Wednesday, March 2, 2022

প্রসাদ

একজায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একজন পরম ভক্তের একটি মূল্যবান বক্তব্য পড়লাম। তিনি বলেছেন যে ঠাকুর-মাকে ভোগ না দিয়ে তিনি কিছু খান না এবং সেই সব খাবারেরই ভোগ নিবেদন করেন যা ঠাকুর বা মা যখন শরীরে ছিলেন, তখন খেতেন। মানতেই হবে যে অত্যন্ত শুদ্ধ বিচার এবং অবশ্যই অনুকরণযোগ্য। এও এক রকমের তপস্যা তো বটেই কারণ আমরা বেশিরভাগই রসনা তথা ইন্দ্রিয়ের দাস। 


আমরা কিন্তু বাপু অতশত মানতে পারিনা। মা বা ঠাকুর হয়তো তাঁদের মর্তলীলার সময়ে কখনো চকোলেট, এপেল টার্ট বা অরেঞ্জ কাস্টার্ড বা ব্লুবেরি চিজকেক জেলাটো খাননি, আমরা কিন্তু সে সব নির্দ্বিধায় ভোগে নিবেদন করি। হ্যাঁ, মুরগির মাংসটা দেওয়া হয়না কারণ মা ও ঠাকুর কেউই ওটা খেতেন না, সে সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষরাও ওসব খেতেন না। ফলে এখন স্প্যাঘাটি বা ফ্রায়েড রাইস রান্না হলে মুরগির মাংস মেশানোর আগে হয় ঠাকুরের ভোগের জন্য আলাদা করে পরিমাণমত তুলে রাখা হয় অথবা পুরোটা নিরামিষই তৈরি করা হয়।


আমাদের বাড়িতে মা আর ঠাকুর রোজকার ডাল ভাত তরকারি মাছ ছাড়াও সেই সবকিছুই খান যা আমরা নিজেরা খেতে ভালোবাসি। আর ওঁরা খান বলেই না মাঝে মধ্যে আমাদেরও সে সব উৎকৃষ্ট খাদ্য জোটে, নইলে তো জীবন থেকে উজ্জ্বলার চানাচুর থেকে নিয়ে আপনজনের মাছের কবিরাজি - সবই বাদ পড়ে যেত। বাড়ির বাইরে কোথাও খেতে গেলে কি কি দিয়ে, কিভাবে, কোন ভাবনা নিয়ে কে যে সেসব তৈরি করেছেন তাতো আর জানিনা, তখন মনে মনে মা আর ঠাকুরকে বলি প্লেটে যা দিয়েছে দয়া করে তোমরাও চুপচাপ খেয়ে নাও, এতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।


হয়তো ভবিষ্যতে খাদ্যের ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দ আরো পাল্টে যাবে। তখন হয়তো আমরা এই শরীরে থাকবো না কিন্তু মা ও ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন তো থাকবে। আমাদের বর্তমান পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি নেহাত দুর্ভাগা হয়, সেখানে হয়তো নিত্যভোগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যত্র, সারা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য কত শত শত ভক্তদের গৃহে তা প্রতিদিন ভক্তিভরে ঠিকই নিবেদিত হবে। তখন মা আর ঠাকুর নিশ্চয় সেই সময়কার খাবার তৃপ্তি করে খাবেন আর তাঁদের সেই প্রসাদ গ্রহণ করে কত না ভক্তের জীবনও প্রতিদিন ধন্য হবে।


নেহাত অখাদ্য আর কুখাদ্য ছাড়া, ভোগ রান্নার কোনো উপাদানই মুখ্য নয়, রান্না আর নিবেদনের সময়ে ভক্তের ভাবটাই আসল। ওই খাবারই মানুষ খেলে উচ্ছিষ্ট আর দেবতা খেলে প্রসাদ, দুইয়ে বিস্তর পার্থক্য। আমি নিজে ভোগ রাঁধলে শুদ্ধতা বজায় রেখে অবশ্যই নুন মিষ্টি ঝাল ইত্যাদি বারেবারে চেখে দেখি, মা আর ঠাকুরকে বিস্বাদ খাবার খেতে দেবো কোন দুঃখে? তাতে যদি কেউ মনে করেন ভোগ উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে, ভারী বয়েই গেল। 


প্রসাদ মানে হাতে হাতে দেবতার সাক্ষাৎ কৃপালাভ, সর্বমঙ্গলময় কল্যাণকারী দৈবীকৃপা, যা মানুষের তৈরি খাদ্য হয়েও দেবতার অনুগ্রহলাভ করেছে, এ কি আর সামান্য জিনিষ? দেবতার প্রসাদের প্রতিটি কণায় সেই অমোঘ দৈবীশক্তি থাকে যা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলে গ্রহীতার বোধ আর বুদ্ধি ধীরে ধীরে আধ্যাত্মপথে চালিত হয়ে ক্রমশঃ তাঁর অন্তরে মানবদেহলাভের উদ্দেশ্যসাধনের ইচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে। প্রসাদলাভ হলো কৃপালাভের প্রথম ইঙ্গিত। তারপরের ধাপগুলো তো কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।


ঠাকুর একদিন কথাপ্রসঙ্গে ভক্তদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের অতি গুহ্য কথা বলছি। জগন্নাথের সঙ্গে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে গিয়েই না হাত ভেঙ্গে গেল। জানিয়ে দিলে,"তুমি শরীর ধারণ করেছ এখন নররূপের সঙ্গে সখ্য, বাৎসল্য এইসব ভাব লয়ে থাক"।’ ভক্তদের পুরীতে জগন্নাথদর্শনে পাঠাতেন কিন্তু নিজে যেতেন না। বলতেন, 'ওখানে গেলে এ শরীর থাকবে না'। সেই জগন্নাথদেবের প্রসাদ ছিল ঠাকুরের কাছে মহাপবিত্র বস্তু। সবসময় কাছে রাখতেন। অনেক ভক্তকেও জগন্নাথদেবের 'আটকে' প্রসাদ খেতে দিতেন। বলতেন, "ওতে ভগবানে ভক্তি হয়, হৃদয় পবিত্র হয়।"


শ্রীশ্রীমায়ের প্রসাদ সম্পর্কে শ্রীমতি সরযূবালা সেন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন:

'ক্রমে ক্রমে অনেক স্ত্রী-ভক্ত আসতে লাগলেন। 

ভক্তি-বিগলিত চিত্তে সকলেই শ্রীশ্রীমায়ের হাসিমাখা স্নেহভরা মুখখানির পানে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন, ওরূপ দৃশ্য আমি আর কখনাে দেখিনি। 

মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছি, এমন সময় বাসায় ফিরবার তাগিদ এলাে—গাড়ি এসেছে। 

শ্রীশ্রীমা তখন উঠে প্রসাদ দিয়ে ‘খাও খাও’ করে একেবারে মুখের কাছে ধরলেন। 

অত লােকের মধ্যে একলা অমন করে খেতে আমার লজ্জা হচ্ছে দেখে বললেন, “লজ্জা কি ? নাও।”

তখন হাত পেতে নিলুম। 

“তবে আসি, মা”, বলে প্রণাম করে বিদায় নেবার সময় বললেন, “এস মা, এস, আবার এস।

একলা নেমে যেতে পারবে তাে ?

আমি আসব ?” 

এ বলে সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। 

তখন আমি বললুম, 

আমি যেতে পারব, মা। আপনি আর আসবেন না।

শ্রীশ্রীমা তাই শুনে বললেন, “আচ্ছা, একদিন সকালে এস।”

পরিপূর্ণ প্রাণে ফিরলুম। ভাবলুম—এ কি অদ্ভুত স্নেহ !


মায়ের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের তাৎপর্য অশেষ, একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে। প্রথমে ভক্তের জড়তা কাটিয়ে নিজের হাতে প্রসাদ খাওয়ানো, তারপর "আবার এস" বলা, তারপর নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ভক্তকে অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখানো যতক্ষণ না তিনি আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন, আর তারপর অন্ধকারে নয়, আলোর ভুবনে তাঁর সামনে প্রকাশিত হওয়ার আশ্বাস - জগ্গজননী মহামায়ার লীলা কে বুঝবে?  ভক্ত একবার উজিয়ে তাঁর কাছে গেলেই হলো, তিনি ঠিক কোলে তুলে নেবেন। ওই প্রসাদ খাওয়া দিয়ে শুভারম্ভ থেকে নিয়ে 'তমসো মা জ্যোতির্গময়' অবধি গোটা পথটি একমাত্র তাঁরই কৃপাতে তাঁরই হাত ধরে যাত্রা করা সম্ভব। জয় মা, জয় ঠাকুর।

No comments:

Post a Comment