মোটামুটি সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিটি প্রশ্নবিমুখ বিশ্বাসভিত্তিক গোঁড়া পন্থই এই তিনটি place, time, separation and causetion-এর কথা বলে:
১. ঈশ্বর স্বর্গে থাকেন;
২. ঈশ্বর আর জীব আলাদা;
৩. ঈশ্বরের কথামতো কাজ করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হয়।
এই ধারণা শুধুমাত্র বিদেশি আব্রাহাম-সম্বন্ধীয় পন্থ বা মতবাদ সমূহে সীমিত নয়, আমাদের দেশেও এমন বিশ্বাসভিত্তিক বহু পন্থ এবং পন্থীয় সংগঠন আছে। এখানে মূল বিষয় হলো বিশ্বাস। কেউ একজন বলে দিয়েছেন যে ঈশ্বর আছেন, এই তাঁর নাম, তিনি ওমুক জায়গায় থাকেন, ওমুক তাঁর বার্তাবাহক, তিনি এই এইসব অবশ্যকর্তব্য ধার্য করে দিয়েছেন আর সেইমতো চললে মৃত্যুর পর তাঁর সাথে দেখা হবে - এই সমস্তটা চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিয়ে সেটিকে কেন্দ্র করেই সারা জীবনটা কাটাতে হবে। কেউ কেউ তো আবার বিশ্বাসে এতটাই অন্ধ হন যে অন্য কেউ যদি সেই মতে বিশ্বাসী না হন, তাঁকে বাধ্য করতেও পিছপা হন না কারণ সেটাও তিনি তাঁর ঈশ্বর নির্দিষ্ট কর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন। পাশ্চাত্যে তাই পন্থকে religion ছাড়াও faith বলে - faith মানে বিশ্বাস।
বিশ্বাসের একটা মজা হলো, এতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজন নেই, বস্তুতঃ স্থানও নেই। যেহেতু ঈশ্বর আর আমি আলাদা আর যেহেতু যা কিছু ঈশ্বরীয় অভিজ্ঞতা হবে সব মৃত্যুর পর, ফলে এই জীবনে কেবলমাত্র পূর্বনির্দিষ্ট কিছু routine বা code মেনে চলতে পারলেই নিজেকে যথেষ্ট religious বলে মনে করা যায়। পুরো বিষয়টাই যেহেতু কারো না কারো কল্পনাপ্রসূত (কারণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকলে তো আর যুক্তিহীন বিশ্বাসকে establish করার প্রয়োজন হতো না), ফলে জাগতিক যা কিছু সুখদায়ী, যা কিছু লোভনীয়, সবকিছু স্বর্গে সহজলভ্য বলে বর্ণিত। এককথায় বলতে গেলে, মানুষকে প্রলুব্ধ করে তাকে একটি অলীক কল্পনায় বিশ্বাস করানোই হলো faith বা organised religion-এর প্রভাববিস্তারের ভিত্তি।
বিশ্বাস আর ভক্তি কিন্তু এক জিনিস নয়। আমার বাবা-মাকে আমি ভক্তি করি কারণ তাঁদের অপত্যস্নেহ এবং আমার খুশির জন্য তাঁদের sacrifice আমি প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি যে। ধরে নেওয়া যাক তাঁরা আমার জৈবিক বাবা-মা নন, তাতেও তাঁদের প্রতি আমার feelings একটুও কমবে না। এটা ভক্তি। আবার ধরে নেওয়া যাক আমার যাঁরা জৈবিক বাবা-মা, তাঁরা জন্মের পরেই আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, বহুদিন পর হটাৎ পরিচয় হলো। কেবল বিশ্বাস নয়, DNA পরীক্ষা করে একেবারে নিশ্চিতও নাহয় হওয়া গেল। কেবলমাত্র বাবা-মা, এই পরিচয়ের জন্যই কি তাঁদের প্রতি আমার ভক্তি একেবারে উথলে উঠবে? সম্ভবত না। বিশ্বাস irrational হতে পারে, ভক্তি কিন্তু অনুভূতিভিত্তিক, ফলে rational - অপাত্রে হতে পারে, কিন্তু অমূলক কখনো নয়।
ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য:
১. যাঁকে ভক্তি করবো তাঁর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক থাকা চাই অর্থাৎ ভক্তি সম্পূর্ণরূপে অনুরাগভিত্তিক;
২. ভক্তির মূলে হচ্ছে প্রেম - এক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম;
৩. জাগতিক বস্তুর প্রতি বৈরাগ্য বা নির্লিপ্ততা ভক্তির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
লক্ষ্যনীয় যে ভক্তির এই পুরো ধারণাটা কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের চেয়ে একদমই আলাদা। এর শুরুও আলাদা, শেষটাও আলাদা। মীরাবাই যখন শ্রীকৃষ্ণকে স্বামীরূপে বরণ করে নিচ্ছেন, তখন তিনি তাঁর একান্ত অনুরাগিনী পরম নিবেদিতপ্রাণা প্রেমিকা হিসেবে নিজেকে দেখছেন, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম। তাঁর থেকে তাঁর ঈশ্বর আলাদা নন, দৈনন্দিন যাপনে সম্পৃক্ত। তাঁর প্রেমিকরূপী ঈশ্বর কোনো কল্পিত স্বর্গে থাকেন না, সূক্ষ্মরূপে থাকেন মীরাবাইয়ের অন্তরে আর বাহ্যিক মূর্তরূপে তাঁর ঘরের ভেতর, পূজাবেদীতে। এখানে ভক্ত ও ভগবানের মিলন এই জীবদ্দশাতেই, কোনো মরণের পারে নয়। শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রেও এটাই দেখা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তাইই, যদিও প্রেমের সম্পর্কগুলো হয়তো আলাদা। শ্রীরামকৃষ্ণ যে মাতৃরূপা মহাশক্তিকে দিনরাত প্রত্যক্ষরূপে দেখছেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন, খাওয়াচ্ছেন, সাজাচ্ছেন, তিনি জীবন্ত, চিন্ময়ী, সাক্ষাৎ বিদ্যমানা।
এখন প্রশ্ন হলো, ভক্তির উৎস যদি কোনো preconceived codified blind faith না হয়, তাহলে ঈশ্বর যে আছেন এবং তাঁকে এই জীবনে, এই সময়েই প্রত্যক্ষরূপে অনুভব করা যায় - এই realisation আসবে কোত্থেকে? বিচার থেকে। গোটা বিশ্বে সেই বিচারের উৎস মূলতঃ বেদ আর মূল বিচার্য বিষয় হলো 'আমি কে?'। এই যে আমি হাঁটছি, চলছি, ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, রেগে যাচ্ছি, দুঃখ পাচ্ছি, হাসছি, আনন্দ পাচ্ছি - এটাই কি আসল আমি? তাহলে স্বপ্নে যে false 'আমি'কে দেখা যায়, তাকে কোন 'আমি' দেখে? আর গভীর সুষুপ্তিতে যখন এই বাহ্যিক দৈহিক বা false আমিবোধ কোনোটাই থাকে না, তখনও যে 'আমি' জেগে থেকে সুষুপ্তির তৃপ্তিবোধ অনুধাবন করে - সেই বা কে? এটা একটা দিক। আর অন্যদিক হলো, যে যেমন কাজ করে তার তো তেমন ফল পাওয়া উচিত। যে ছাত্র খুব মন দিয়ে sincerely পড়াশুনা করে, তার ভালো নম্বরই পাওয়া উচিৎ। কিন্তু আমরা কি দেখি? একজন সৎ সংবেদনশীল ব্যক্তি, জ্ঞানত কোনো পাপকর্ম করেননি, অথচ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অশেষ জাগতিক দুর্গতি ভোগ করছেন - কেন এমন হবে? হিসেব তো মিলছে না। তাহলে কি জীবনের কোনো অবিচ্ছিন্নতা আছে - এক জন্মের কুকর্মফল অন্যজন্মে ভোগ করতে হচ্ছে?
তাহলে নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এটা যখন বোঝা যায় যে এই রক্ত মাংসের শরীর-মনটা সত্যিকারের আমি নই এবং আমাকে বারেবারে জন্মাতে আর মরতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্ৰশ্ন ওঠে - কেন? এই যে এতসব সম্পর্ক, কেউ পরিবার, কেউ আত্মীয়, কেউ বন্ধু ইত্যাদি, এসব তো আগের জন্মেও ছিল, সব গেল কোথায়? তাহলে কি অস্থায়ী জাগতিক সম্পর্কগুলোর চেয়েও কোনো meaningful স্থায়ী সম্পর্ক আছে? আর প্রশ্ন ওঠে এই দুঃখকষ্টের জীবন থেকে চিরকালের মতন মুক্তি পাওয়ার উপায় কি? যেই মন স্থায়িত্বের দিকে মোড় নেয়, অমনি অস্থায়ী সমস্তকিছুর চাহিদা কমতে শুরু করে আর যেহেতু বাইরের জগৎটা distracting, মন অন্তর্মুখী হয়। সে তার permanent স্বত্তাকে খুঁজতে থাকে। সবাই খোঁজেন না অবশ্য - যাঁর মনে বিচার উদয় হয়, তিনি খোঁজেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "মানুষ দুরকম - মানুষ ও মানহুঁশ। যাঁরা ভগবানের জন্য ব্যাকুল তাঁদের মানহুঁশ বলে; আর যারা কামিনী-কাঞ্চনরূপ বিষয় নিয়ে মত্ত, তারা সব সাধারণ মানুষ।" বলছেন, "ভগবান সকলকার ভেতর কিরূপে বিরাজ করেন জান? যেমন চিকের ভেতর বড়লোকের মেয়েরা থাকে। তারা সকলকে দেখতে পায়, কিন্তু তাদের কেউ দেখতে পায় না; ভগবান ঠিক সেইরূপে বিরাজ করছেন।" আর বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান দেখা দেন।" মায়া সরে গেল, আসল আমির সাথে যোগাযোগ হলো - এই হলো আসল জ্ঞানপ্রাপ্তি।
এই উপলব্ধির পথে তাহলে ভক্তির ভূমিকাটি কি? শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, "পানাপুকুরে নেবে যদি পানাকে সরিয়ে দাও আবার তখন এসে জোটে; সেই রকম মায়াকে ঠেলে দিলেও আবার মায়া এসে জোটে। তবে যদি পানাকে সরিয়ে বাঁশ বেঁধে দেওয়া যায়, তা হলে আর বাঁশ ঠেলে আসতে পারে না। সেই রকম মায়াকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞান ভক্তির বেড়া দিতে পারলে আর মায়া তার ভেতর আসতে পারে না। সচ্চিদানন্দই কেবলমাত্র প্রকাশ থাকেন।" ভক্তির আধার হলো প্রেম, ভালোবাসা। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয় — তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, — সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়।
"এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়।
"ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিক ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়।
"তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, ‘আমিই কালী’।
"গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ।’
"তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন — প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক, তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।"