Wednesday, March 2, 2022

স্বধর্ম

যখন যা কর, তখনকার মতো তাই হবে ভগবৎ-সেবা। - স্বামী বিবেকানন্দ (পত্রাবলী ২৬/০৮/১৮৯৬)

প্রতিবছর শিবরাত্রির পবিত্র রাতে মহাদেব স্বধর্ম পালন করতে আগ্রহী পুণ্যার্থীদের কৃপারূপ উর্যা প্রদান করেন। গতকাল রাত তাই বিশেষরূপে মহত্বপূর্ণ ছিল, যার পুণ্য রেশ আজও ভূমণ্ডলে রয়েছে, একটু সংবেদনশীল মন হলেই সর্বত্র অনুভব করতে পারা যাবে। এই স্বধর্ম পালনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব একদিন একটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় গল্প বলেছিলেন। অনেকদিন ধরে জঙ্গলে ঘোর তপস্যা করে, বহুবছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে, আরো অনেক বেশি বছর মাথা নিচু আর পা ওপরে করে থেকে এক সাধুর কিছু ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। একদিন কাছের একটি গাছের ডালে বসে একটা কাক বড় কা কা করে চেঁচাচ্ছিল, যেই রেগে গিয়ে তিনি তার দিকে কটমট করে তাকালেন অমনি কাকটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সাধু তখন খুব খুশি, এতদিনের তপস্যার বিরাট একটা ফল ফলেছে ভেবে বেশ গর্বিতও বটে। অবশ্য আগুন জ্বালানোর কাজ তো কয়েক পয়সার একটা সামান্য দেশলাই দিয়েই সেরে ফেলা যায়, তার জন্য এতদিন উল্টো হয়ে পড়ে থাকার কি দরকার ছিল তা ঈশ্বরই জানেন। 


যাইহোক, সেই সাধুর খিদে পাওয়ায় জঙ্গলের ঠিক বাইরে একটি গ্রামে এক গৃহস্থ বাড়ীর দরজায় গিয়ে 'ভিক্ষাং দেহি' বলে হুঙ্কার ছাড়লেন। ভেতর থেকে এক গৃহবধূ বিনীতভাবে উত্তর দিলেন, "বাবা, উঠোনের গাছের ছায়ায় একটু ঠান্ডা হয়ে বসো, আমি আমার স্বামী-সন্তানদের ভাত দিচ্ছি, ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই তোমায় ভিক্ষা দেবো"। সাধু তখন মনে মনে ভাবছেন, 'বেটি তো জানে না আমি কে, আমি রেগে গেলে ওর সব ভস্ম করে দিতে পারি, তাই আমায় অমন অবহেলায় বসিয়ে রাখছে'। যেই না ভেবেছেন অমনি ভেতর থেকে গৃহবধূর গলা শোনা গেল, "বাবা, আমরা কাকপক্ষী নই যে তুমি আমাদের ভস্ম করে দেবে। চুপ করে ঠান্ডা হয়ে বসো, আমার হাত খালি হলেই তোমার সেবা করবো"। সাধু তো একেবারে অবাক! একজন সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ, তিনি দূর থেকে কি করে সাধুর মনের কথা জানালেন? খানিকক্ষণ পর মুখোমুখি হতেই সাধু বধূকে জিজ্ঞেস করলেন, "মা, আপনি কি করে এই ক্ষমতা পেলেন?" বধূটি লজ্জিত হয়ে বললেন, "বাবা, আমি আজীবন কেবলমাত্র স্বধর্ম পালন করেছি"। 


গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,

श्रेयान्स्वधर्मो विगुण: परधर्मात्स्वनुष्ठितात् ।

स्वधर्मे निधनं श्रेय: परधर्मो भयावह: ।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৩য় অধ্যায়: কর্মযোগ, শ্লোক ৩৫)

It is far better to perform one’s natural prescribed duty, though tinged with faults, than to perform another’s prescribed duty, though perfectly well. In fact, it is preferable to die in the discharge of one’s duty, than to follow the path of another, which is fraught with danger.

না জেনে অনেকে এই শ্লোকটিকে পন্থের (religion) নিরিখে ব্যবহার করে থাকেন বটে, কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হলো প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা। যিনি যখন চতুর্রাশ্রমের যে আশ্রমে বিরাজ করছেন, তখন একনিষ্ঠভাবে সেই আশ্রমের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্ম পালনই তাঁর স্বধর্ম। একইসঙ্গে, তিনি চতুর্বর্ণের অর্থাৎ পালিত কর্মের গুনগত শ্রেণীবিভাগ অনুসারে যে বর্ণে যখন আছেন, তখন সেই বর্ণ অনুযায়ী যা তাঁর কর্তব্য, একনিষ্ঠভাবে সেটি পালন করাও তাঁর স্বধর্ম। ধর্ম মানে সেই মানবিক মূল্যবোধ যা সমস্ত কর্তব্য - অকর্তব্যের মানক।


শরীরধারণ করতে গেলে কর্ম অবশ্যম্ভাবী, তাই হিন্দুশাস্ত্রে কর্মকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে - নিকৃষ্ট, মধ‍্যম, উত্তম আর অতি উত্তম। সাধকের সুবিধার জন্য এই শ্রেণী বিভাগকে স্তর অনুসারে শূদ্র, বৈশ‍্য, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণের নাম দেওয়া হয়েছে। শূদ্র স্থিতি (সেবাকর্ম) থেকে আরম্ভ করে আশ্রম অনুসারে স্বধর্ম পালন করতে করতে সেই স্তরের ক্রমন্নতি ঘটিয়ে সাধককে ব্রাহ্মণের স্থিতিতে পৌঁছতে হয়। ব্রাহ্মণ মানে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি, সামাজিক কুসংস্কার অনুসারী পুরুষানুক্রমিকরূপে পৈতাধারী কোনো অজ্ঞান ব্যক্তি নন। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীবনের প্রতিটি স্তরে স্বধর্ম অনুসারে নিরাসক্তভাবে কর্ম করতে করতে মানুষ যখন অবশেষে কর্মফলের আশা ত্যাগ করতে সক্ষম হন, তখন তিনি সন্ন্যাসী, তাঁর ঈশ্বর দর্শনের পথ তখন প্রশস্ত হয়। ওই স্তিতিতে কোনকিছুই আর তাঁর কাছে অজ্ঞাত নয়। তখন সর্বদা তাঁর মনের মধ্যে নিত্যের সাথে একাত্মতার সুর ভেসে চলে,

मनो बुद्ध्यहंकारचित्तानि नाहम् न च श्रोत्र जिह्वे न च घ्राण नेत्रे ।

न च व्योम भूमिर् न तेजॊ न वायु: चिदानन्द रूप: शिवोऽहम् शिवॊऽहम् ।।

(শ্রীমৎ শংকরাচার্য্য বিরোচিত নির্বাণ শতকম, শ্লোক ১)

I am not mind, nor intellect, nor ego, nor the reflections of inner self. I am not the five senses. I am beyond that. I am not the ether, nor the earth, nor the fire, nor the wind (i.e. the five elements). I am indeed That Eternal Knowledge and Eternal Bliss, That Eternal Love and Eternal Consciousness. I am Shiva, I am Shiva.

মহাদেবের কৃপা আমাদের সকলের ওপর সতত বর্ষিত হোক।

No comments:

Post a Comment