকা হিসেবে নিজেকে দেখছেন, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম। তাঁর থেকে তাঁর ঈশ্বর আলাদা নন, দৈনন্দিন যাপনে সম্পৃক্ত। তাঁর প্রেমিকরূপী ঈশ্বর কোনো কল্পিত স্বর্গে থাকেন না, সূক্ষ্মরূপে থাকেন মীরাবাইয়ের অন্তরে আর বাহ্যিক মূর্তরূপে তাঁর ঘরের ভেতর, পূজাবেদীতে। এখানে ভক্ত ও ভগবানের মিলন এই জীবদ্দশাতেই, কোনো মরণের পারে নয়। শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রেও এটাই দেখা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তাইই, যদিও প্রেমের সম্পর্কগুলো হয়তো আলাদা। শ্রীরামকৃষ্ণ যে মাতৃরূপা মহাশক্তিকে দিনরাত প্রত্যক্ষরূপে দেখছেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন, খাওয়াচ্ছেন, সাজাচ্ছেন, তিনি জীবন্ত, চিন্ময়ী, সাক্ষাৎ বিদ্যমানা।


এখন প্রশ্ন হলো, ভক্তির উৎস যদি কোনো preconceived codified blind faith না হয়, তাহলে ঈশ্বর যে আছেন এবং তাঁকে এই জীবনে, এই সময়েই প্রত্যক্ষরূপে অনুভব করা যায় - এই realisation আসবে কোত্থেকে? বিচার থেকে। গোটা বিশ্বে সেই বিচারের উৎস মূলতঃ বেদ আর মূল বিচার্য বিষয় হলো 'আমি কে?'। এই যে আমি হাঁটছি, চলছি, ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, রেগে যাচ্ছি, দুঃখ পাচ্ছি, হাসছি, আনন্দ পাচ্ছি - এটাই কি আসল আমি? তাহলে স্বপ্নে যে false 'আমি'কে দেখা যায়, তাকে কোন 'আমি' দেখে? আর গভীর সুষুপ্তিতে যখন এই বাহ্যিক দৈহিক বা false আমিবোধ কোনোটাই থাকে না, তখনও যে 'আমি' জেগে থেকে সুষুপ্তির তৃপ্তিবোধ অনুধাবন করে - সেই বা কে? এটা একটা দিক। আর অন্যদিক হলো, যে যেমন কাজ করে তার তো তেমন ফল পাওয়া উচিত। যে ছাত্র খুব মন দিয়ে sincerely পড়াশুনা করে, তার ভালো নম্বরই পাওয়া উচিৎ। কিন্তু আমরা কি দেখি? একজন সৎ সংবেদনশীল ব্যক্তি, জ্ঞানত কোনো পাপকর্ম করেননি, অথচ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অশেষ জাগতিক দুর্গতি ভোগ করছেন - কেন এমন হবে? হিসেব তো মিলছে না। তাহলে কি জীবনের কোনো অবিচ্ছিন্নতা আছে - এক জন্মের কুকর্মফল অন্যজন্মে ভোগ করতে হচ্ছে? 


তাহলে নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এটা যখন বোঝা যায় যে এই রক্ত মাংসের শরীর-মনটা সত্যিকারের আমি নই এবং আমাকে বারেবারে জন্মাতে আর মরতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্ৰশ্ন ওঠে - কেন? এই যে এতসব সম্পর্ক, কেউ পরিবার, কেউ আত্মীয়, কেউ বন্ধু ইত্যাদি, এসব তো আগের জন্মেও ছিল, সব গেল কোথায়? তাহলে কি অস্থায়ী জাগতিক সম্পর্কগুলোর চেয়েও কোনো meaningful স্থায়ী সম্পর্ক আছে? আর প্রশ্ন ওঠে এই দুঃখকষ্টের জীবন থেকে চিরকালের মতন মুক্তি পাওয়ার উপায় কি? যেই মন স্থায়িত্বের দিকে মোড় নেয়, অমনি অস্থায়ী সমস্তকিছুর চাহিদা কমতে শুরু করে আর যেহেতু বাইরের জগৎটা distracting, মন অন্তর্মুখী হয়। সে তার permanent স্বত্তাকে খুঁজতে থাকে। সবাই খোঁজেন না অবশ্য - যাঁর মনে বিচার উদয় হয়, তিনি খোঁজেন। 


শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "মানুষ দুরকম - মানুষ ও মানহুঁশ। যাঁরা ভগবানের জন্য ব্যাকুল তাঁদের মানহুঁশ বলে; আর যারা কামিনী-কাঞ্চনরূপ বিষয় নিয়ে মত্ত, তারা সব সাধারণ মানুষ।" বলছেন, "ভগবান সকলকার ভেতর কিরূপে বিরাজ করেন জান? যেমন চিকের ভেতর বড়লোকের মেয়েরা থাকে। তারা সকলকে দেখতে পায়, কিন্তু তাদের কেউ দেখতে পায় না; ভগবান ঠিক সেইরূপে বিরাজ করছেন।" আর বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান দেখা দেন।" মায়া সরে গেল, আসল আমির সাথে যোগাযোগ হলো - এই হলো আসল জ্ঞানপ্রাপ্তি।


এই উপলব্ধির পথে তাহলে ভক্তির ভূমিকাটি কি? শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, "পানাপুকুরে নেবে যদি পানাকে সরিয়ে দাও আবার তখন এসে জোটে; সেই রকম মায়াকে ঠেলে দিলেও আবার মায়া এসে জোটে। তবে যদি পানাকে সরিয়ে বাঁশ বেঁধে দেওয়া যায়, তা হলে আর বাঁশ ঠেলে আসতে পারে না। সেই রকম মায়াকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞান ভক্তির বেড়া দিতে পারলে আর মায়া তার ভেতর আসতে পারে না। সচ্চিদানন্দই কেবলমাত্র প্রকাশ থাকেন।" ভক্তির আধার হলো প্রেম, ভালোবাসা। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয় — তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, — সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়। 

"এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়। 

"ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিক ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়।

"তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, ‘আমিই কালী’।

"গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ।’

"তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন — প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক, তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।"

চারটি বিবেচ্য বিষয়

এক হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি কাটিয়ে উঠে শেষ দখলদারদের দেশ থেকে তাড়ানোর পরেও কিন্তু পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল, অথচ এতদিনের স্বশাসনেও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে আমরা বিশেষ উন্নতি করতে পারিনি, তার জন্য সরকার অবশ্যই দায়ী, আমরাও কিছু কম দায়ী নই। আজ এর মধ্যে চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।  


প্রথম সমস্যাটি হোল আমাদের অন্নদাতাদের আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখে দিয়েছি, ওঁদের দৈন্যদশা থেকে উত্তরনের কোন সার্বিক ব্যাবস্থা হয় আমরা করতে চাইনি অথবা পারিনি। ১৯৬১ সাল থেকে  দেশে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের নামে জমিতে বিষ মেশাতে মেশাতে ধীরে ধীরে আমরা তাকে নিষ্ফলা এবং বন্ধ্যা করে তুলেছি। একজোড়া বলদের জায়গা নিয়েছে কেঁচোর বসবাস ধ্বংসকারী বড় দাঁতওলা ট্র্যাক্টর আর সুপরিকল্পিতভাবে যে গোবর আর গোমূত্র বিনাপয়শায় জমির উর্বরতার কারিগর কেঁচোর খাদ্য যোগাতো, আমরা তার যোগান বন্ধ করিয়ে দিয়েছি। কেঁচো নেই, তাই ক্ষেতে পাখি নেই, রেনুর হাওয়াই সফর বাতিল। বাড়ির নিমপাতার তেল, গোমূত্র আর বেসনের ঘোল বানিয়ে খুব কম পয়সার যে জৈবিক কীটনাশক কৃষক ব্যবহার করতেন, তার জায়গায় তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি বিশুদ্ধ বিষ, যার ফলে আর মৌমাছি এবং বন্ধু কীটপতঙ্গ আসে না, পরাগ বিতরণ বন্ধ, কৃষক হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাহলে গত একাত্তর বছরে আমরা ফলন বাড়ানোর নামে কি করলাম? ১। কৃষিকে মুনাফাখোর শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিলাম, ২। কৃষককে ভর্তুকির প্রলোভন দেখিয়ে সরকার নির্ভর করে দিলাম, ৩। কৃষকের গোসম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে যন্ত্র নির্ভর করে দিলাম, ৪। জমিকে বন্ধ্যা করে দিলাম, ৫। কৃষকের স্বনির্ভরতাকে শেষ করে দিয়ে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাঁর জীবনকে জুড়ে দিলাম আর ৫। অন্নদাতাকে বিষ ফলাতে আর বিষ খেতে বাধ্য করলাম। এর নিট ফল হচ্ছে কৃষি আজ আর যথেষ্ট অর্থকরী বৃত্তি নয়। একটা পরিসংখ্যান হয়তো বিষয়টিকে আরও প্রাঞ্জল করবে। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ৩৪০ কেজি চাল হত, এখন পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ মিলিয়ে হয় হেক্টরপ্রতি ৩১৮ কেজি, এত কাণ্ড করার পরেও আখেরে কম।  ভুলে যাবেন না ভারতের ৪২৩ মিলিয়ন হেক্টার জমির মধ্যে ১৯০ মিলিয়ন হেক্টার জমি এখনও কৃষিযোগ্য, রাশিয়ার ক্ষেত্রে যেটি ১৭০৮ এর মধ্যে মাত্র ১২৬, আমেরিকার ক্ষেত্রে ৯৩৬ এর মধ্যে ১৭৭ আর চিনের ক্ষেত্রে ৯৬০ এর মধ্যে ১২৪, অর্থাৎ ৮০ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে আমরা এতদিন ছিনিমিনি খেলেছি, এখনো খেলছি। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পরিশুদ্ধ জলের রিসার্ভ ভারতে, রাসায়নিক ও শিল্পবর্জ্যের কল্যানে সেই জলকেও আমরা তিলে তিলে বিষাক্ত করে তুলেছি। প্রকৃতিকে নিয়ে অনেক তো হল পরিক্ষা-নিরিক্ষা, এবার জল, জমি আর জঙ্গলকে আসল মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে পাপমুক্ত ও বিষমুক্ত হলে ক্ষতি কি?


দ্বিতীয় বিষয়টি হোল কাশ্মীর। সরকারের পর সরকার এসেছেন আর গেছেন, কাশ্মীরিদের কাছে ভারত ইন্ডিয়া হয়েই রয়ে গেছে, নিজের দেশ হয়ে উঠতে পারেনি। জওহরলাল নেহরু কি করেছেন, সর্দার প্যাটেলের কি ভুমিকা হতে পারতো, ডঃ শ্যমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বলিদান কেন বিফলে গেল সে সব ঐতিহাসিক তথ্য এবং তর্কের মধ্যে না ঢুকেও, আজকের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে আজ আমরা কাশ্মীরের মানসিকরূপে ভারতভুক্তির জন্য কি করছি, তার উত্তর কি পাবো? কাশ্যপমুনির কথা কি কাশ্মীরের স্কুলে পড়ানো হয়,  কালহানার রাজতরঙ্গিনির কথা কতজন কাশ্মীরি জানেন, কর্ণ রাজপুরম থেকে রাজপুরা হয়ে আজকের রাজৌরি, রাজা জম্বু লোচন, সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক, বৌদ্ধ মনিষী অস্বঘোষ, নাগার্জুন ও বসুমিত্র এবং কাশ্মীরি পণ্ডিত কুমারজিব, যিনি চিনে গিয়ে সেখানকার সম্রাটকে সংস্কৃত গ্রন্থ চিনেভাষায় অনুবাদ করতে অনুপ্রানিত করেন, এই সব পূর্বইতিহাস কি স্থানীয় পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে? একজন কাশ্মীরির মূল পরিচয় যে তিনি ভারতীয়, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির তিনিও সমানভাবে ধারক ও বাহক, এই ঐতিহ্যের শিক্ষা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিতে না লাগে সংবিধান সংশোধন, না লাগে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাহলে আমরা এই সাংস্কৃতিক শোধনটি করলাম না কেন? এখন থেকেও যদি শুরু করা যায়, আগামী পনেরো-বিশ বছরে কাশ্মীরে মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।    


তৃতীয় বিষয়টি হল সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ ও রাষ্ট্রের একিকরণের ক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগে আমাদের সর্বাঙ্গীণ ব্যর্থতা।  আসলে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারনাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন সরকার এবং আমরা নিজেরাও কোথায় যেন আমাদের ভারতীয়ত্বের মূল জায়গাটা খুইয়ে বসেছি। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা কি? সত্যি কি আমরা একটাই ভারত নাকি নানা ভারতের সমষ্টি? একজন কাশ্মীরির সাথে একজন কেরালাবাসীর চেহারা, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, মানসিকতায়, বস্তুত বাহ্যিকরূপে কোনকিছুতেই তো তেমন মিল নেই, ঠিক যেমন একজন মিজোর সাথে একজন গুজরাতির আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর অমিল, তাহলে আমরা এক জাতি হলাম কি করে?  আসলে ভারতীয়ত্ব শুধুমাত্র একটি ভৌগলিক অবস্থানের পরিচায়ক নয়, এটি একটি বৃহত্তর জাতীয় চরিত্রের নির্দেশক। ভারতীয়ত্ব আমাদের গোটা রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষেত্রের চিন্তাধারা এবং কর্ম সমুহের সমষ্টি। ভারত যেকটি সিদ্ধান্তের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলি চিরন্তন, যেমন সহিষ্ণুতা, সম্মান, সমন্বয়, স্বাধিকার এবং সংবাদ। এতে ঈশ্বরহীনতার স্থান আছে বৈকি কিন্তু স্থান নেই ধর্মহীনতার। বহুত্ববাদ আর সংস্কার ভারতের প্রকৃতি। আমরা দেখতে পাই মহাভারতের শান্তিপর্বে জাতির বৈশিষ্ট বোঝাতে গিয়ে ভৃগু ভরদ্বাজকে বলছেন ‘ব্রাহ্মনেরা গৌরবর্ণ, ক্ষত্রিয়রা রক্তবর্ণ, বৈশ্যরা পীতবর্ণ আর শূদ্রেরা কৃষ্ণবর্ণ’। উত্তরে ভরদ্বাজ বলছেন, ‘যদি বিভিন্ন বর্ণ বিভিন্ন জাতি নির্দেশ করে তবে বলতে হয় সব জাতিই মিশ্র জাতি।‘ (১৮৮/৬)। তারপরেই বলছেন, ‘আমরা সকলেই কাম, ক্রোধ, ভয়, দুঃখ, উৎকণ্ঠা, ক্ষুধা আর শ্রম এই সবেই প্রভাবিত হই, তা হলে জাতিতে জাতিতে আমাদের প্রভেদ কোথায় ?’ ভারতের এই সর্বংসহা রূপটির সুরভি বহন করে আনে প্রাচীন ভবিষ্যপুরাণের একটি অসাধারণ শ্লোক, যাতে ঋষি বলছেন, ‘যেহেতু চতুর্বর্ণের সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, তাই তারা এক বর্ণের। সমস্ত মানুষের জনক এক, আর একই জনকের সন্তানদের ভিন্ন জাত হতে পারেনা‘ (ব্রাহ্মপর্ব, ৪১, ৪৫)। আবার অথর্ববেদে বর্ণিত মাতৃভূমির বন্দনায় ঋষি বলছেন,

জনং বিভ্রতি বহুধা বিবাচসম, নানা ধর্মানং পৃথিবী যথৌকসম।

সহস্রধারা দ্রবিনস্য মে দুহাম, ধ্রুবেন ধেনুং রন প্রস্ফুরনস্ত।।

অর্থাৎ, ‘বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং বিভিন্ন গুনসমন্বিত মানুষকে একই পরিবারের মত যিনি ধারণ করছেন, নিজ দুগ্ধধারাকে কোন প্রকার প্রতিহত না করে, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে রাখা গোমাতার ন্যায়, যিনি আমাদের ধন সম্পদের সহস্রধারা প্রদান করে চলেছেন, তিনিই আমাদের মাতৃভূমি, অর্থাৎ ভারতমাতা।‘ যেদিন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকে আমরা একই সাংস্কৃতিক একাত্মতা সুত্রে এবং আত্মিক বন্ধনে বাঁধতে পারবো, সেদিন কারো সাহস হবে না ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ বলার। এই কাজটা না আমাদের সরকার করেছেন, না আমরা করেছি, আজ কিন্তু এ কথা ভাববার বিশেষভাবে সময় এসেছে। এতদিন যে সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের প্রাসঙ্গিকতার চর্চা সমষ্টিগত ছিল তা যেদিন সর্বাঙ্গীণ হবে, সেদিন সত্যিই আমাদের জননী জন্মভুমি স্বর্গাদপি গরীয়সী হবেন।  


এই পর্বে শেষ আলোচ্য বিষয় হল আমাদের দেশে গনতান্ত্রিক মুল্যবোধ সমাজের সমস্ত স্তরে, সমস্ত ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক ভাবে জনমানসে এখনো দৃঢ় না হওয়া।  বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪-২৯৭ সনের মধ্যে নন্দসাম্রাজ্য পতনে চাণক্যের  যে ভূমিকা বর্ণিত রয়েছে, তার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদি রাজনৈতিক সংঘর্ষের কাহিনি। এর আগেও বিচ্ছিন্নভাবে ভারত ভুভাগে জনপদ-বিশেষে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু দেশের বৃহত্তর অংশ জুড়ে গনতান্ত্রিক পরম্পরা স্থাপনের সময়কাল ঐ বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যর দৌলতে। ভারতে গনতান্ত্রিক পরম্পরা সুদৃঢ় ছিল সেই জন্যই  হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ, বিশ্বের এই চার ধর্মের উৎসভূমি ভারত হওয়া স্বত্তেও পরবর্তীকালে খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম (পারসি ধর্ম), ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম এদেশে অবাধে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দেশের এই গনতান্ত্রিক পরিবেশ এক হাজার বছরের দাসত্বের চাপে সুপ্ত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার ফলস্বরূপ সমাজের সর্বস্তরে আবার তার যে সর্বব্যাপী পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল, তা ঘটেনি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য এবং চরম অপারগতা। আমাদের দেশে জাতপাতের রাজনীতি, গরিব-বিত্তবানের রাজনীতি, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর রাজনীতি, উত্তরভারত-দক্ষিনভারতের রাজনীতি, ইত্যাদি নানান রকমের অরাজক ও নক্কারজনক মতবাদ এই কারণে আজও সমাজের ক্ষতি করতে পারছে কারণ স্বাধীনতার পর আমরা আমাদের সুপ্রাচীন বহুত্ববাদী সর্বংসহা গনতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে প্রতিস্থাপিত করতে পারিনি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষুদ্রস্বার্থে মানুষের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন আর আমরা চুপচাপ তা মুখ বুঝে মেনে নিয়েছি। আপাতকালের সময় জেলখাটা একজন মহাপুরুষ একবার আমায় বলেছিলেন যে  রোজ উনি নিজেকে বোঝাতেন, সরকার ওঁর শরীরকে বধ করতে পারেন কিন্তু ওঁর আত্মা অবধ্য, উনি আবার জন্ম নেবেন এবং আবার নিজের গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই লড়বেন। আমাদের নাগরিক অধিকার এবং নাগরিক কর্তব্য দুটোকেই যেদিন আমরা সমান সন্মান করতে শিখব, সেদিন এঁদের সকলের আত্মত্যাগ সফল হবে।

Saturday, March 26, 2022

লাটু মহারাজ

আজ ভোরবেলা থেকে ক্রমাগত পূজনীয় লাটু মহারাজের কথা মনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে, চোখ বন্ধ করলেই বারেবারে ওঁর সেই দাঁড়িগোঁফওলা পাঞ্জাবির হাতা গোটানো ছবিটা মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। বিহারের ছাপড়া জেলার কোন গ্রামে কবে জন্ম জানা নেই, বাবা মায়ের নাম কি জানা নেই, রাখতুরাম ছাড়া পূর্বাশ্রমের গোটা নামটা পর্য্যন্ত কেউ জানেন না। অনাথ ছিলেন, অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন, গ্রামে গরু চরাতেন, ছেলেবেলায় কাকার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত শ্রী রামচন্দ্র দত্তের গৃহভৃত্য ছিলেন, কুস্তি লড়তেন আর রামজীর ভক্ত ছিলেন - ব্যাস এটুকুই মাত্র প্রাথমিক পরিচয়। রাখতুরাম থেকে নাম পাল্টে প্রথমে লাল্টু, তারপর ঠাকুরের লেটো, নেটো, স্বামীজীর প্লেটো, সবশেষে সর্বজনপূজ্য শ্রীরামকৃষ্ণপার্ষদ ব্রহ্মজ্ঞানী ঈশ্বরকোটি শ্রীমৎ স্বামী অদ্ভুতানন্দজী মহারাজ। 

ঠাকুরের অন্য সমস্ত পার্ষদদের থেকে লাটু মহারাজ একেবারে আলাদা। অন্য সকলের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ গুরু এবং পরবর্তীতে একাধারে ইষ্টও বটে কিন্তু লাটু মহারাজের কাছে প্রথমদিন থেকেই তিনি প্রভু আর লাটু তাঁর দাস। সমস্ত পার্ষদদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে লাটু মহারাজই ঠাকুরের কাছে এসেছিলেন, তাও একরকম প্রায় জোর করেই, আর তারপর থেকে আজীবন ঠাকুরের ভৃত্য হয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অবলম্বন আর তাঁর ছিলনা। 

ঠাকুরের কাছে লাটু মহারাজ 'ক' অবধি পড়েছিলেন, উচ্চারণ না করতে পারায় ওখানেই ওঁর অক্ষরজ্ঞানের ইতি হয়। ইংরিজি জানতেন না, ফলে অন্যান্য গুরুভাইদের মতন কান্ট, মিল বা স্পেন্সার পড়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। সংস্কৃতও জানতেন না, ফলে বেদ, উপনিষদ বা অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ এবং সেগুলির ভাষ্য ইত্যাদি পড়ার সুযোগও তাঁর ঘটেনি। অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলেন, স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল, হিন্দি আর বাংলা বুঝতেন, ফলে প্রভু মুখে মুখে যা কিছু শেখাতেন, সেসব তিনি একেবারে আত্মসাৎ করে নিতেন। জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত প্রভুর প্রতিটি শব্দ তাঁর কাছে প্রশ্নাতীত বেদবাক্য ছিল। 

অন্যান্য গুরুভাইদের কারো কারো মতন লাটু মহারাজ কিন্তু কোনোদিনই গুরুকে বাজিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি আর গুরুও তাঁকে পর্দানশীন শ্রীশ্রীমায়ের সেবায় নিযুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আহা, গুরু আর শিষ্য, প্রভু আর ভৃত্য, ইষ্ট আর ভক্তের কি মধুর সম্পর্ক! শিষ্যের একপাটি নতুন চটি শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে, গুরু লণ্ঠন হাতে বনে বাদারে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শিষ্য শিবমন্দিরে গভীর ধ্যানে লীন, দরদর করে ঘাম হচ্ছে, গুরু তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছেন আর ঠান্ডা জলের গেলাস নিয়ে বসে আছেন, খাওয়াবেন বলে। আবার শিষ্য রাতে ঘুমোনই না, যাতে গুরুর সেবায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে। গুরু গভীর রাতে ঝাউতলায় যাচ্ছেন বাহ্যি করতে, সঙ্গে লোটা আর লন্ঠন নিয়ে শিষ্য চলেছেন ছায়ার মতন।

আসলে লাটু মহারাজের গোটা স্বত্তা জুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু নেই। অন্যরা যদিও বা কখনো কখনো নিজেদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রেক্ষিতে ঠাকুরের কথাগুলোকে নিয়ে মনে মনে বা নিজেদের মধ্যে সত্যাসত্য বিচার করে থাকেন, লাটু মহারাজের পুরো মানসিক এবং আধ্যাত্মিক গঠনতন্ত্রটিই হলো নির্ভেজাল শ্রীরামকৃষ্ণ-নির্ভর। ওনার মনের মধ্যে গুরু ব্যতীত বাইরের কোনো প্রভাব ছিল না, গুরুকৃপায় ওঁর সমস্ত জ্ঞানই ছিল অন্তঃস্তিত। 

তাঁর পক্ষে সংগঠিত সন্ন্যাসীসঙ্ঘের নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব হতো না, প্রকৃতার্থেই উনি ছিলেন মুক্তকচ্ছ ব্রহ্মজ্ঞানী - ভোজনম্ যত্রতত্র, শয়নম্ হট্টমন্দিরে। নিজেকে কম্বলে মুড়ে চুপ করে ঘাটেবাটে পড়ে থাকতেন যাতে তাঁর বিরাট আধ্যাত্মিক শক্তিকে কেউ চট করে বুঝতে না পারেন। তবে মাঝেমাঝে তাঁর অজান্তেই তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেমন একবার নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কাশীতে পশুপতি মহারাজকে গঙ্গার ঘাটে দাঁড় করিয়ে বিশ্বনাথ দর্শন করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর ভুল ভাঙানোর জন্য। 

'প্রাচীন সাধুদের কথা' বইতে পূজনীয় স্বামী ধীরেশানন্দজী মহারাজ তাঁর স্মৃতিকথায় পূজনীয় সুধীর মহারাজের (স্বামী শুদ্ধানন্দ) মুখে শোনা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। সুধীর মহারাজের বর্ণনা: “লাটু মহারাজকে নিয়ে এক সভায় এক পণ্ডিতের উপনিষদ্ ব্যাখ্যা শুনতে গিয়েছি। “তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেঞ্জাদিবেষীকাং ধৈর্যেণ’ (কঠ উপনিষদ, ২/৩/১৭)–এর ব্যাখ্যা শুনেই লাটু মহারাজ ঐ সভার মধ্যেই জোরে বলে উঠলেন, "এই সুধীর! পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। আমি অপ্রস্তুত। বলি, "মহারাজ, চুপ চুপ"। আবার ঐরূপ বললেন। আমি বললাম, "মহারাজ, চুপ চুপ"। কিছুক্ষণ পরপর তিনি ঐরূপ বলাতে লােকের বিরক্তিভাজন হওয়ার ভয়ে বললাম, “মহারাজ, চলুন মঠে যাই"। তাঁকে নিয়ে মঠে এলাম। একঘরে থাকি। রাত্রে আমি ঘুমােচ্ছি। তিনি জেগে বসে, ডেকে বলছেন, "এই সুধীর"। আমি উঠলাম। তিনি বললেন, "পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। আমি আবার শুলাম। আবার ঐ ডাক— "এই সুধীর, পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। কিছুক্ষণ পরপর এইরূপ চলল। আমার আর সারারাত ঘুম হলাে না। লাটু মহারাজ এমনই তন্ময় হয়েছিলেন ঐ ভাবে! স্বানুভূত বিষয় কিনা! তাই এত উল্লাস!” 
[বি‌ঃদ্রঃ: কঠ উপনিষদের মূল শ্লোকটি হলো, 
'অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষােহন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। 
তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেঞ্জাদিবেষীকাং ধৈর্যেণ।।' 
অর্থাৎ অঙ্গুষ্ঠমাত্র পরিমাণস্বরূপ অন্তরাত্মাপুরুষ সর্বজনের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থিত আছেন। মুঞ্জ ঘাস থেকে শিষের ন্যায় তাঁকে স্বীয় শরীর থেকে ধৈর্যের সঙ্গে পৃথক করবে।]

লাটু মহারাজকে সবচেয়ে ভালো চিনতেন তাঁর গুরুভাইয়েরা। তিনি দৈহিকভাবে তাঁদের সঙ্গে থাকুন আর নাই থাকুন, শ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে ওঁদের সকলের মধ্যে ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার কি যে এক অটুট বন্ধন ছিল, বলে বোঝানো যায় না। একদিন স্বামীজীকে লাটু মহারাজ বলছেন, “দেখ ভাই লােরেন, কিশুববাবু টাউন হলে কিমন লিকচার দেয়। তুই ভাই অমন লিকচার দিবি, আর আমি তাের জন্য এক কুঁজো জল লিয়ে বসে থাকব।” আর যখন স্বামীজী আমেরিকায় গিয়ে জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন, তখন সেখান থেকে চিঠিতে লিখছেন, “লেটো ভাই-এর ইচ্ছা এখানে পূরণ করছি। খুব lecture দিচ্ছি।”

স্বামীজী একজায়গায় বলেছেন, "লাটু যেরূপ পারিপার্শিক অবস্থার মধ্য হইতে আসিয়া অল্প দিনের মধ্যে আধ্যাত্মিক জগতে যতটা উন্নতিলাভ করিয়াছে - এতদুভয়ের তুলনা করিয়া দেখিলে সে আমাদের অপেক্ষা অনেক বড়। আমরা সকলেই উচ্চবংশজাত এবং লেখাপড়া শিখিয়া মার্জিত বুদ্ধি লইয়া ঠাকুরের নিকট আসিয়াছিলাম; লাটু কিন্তু সম্পূর্ণ নিরক্ষর। 
আমরা ধ্যান-ধারণা ভাল না লাগিলে পড়াশুনা করিয়া মনের সে ভাব দূর করিতে পারিতাম। লাটুর কিন্তু অন্য অবলম্বন ছিল না - তাঁহাকে একটিমাত্র ভাব অবলম্বনেই চলিতে হইয়াছে।
কেবলমাত্র ধ্যান-ধারণা সহায়ে লাটু যে মস্তিষ্ক ঠিক রাখিয়া অতি নিন্ম অবস্থা হইতে উচ্চতম আধ্যাত্মিক সম্পদের অধিকারী হইয়াছে, তাহাতে তাঁহার অন্তর্নিহিত শক্তির ও তাহার প্রতি শ্রীশ্রীঠাকুর-এর অশেষ কৃপার পরিচয় পাই।"

Friday, March 25, 2022

২০২১ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন

 পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রথম চরণের প্রাক্কালে ভারতের দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কয়েকটা বিষয় সত্যিই আমায় ভাবাচ্ছে। 

১. প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের একটি নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র আদর্শ থাকবে, সেটাই কাম্য। কিন্তু সেই আদর্শের উৎসমুখে যে সমাজচেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা কেন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল নির্ভর হবে? নিজস্ব সীমাবদ্ধতা স্বত্তেও রাজনীতি যখন কোনো আদর্শকে তৃণমূল স্তর অবধি নিয়ে যাওয়া এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের একটি উৎকৃষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তখন তার ব্যবহার সর্বব্যাপী করার প্রচেষ্টা হবে না কেন? কেন গোটা জাতীয়তাবাদী আদর্শটাই যেন একটিমাত্র দলের কুক্ষিগত মালিকানা হয়ে থাকবে?

২. বামেরা নিজেদের মতাদর্শকে welfare state থেকে শুরু করে democratic socialism হয়ে armed revolution অবধি নানা স্তরে বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলত, বাম মতাদর্শ একটি সর্বজনীনতা পেয়েছিল যার মূলে ছিল বিভিন্ন বাম ধারায় বিশ্বাসী নানান স্তরের এবং উপমতধারার রাজনৈতিক দল। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীরা এই সহজ রাস্তাটা কেন অনুসরণ করতে পারলেন না এবং কেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনৈতিক মূল্যবোধের মূলে গিয়ে সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করতে পারলেন না?

৩. Identity politics এর প্রকৃত সংজ্ঞা কি? সে কি কেবল ব্যক্তিস্বত্তার রাজনৈতিক পরিচয়কে নির্দিষ্ট এবং মেরুকৃত করে নাকি সঠিকভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের মাধ্যমে সংকুচিত স্বত্তাকে বৃহত্তর সত্তায় পর্যবসিত করে? সেক্ষেত্রে একটি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে ব্যক্তিস্বত্তার সাথে সম্পৃক্ত করে ব্যক্তির সাথে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মেলবন্ধনের মাধ্যমে শ্রেণীনির্ভর বামপন্থার বিপরীতে যে সার্বিক সাম্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, সে বিষয়ে রাজনৈতিক পদক্ষেপ হয়নি কেন? এটা কি মতাদর্শীদের একটি দল বিশেষের ওপর অতিনির্ভরতার ফল?

৪. দেশের যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে এমন অনেক কিছুই মানুষ সাগ্রহে গ্রহণ করছেন যা গত সাড়ে ছয় দশকে সম্ভব হয়নি। মানুষ আজ নিজের অতীত সম্পর্কে নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে বেশি সচেতন এবং সমাজজীবনে জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের প্রভাব বাড়ছে। একদিকে বামপন্থীয় শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা এবং বামপন্থাশ্রয়ী অনুকরণকামী অন্তর্জাতিকতাবাদ ক্ষয়িষ্ণু, অন্যদিকে সমাজের সব স্তরে দেশীয় আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মনির্ভরতার উত্থান লক্ষণীয়। সামগ্রিকভাবে রাজনীতি এমনদিকে মোড় নিচ্ছে যে তরুণ গগৈ জীবিত থাকাকালীন আসামে যে বদরুদ্দীন আজমলের মতন সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কোনোদিন কংগ্রেস হাত মেলায়নি, আজ তাদেরই সাথে জোট বাঁধতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টেরও, সোজা ওয়াজ মাহফিল থেকে রাজনীতির আঙিনায় উঠে আসা ফুরফুরা শরীফের পীরজাদার সাথে সাম্প্রদায়িক জোট করতে হয়েছে তাঁদের। এই যে অস্তিত্বসংকটে পড়া mainstream রাজনীতির তথাকথিত পন্থনিরপেক্ষ শক্তির পন্থীয় মেরুকরণ, যা ভবিষ্যতে সমাজকে আরো বিভাজিত করবে, তাকে রোখার উপায় কি শুধুমাত্র একদলীয় বা একপন্থীয় ক্ষেত্রবিস্তার নাকি বহুদলের ভেতরে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে সার্বিকভাবে রাজনীতিতে পন্থীয় প্রভাবকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া? 

৫. শেষ প্রশ্ন। ভারতের মতন ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্রে রাজনীতিকে কিভাবে ধর্ম আধারিত এবং ধর্মাশ্রয়ী করে তোলা যায় যাতে ভারতের রাজনীতি পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে ওঠে এবং তাকে ব্যবহার করে প্রাচীন ঐতিহ্যে আস্থাবান কিন্তু ভবিষ্যতদর্শী ভারতবর্ষ গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তা নিয়ে চর্চা হওয়া দরকার। ভারতের গোটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি জুড়ে যখন হিন্দুত্বের হওয়া বইবে, বস্তুতঃ সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিন্দু সভ্যতার শিক্ষা, মনন, কৃষ্টি এবং চেতনার পুনঃপ্রকাশ ঘটবে, তখনই তো এই দেশ সত্যিকারের আত্মাবলম্বী হয়ে উঠবে। আজ যাঁরা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জোট করছেন তাঁরা জনসমর্থনের রাস্তা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। কাল যদি তাঁরা বোঝেন যে দেশ বদলে গেছে, তাঁরাই প্রাসঙ্গিকতার তাগিদে হিন্দু সভ্যতার গুনগান গাইতে শুরু করবেন। সেই দিশা মাথায় রেখে ভারতপন্থী আদর্শবাদীদের কি এখন থেকেই একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া জরুরি নয়? উদাহরণস্বরূপ, RSP কেন বামফ্রন্টে থাকবে, ওঁদের উদ্ভব তো অনুশীলন সমিতি থেকে।


Thursday, March 17, 2022

দোল

আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা, চৈতন্য মহাপ্রভুর ধরাধামে পুণ্য আবির্ভাব তিথি। আজ সত্য, প্রেম, ক্ষমা, ধৈর্য্য, কৃপা, অনুকম্পা, অনুরাগ, সমর্পণ আর মুক্তিকে উজ্জাপন করার শুভদিন। অন্য এক যুগে আজকের এই তিথিতেই ব্রহ্মরূপী শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ব্রহ্মশক্তি শ্রীমতি রাধারাণী ও জীবরূপী ভক্তকুল গোপিনীদের সাথে নানান দৈবীগুণের প্রতীক হিসেবে নানা রঙের গুলাল নিয়ে হোলি খেলে সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। এই হোলি শব্দটি এসেছে 'হোলিকা' নামের এক দৈত্যকন্যার নাম থেকে। গল্পটা হয়তো সবার জানা, তবুও বারবার শুনতে মন্দ লাগে না। 


এ আরো আগের এক যুগের ঘটনা। হোলিকা ছিলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন। একসময় তিনি কঠোর তপস্যা করে এমন একটি চাদর পেয়েছিলেন যেটি পরে থাকলে আগুন আর তাঁকে পোড়াতে পারবে না। হিরণ্যকশিপু নিজেও আবার দীর্ঘদিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে বারবার দেবলোক আক্রমণ করছিলেন। আসলে দেবত্বের ওপর অসুরত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা তো আর আজকের ব্যাপার নয়, এ চিরকালীন। তাই তো 'ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে'। যাইহোক, রাজার নিজের ঘরেই এক মস্ত বড় সমস্যা ছিল - তাঁর নিজের ছেলে প্রহ্লাদ। তিনি শিশু হলে কি হবে, আজন্ম পরম বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, মূর্তিমান বিবেক। যতবার রাজা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন ততবার বিষ্ণুর আশীর্বাদে তা ব্যর্থ হয় আর প্রহ্লাদ বেঁচে যান। শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে হিরণ্যকশিপুর মনে পড়ে হোলিকার বরের কথা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হিরণ্যকশিপু হোলিকার কোলে বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলেন। প্রহ্লাদ ছোট ছেলে, কি আর করবেন? দাউদাউ অগ্নিশিখার মধ্যে চুপচাপ বসে শুধু একমনে ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে যাচ্ছেন। যাঁর ওপর ঈশ্বরের কৃপা আছে, তাঁকে ছোঁবে এমন সাধ্যি যে স্বয়ং অগ্নিদেবেরও নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কি না হতে পারে? ফলে বিষ্ণুর কৃপায় ভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত থেকে গেলেন আর বর পাওয়া স্বত্তেও হোলিকা পুড়ে ছাই।


গতকাল সারা দেশ জুড়ে প্রতীকী হোলিকা দহন করা হয়েছে, যাকে আমরা নেড়াপোড়া বলি। হিংসা, দ্বেষ, লোভ, মদ, মৎসর্য্য, ক্রুরতা, নিচতা ইত্যাদি সমস্ত আসুরিক প্রবৃত্তিকে দমন করে আজকের দিনে নিজেদের মধ্যে দৈবত্বকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই আমরা এই হোলি উৎসব পালন করছি। আমাদের বাংলায় অবশ্য হোলিকে গৌড়ীয়বৈষ্ণবধারা অনুযায়ী দোলযাত্রা বলা হয় কারণ প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রার অনুকরণে এইদিন মন্দির থেকে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে বের করে এনে, আবিরে রাঙিয়ে, দোলায় চড়িয়ে কীর্তন করতে করতে সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে আসার যে প্রথা এখানে চালু হয়েছিল, তার থেকেই লোকের মুখে মুখে হোলি একসময় দোল হয়ে গেছে। মূল কথা হচ্ছে 'every man is potentially divine', স্বামীজীর বাণীর সেই স্পিরিটটাকে হৃদয়ে ধারণ করা আর মনুষ্যত্বের রঙে নিজেদের মনকে রাঙিয়ে নেওয়ার দিন আজ, যাতে চেষ্টা চালিয়ে গেলে আমরা প্রত্যেকেই একদিন না একদিন দেবত্বে উন্নীত হতে পারি।


শুভ দোলযাত্রা।

Monday, March 14, 2022

ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য

এক পরিচিতজনের অকালমৃত্যুর খবর শোনা ইস্তক মনের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যে থেকে এই যে খেদ ও পীড়া নিরন্তর বয়ে চলেছে, একে কি আর ইচ্ছেমতো 'জগৎ মিথ্যা' বলে অত সহজে তুড়ি মেরে হওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া যায়? নাকি ছাদের বাগানের গাছে গাছে যে সব অপূর্ব সুন্দর ফুলগুলি প্রতিদিন সকালে ফুটে থাকে, গাছেদের কত ব্যাথা লাগবে ভেবে কোনদিনই পুজোর জন্যে সেগুলি প্রাণে ধরে তুলতে পারিনা যে, সেই অনুকম্পা বোধটাও কি মিথ্যা, নিছক মায়া? যদি জগতে বিভিন্ন নাম-রূপের মধ্যে কোনো আত্মীয়তা আর একাত্মতা নাই থাকতো, তাহলে একে অপরের প্রতি এই ধরণের সমবেদনা বা সহমর্মিতা জাগা অসম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। 


ঠাকুরের সন্তান পরম পূজনীয় হরি মহারাজের (শ্রীমৎ স্বামী তুরীয়ানন্দ) শেষ উক্তি ছিল, "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত" - সেটা তো ঠাকুরেরই কথা - এ কি করে মিথ্যা হতে পারে? 'শিব জ্ঞানে জীব সেবা' করতে গেলেও তো জীবকে আগে এমন এক সত্য বলে মেনে নিতে হবে যার মধ্যে শিবত্ব অন্তর্নিহিত আছে। নাহলে এক অসত্য, সব অসত্য জেনেও, আর এক অসত্যের সেবা করছে - এ তো এক মস্ত বড় comedy of errors হয়ে যাবে!


আচার্য্য শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাখ্যার মূল কথা, যিনি সত্য, যিনি নিত্য, যিনি চৈতন্য, তিনিই ব্রহ্ম, একমেবাদ্বিতীয়ম, বাকি সব মিথ্যা। তাঁর মতে জগৎ মিথ্যা কারণ, 

১. ব্রহ্ম যেহেতু শুদ্ধ চৈতন্য, তাঁর সঙ্গে অনিত্য জগতের কোনো পৃথক সম্বন্ধ থাকতে পারেনা কারণ সম্বন্ধ কেবল দুটি ভিন্ন স্বত্তার মধ্যেই হওয়া সম্ভব আর ব্রহ্ম অদ্বিতীয়।

২. ব্রহ্ম জগতের ক্রিয়াশীল স্রষ্টা হতে পারেন না কারণ ক্রিয়ামাত্রেই অভাবের সূচক আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণ।

৩. জগতের মাধ্যমে ব্রহ্মের লীলা প্রকাশমানও বলা যাবে না কারণ সসীম জগৎ অসীম ব্রহ্মের প্রকাশক হতে পারে না।

৪. জগৎ ব্রহ্মের পরিণামও হতে পারে না কারণ তা হলে অসীম ব্রহ্মকে সীমিত বলে মেনে নিতে হয়।


আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব confusing একটা বিষয়। আমি অর্থাৎ আত্মা যদি পরমাত্মারই প্রতিবিম্ব হই, তাহলে সেটি ধারণকারী কায়িক অস্তিত্বকে, হলোই বা সে সাময়িক, মিথ্যা বলে অস্বীকার করি কিভাবে? গুরুকৃপায় আমার এই কায়িক শরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনের মধ্যে যে আত্মবোধের প্রয়োজনীয়তা জাগছে, বা বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা তাঁদের কায়িক শরীর ও মন ব্যবহার করে যে সমস্ত সত্য প্রকাশ করে গেছেন, অথবা যুগে যুগে অবতারেরা সাময়িক শরীর ধারণ করে যা যা দৈববাণী প্রচার করেছেন, সেই অস্তিত্ব, এবং তাঁদের শিক্ষা সবই অসত্য, কেবলই মায়া? তাঁরা যুগোপযোগী করে যে পরমসত্য প্রতিষ্ঠা করতে এই দেশে জন্মালেন, কেউ সত্যযুগে, কেউ ত্রেতায়, কেউ দ্বাপরে, কেউ বা কলিতে, সব মিথ্যা হতে পারে নাকি? আচার্য্য শঙ্করের অবশ্য মূলত জ্ঞানমার্গেই বিচরণ, তাই এই বিষয়ে স্বামীজী তাঁর জ্ঞানযোগ গ্রন্থে কি বলছেন, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বলছেন,


"তোমরা শুদ্ধ ‘দেশের’ বিষয় ভাবিতে চেষ্টা কর, যাহাতে কোন বর্ণ নাই, যাহার সীমা নাই, চারিদিকের কোন বস্তুর সহিত যাহার কোন সংস্রব নাই। তুমি উহার বিষয় চিন্তাই করিতে পারিবে না। তোমাকে দেশের বিষয় চিন্তা করিতে হইলে দুইটি সীমার মধ্যস্থিত অথবা তিনটি বস্তুর মধ্যে অবস্থিত দেশের বিষয় চিন্তা করিতে হইবে। তবেই দেখা গেল, দেশের অস্তিত্ব অন্য বস্তুর উপর নির্ভর করিতেছে। কাল সন্বন্ধেও তদ্রুপ; শুদ্ধ কাল সম্বন্ধে তুমি কোন ধারণা করিতে পার না; কালের ধারণা করিতে হইলে তোমাকে একটি পূর্ববর্তী আর একটি পরবর্তী ঘটনা লইতে হইবে এবং কালের ধারণা দ্বারা ঐ দুইটিকে যোগ করিতে হইবে। দেশ যেমন বাহিরের দুইটি বস্তুর উপর নির্ভর করিতেছে, কালও তেমনি দুইটি ঘটনার উপর নির্ভর করিতেছে। আর ‘নিমিত্ত’ বা ‘কার্যকারণ’ভাবে ধারণা এই দেশকালের উপর নির্ভর করিতেছে। ‘দেশ-কাল-নিমিত্ত’ এই সবগুলিরই ভিতর বিশেষত্ব এই যে, উহাদের স্বতন্ত্র সত্তা নাই।


"এই চেয়ারখানা বা ঐ দেয়ালটার যেরূপ অস্তিত্ব আছে; উহার তাহাও নাই। ইহারা যেন সকল বস্তুরই পিছনে ছায়ার মতো, তুমি কোনমতে উহাদিগকে ধরিতে পার না। উহাদের তো কোন সত্তা নাই—আবার উহারা যে কিছুই নয়, তাহাও বলিতে পারা যায় না; কারণ উহাদেরই ভিতর দিয়া জগতের প্রকাশ হইতেছে। অতএব আমরা প্রথমতঃ দেখিলাম, এই দেশ-কাল-নিমিত্তের সমষ্টির অস্তিত্ব নাই এবং উহারা একেবারে অসৎ বা অস্তিত্বশূন্যও নহে। দ্বিতীয়তঃ উহারা আবার এক সময়ে একেবারে অন্তর্হিত হইয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ সমুদ্রের উপর তরঙ্গ চিন্তা কর। তরঙ্গ অবশ্যই সমুদ্রের সহিত অভিন্ন, তথাপি আমরা মনে করি—ইহা তরঙ্গ এবং সমুদ্র হইতে পৃথক‍্। এই পৃথক্-ভাবের কারণ কি? নাম ও রূপ।


"নাম অর্থাৎ সেই বস্তু সম্বন্ধে আমাদের মনে যে একটি ধারণা রহিয়াছে, আর রূপ অর্থাৎ আকার। আবার তরঙ্গকে সমুদ্র হইতে একেবারে পৃথক্‌রূপে কি আমরা চিন্তা করিতে পারি? কখনই না। উহা সকল সময়েই ঐ সমুদ্রের ধারণার উপর নির্ভর করিতেছে। যদি ঐ তরঙ্গ চলিয়া যায়, তবে রূপও অন্তর্হিত হইল, কিন্তু ঐ রূপটি যে একেবারে ভ্রমাত্মক ছিল, তাহা নহে। যতদিন ঐ তরঙ্গ ছিল, ততদিন ঐ রূপটি ছিল এবং তোমাকে বাধ্য হইয়া ঐ রূপ দেখিতে হইত; ইহাই মায়া। অতএব এই সমগ্র জগৎ যেন সেই ব্রহ্মের এক বিশেষ রূপ। ব্রহ্মই সেই সমুদ্র এবং তুমি আমি সূর্য তারা সবই সেই সমুদ্রে ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গমাত্র। তরঙ্গগুলিকে সমুদ্র হইতে পৃথক‍্ করে কে? রূপ। আর ঐ রূপ — দেশ-কাল-নিমিত্ত ব্যতীত আর কিছুই নহে। ঐ দেশ-কাল-নিমিত্ত আবার সম্পূর্ণরূপে ঐ তরঙ্গের উপর নির্ভর করিতেছে। তরঙ্গও যেই চলিয়া যায়, অমনি তাহারাও অন্তর্হিত হয়। জীবাত্মা যখনই এই মায়া পরিত্যাগ করে, তখনই তাহার পক্ষে উহা অন্তর্হিত হইয়া যায়, সে মুক্ত হইয়া যায়।"


স্বামীজী আর হরি মহারাজের এই যে এক অনন্য দৃষ্টিকোণ, তার উৎস কিন্তু সেই একই - ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিক্ষা। ঠাকুর একে বলছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান। কথামৃত জুড়ে বারবার ঠাকুরের মুখে এই চারটি বিষয় উঠে আসছে:

১. ব্রহ্ম আর ব্রহ্মশক্তি এক এবং অভেদ, যেমন আগুন আর তার দহিকাশক্তি। শক্তি মানে সগুণ ব্রহ্ম, মানে ভগবান, মানে সর্বপ্রকাশমানা মহামায়া পরমাপ্রকৃতি। অদ্বৈতের মধ্যেই ভগবান, আলাদা নন।

২. জগৎ ব্রহ্মশক্তিরূপীণি ভগবানের সৃষ্টি। ভক্ত তারই মধ্যে। আর ভক্ত ও ভগবান এক। ফলে ভগবৎ দর্শনই আত্মবোধ। তাই জগৎ সত্য।

৩. যত মত তত পথ। বলছেন "অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা কিছু করো"। মূলে অদ্বৈতবোধ, উপলব্ধির পথ আলাদা আলাদা।

৪. যতক্ষণ শরীর আছে ততক্ষণ একটুখানি হলেও অহঙ্কার থাকবে। ফলে ভক্তের নির্বিকল্প সমাধি অর্থাৎ সম্পুর্ন যোগ অর্থাৎ আত্মবোধ হওয়ার পরেও জনহিতে যথাসম্ভব শরীরধারণ করে থাকা প্রয়োজন।


দেখছি ঈশ ঊপনিষদের ষষ্ঠ শ্লোকে ব্রহ্মনিষ্ঠ ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক্য বলছেন,

যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মনেব অনুপশ্যতি ।

সর্ব ভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্ততে ।।

অর্থাৎ যিনি নিজের আত্মায় সবাইকে এবং সবার মধ্যে নিজেকে দর্শন করেন তিনি কখনও কারো কাছ থেকে নিজেকে (অর্থাৎ স্বরূপ) গোপন করেন না। এটাই তো সবাইকে আপন জানার সূত্র। পর বলে কেউ নেই, সবাই আপন - বসুধৈব কুটুম্বকম্। এও তো অদ্বৈতই। আর এখানেও সেই "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।


আবার তৈত্তেরিয় উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হচ্ছে,

'তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ' 

অর্থাৎ তিনি (ব্রহ্ম) [এ জগৎ] সৃষ্টি করে তন্মধ্যে (জীবরূপে) প্রবিষ্ট আছেন। 

এবার গীতার নবম অধ্যায়ের চতুর্থ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কি বলছেন, সেটাও দেখে নেওয়া যাক:

ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা ।

মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ ।।

সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, 'অব্যক্তরূপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হয়ে আছি। সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই'। শ্রীধরস্বামীর ব্যাখ্যা কিন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি গভীর। 'মৎস্থানি', অর্থাৎ কারণভূত যে আমি, সেই আমাতেই সর্বভূত অর্থাৎ চরাচর সকল রয়েছে। তাহলেও ঘটাদিতে যেমন মৃত্তিকা থাকে, আমি ভূতসকলে তেমনভাবে অবস্থান করিনা কারণ এই বিশ্বভুবন আমার একাংশমাত্র, আমি বিশ্বানুগ হয়েও বিশ্বাতীত। এটাই কিন্তু বেদান্তের মূল কথা, জগৎ ব্রহ্মের বিকাশ অর্থাৎ ব্রহ্ম নিজের অস্তিত্বে নিজে প্রকাশিত কিন্তু ব্রহ্ম জগতের বিকার নন, অর্থাৎ তিনি জগতের পরিণাম নন, তিনি দেশ-কাল-নিমিত্তহীন অনন্তস্বত্তা। আবারো সেই "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।


ঠাকুর কিন্তু এবারেও সেই একই কথা বলছেন যা তাঁর আগের আগের অবতারে বলেছিলেন। জগতের সবখানে ঈশ্বরের বাস, সকলের মধ্যে ঈশ্বর আছেন অথচ জগতটি পরিবর্তনশীল, অর্থাৎ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এখানে কর্মফল ছাড়া যেহেতু পুঁটলি বাঁধার কিছু নেই, ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ভোগ করো। অর্থাৎ যা পাচ্ছ, সবটাই তাঁর প্রসাদ, তাঁর কৃপা, এই বুঝে দুর্লভ মানবজীবন উপভোগ করো, তার সদ্ব্যবহার করো। সবাই আপন, কেউ পর নয়। ফলে অন্য কারো প্রাপ্যতে লোভ কোরো না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে বলছেন,

"আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে,

তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে।"

সব দিয়ে সব পাওয়া। ঈশ ঊপনিষদের প্রথম শ্লোকের 'তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা'।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ততঃ কিম্‌' প্রবন্ধে বড় সুন্দর করে এর ব্যাখ্যা করেছেন,

"মানুষকে পূর্ণতালাভ করিতে হইলে পরিপূর্ণ জীবন এবং সম্পূর্ণ কর্মের প্রয়োজন হয়। জীবন সম্পূর্ণ হইলেই জীবনের প্রয়োজন নিঃশেষ হইয়া যায়, কর্ম সমাপ্ত হইলেই কর্মের বন্ধন শিথিল হইয়া আসে।


"জীবনকে ও জীবনের অবসানকে, কর্মকে ও কর্মের সমাপ্তিকে এইরূপ অত্যন্ত সহজভাবে গ্রহণ করিতে হইলে যে-কথাটি মনে রাখিতে হইবে, তাহা ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকেই রহিয়াছে-

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

ঈশ্বরের দ্বারা এই জগতের সমস্ত যাহা-কিছু আচ্ছন্ন জানিবে।

এবং

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্‌।

তিনি যাহা ত্যাগ করিতেছেন—তিনি যাহা দিতেছেন, তাহাই ভোগ করিবে, অন্য কাহারও ধনে লোভ করিবে না।


"সংসারকে যদি ব্রহ্মের দ্বারা আচ্ছন্ন বলিয়া জানিতে পারি, তাহা হইলে সংসারের বিষ কাটিয়া যায়, তাহার সংকীর্ণতা দূর হইয়া তাহার বন্ধন আমাদিগকে আঁটিয়া ধরে না। এবং সংসারের ভোগকে ঈশ্বরের দান বলিয়া গ্রহণ করিলে কাড়াকাড়ি-মারামারি থামিয়া যায়।"

ঘুরে ফিরে এও তো সেই হরি মহারাজেরই কথা, "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।

Friday, March 11, 2022

হিন্দুর জাত

একটা ছোট ভিডিও কেউ পাঠিয়েছেন, দেখে বেশ আনন্দ পেলাম। একজন সাংবাদিক গাঁও-দেহাতের এক সাধারণ গরিব মাকে জিজ্ঞেস করছেন তাঁর জাত কি আর সেই মা সপাটে জবাব দিচ্ছেন,"হাম হিন্দু হ্যায়"। সাংবাদিক ভাবছেন হয়তো প্রশ্নটি তিনি ঠিক বোঝাতে পারেননি, তাই দ্বিতীয়বার একই কথা ফের জিজ্ঞেস করছেন এবং আবার সেই একই দৃঢ় উত্তর পাচ্ছেন, "হাম হিন্দু হ্যায়"। 


জাত অর্থাৎ caste; এটি এখন আর সেই বৈদিকযুগের কর্মবিন্যাস ভিত্তিক interchangeable শ্রেণীকরণে সীমাবদ্ধ নেই, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা সমাজকে বিভাজিত করে রাখার ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান হাতিয়াররূপে তা আজ এক ভয়ঙ্কর সামাজিক কুপ্রথার রূপ নিয়ে নিয়েছে। আজ আমাদের গোটা সমাজটা ৩০০০ caste আর ২৫০০০ sub-caste-এ বিভক্ত হয়ে গেছে আর রাজনৈতিক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে এই বিভাজনকে এতদিন ধরে খুব ইন্ধনও জোগানো হয়েছে। এমনকি ভারতে যাঁদের পূর্বপুরুষ সনাতন ধর্ম ছেড়ে মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের পন্থটিকে তো ছেড়েছিলেন কিন্তু caste identity-টি ঠিক সঙ্গে করে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন, এ এমনই এক অদ্ভুত পরিচয়লিপ্সা। 


এই জাত জাত করে আমাদের দেশের কি সর্বনাশ যে হয়েছে, সে আর বলার কথা নয়। ইংরেজদের census জনিত একটা মিথ্যা construct-এর ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন ভারতবর্ষেও কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা সেই মেকি দূষিত বিভাজনকারী সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ফলে কত যে হিংসা, কত শোষণ, কত অত্যাচার আর কত যে ঘৃণার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, এক আধুনিক মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রে সে কলঙ্ক রাখার জায়গা নেই। 


এই দুদিন আগে পর্য্যন্তও classless society-র নাম করে তথাকথিত উচ্চবর্নীয়দের বিরুদ্ধে তথাকথিত নিম্নবর্নীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলাই ছিল ভারতে সমাজতন্ত্র বিস্তারের ভিত্তি। অবশ্য এর পেছনে আবার সেই পুরানো বুর্জোয়া বনাম প্রলেতারিয়েতের ছেঁদো গল্পটাও ছিল, যেখানে উঁচুজাত মানেই বড়লোক আর নিচুজাত মানেই গরিব বলে ধরে নেওয়াটাই ছিল দস্তুর, তা সে গরিব পূজারী ব্রাহ্মণের দুবেলা পেট চলুক আর নাই চলুক আর কোটায় চান্স পাওয়া অর্থপিশাচ ডাক্তারের বখাটে ছেলে দুহাতে যত টাকাই ওড়াক না কেন।


আজ যখন এক গরীব মায়ের ছোট্ট উত্তরের এই ছোট্ট ভিডিওটি দেখলাম, তখন হিন্দুত্বের প্রয়োজনীয়তাটি আরো বেশি করে অনুধাবন করা গেল। আমরা হিন্দু - ব্যাস এইটুকুই তো যথেষ্ট। এটাই আমাদের সত্যিকারের রাষ্ট্রীয় পরিচয়। এই পরিচয় সমাজের ভাঙ্গন রুখে দেয়, বিভাজন রুখে দিয়ে সমাজকে এক করে দেয়, শ্রেণীশোষণ বন্ধ হয়ে যায়, ভেদাভেদ শেষ হয়ে যায়, সমবেতভাবে গোটা বিশ্বের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর বল পাওয়া যায়। বিগত কয়েকদশক ধরে রাজনৈতিক narrative পরিবর্তিত হতে হতে আজ যে আমাদের সমাজ এই জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছে, যেখানে জাত জিজ্ঞেস করলে জবাব আসছে 'আমি হিন্দু', এ কিন্তু মারাত্মক বড় একটা সদর্থক সমাজসংস্কার, এটা সর্বাত্মক হওয়া দরকার। এরপরের ধাপ হলো পন্থনির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসীর কাছে এই রাষ্ট্রীয় পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠা। যেদিন সেটা হয়ে যাবে, সেদিন আর কেউ আমাদের সমাজের মজবুত দেওয়ালে কোনোভাবেই সিঁদ কাটতে পারবে না।

অবলম্বন

আজ জ্যেষ্ঠপুত্র ঘুম থেকে উঠতেই সদরের চাবিগুলি ওর কাছ থেকে ফেরত চেয়ে নিলুম। প্রতিবারই এটি করা হয়। যখনই ও বাড়ি ফেরে ওকে এক সেট সদরের চাবি দেওয়া হয় যাতে ও নিজের মতন করে বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে পারে আর চলে যাওয়ার আগে ফেরত নিয়ে নেওয়া হয় কারণ প্রথমত, ওগুলি বিভূঁইয়ে কোনো কাজে লাগার নয় আর দ্বিতীয়ত, হারিয়ে ফেলা বা সঙ্গে করে ফেরত না নিয়ে আসার সম্ভাবনাও সমূহ। ওর এই চাবির গোছাটি কিন্তু অন্যগুলির সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়না। ওটি ওর ঘরের দেওয়াল আলমারিতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তুলে রাখা হয়। ওটা শুধু ওরই। 


আজ চাবি ফেরত চাইবার সময় হটাৎ পুরনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে গেল। এককালে আমাদের বাড়িতে মূর্তিতে কালীপূজো হতো। মায়ের একটি রুপোর জল করা তামার খাঁড়া ছিল, তাতে আবার খুব সুন্দর করে মিনে করা একটি লাল রঙের চোখও আঁকা ছিল। প্রতিবার মাকে বাড়ি নিয়ে আসার পর সেটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হতো আর পরের দিন ভাশানের ঠিক আগে খুলে নিয়ে যত্ন করে মুছেটুছে ঠাকুরের ট্রাঙ্কে তুলে রাখা হতো। তারপর মাঝখানে বাড়িতে যতবার যত রকমের পূজাই হোক না কেন, বাবাকে দেখেছি ওই খাঁড়াটি বের করে সযত্নে পূজার আসনে রাখতেন।


আসলে ভালোবাসার কেউ চোখের সামনে না থাকলেও মনের ভেতরে তার অস্তিত্ব বাস্তবিকই থাকে। অন্যসময় হয়তো কোনো এক নিভৃত ট্রাঙ্কে সে ঘুমিয়ে থাকে কিন্তু যেই কোনো শুভ অনুষ্ঠান হয় বা এমন কোনো ঘটনা ঘটে যেখানে সেই জনের উপস্থিতি কাম্য ছিল, তখনই সে ঠিক টুক করে ডালাটি খুলে বেরিয়ে আসে। আসলে ভালোবাসার সাথে কাছে পাওয়ার খুব গভীর একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে, এবং যত বয়স বাড়ছে তত উপলব্ধি করছি যে সেটা যত না শারীরিক, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি মানসিক, বস্তুত সাংকেতিকও। 


ছোটবেলায় ভাইফোঁটার দিন মাকে দেখেছি মামারবাড়ি যাওয়ার আগে নিজের প্রবাসী ভাইদের উদ্দেশ্যে দেওয়ালে চন্দনের ফোঁটা দিতে। বিষয়টা একই, একটা কিছু উপলক্ষ করে প্রিয়জনকে মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। তবে উপলক্ষটাও কিন্তু ভীষণ জরুরি, তা সে কোনো আনুষ্ঠানই হোক বা স্মৃতিচিহ্ন অথবা স্মৃতিচারণ। যা সর্বক্ষণ চোখের সামনে আছে, তাকে তো আর আলাদা করে মনে করতে হয়না কিন্তু যা মনের মধ্যেই আছে, তার জন্য অনেকসময়েই বাহ্যিক কোনো একটা কিছুর অবলম্বন লাগে, যেটিকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তা সে চাবির গোছাই হোক, মায়ের হাতের খাঁড়া বা ঠাকুরঘরের পুবদিকের দেওয়াল।

আমি হিন্দু

আমি হিন্দু - এই শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে অন্তরে এক ধরণের অদ্ভুত শক্তি উৎপন্ন হয়। সেই শক্তির উৎস কি, আদপে তার মূল্য কতটুকু আর তা কিসেরই বা ইঙ্গিতবাহী? 


প্রথম কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথেই দেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে এমন এক মহান প্রাচীন সভ্যতার সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, যা দীর্ঘ কালখন্ড জুড়ে গোটা মানবজাতির ইতিহাসকে উন্নততর জীবনশৈলী এবং উন্নততর জীবনবোধ অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার আলোকে উদ্ভাসিত করেছে।


দ্বিতীয় কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে ক্ষুদ্র জাতিভেদ, আঞ্চলিকতা, পন্থ-মত, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির অনেক উর্দ্ধে উঠে নিজেদের পূর্বপুরুষদের হাতে গড়া এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তার সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, যা মূলত মানবিক মূল্যবোধ আর মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্যসাধনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক ঐতিহ্যের ওপর আধারিত। 


তৃতীয় কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে বিশ্বজনীনতা, অভিন্নতা, ক্ষমা, উদারতা, সমতা, সমদর্শীতা, সমভাব, সহমর্মিতা, প্রেম ইত্যাদি উচ্চ সংস্কারকে নিজের দৈনন্দিন যাপনে স্বীকার করে নেওয়া যায়, যা অহঙ্কার ও ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষকে ক্রমে ক্রমে দেবত্বে উন্নীত হতে সহায়তা করে।


চতুর্থ কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে এমন এক বিশ্বজনীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায়, যা এক প্রাচীন মহান রাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাসও বটে - যে রাষ্ট্র সাম্যবোধের জননী, যে রাষ্ট্র গণতন্ত্রের জননী, যে রাষ্ট্র অহিংসার জননী, যে রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার জননী এবং যে রাষ্ট্র সামাজিক ন্যায় ও নীতিবোধেরও জননী।


পঞ্চম কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে বেদান্তের সেই সনাতন সত্যের সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, নিজেদের গোত্রের সূত্র ধরে সেইসব পূর্বজ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে, যাঁরা নিজেরা দেবত্বকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং গোটা মানবজাতির জন্য বিভিন্ন পথের সন্ধানও রেখে গিয়েছিলেন। সারা বিশ্বে একমাত্র তাঁরাই বলেছিলেন যে বাইরে নয়, ভেতরে খোঁজো আর ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি। তাঁরা ত্তজস্বল ছিলেন, ক্ষম ছিলেন, প্রগাঢ়রূপে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন আর প্রশ্নাতীতভাবে প্রেমিক ছিলেন। 


তারপরে এই পুণ্যভূমিতে যুগে যুগে কত না মহাত্মা আর অবতার জন্মেছেন, তাঁরা কত না সমকালীন পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু যা সনাতন তা যেহেতু অপরিবর্তনীয়, তাঁদের সকলের মূল লক্ষ্য কিন্তু সেই একই থেকেছে - 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' অর্থাৎ হিন্দুর জন্ম আত্মার মোক্ষ ও জগতের কল্যাণের জন্য। 


এর ফলে হিন্দু ধর্মসংস্কৃতিতে এমন এক জীবন্ত ও চিরন্তন সমভাব ও আত্মনির্ভরতা জাগ্রত হয়েছে যে সংকীর্নমনা অধর্মী বিদেশি আক্রমণকারীরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে নাশ করতে পারেনি। যুগে যুগে শ্রীরামচন্দ্র থেকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ, শংকরাচার্য্য স্বামী থেকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ, নানক থেকে কবীর হিন্দুর অন্তঃকরণকে সর্বদা ধর্মময় করে রেখেছেন, কখনো এর কোনো ছেদ ঘটেনি।


বহু আত্মবোধির বহু তপস্যায় হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই প্রচন্ড শক্তিপুঞ্জ আজো এই পুণ্যভূমিতে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে। কাশীর গঙ্গায়, প্রয়াগের সঙ্গমে আর পুষ্করের সরোবরে আজো প্রতিদিন তিতিক্ষার ঢেউ উঠছে, আজো হিন্দু সেই পুণ্যসলিলে অবগাহন করে তার গৌরবময় অতীতের সাথে জুড়ছেন, সদর্থকরূপে প্রভাবিত হচ্ছেন। এই বহমান স্রোতের অক্ষয় শক্তিতে আজো তার অন্তর ধৌত হচ্ছে।


গর্বের সাথে নিজেকে হিন্দু বলতে পারলে হিন্দুত্বের মূল শক্তিকে ছোঁয়া যায়, বিজাতীয় আরোপিত কৃত্তিম সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় গুরুভার ত্যাগ করে ভারতের চিরাচরিত রাষ্ট্রচেতনা, সাংস্কৃতিক পরম্পরা, মনন-চিন্তন, কৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রগতিকে পুনরুজ্জীবিত করার অনুপ্রেরণা উৎপন্ন হয়। 


কাশী, প্রয়াগ, ইন্দ্রপ্রস্থ, অযোধ্যা, উজ্জয়িনী, অমরকন্টক, দ্বারকা, মথুরা হয়ে এই বাংলার কোচ, বর্ধমাননগর, তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়, নবদ্বীপ, কর্ণসুবর্ণ, গৌড় ইত্যাদি প্রত্যেকটি প্রাচীন জনপদের ধূলিকণায় যে উন্নত ভারতবর্ষের গন্ধ ও স্পর্শ মিশে রয়েছে, সেটাই আমাদের জাতির প্রকৃত স্বত্তা, আমাদের গৌরবময় উত্তরাধিকার। 


এই পুণ্যভূমিতেই আমাদের সংস্কারের উৎপত্তি, এইখানেই আমাদের সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার আর এইখানেই বহতি আমাদের মুক্তির উপায়ও বটে। বস্তুতঃ হিন্দু মানে গোটা ভারতরাষ্ট্রবাসীর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এই সহজ সত্যটার মধ্যেই এক অখন্ড মহাশক্তি নিহিত আছে, একবার মুখে উচ্চারণ করলেই যা অন্তরে বাইরে দপ করে জ্বলে ওঠে।

Wednesday, March 9, 2022

আমেরিকা

আমেরিকা - এককালে তৃতীয়বিশ্বের বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ ছিল। হয়তো এখনো সোমালিয়ার কোনো দরিদ্র বস্তিতে বা সিন্ধের কোনো অন্ধকার গলিতে তিতিবিরক্ত হয়ে কিছু মানুষ ভাবেন একবার যদি কোনোরকমে আমেরিকায় পৌঁছানো যায়, জীবনটাই বদলে যাবে আমূল। হয়তো যাবে, বা হয়তো যাবেনা। হয়তো বড়লোকদের দেশের ভিখারিরাও গরিবের দেশের মধ্যবিত্তদের চেয়ে ভালো থাকেন বলে কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন কারণ হয়তো এর মাধ্যমে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশা জাগে, যদিও তাতে আজকের আমেরিকার ক্রম অধঃপতনের বাস্তবকে অস্বীকার করা যায়না। 


হ্যাঁ, আমেরিকা প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে সারা বিশ্বের চোখে আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে, তা সে ইজ্জতেই হোক, প্রভাবেই হোক বা স্বপ্ন সফল করানোর শক্তিতে। ভারত হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর গ্রেট ব্রিটেনের দশা যেমন হয়েছিল বা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশের, আজ আমেরিকার দশা অনেকটা প্রায় সেইরকমই - এক ক্ষয়িষ্ণু মহাশক্তির। মজার ব্যাপার হলো ব্রিটেন বা রুশ দেশের বাইরে সাম্রাজ্য খুইয়ে কাহিল হয়েছিল আর আমেরিকা দেশের ভেতরেই মাত্র কয়েকদিনের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের ধাক্কায় বেলাইন হয়ে গেল। 


আমেরিকানদের এমনই দুর্ভাগ্য যে কতিপয় ঘুষখোর বামপন্থী মিডিয়ার অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে কয়েকটি আগমার্কা অস্ত্র, তেল আর ফার্মা ব্যবসায়ীদের লবির ফাঁদে পা দিয়ে কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের হাতে দেশের পরিচালনভার তুলে দিয়ে তাঁরা নিজেদের দেশের সাড়েসর্বনাশ করে ফেললেন। নতুন প্রশাসনের পাল্লায় পড়ে মাত্র এইকটা দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার কি দুরাবস্তা হলো ভাবা যায়? আজ থেকেই ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এশিয়ার বেশ কিছু ফ্লাইট রদ করতে বাধ্য হয়েছে কারণ রাশিয়ার ওপর দিয়ে না উড়তে পারার ফলে খরচা প্রচুর বেড়ে গেছে। এ তো আর্থিক ক্ষতির সবে শুরু। রুশ হয়তো কিছুদিনের মধ্যে অনেকটাই সামলে নেবে কিন্তু আমেরিকা যে জায়গাটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলো, সেটা আবার দখল করতে পারবে কি?


হু চিনের কব্জায়, রাষ্ট্রসঙ্ঘ হাতের বাইরে, ওপেক কথা শোনে না, ন্যাটো বিভক্ত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিরক্ত, আফগানিস্তানের হঠকারিতার পর কম শক্তিশালী দেশগুলোর কাছেও পশ্চিমী মহাশক্তির মূল্য তলানিতে এসে ঠেকেছে, গত তিরিশ বছরের unipolar world order প্রায় খতম, এবার রাশিয়াকে উস্কানি দিতে গিয়ে বোধহয় ডলারের একচ্ছত্র রমরমাও শেষ হবার জোগাড়! অর্থনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে এতে ইকোনোমিক এন্টিটিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নিজের দেশের স্বাধীন ব্যবসাও পড়ে। আমেরিকার এই যে পতনের শুরু হলো, এর গতি বোধহয় আর রোখা গেল না। 


একটা মহাশক্তির বিশ্বাসযোগ্যতায় যখন আঘাত লাগে, তখন একসাথে এতগুলো বিপরীতধর্মী গুণক কাজ করতে শুরু করে দেয় যে পতন মারাত্মক রকমের ত্বরান্বিত হয়। যেমন মাত্র ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে আমাদের এ তল্লাটে ভারতের গোয়া, দিউ, দাদরা, নগর হাভেলি আর দমন, চিনের মাকাউ আর মালের টিমর দখল করে রাখা এককালের বিশ্বশক্তি মহান পর্তুগাল আজ জিডিপির নিরিখে ৪৯ নম্বরে নেমে গেছে, অন্যদিকে চিন ২ আর ভারত ৬ নম্বরে উঠে এসেছে। 


এই যে রুশ একবার ভিসা আর মাস্টারকার্ড ছেড়ে চিনের ইউনিয়ন পের সাথে জুড়ে গেল, এই যে আমেরিকা রুশের তেল কিনতে অস্বীকার করলেও জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ তা কেনা জারি রাখলো, এই যে হাঙ্গারি ন্যাটোকে সৈন্য বা যুদ্ধের সাজোসমান পাঠাতে মানা করে দিলো, এই যে ইউক্রেনকে প্লেন দেওয়ার ব্যাপারে পোল্যান্ড শুধু না-তেই থামলো না, এটাও বলে দিল যে আমেরিকা অপপ্রচার করছে, এই যে ইউক্রেনের ভেতরে আমেরিকার সাহায্যে চলা জৈবিক ল্যাবরেটরিগুলোর কথা সারা দুনিয়া জেনে গেল আর রুশের ক্ষতি করতে গিয়ে ইউক্রেনকে শিখন্ডি খাড়া করে আমেরিকা সারা বিশ্বকে যে পরমানু যুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলো, এর ফল কি আমেরিকার পক্ষে কোনোদিন ভালো হতে পারে নাকি? 


এখানেই শেষ নয়, আমেরিকার ঘুমন্ত নেতা এখনো মনে করছেন যে তিনি পৃথিবীর দাদা এবং তিনি যা বলবেন সবাই 'জী হুজুর' বলে চুপচাপ মেনে নেবে! একেবারে হাতগরম উত্তরটা বোধহয় আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দিয়েই দিয়েছেন। খবরে প্রকাশ যে বাইডেনসাহেব ওনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন তেলের দাম কমানোর জন্য, উনি ফোন ধরেননি; পুতিনসাহেবের সাথে প্রিন্সের কথাবার্তায় কিন্তু কোনো বিরাম পড়েনি। হায় রে! ট্রাম্পের আমলে যে দেশ আব্রাহাম একর্ডের মতন অসম্ভবকে সম্ভব করে ইজরাইলের সাথে আরবের বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো, যে দেশ চার চারটি বছর একটি গুলিও না ছুঁড়ে নিজের এক নম্বর জায়গাটা সুরক্ষিত রাখার হিম্মত রাখতো, আজ তার কি দুর্দশা! এরই নাম বোধহয় গণতন্ত্র। চিন মনে মনে হাসছে আর সাধারণ আত্মতুষ্ট অর্বাচীন বেচারা ব্লুকলার্ড আমেরিকানরা বুঝতেও পারছেন না অতঃপর তাঁদের পাসপোর্টের মূল্য কিভাবে হু হু করে পড়বে।

Monday, March 7, 2022

জ্ঞান ও কর্ম

 ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যতে একজায়গায় শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য স্বামী বলছেন, 

पुरुषेण कर्तुमकर्तुमन्यथा वा कर्तुं शक्यम् , पुरुषतन्त्रत्वात् । ज्ञानं तु प्रमाणजन्यम् । 

(পুরুষেন কার্তুমকার্তুমন্যথা বা কার্তুম সক্ষম, পুরুষতন্ত্রতয়াৎ । জ্ঞানম তু প্রমানজন্যম ।)


মুখ্যত এই কথাই আচার্য্য বোঝাচ্ছেন যে যিনি কর্ম করছেন তাঁর বুদ্ধি, ইচ্ছা ও সক্ষমতার ওপর তাঁর কর্ম নির্ভরশীল। সেটা যে কোনো প্রমাণিত সত্যের উপর base করেই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, আবেগেরও ভূমিকা থাকতে পারে। জ্ঞান কিন্তু কেবলমাত্র প্রমাননির্ভর। এখানে অন্যতম মজার ব্যাপার হলো এই 'কার্তুমকার্তুমন্যথা বা কার্তুম' শব্দবন্ধটি - ভেঙে ভেঙে পড়লে 'কার্তুম অকার্তুম অন্যথা কার্তুম'। এই একটি শব্দবন্ধের মধ্যে যেন হিন্দু সভ্যতার উদারতার গোটা ভাবটি ধরা আছে। তোমাকে আমার কথা শুনেই চলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তুমি তোমার যে কোনো ধরণের কাজ, তা সে বস্তুগতই হোক বা উপাসনাগত, সেগুলো আমি যে ভাবে বলছি সেভাবে করতেও পারো, নাও করতে পারো অথবা অন্যভাবেও করতে পারো। এখানে আমি মানে বেদ। ধরো তোমায় কোথাও যেতে বলা হয়েছে। এখন, তুমি হেঁটে যাবে না ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাবে না অন্য কোনোভাবে যাবে নাকি আদৌ যাবে না, সেটা সম্পূর্ণভাবে তোমার ব্যাপার - 'পুরুষতন্ত্র'। 


কিন্তু জ্ঞানের বিষয়টি বাপু কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল, ফলে ঐখানে শুধুই 'বস্তুতন্ত্র' - প্রমাণিত সত্য। Eternal Knowledge is an already existent thing, therefore does not offer options; ওটা পেতে গেলে ওই নির্দিষ্ট প্রমান ধরে ধরেই এগোতে হবে কারণ ওটি অপরিবর্তনীয়, নিত্য, সত্য - আগেও যেমনটি ছিল এখনো তেমনটিই আছে, ভবিষ্যতেও একইরকম অপরিবর্তিত থাকবে, ফলে ওতে নিজের জারিজুরি করার খুব একটা scope নেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য চোখ তখনই ব্যবহার করতে পারি যখন দৃষ্টির range-এর মধ্যে কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়ে আর তার form বা রং দেখা যায়। যদি আলো না থাকে বা দৃষ্টির range-এর মধ্যে বস্তুটিই না থাকে, তাহলে দৃষ্টিসক্ষম হলে এবং চোখ ব্যবহার করার ইচ্ছে থাকলেও সেইসময় সেদুটির কোনো উপযোগিতা নেই, ফলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়ার ব্যাপারও নেই। 


এবার তুমি আলো জ্বলার জন্য অপেক্ষা করবে না আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করবে নাকি 'ধুর, এখানে কিছুই দেখার নেই' বলে উল্টো দিকে হাঁটা দেবে, সেটা তোমার কর্ম। সেখানে যেমন কর্ম তেমন ফল। জ্ঞানের ফল কিন্তু অন্যরকম। জ্ঞান বস্তুতঃ বর্তমান এবং তাকে জানতে পারাই যথেষ্ট - it already exists and just knowing it is sufficient. No action is required thereafter to produce it; জ্ঞানের ফল জ্ঞানলাভের মধ্যেই নিহিত থাকে। অবশ্য এখানে পরাবিদ্যা অর্থাৎ পরমজ্ঞান আর অপরাবিদ্যা অর্থাৎ জাগতিক জ্ঞানের মধ্যে শঙ্করাচার্য্য যে পরমজ্ঞানের কথাই আলোচনা করছেন, সেটা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না।

Thursday, March 3, 2022

পাপ থেকে মুক্তি

অদ্বৈত বেদান্ত বড় কঠিন বস্তু, মুখে বলা যত সহজ, যাপনে ধারণ করা তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি কঠিন। মুখে 'আমিই সেই' বললেই তো আর হলো না, গোটা জীবনটা সেই বোধের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে তো - কোটি কোটি বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ক'জনই বা তা অর্জন করতে পেরেছেন? তাই যতক্ষন ভেদাভেদ জ্ঞান থাকবে ততক্ষণ স্বার্থপরতাও থাকবে, এটাই মায়ার জগতের নিয়ম। যদি ভেদাভেদ জ্ঞান একেবারে নির্মূল হয়ে যায়, শুধু শরীরধারণের জন্য যেটুকু 'আমি'র প্রয়োজন কেবল ততটুকুই নামমাত্র অহং পড়ে থাকে, তখন তাঁরা কেউ হয় ত্রৈলঙ্গস্বামী নয় লাহিড়ীমশাই হয়ে যান, তাঁদের ভেতর আর শরীরবোধ বা স্বার্থের লেশমাত্র থাকে না। তবে ক'জন মহাত্মাই বা আর এই আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌঁছতে পারেন, তা তিনি গেরুয়াধারীই হন বা গৃহস্থ? হয়তো অহংবোধ কারো প্রবল, কারো বা দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে খানিকটা স্তিমিত হয়, কারো বা ভগবৎ কৃপায় প্রায় যায় যায়, কিন্তু কিছু না কিছু তো তাও থাকবেই।


পাপকর্ম সরাসরি এই অহংবোধের সঙ্গে যুক্ত। অহং মানে আমি, আমার ইত্যাদি। আমি এত ভালো ভালো কথা বলছি আর ওরা শুনছে না, কি মূর্খ! মনে হঠাৎ এই ধরণের 'আমি পন্ডিত ওরা মূর্খ' ভাবনা কেন এলো? না 'আমি' বোধ প্রবল, তাই। কোন আমি? যে আমিটা আর বছরকয়েক পর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর যার বড়জোর এক-দু প্রজন্ম পর্য্যন্ত দেওয়ালে একখানা ছবি ঝুলবে, তারপর সেটাও টান মেরে ফেলে দেওয়া হবে। আরে, সেসব তো পরের কথা, আমি নিজেই পরের জন্মে এই জন্মের আমিটাকে চিনতে পারবো না, বস্তুটি এতটাই ঠুনকো। এই অহং হলো পুরোপুরি শরীর-নির্ভর, শরীর থাকলে আমি আছি, আমার অহংকার আছে, অন্যদের চেয়ে আমি যে স্বতন্ত্র - সেই বোধ আছে, নীচতা আছে, সুখ ভোগ করার তীব্র বাসনা আছে, অন্যের কাঁধে পা দিয়ে সমাজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তাগিদ আছে, অন্যকে ঠকানো আছে, আস্ফালন আছে, নিন্দামন্দ আছে, অন্যকে দুঃখ দিয়ে নিজের কামনা চরিতার্থ করা আছে - আরো কি কি ধরণের বিষ যে এই 'আমি'র ভেতর ভরা আছে কে জানে বাপু! 


এখন বিষয়টা হলো, এই যে এতদিনের গড়ে ওঠা পাপের কর্মফল, সে কি একবার গঙ্গোত্রীতে গিয়ে মা গঙ্গায় ডুব দিলে বা অমরনাথে গিয়ে মহাদেবের নাম করলেই হটাৎ ভোজবাজির মতন হুশ করে উবে যাবে? কখনো হতে পারে নাকি, না হওয়া উচিত? ব্যবসা করতে গিয়ে ভুরি ভুরি মিথ্যে কথা বলে সারা সপ্তাহ ধরে গ্রাহকদের বেশি দামে বাজে জিনিষ গছিয়ে দিলুম আর শনি বা মঙ্গলবার দেখে কালীঘাটে গিয়ে এক চাঙারি প্যাঁরা কিনে মায়ের পুজো দিয়ে সামনের চাতালে বসা কোনো ভিখারির হাতে পঞ্চাশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে ভাবলুম এইতো, ডেবিট ক্রেডিট দুদিক মিলে গেল - এত সোজা? আবার মায়া এমন এক গ্যাঁড়াকল করেছেন যে প্রত্যেকের জীবনে ভালো সময় আর খারাপ সময় চক্রাকারে আসতে আর যেতেই থাকে। ভালো সময় মানে যখন 'আমি' খুশি, তা সে দুনিয়াজাহান জাহান্নামে যাক, আর খারাপ সময় মানে 'আমি' অসুখী, তাতে কার কি উপকার হলো বয়েই গেল। এই দুঃখের সময়ই তো মানুষের দৈবের কথা মনে পড়ে, কারণ সেখানেও স্বার্থ জড়িয়ে আছে - যদি প্রার্থনা করে আবার সুখের সময়টা তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনা যায়! আসলে পাপ করার পর 'আমায় উদ্ধার করো' বলে কেঁদে আর লাভ কি? আমি পাপ করেছি, আমি পাপী, এসব শুনলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব খুব রেগে যেতেন।  যদি বোঝোই যে ওগুলো পাপকাজ, তাহলে জেনেশুনে সেসব করতে গেলে কেন বাপু? ঠাকুর বদ্ধজীবের এই কপটতা বা hypocrisy একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তবে ব্যতিক্রম কি আর নেই? না থাকলে গিরিশ ঘোষের পাপ নীলকন্ঠ হয়ে গলায় ধারণ করতে গেলেন কেন। ওটা দৈবলীলা।


আমজনকে কর্মফল ভুগতেই হবে, ওতে কোনো ছাড় নেই। ঠাকুর বলছেন, "কি জানো, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহ ধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।" তবে ঠাকুর তো জীবন্ত ইতিবাচকতা, positivity personified, তাই বলছেন, "সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য — এ-সব আত্মার কোনও অপকার করতে পারে না; তবে দেহাভিমানী লোকদের কষ্ট দিতে পারে। ধোঁয়া দেওয়াল ময়লা করে, আকাশের কিছু করতে পারে না।...‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ এ-কথা বলতে বলতে সে ব্যক্তি বদ্ধই হয়ে যায়। যে কেবল বলে ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ সেই শালাই পড়ে যায়! বরং বলতে হয়, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার পাপ কি, বন্ধন কি!" এই বিষয়ে একদিনের একটি কথোপকথন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ: 

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চন্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। — কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে।

“শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুল্লনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল।

“একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না! সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চর্তুভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হল। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।”

মাস্টার — শুধু কারাগার ঘোচা কেন? দেহই তো যত জঞ্জালের গোড়া। দেহটা ঘুচে যাওয়া উচিত ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহ ধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। (সকলের হাস্য) পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।

মণি — যে বাণটা ছোঁড়া গেল, তার উপর কোনও আয়ত্ত থাকে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেহের সুখ-দুঃখ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান, ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে সে ঐশ্বর্য কখনও যাবার নয়। দেখ না, পাণ্ডবের অত বিপদ! কিন্তু এ-বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। তাদের মতো জ্ঞানী, তাদের মতো ভক্ত কোথায়?"  


তবে ঠাকুরের মতন ত্যাগীশ্বর পাওয়া তো আর চট করে সম্ভব নয় কারণ তিনি স্বয়ং পরমব্রহ্ম। কথামৃতে ঠকুরের একটি ঘটনার কথা উল্লেখিত আছে, যা আমাদের সকলকে এই 'আমি'র বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখায়। জীবন থেকে লোভ বাদ দিতে পারলেই মনের ওপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ এসে যায়। আর মন একবার বশে এলে সে অন্তর্মুখী হতে বাধ্য। লক্ষ্মীনারায়ণ নামক একজন মাড়োয়ারী সৎসঙ্গী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন। ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বেদান্তের বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠাকুরের সঙ্গে ধর্মপ্রসঙ্গ করে ও তাঁর বেদান্ত সম্পর্কিত আলোচনা শুনে তিনি বড়ই প্রীত হন। পরিশেষে ঠাকুরের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় বলেন, "আমি দশ হাজার টাকা আপনার সেবার নিমিত্ত দিতে চাই।"  ঠাকুর এই কথা শোনবামাত্র, মাথায় দারুণ আঘাত লাগলে যেমন হয়, মূর্ছাগতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি প্রকাশ ক'রে বালকবৎ হয়ে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, "শালা, তুম্ হিঁয়াসে আভি উঠ্ যাও। তুম্ হামকো মায়াকা প্রলোভন দেখাতা হ্যায়?" উক্ত মাড়োয়ারী ভক্ত একটু অপ্রতিভ হয়ে ঠাকুরকে বললেন, "আপ্ আভি থোড়া কাঁচা হ্যায়।" তার উত্তরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, "ক্যায়সা হ্যায়?" মাড়োয়ারী ভক্ত বললেন, "মহাপুরুষ লোগোকোঁ খুব উচ্চ অবস্থা হোনেসে ত্যাজ্য গ্রাহ্য এক সমান বরাবর হো যাতা হ্যায়, কোই কুছ্ দিয়া অথবা লিয়া উসমে উনকা চিত্তমে সন্তোষ বা ক্ষোভ কুছ্ নেহি হোতা।" ঠাকুর ঐ কথা শুনে ঈষৎ হেসে তাকে বোঝাতে লাগলেন, "দেখ, আর্শিতে কিছু অপরিষ্কার দাগ থাকলে যেমন ঠিক ঠিক মুখ দেখা যায় না, তেমনি যার মন নির্মল হয়েছে, সেই নির্মল মনে কামিনী-কাঞ্চন-দাগ পড়া ঠিক নয়।" ভক্ত মাড়োয়ারী বললেন, "বেশ কথা, তবে হৃদয়, যে আপনার সেবা করে, না হয় তার নামে আপনার সেবার জন্য টাকা থাক।" তদুত্তরে ঠাকুর বললেন, "না, তাও হবে না। কারণ, তার কাছে থাকলে যদি কোন সময় আমি বলি যে অমুককে কিছু দাও বা অন্য কোন বিষয়ে আমার খরচ করতে ইচ্ছা হয়, তাতে যদি সে দিতে না চায় তখন মনে সহজেই এই অভিমান আসতে পারে যে, ও টাকা তো তোর নয়, ও আমার জন্য দিয়েছে। এও ভাল নয়।" 


এই হলো আসল উপায়। গঙ্গাস্নান আক্ষরিক অর্থে পাপ ধোয়ার জন্য নয়, গোড়ার অজ্ঞান ধুয়ে ফেলার মানসিকতা তৈরি করার জন্য উপযোগী। অমরনাথের কষ্টকর দীর্ঘ চড়াই আর উৎরাই মন থেকে অভিমান মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন। আর দরকার খুব করে প্রার্থনা, নিরন্তর তাঁর কৃপা প্রার্থনা। তাঁর কৃপা হলে কর্মফল ভোগ তো কোন ছাড়, জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকেই স্থায়ী ছুটি পাওয়া যেতে পারে। ঠাকুর তাঁর গোটা মর্তলীলা জুড়ে লোককে ডেকে ডেকে, তাদের প্রার্থনাস্থলে গিয়ে, মায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি পর্য্যন্ত গিয়ে মুক্তির পথই দেখিয়ে গেছেন।

সবাইকে শ্রীরামকৃষ্ণ জয়ন্তীর শুভেচ্ছা।

Wednesday, March 2, 2022

প্রসাদ

একজায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একজন পরম ভক্তের একটি মূল্যবান বক্তব্য পড়লাম। তিনি বলেছেন যে ঠাকুর-মাকে ভোগ না দিয়ে তিনি কিছু খান না এবং সেই সব খাবারেরই ভোগ নিবেদন করেন যা ঠাকুর বা মা যখন শরীরে ছিলেন, তখন খেতেন। মানতেই হবে যে অত্যন্ত শুদ্ধ বিচার এবং অবশ্যই অনুকরণযোগ্য। এও এক রকমের তপস্যা তো বটেই কারণ আমরা বেশিরভাগই রসনা তথা ইন্দ্রিয়ের দাস। 


আমরা কিন্তু বাপু অতশত মানতে পারিনা। মা বা ঠাকুর হয়তো তাঁদের মর্তলীলার সময়ে কখনো চকোলেট, এপেল টার্ট বা অরেঞ্জ কাস্টার্ড বা ব্লুবেরি চিজকেক জেলাটো খাননি, আমরা কিন্তু সে সব নির্দ্বিধায় ভোগে নিবেদন করি। হ্যাঁ, মুরগির মাংসটা দেওয়া হয়না কারণ মা ও ঠাকুর কেউই ওটা খেতেন না, সে সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষরাও ওসব খেতেন না। ফলে এখন স্প্যাঘাটি বা ফ্রায়েড রাইস রান্না হলে মুরগির মাংস মেশানোর আগে হয় ঠাকুরের ভোগের জন্য আলাদা করে পরিমাণমত তুলে রাখা হয় অথবা পুরোটা নিরামিষই তৈরি করা হয়।


আমাদের বাড়িতে মা আর ঠাকুর রোজকার ডাল ভাত তরকারি মাছ ছাড়াও সেই সবকিছুই খান যা আমরা নিজেরা খেতে ভালোবাসি। আর ওঁরা খান বলেই না মাঝে মধ্যে আমাদেরও সে সব উৎকৃষ্ট খাদ্য জোটে, নইলে তো জীবন থেকে উজ্জ্বলার চানাচুর থেকে নিয়ে আপনজনের মাছের কবিরাজি - সবই বাদ পড়ে যেত। বাড়ির বাইরে কোথাও খেতে গেলে কি কি দিয়ে, কিভাবে, কোন ভাবনা নিয়ে কে যে সেসব তৈরি করেছেন তাতো আর জানিনা, তখন মনে মনে মা আর ঠাকুরকে বলি প্লেটে যা দিয়েছে দয়া করে তোমরাও চুপচাপ খেয়ে নাও, এতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।


হয়তো ভবিষ্যতে খাদ্যের ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দ আরো পাল্টে যাবে। তখন হয়তো আমরা এই শরীরে থাকবো না কিন্তু মা ও ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন তো থাকবে। আমাদের বর্তমান পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি নেহাত দুর্ভাগা হয়, সেখানে হয়তো নিত্যভোগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যত্র, সারা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য কত শত শত ভক্তদের গৃহে তা প্রতিদিন ভক্তিভরে ঠিকই নিবেদিত হবে। তখন মা আর ঠাকুর নিশ্চয় সেই সময়কার খাবার তৃপ্তি করে খাবেন আর তাঁদের সেই প্রসাদ গ্রহণ করে কত না ভক্তের জীবনও প্রতিদিন ধন্য হবে।


নেহাত অখাদ্য আর কুখাদ্য ছাড়া, ভোগ রান্নার কোনো উপাদানই মুখ্য নয়, রান্না আর নিবেদনের সময়ে ভক্তের ভাবটাই আসল। ওই খাবারই মানুষ খেলে উচ্ছিষ্ট আর দেবতা খেলে প্রসাদ, দুইয়ে বিস্তর পার্থক্য। আমি নিজে ভোগ রাঁধলে শুদ্ধতা বজায় রেখে অবশ্যই নুন মিষ্টি ঝাল ইত্যাদি বারেবারে চেখে দেখি, মা আর ঠাকুরকে বিস্বাদ খাবার খেতে দেবো কোন দুঃখে? তাতে যদি কেউ মনে করেন ভোগ উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে, ভারী বয়েই গেল। 


প্রসাদ মানে হাতে হাতে দেবতার সাক্ষাৎ কৃপালাভ, সর্বমঙ্গলময় কল্যাণকারী দৈবীকৃপা, যা মানুষের তৈরি খাদ্য হয়েও দেবতার অনুগ্রহলাভ করেছে, এ কি আর সামান্য জিনিষ? দেবতার প্রসাদের প্রতিটি কণায় সেই অমোঘ দৈবীশক্তি থাকে যা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলে গ্রহীতার বোধ আর বুদ্ধি ধীরে ধীরে আধ্যাত্মপথে চালিত হয়ে ক্রমশঃ তাঁর অন্তরে মানবদেহলাভের উদ্দেশ্যসাধনের ইচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে। প্রসাদলাভ হলো কৃপালাভের প্রথম ইঙ্গিত। তারপরের ধাপগুলো তো কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।


ঠাকুর একদিন কথাপ্রসঙ্গে ভক্তদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের অতি গুহ্য কথা বলছি। জগন্নাথের সঙ্গে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে গিয়েই না হাত ভেঙ্গে গেল। জানিয়ে দিলে,"তুমি শরীর ধারণ করেছ এখন নররূপের সঙ্গে সখ্য, বাৎসল্য এইসব ভাব লয়ে থাক"।’ ভক্তদের পুরীতে জগন্নাথদর্শনে পাঠাতেন কিন্তু নিজে যেতেন না। বলতেন, 'ওখানে গেলে এ শরীর থাকবে না'। সেই জগন্নাথদেবের প্রসাদ ছিল ঠাকুরের কাছে মহাপবিত্র বস্তু। সবসময় কাছে রাখতেন। অনেক ভক্তকেও জগন্নাথদেবের 'আটকে' প্রসাদ খেতে দিতেন। বলতেন, "ওতে ভগবানে ভক্তি হয়, হৃদয় পবিত্র হয়।"


শ্রীশ্রীমায়ের প্রসাদ সম্পর্কে শ্রীমতি সরযূবালা সেন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন:

'ক্রমে ক্রমে অনেক স্ত্রী-ভক্ত আসতে লাগলেন। 

ভক্তি-বিগলিত চিত্তে সকলেই শ্রীশ্রীমায়ের হাসিমাখা স্নেহভরা মুখখানির পানে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন, ওরূপ দৃশ্য আমি আর কখনাে দেখিনি। 

মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছি, এমন সময় বাসায় ফিরবার তাগিদ এলাে—গাড়ি এসেছে। 

শ্রীশ্রীমা তখন উঠে প্রসাদ দিয়ে ‘খাও খাও’ করে একেবারে মুখের কাছে ধরলেন। 

অত লােকের মধ্যে একলা অমন করে খেতে আমার লজ্জা হচ্ছে দেখে বললেন, “লজ্জা কি ? নাও।”

তখন হাত পেতে নিলুম। 

“তবে আসি, মা”, বলে প্রণাম করে বিদায় নেবার সময় বললেন, “এস মা, এস, আবার এস।

একলা নেমে যেতে পারবে তাে ?

আমি আসব ?” 

এ বলে সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। 

তখন আমি বললুম, 

আমি যেতে পারব, মা। আপনি আর আসবেন না।

শ্রীশ্রীমা তাই শুনে বললেন, “আচ্ছা, একদিন সকালে এস।”

পরিপূর্ণ প্রাণে ফিরলুম। ভাবলুম—এ কি অদ্ভুত স্নেহ !


মায়ের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের তাৎপর্য অশেষ, একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে। প্রথমে ভক্তের জড়তা কাটিয়ে নিজের হাতে প্রসাদ খাওয়ানো, তারপর "আবার এস" বলা, তারপর নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ভক্তকে অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখানো যতক্ষণ না তিনি আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন, আর তারপর অন্ধকারে নয়, আলোর ভুবনে তাঁর সামনে প্রকাশিত হওয়ার আশ্বাস - জগ্গজননী মহামায়ার লীলা কে বুঝবে?  ভক্ত একবার উজিয়ে তাঁর কাছে গেলেই হলো, তিনি ঠিক কোলে তুলে নেবেন। ওই প্রসাদ খাওয়া দিয়ে শুভারম্ভ থেকে নিয়ে 'তমসো মা জ্যোতির্গময়' অবধি গোটা পথটি একমাত্র তাঁরই কৃপাতে তাঁরই হাত ধরে যাত্রা করা সম্ভব। জয় মা, জয় ঠাকুর।

স্বধর্ম

যখন যা কর, তখনকার মতো তাই হবে ভগবৎ-সেবা। - স্বামী বিবেকানন্দ (পত্রাবলী ২৬/০৮/১৮৯৬)

প্রতিবছর শিবরাত্রির পবিত্র রাতে মহাদেব স্বধর্ম পালন করতে আগ্রহী পুণ্যার্থীদের কৃপারূপ উর্যা প্রদান করেন। গতকাল রাত তাই বিশেষরূপে মহত্বপূর্ণ ছিল, যার পুণ্য রেশ আজও ভূমণ্ডলে রয়েছে, একটু সংবেদনশীল মন হলেই সর্বত্র অনুভব করতে পারা যাবে। এই স্বধর্ম পালনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব একদিন একটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় গল্প বলেছিলেন। অনেকদিন ধরে জঙ্গলে ঘোর তপস্যা করে, বহুবছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে, আরো অনেক বেশি বছর মাথা নিচু আর পা ওপরে করে থেকে এক সাধুর কিছু ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। একদিন কাছের একটি গাছের ডালে বসে একটা কাক বড় কা কা করে চেঁচাচ্ছিল, যেই রেগে গিয়ে তিনি তার দিকে কটমট করে তাকালেন অমনি কাকটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সাধু তখন খুব খুশি, এতদিনের তপস্যার বিরাট একটা ফল ফলেছে ভেবে বেশ গর্বিতও বটে। অবশ্য আগুন জ্বালানোর কাজ তো কয়েক পয়সার একটা সামান্য দেশলাই দিয়েই সেরে ফেলা যায়, তার জন্য এতদিন উল্টো হয়ে পড়ে থাকার কি দরকার ছিল তা ঈশ্বরই জানেন। 


যাইহোক, সেই সাধুর খিদে পাওয়ায় জঙ্গলের ঠিক বাইরে একটি গ্রামে এক গৃহস্থ বাড়ীর দরজায় গিয়ে 'ভিক্ষাং দেহি' বলে হুঙ্কার ছাড়লেন। ভেতর থেকে এক গৃহবধূ বিনীতভাবে উত্তর দিলেন, "বাবা, উঠোনের গাছের ছায়ায় একটু ঠান্ডা হয়ে বসো, আমি আমার স্বামী-সন্তানদের ভাত দিচ্ছি, ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই তোমায় ভিক্ষা দেবো"। সাধু তখন মনে মনে ভাবছেন, 'বেটি তো জানে না আমি কে, আমি রেগে গেলে ওর সব ভস্ম করে দিতে পারি, তাই আমায় অমন অবহেলায় বসিয়ে রাখছে'। যেই না ভেবেছেন অমনি ভেতর থেকে গৃহবধূর গলা শোনা গেল, "বাবা, আমরা কাকপক্ষী নই যে তুমি আমাদের ভস্ম করে দেবে। চুপ করে ঠান্ডা হয়ে বসো, আমার হাত খালি হলেই তোমার সেবা করবো"। সাধু তো একেবারে অবাক! একজন সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ, তিনি দূর থেকে কি করে সাধুর মনের কথা জানালেন? খানিকক্ষণ পর মুখোমুখি হতেই সাধু বধূকে জিজ্ঞেস করলেন, "মা, আপনি কি করে এই ক্ষমতা পেলেন?" বধূটি লজ্জিত হয়ে বললেন, "বাবা, আমি আজীবন কেবলমাত্র স্বধর্ম পালন করেছি"। 


গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,

श्रेयान्स्वधर्मो विगुण: परधर्मात्स्वनुष्ठितात् ।

स्वधर्मे निधनं श्रेय: परधर्मो भयावह: ।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৩য় অধ্যায়: কর্মযোগ, শ্লোক ৩৫)

It is far better to perform one’s natural prescribed duty, though tinged with faults, than to perform another’s prescribed duty, though perfectly well. In fact, it is preferable to die in the discharge of one’s duty, than to follow the path of another, which is fraught with danger.

না জেনে অনেকে এই শ্লোকটিকে পন্থের (religion) নিরিখে ব্যবহার করে থাকেন বটে, কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হলো প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা। যিনি যখন চতুর্রাশ্রমের যে আশ্রমে বিরাজ করছেন, তখন একনিষ্ঠভাবে সেই আশ্রমের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্ম পালনই তাঁর স্বধর্ম। একইসঙ্গে, তিনি চতুর্বর্ণের অর্থাৎ পালিত কর্মের গুনগত শ্রেণীবিভাগ অনুসারে যে বর্ণে যখন আছেন, তখন সেই বর্ণ অনুযায়ী যা তাঁর কর্তব্য, একনিষ্ঠভাবে সেটি পালন করাও তাঁর স্বধর্ম। ধর্ম মানে সেই মানবিক মূল্যবোধ যা সমস্ত কর্তব্য - অকর্তব্যের মানক।


শরীরধারণ করতে গেলে কর্ম অবশ্যম্ভাবী, তাই হিন্দুশাস্ত্রে কর্মকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে - নিকৃষ্ট, মধ‍্যম, উত্তম আর অতি উত্তম। সাধকের সুবিধার জন্য এই শ্রেণী বিভাগকে স্তর অনুসারে শূদ্র, বৈশ‍্য, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণের নাম দেওয়া হয়েছে। শূদ্র স্থিতি (সেবাকর্ম) থেকে আরম্ভ করে আশ্রম অনুসারে স্বধর্ম পালন করতে করতে সেই স্তরের ক্রমন্নতি ঘটিয়ে সাধককে ব্রাহ্মণের স্থিতিতে পৌঁছতে হয়। ব্রাহ্মণ মানে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি, সামাজিক কুসংস্কার অনুসারী পুরুষানুক্রমিকরূপে পৈতাধারী কোনো অজ্ঞান ব্যক্তি নন। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীবনের প্রতিটি স্তরে স্বধর্ম অনুসারে নিরাসক্তভাবে কর্ম করতে করতে মানুষ যখন অবশেষে কর্মফলের আশা ত্যাগ করতে সক্ষম হন, তখন তিনি সন্ন্যাসী, তাঁর ঈশ্বর দর্শনের পথ তখন প্রশস্ত হয়। ওই স্তিতিতে কোনকিছুই আর তাঁর কাছে অজ্ঞাত নয়। তখন সর্বদা তাঁর মনের মধ্যে নিত্যের সাথে একাত্মতার সুর ভেসে চলে,

मनो बुद्ध्यहंकारचित्तानि नाहम् न च श्रोत्र जिह्वे न च घ्राण नेत्रे ।

न च व्योम भूमिर् न तेजॊ न वायु: चिदानन्द रूप: शिवोऽहम् शिवॊऽहम् ।।

(শ্রীমৎ শংকরাচার্য্য বিরোচিত নির্বাণ শতকম, শ্লোক ১)

I am not mind, nor intellect, nor ego, nor the reflections of inner self. I am not the five senses. I am beyond that. I am not the ether, nor the earth, nor the fire, nor the wind (i.e. the five elements). I am indeed That Eternal Knowledge and Eternal Bliss, That Eternal Love and Eternal Consciousness. I am Shiva, I am Shiva.

মহাদেবের কৃপা আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হোক।