Wednesday, March 9, 2022

আমেরিকা

আমেরিকা - এককালে তৃতীয়বিশ্বের বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ ছিল। হয়তো এখনো সোমালিয়ার কোনো দরিদ্র বস্তিতে বা সিন্ধের কোনো অন্ধকার গলিতে তিতিবিরক্ত হয়ে কিছু মানুষ ভাবেন একবার যদি কোনোরকমে আমেরিকায় পৌঁছানো যায়, জীবনটাই বদলে যাবে আমূল। হয়তো যাবে, বা হয়তো যাবেনা। হয়তো বড়লোকদের দেশের ভিখারিরাও গরিবের দেশের মধ্যবিত্তদের চেয়ে ভালো থাকেন বলে কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন কারণ হয়তো এর মাধ্যমে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশা জাগে, যদিও তাতে আজকের আমেরিকার ক্রম অধঃপতনের বাস্তবকে অস্বীকার করা যায়না। 


হ্যাঁ, আমেরিকা প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে সারা বিশ্বের চোখে আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে, তা সে ইজ্জতেই হোক, প্রভাবেই হোক বা স্বপ্ন সফল করানোর শক্তিতে। ভারত হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর গ্রেট ব্রিটেনের দশা যেমন হয়েছিল বা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশের, আজ আমেরিকার দশা অনেকটা প্রায় সেইরকমই - এক ক্ষয়িষ্ণু মহাশক্তির। মজার ব্যাপার হলো ব্রিটেন বা রুশ দেশের বাইরে সাম্রাজ্য খুইয়ে কাহিল হয়েছিল আর আমেরিকা দেশের ভেতরেই মাত্র কয়েকদিনের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের ধাক্কায় বেলাইন হয়ে গেল। 


আমেরিকানদের এমনই দুর্ভাগ্য যে কতিপয় ঘুষখোর বামপন্থী মিডিয়ার অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে কয়েকটি আগমার্কা অস্ত্র, তেল আর ফার্মা ব্যবসায়ীদের লবির ফাঁদে পা দিয়ে কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের হাতে দেশের পরিচালনভার তুলে দিয়ে তাঁরা নিজেদের দেশের সাড়েসর্বনাশ করে ফেললেন। নতুন প্রশাসনের পাল্লায় পড়ে মাত্র এইকটা দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার কি দুরাবস্তা হলো ভাবা যায়? আজ থেকেই ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এশিয়ার বেশ কিছু ফ্লাইট রদ করতে বাধ্য হয়েছে কারণ রাশিয়ার ওপর দিয়ে না উড়তে পারার ফলে খরচা প্রচুর বেড়ে গেছে। এ তো আর্থিক ক্ষতির সবে শুরু। রুশ হয়তো কিছুদিনের মধ্যে অনেকটাই সামলে নেবে কিন্তু আমেরিকা যে জায়গাটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলো, সেটা আবার দখল করতে পারবে কি?


হু চিনের কব্জায়, রাষ্ট্রসঙ্ঘ হাতের বাইরে, ওপেক কথা শোনে না, ন্যাটো বিভক্ত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিরক্ত, আফগানিস্তানের হঠকারিতার পর কম শক্তিশালী দেশগুলোর কাছেও পশ্চিমী মহাশক্তির মূল্য তলানিতে এসে ঠেকেছে, গত তিরিশ বছরের unipolar world order প্রায় খতম, এবার রাশিয়াকে উস্কানি দিতে গিয়ে বোধহয় ডলারের একচ্ছত্র রমরমাও শেষ হবার জোগাড়! অর্থনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে এতে ইকোনোমিক এন্টিটিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নিজের দেশের স্বাধীন ব্যবসাও পড়ে। আমেরিকার এই যে পতনের শুরু হলো, এর গতি বোধহয় আর রোখা গেল না। 


একটা মহাশক্তির বিশ্বাসযোগ্যতায় যখন আঘাত লাগে, তখন একসাথে এতগুলো বিপরীতধর্মী গুণক কাজ করতে শুরু করে দেয় যে পতন মারাত্মক রকমের ত্বরান্বিত হয়। যেমন মাত্র ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে আমাদের এ তল্লাটে ভারতের গোয়া, দিউ, দাদরা, নগর হাভেলি আর দমন, চিনের মাকাউ আর মালের টিমর দখল করে রাখা এককালের বিশ্বশক্তি মহান পর্তুগাল আজ জিডিপির নিরিখে ৪৯ নম্বরে নেমে গেছে, অন্যদিকে চিন ২ আর ভারত ৬ নম্বরে উঠে এসেছে। 


এই যে রুশ একবার ভিসা আর মাস্টারকার্ড ছেড়ে চিনের ইউনিয়ন পের সাথে জুড়ে গেল, এই যে আমেরিকা রুশের তেল কিনতে অস্বীকার করলেও জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ তা কেনা জারি রাখলো, এই যে হাঙ্গারি ন্যাটোকে সৈন্য বা যুদ্ধের সাজোসমান পাঠাতে মানা করে দিলো, এই যে ইউক্রেনকে প্লেন দেওয়ার ব্যাপারে পোল্যান্ড শুধু না-তেই থামলো না, এটাও বলে দিল যে আমেরিকা অপপ্রচার করছে, এই যে ইউক্রেনের ভেতরে আমেরিকার সাহায্যে চলা জৈবিক ল্যাবরেটরিগুলোর কথা সারা দুনিয়া জেনে গেল আর রুশের ক্ষতি করতে গিয়ে ইউক্রেনকে শিখন্ডি খাড়া করে আমেরিকা সারা বিশ্বকে যে পরমানু যুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলো, এর ফল কি আমেরিকার পক্ষে কোনোদিন ভালো হতে পারে নাকি? 


এখানেই শেষ নয়, আমেরিকার ঘুমন্ত নেতা এখনো মনে করছেন যে তিনি পৃথিবীর দাদা এবং তিনি যা বলবেন সবাই 'জী হুজুর' বলে চুপচাপ মেনে নেবে! একেবারে হাতগরম উত্তরটা বোধহয় আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দিয়েই দিয়েছেন। খবরে প্রকাশ যে বাইডেনসাহেব ওনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন তেলের দাম কমানোর জন্য, উনি ফোন ধরেননি; পুতিনসাহেবের সাথে প্রিন্সের কথাবার্তায় কিন্তু কোনো বিরাম পড়েনি। হায় রে! ট্রাম্পের আমলে যে দেশ আব্রাহাম একর্ডের মতন অসম্ভবকে সম্ভব করে ইজরাইলের সাথে আরবের বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো, যে দেশ চার চারটি বছর একটি গুলিও না ছুঁড়ে নিজের এক নম্বর জায়গাটা সুরক্ষিত রাখার হিম্মত রাখতো, আজ তার কি দুর্দশা! এরই নাম বোধহয় গণতন্ত্র। চিন মনে মনে হাসছে আর সাধারণ আত্মতুষ্ট অর্বাচীন বেচারা ব্লুকলার্ড আমেরিকানরা বুঝতেও পারছেন না অতঃপর তাঁদের পাসপোর্টের মূল্য কিভাবে হু হু করে পড়বে।

No comments:

Post a Comment