Friday, March 11, 2022

অবলম্বন

আজ জ্যেষ্ঠপুত্র ঘুম থেকে উঠতেই সদরের চাবিগুলি ওর কাছ থেকে ফেরত চেয়ে নিলুম। প্রতিবারই এটি করা হয়। যখনই ও বাড়ি ফেরে ওকে এক সেট সদরের চাবি দেওয়া হয় যাতে ও নিজের মতন করে বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে পারে আর চলে যাওয়ার আগে ফেরত নিয়ে নেওয়া হয় কারণ প্রথমত, ওগুলি বিভূঁইয়ে কোনো কাজে লাগার নয় আর দ্বিতীয়ত, হারিয়ে ফেলা বা সঙ্গে করে ফেরত না নিয়ে আসার সম্ভাবনাও সমূহ। ওর এই চাবির গোছাটি কিন্তু অন্যগুলির সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়না। ওটি ওর ঘরের দেওয়াল আলমারিতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তুলে রাখা হয়। ওটা শুধু ওরই। 


আজ চাবি ফেরত চাইবার সময় হটাৎ পুরনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে গেল। এককালে আমাদের বাড়িতে মূর্তিতে কালীপূজো হতো। মায়ের একটি রুপোর জল করা তামার খাঁড়া ছিল, তাতে আবার খুব সুন্দর করে মিনে করা একটি লাল রঙের চোখও আঁকা ছিল। প্রতিবার মাকে বাড়ি নিয়ে আসার পর সেটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হতো আর পরের দিন ভাশানের ঠিক আগে খুলে নিয়ে যত্ন করে মুছেটুছে ঠাকুরের ট্রাঙ্কে তুলে রাখা হতো। তারপর মাঝখানে বাড়িতে যতবার যত রকমের পূজাই হোক না কেন, বাবাকে দেখেছি ওই খাঁড়াটি বের করে সযত্নে পূজার আসনে রাখতেন।


আসলে ভালোবাসার কেউ চোখের সামনে না থাকলেও মনের ভেতরে তার অস্তিত্ব বাস্তবিকই থাকে। অন্যসময় হয়তো কোনো এক নিভৃত ট্রাঙ্কে সে ঘুমিয়ে থাকে কিন্তু যেই কোনো শুভ অনুষ্ঠান হয় বা এমন কোনো ঘটনা ঘটে যেখানে সেই জনের উপস্থিতি কাম্য ছিল, তখনই সে ঠিক টুক করে ডালাটি খুলে বেরিয়ে আসে। আসলে ভালোবাসার সাথে কাছে পাওয়ার খুব গভীর একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে, এবং যত বয়স বাড়ছে তত উপলব্ধি করছি যে সেটা যত না শারীরিক, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি মানসিক, বস্তুত সাংকেতিকও। 


ছোটবেলায় ভাইফোঁটার দিন মাকে দেখেছি মামারবাড়ি যাওয়ার আগে নিজের প্রবাসী ভাইদের উদ্দেশ্যে দেওয়ালে চন্দনের ফোঁটা দিতে। বিষয়টা একই, একটা কিছু উপলক্ষ করে প্রিয়জনকে মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। তবে উপলক্ষটাও কিন্তু ভীষণ জরুরি, তা সে কোনো আনুষ্ঠানই হোক বা স্মৃতিচিহ্ন অথবা স্মৃতিচারণ। যা সর্বক্ষণ চোখের সামনে আছে, তাকে তো আর আলাদা করে মনে করতে হয়না কিন্তু যা মনের মধ্যেই আছে, তার জন্য অনেকসময়েই বাহ্যিক কোনো একটা কিছুর অবলম্বন লাগে, যেটিকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তা সে চাবির গোছাই হোক, মায়ের হাতের খাঁড়া বা ঠাকুরঘরের পুবদিকের দেওয়াল।

No comments:

Post a Comment