আমি হিন্দু - এই শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে অন্তরে এক ধরণের অদ্ভুত শক্তি উৎপন্ন হয়। সেই শক্তির উৎস কি, আদপে তার মূল্য কতটুকু আর তা কিসেরই বা ইঙ্গিতবাহী?
প্রথম কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথেই দেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে এমন এক মহান প্রাচীন সভ্যতার সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, যা দীর্ঘ কালখন্ড জুড়ে গোটা মানবজাতির ইতিহাসকে উন্নততর জীবনশৈলী এবং উন্নততর জীবনবোধ অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার আলোকে উদ্ভাসিত করেছে।
দ্বিতীয় কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে ক্ষুদ্র জাতিভেদ, আঞ্চলিকতা, পন্থ-মত, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির অনেক উর্দ্ধে উঠে নিজেদের পূর্বপুরুষদের হাতে গড়া এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তার সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, যা মূলত মানবিক মূল্যবোধ আর মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্যসাধনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক ঐতিহ্যের ওপর আধারিত।
তৃতীয় কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে বিশ্বজনীনতা, অভিন্নতা, ক্ষমা, উদারতা, সমতা, সমদর্শীতা, সমভাব, সহমর্মিতা, প্রেম ইত্যাদি উচ্চ সংস্কারকে নিজের দৈনন্দিন যাপনে স্বীকার করে নেওয়া যায়, যা অহঙ্কার ও ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষকে ক্রমে ক্রমে দেবত্বে উন্নীত হতে সহায়তা করে।
চতুর্থ কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে এমন এক বিশ্বজনীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায়, যা এক প্রাচীন মহান রাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাসও বটে - যে রাষ্ট্র সাম্যবোধের জননী, যে রাষ্ট্র গণতন্ত্রের জননী, যে রাষ্ট্র অহিংসার জননী, যে রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার জননী এবং যে রাষ্ট্র সামাজিক ন্যায় ও নীতিবোধেরও জননী।
পঞ্চম কথা, নিজেকে হিন্দু বলার সাথে সাথে বেদান্তের সেই সনাতন সত্যের সাথে জুড়ে যাওয়া যায়, নিজেদের গোত্রের সূত্র ধরে সেইসব পূর্বজ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে, যাঁরা নিজেরা দেবত্বকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং গোটা মানবজাতির জন্য বিভিন্ন পথের সন্ধানও রেখে গিয়েছিলেন। সারা বিশ্বে একমাত্র তাঁরাই বলেছিলেন যে বাইরে নয়, ভেতরে খোঁজো আর ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি। তাঁরা ত্তজস্বল ছিলেন, ক্ষম ছিলেন, প্রগাঢ়রূপে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন আর প্রশ্নাতীতভাবে প্রেমিক ছিলেন।
তারপরে এই পুণ্যভূমিতে যুগে যুগে কত না মহাত্মা আর অবতার জন্মেছেন, তাঁরা কত না সমকালীন পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু যা সনাতন তা যেহেতু অপরিবর্তনীয়, তাঁদের সকলের মূল লক্ষ্য কিন্তু সেই একই থেকেছে - 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' অর্থাৎ হিন্দুর জন্ম আত্মার মোক্ষ ও জগতের কল্যাণের জন্য।
এর ফলে হিন্দু ধর্মসংস্কৃতিতে এমন এক জীবন্ত ও চিরন্তন সমভাব ও আত্মনির্ভরতা জাগ্রত হয়েছে যে সংকীর্নমনা অধর্মী বিদেশি আক্রমণকারীরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে নাশ করতে পারেনি। যুগে যুগে শ্রীরামচন্দ্র থেকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ, শংকরাচার্য্য স্বামী থেকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ, নানক থেকে কবীর হিন্দুর অন্তঃকরণকে সর্বদা ধর্মময় করে রেখেছেন, কখনো এর কোনো ছেদ ঘটেনি।
বহু আত্মবোধির বহু তপস্যায় হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই প্রচন্ড শক্তিপুঞ্জ আজো এই পুণ্যভূমিতে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে। কাশীর গঙ্গায়, প্রয়াগের সঙ্গমে আর পুষ্করের সরোবরে আজো প্রতিদিন তিতিক্ষার ঢেউ উঠছে, আজো হিন্দু সেই পুণ্যসলিলে অবগাহন করে তার গৌরবময় অতীতের সাথে জুড়ছেন, সদর্থকরূপে প্রভাবিত হচ্ছেন। এই বহমান স্রোতের অক্ষয় শক্তিতে আজো তার অন্তর ধৌত হচ্ছে।
গর্বের সাথে নিজেকে হিন্দু বলতে পারলে হিন্দুত্বের মূল শক্তিকে ছোঁয়া যায়, বিজাতীয় আরোপিত কৃত্তিম সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় গুরুভার ত্যাগ করে ভারতের চিরাচরিত রাষ্ট্রচেতনা, সাংস্কৃতিক পরম্পরা, মনন-চিন্তন, কৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রগতিকে পুনরুজ্জীবিত করার অনুপ্রেরণা উৎপন্ন হয়।
কাশী, প্রয়াগ, ইন্দ্রপ্রস্থ, অযোধ্যা, উজ্জয়িনী, অমরকন্টক, দ্বারকা, মথুরা হয়ে এই বাংলার কোচ, বর্ধমাননগর, তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়, নবদ্বীপ, কর্ণসুবর্ণ, গৌড় ইত্যাদি প্রত্যেকটি প্রাচীন জনপদের ধূলিকণায় যে উন্নত ভারতবর্ষের গন্ধ ও স্পর্শ মিশে রয়েছে, সেটাই আমাদের জাতির প্রকৃত স্বত্তা, আমাদের গৌরবময় উত্তরাধিকার।
এই পুণ্যভূমিতেই আমাদের সংস্কারের উৎপত্তি, এইখানেই আমাদের সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার আর এইখানেই বহতি আমাদের মুক্তির উপায়ও বটে। বস্তুতঃ হিন্দু মানে গোটা ভারতরাষ্ট্রবাসীর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এই সহজ সত্যটার মধ্যেই এক অখন্ড মহাশক্তি নিহিত আছে, একবার মুখে উচ্চারণ করলেই যা অন্তরে বাইরে দপ করে জ্বলে ওঠে।
No comments:
Post a Comment