একটা ছোট ভিডিও কেউ পাঠিয়েছেন, দেখে বেশ আনন্দ পেলাম। একজন সাংবাদিক গাঁও-দেহাতের এক সাধারণ গরিব মাকে জিজ্ঞেস করছেন তাঁর জাত কি আর সেই মা সপাটে জবাব দিচ্ছেন,"হাম হিন্দু হ্যায়"। সাংবাদিক ভাবছেন হয়তো প্রশ্নটি তিনি ঠিক বোঝাতে পারেননি, তাই দ্বিতীয়বার একই কথা ফের জিজ্ঞেস করছেন এবং আবার সেই একই দৃঢ় উত্তর পাচ্ছেন, "হাম হিন্দু হ্যায়"।
জাত অর্থাৎ caste; এটি এখন আর সেই বৈদিকযুগের কর্মবিন্যাস ভিত্তিক interchangeable শ্রেণীকরণে সীমাবদ্ধ নেই, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা সমাজকে বিভাজিত করে রাখার ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান হাতিয়াররূপে তা আজ এক ভয়ঙ্কর সামাজিক কুপ্রথার রূপ নিয়ে নিয়েছে। আজ আমাদের গোটা সমাজটা ৩০০০ caste আর ২৫০০০ sub-caste-এ বিভক্ত হয়ে গেছে আর রাজনৈতিক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে এই বিভাজনকে এতদিন ধরে খুব ইন্ধনও জোগানো হয়েছে। এমনকি ভারতে যাঁদের পূর্বপুরুষ সনাতন ধর্ম ছেড়ে মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের পন্থটিকে তো ছেড়েছিলেন কিন্তু caste identity-টি ঠিক সঙ্গে করে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন, এ এমনই এক অদ্ভুত পরিচয়লিপ্সা।
এই জাত জাত করে আমাদের দেশের কি সর্বনাশ যে হয়েছে, সে আর বলার কথা নয়। ইংরেজদের census জনিত একটা মিথ্যা construct-এর ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন ভারতবর্ষেও কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা সেই মেকি দূষিত বিভাজনকারী সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ফলে কত যে হিংসা, কত শোষণ, কত অত্যাচার আর কত যে ঘৃণার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, এক আধুনিক মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রে সে কলঙ্ক রাখার জায়গা নেই।
এই দুদিন আগে পর্য্যন্তও classless society-র নাম করে তথাকথিত উচ্চবর্নীয়দের বিরুদ্ধে তথাকথিত নিম্নবর্নীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলাই ছিল ভারতে সমাজতন্ত্র বিস্তারের ভিত্তি। অবশ্য এর পেছনে আবার সেই পুরানো বুর্জোয়া বনাম প্রলেতারিয়েতের ছেঁদো গল্পটাও ছিল, যেখানে উঁচুজাত মানেই বড়লোক আর নিচুজাত মানেই গরিব বলে ধরে নেওয়াটাই ছিল দস্তুর, তা সে গরিব পূজারী ব্রাহ্মণের দুবেলা পেট চলুক আর নাই চলুক আর কোটায় চান্স পাওয়া অর্থপিশাচ ডাক্তারের বখাটে ছেলে দুহাতে যত টাকাই ওড়াক না কেন।
আজ যখন এক গরীব মায়ের ছোট্ট উত্তরের এই ছোট্ট ভিডিওটি দেখলাম, তখন হিন্দুত্বের প্রয়োজনীয়তাটি আরো বেশি করে অনুধাবন করা গেল। আমরা হিন্দু - ব্যাস এইটুকুই তো যথেষ্ট। এটাই আমাদের সত্যিকারের রাষ্ট্রীয় পরিচয়। এই পরিচয় সমাজের ভাঙ্গন রুখে দেয়, বিভাজন রুখে দিয়ে সমাজকে এক করে দেয়, শ্রেণীশোষণ বন্ধ হয়ে যায়, ভেদাভেদ শেষ হয়ে যায়, সমবেতভাবে গোটা বিশ্বের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর বল পাওয়া যায়। বিগত কয়েকদশক ধরে রাজনৈতিক narrative পরিবর্তিত হতে হতে আজ যে আমাদের সমাজ এই জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছে, যেখানে জাত জিজ্ঞেস করলে জবাব আসছে 'আমি হিন্দু', এ কিন্তু মারাত্মক বড় একটা সদর্থক সমাজসংস্কার, এটা সর্বাত্মক হওয়া দরকার। এরপরের ধাপ হলো পন্থনির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসীর কাছে এই রাষ্ট্রীয় পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠা। যেদিন সেটা হয়ে যাবে, সেদিন আর কেউ আমাদের সমাজের মজবুত দেওয়ালে কোনোভাবেই সিঁদ কাটতে পারবে না।
No comments:
Post a Comment