Monday, March 14, 2022

ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য

এক পরিচিতজনের অকালমৃত্যুর খবর শোনা ইস্তক মনের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যে থেকে এই যে খেদ ও পীড়া নিরন্তর বয়ে চলেছে, একে কি আর ইচ্ছেমতো 'জগৎ মিথ্যা' বলে অত সহজে তুড়ি মেরে হওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া যায়? নাকি ছাদের বাগানের গাছে গাছে যে সব অপূর্ব সুন্দর ফুলগুলি প্রতিদিন সকালে ফুটে থাকে, গাছেদের কত ব্যাথা লাগবে ভেবে কোনদিনই পুজোর জন্যে সেগুলি প্রাণে ধরে তুলতে পারিনা যে, সেই অনুকম্পা বোধটাও কি মিথ্যা, নিছক মায়া? যদি জগতে বিভিন্ন নাম-রূপের মধ্যে কোনো আত্মীয়তা আর একাত্মতা নাই থাকতো, তাহলে একে অপরের প্রতি এই ধরণের সমবেদনা বা সহমর্মিতা জাগা অসম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। 


ঠাকুরের সন্তান পরম পূজনীয় হরি মহারাজের (শ্রীমৎ স্বামী তুরীয়ানন্দ) শেষ উক্তি ছিল, "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত" - সেটা তো ঠাকুরেরই কথা - এ কি করে মিথ্যা হতে পারে? 'শিব জ্ঞানে জীব সেবা' করতে গেলেও তো জীবকে আগে এমন এক সত্য বলে মেনে নিতে হবে যার মধ্যে শিবত্ব অন্তর্নিহিত আছে। নাহলে এক অসত্য, সব অসত্য জেনেও, আর এক অসত্যের সেবা করছে - এ তো এক মস্ত বড় comedy of errors হয়ে যাবে!


আচার্য্য শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাখ্যার মূল কথা, যিনি সত্য, যিনি নিত্য, যিনি চৈতন্য, তিনিই ব্রহ্ম, একমেবাদ্বিতীয়ম, বাকি সব মিথ্যা। তাঁর মতে জগৎ মিথ্যা কারণ, 

১. ব্রহ্ম যেহেতু শুদ্ধ চৈতন্য, তাঁর সঙ্গে অনিত্য জগতের কোনো পৃথক সম্বন্ধ থাকতে পারেনা কারণ সম্বন্ধ কেবল দুটি ভিন্ন স্বত্তার মধ্যেই হওয়া সম্ভব আর ব্রহ্ম অদ্বিতীয়।

২. ব্রহ্ম জগতের ক্রিয়াশীল স্রষ্টা হতে পারেন না কারণ ক্রিয়ামাত্রেই অভাবের সূচক আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণ।

৩. জগতের মাধ্যমে ব্রহ্মের লীলা প্রকাশমানও বলা যাবে না কারণ সসীম জগৎ অসীম ব্রহ্মের প্রকাশক হতে পারে না।

৪. জগৎ ব্রহ্মের পরিণামও হতে পারে না কারণ তা হলে অসীম ব্রহ্মকে সীমিত বলে মেনে নিতে হয়।


আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব confusing একটা বিষয়। আমি অর্থাৎ আত্মা যদি পরমাত্মারই প্রতিবিম্ব হই, তাহলে সেটি ধারণকারী কায়িক অস্তিত্বকে, হলোই বা সে সাময়িক, মিথ্যা বলে অস্বীকার করি কিভাবে? গুরুকৃপায় আমার এই কায়িক শরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনের মধ্যে যে আত্মবোধের প্রয়োজনীয়তা জাগছে, বা বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা তাঁদের কায়িক শরীর ও মন ব্যবহার করে যে সমস্ত সত্য প্রকাশ করে গেছেন, অথবা যুগে যুগে অবতারেরা সাময়িক শরীর ধারণ করে যা যা দৈববাণী প্রচার করেছেন, সেই অস্তিত্ব, এবং তাঁদের শিক্ষা সবই অসত্য, কেবলই মায়া? তাঁরা যুগোপযোগী করে যে পরমসত্য প্রতিষ্ঠা করতে এই দেশে জন্মালেন, কেউ সত্যযুগে, কেউ ত্রেতায়, কেউ দ্বাপরে, কেউ বা কলিতে, সব মিথ্যা হতে পারে নাকি? আচার্য্য শঙ্করের অবশ্য মূলত জ্ঞানমার্গেই বিচরণ, তাই এই বিষয়ে স্বামীজী তাঁর জ্ঞানযোগ গ্রন্থে কি বলছেন, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বলছেন,


"তোমরা শুদ্ধ ‘দেশের’ বিষয় ভাবিতে চেষ্টা কর, যাহাতে কোন বর্ণ নাই, যাহার সীমা নাই, চারিদিকের কোন বস্তুর সহিত যাহার কোন সংস্রব নাই। তুমি উহার বিষয় চিন্তাই করিতে পারিবে না। তোমাকে দেশের বিষয় চিন্তা করিতে হইলে দুইটি সীমার মধ্যস্থিত অথবা তিনটি বস্তুর মধ্যে অবস্থিত দেশের বিষয় চিন্তা করিতে হইবে। তবেই দেখা গেল, দেশের অস্তিত্ব অন্য বস্তুর উপর নির্ভর করিতেছে। কাল সন্বন্ধেও তদ্রুপ; শুদ্ধ কাল সম্বন্ধে তুমি কোন ধারণা করিতে পার না; কালের ধারণা করিতে হইলে তোমাকে একটি পূর্ববর্তী আর একটি পরবর্তী ঘটনা লইতে হইবে এবং কালের ধারণা দ্বারা ঐ দুইটিকে যোগ করিতে হইবে। দেশ যেমন বাহিরের দুইটি বস্তুর উপর নির্ভর করিতেছে, কালও তেমনি দুইটি ঘটনার উপর নির্ভর করিতেছে। আর ‘নিমিত্ত’ বা ‘কার্যকারণ’ভাবে ধারণা এই দেশকালের উপর নির্ভর করিতেছে। ‘দেশ-কাল-নিমিত্ত’ এই সবগুলিরই ভিতর বিশেষত্ব এই যে, উহাদের স্বতন্ত্র সত্তা নাই।


"এই চেয়ারখানা বা ঐ দেয়ালটার যেরূপ অস্তিত্ব আছে; উহার তাহাও নাই। ইহারা যেন সকল বস্তুরই পিছনে ছায়ার মতো, তুমি কোনমতে উহাদিগকে ধরিতে পার না। উহাদের তো কোন সত্তা নাই—আবার উহারা যে কিছুই নয়, তাহাও বলিতে পারা যায় না; কারণ উহাদেরই ভিতর দিয়া জগতের প্রকাশ হইতেছে। অতএব আমরা প্রথমতঃ দেখিলাম, এই দেশ-কাল-নিমিত্তের সমষ্টির অস্তিত্ব নাই এবং উহারা একেবারে অসৎ বা অস্তিত্বশূন্যও নহে। দ্বিতীয়তঃ উহারা আবার এক সময়ে একেবারে অন্তর্হিত হইয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ সমুদ্রের উপর তরঙ্গ চিন্তা কর। তরঙ্গ অবশ্যই সমুদ্রের সহিত অভিন্ন, তথাপি আমরা মনে করি—ইহা তরঙ্গ এবং সমুদ্র হইতে পৃথক‍্। এই পৃথক্-ভাবের কারণ কি? নাম ও রূপ।


"নাম অর্থাৎ সেই বস্তু সম্বন্ধে আমাদের মনে যে একটি ধারণা রহিয়াছে, আর রূপ অর্থাৎ আকার। আবার তরঙ্গকে সমুদ্র হইতে একেবারে পৃথক্‌রূপে কি আমরা চিন্তা করিতে পারি? কখনই না। উহা সকল সময়েই ঐ সমুদ্রের ধারণার উপর নির্ভর করিতেছে। যদি ঐ তরঙ্গ চলিয়া যায়, তবে রূপও অন্তর্হিত হইল, কিন্তু ঐ রূপটি যে একেবারে ভ্রমাত্মক ছিল, তাহা নহে। যতদিন ঐ তরঙ্গ ছিল, ততদিন ঐ রূপটি ছিল এবং তোমাকে বাধ্য হইয়া ঐ রূপ দেখিতে হইত; ইহাই মায়া। অতএব এই সমগ্র জগৎ যেন সেই ব্রহ্মের এক বিশেষ রূপ। ব্রহ্মই সেই সমুদ্র এবং তুমি আমি সূর্য তারা সবই সেই সমুদ্রে ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গমাত্র। তরঙ্গগুলিকে সমুদ্র হইতে পৃথক‍্ করে কে? রূপ। আর ঐ রূপ — দেশ-কাল-নিমিত্ত ব্যতীত আর কিছুই নহে। ঐ দেশ-কাল-নিমিত্ত আবার সম্পূর্ণরূপে ঐ তরঙ্গের উপর নির্ভর করিতেছে। তরঙ্গও যেই চলিয়া যায়, অমনি তাহারাও অন্তর্হিত হয়। জীবাত্মা যখনই এই মায়া পরিত্যাগ করে, তখনই তাহার পক্ষে উহা অন্তর্হিত হইয়া যায়, সে মুক্ত হইয়া যায়।"


স্বামীজী আর হরি মহারাজের এই যে এক অনন্য দৃষ্টিকোণ, তার উৎস কিন্তু সেই একই - ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিক্ষা। ঠাকুর একে বলছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান। কথামৃত জুড়ে বারবার ঠাকুরের মুখে এই চারটি বিষয় উঠে আসছে:

১. ব্রহ্ম আর ব্রহ্মশক্তি এক এবং অভেদ, যেমন আগুন আর তার দহিকাশক্তি। শক্তি মানে সগুণ ব্রহ্ম, মানে ভগবান, মানে সর্বপ্রকাশমানা মহামায়া পরমাপ্রকৃতি। অদ্বৈতের মধ্যেই ভগবান, আলাদা নন।

২. জগৎ ব্রহ্মশক্তিরূপীণি ভগবানের সৃষ্টি। ভক্ত তারই মধ্যে। আর ভক্ত ও ভগবান এক। ফলে ভগবৎ দর্শনই আত্মবোধ। তাই জগৎ সত্য।

৩. যত মত তত পথ। বলছেন "অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা কিছু করো"। মূলে অদ্বৈতবোধ, উপলব্ধির পথ আলাদা আলাদা।

৪. যতক্ষণ শরীর আছে ততক্ষণ একটুখানি হলেও অহঙ্কার থাকবে। ফলে ভক্তের নির্বিকল্প সমাধি অর্থাৎ সম্পুর্ন যোগ অর্থাৎ আত্মবোধ হওয়ার পরেও জনহিতে যথাসম্ভব শরীরধারণ করে থাকা প্রয়োজন।


দেখছি ঈশ ঊপনিষদের ষষ্ঠ শ্লোকে ব্রহ্মনিষ্ঠ ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক্য বলছেন,

যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মনেব অনুপশ্যতি ।

সর্ব ভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্ততে ।।

অর্থাৎ যিনি নিজের আত্মায় সবাইকে এবং সবার মধ্যে নিজেকে দর্শন করেন তিনি কখনও কারো কাছ থেকে নিজেকে (অর্থাৎ স্বরূপ) গোপন করেন না। এটাই তো সবাইকে আপন জানার সূত্র। পর বলে কেউ নেই, সবাই আপন - বসুধৈব কুটুম্বকম্। এও তো অদ্বৈতই। আর এখানেও সেই "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।


আবার তৈত্তেরিয় উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হচ্ছে,

'তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ' 

অর্থাৎ তিনি (ব্রহ্ম) [এ জগৎ] সৃষ্টি করে তন্মধ্যে (জীবরূপে) প্রবিষ্ট আছেন। 

এবার গীতার নবম অধ্যায়ের চতুর্থ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কি বলছেন, সেটাও দেখে নেওয়া যাক:

ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা ।

মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ ।।

সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, 'অব্যক্তরূপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হয়ে আছি। সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই'। শ্রীধরস্বামীর ব্যাখ্যা কিন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি গভীর। 'মৎস্থানি', অর্থাৎ কারণভূত যে আমি, সেই আমাতেই সর্বভূত অর্থাৎ চরাচর সকল রয়েছে। তাহলেও ঘটাদিতে যেমন মৃত্তিকা থাকে, আমি ভূতসকলে তেমনভাবে অবস্থান করিনা কারণ এই বিশ্বভুবন আমার একাংশমাত্র, আমি বিশ্বানুগ হয়েও বিশ্বাতীত। এটাই কিন্তু বেদান্তের মূল কথা, জগৎ ব্রহ্মের বিকাশ অর্থাৎ ব্রহ্ম নিজের অস্তিত্বে নিজে প্রকাশিত কিন্তু ব্রহ্ম জগতের বিকার নন, অর্থাৎ তিনি জগতের পরিণাম নন, তিনি দেশ-কাল-নিমিত্তহীন অনন্তস্বত্তা। আবারো সেই "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।


ঠাকুর কিন্তু এবারেও সেই একই কথা বলছেন যা তাঁর আগের আগের অবতারে বলেছিলেন। জগতের সবখানে ঈশ্বরের বাস, সকলের মধ্যে ঈশ্বর আছেন অথচ জগতটি পরিবর্তনশীল, অর্থাৎ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এখানে কর্মফল ছাড়া যেহেতু পুঁটলি বাঁধার কিছু নেই, ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ভোগ করো। অর্থাৎ যা পাচ্ছ, সবটাই তাঁর প্রসাদ, তাঁর কৃপা, এই বুঝে দুর্লভ মানবজীবন উপভোগ করো, তার সদ্ব্যবহার করো। সবাই আপন, কেউ পর নয়। ফলে অন্য কারো প্রাপ্যতে লোভ কোরো না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে বলছেন,

"আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে,

তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে।"

সব দিয়ে সব পাওয়া। ঈশ ঊপনিষদের প্রথম শ্লোকের 'তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা'।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ততঃ কিম্‌' প্রবন্ধে বড় সুন্দর করে এর ব্যাখ্যা করেছেন,

"মানুষকে পূর্ণতালাভ করিতে হইলে পরিপূর্ণ জীবন এবং সম্পূর্ণ কর্মের প্রয়োজন হয়। জীবন সম্পূর্ণ হইলেই জীবনের প্রয়োজন নিঃশেষ হইয়া যায়, কর্ম সমাপ্ত হইলেই কর্মের বন্ধন শিথিল হইয়া আসে।


"জীবনকে ও জীবনের অবসানকে, কর্মকে ও কর্মের সমাপ্তিকে এইরূপ অত্যন্ত সহজভাবে গ্রহণ করিতে হইলে যে-কথাটি মনে রাখিতে হইবে, তাহা ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকেই রহিয়াছে-

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

ঈশ্বরের দ্বারা এই জগতের সমস্ত যাহা-কিছু আচ্ছন্ন জানিবে।

এবং

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্‌।

তিনি যাহা ত্যাগ করিতেছেন—তিনি যাহা দিতেছেন, তাহাই ভোগ করিবে, অন্য কাহারও ধনে লোভ করিবে না।


"সংসারকে যদি ব্রহ্মের দ্বারা আচ্ছন্ন বলিয়া জানিতে পারি, তাহা হইলে সংসারের বিষ কাটিয়া যায়, তাহার সংকীর্ণতা দূর হইয়া তাহার বন্ধন আমাদিগকে আঁটিয়া ধরে না। এবং সংসারের ভোগকে ঈশ্বরের দান বলিয়া গ্রহণ করিলে কাড়াকাড়ি-মারামারি থামিয়া যায়।"

ঘুরে ফিরে এও তো সেই হরি মহারাজেরই কথা, "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য, সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত"।

No comments:

Post a Comment