পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রথম চরণের প্রাক্কালে ভারতের দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কয়েকটা বিষয় সত্যিই আমায় ভাবাচ্ছে।
১. প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের একটি নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র আদর্শ থাকবে, সেটাই কাম্য। কিন্তু সেই আদর্শের উৎসমুখে যে সমাজচেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা কেন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল নির্ভর হবে? নিজস্ব সীমাবদ্ধতা স্বত্তেও রাজনীতি যখন কোনো আদর্শকে তৃণমূল স্তর অবধি নিয়ে যাওয়া এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের একটি উৎকৃষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তখন তার ব্যবহার সর্বব্যাপী করার প্রচেষ্টা হবে না কেন? কেন গোটা জাতীয়তাবাদী আদর্শটাই যেন একটিমাত্র দলের কুক্ষিগত মালিকানা হয়ে থাকবে?
২. বামেরা নিজেদের মতাদর্শকে welfare state থেকে শুরু করে democratic socialism হয়ে armed revolution অবধি নানা স্তরে বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলত, বাম মতাদর্শ একটি সর্বজনীনতা পেয়েছিল যার মূলে ছিল বিভিন্ন বাম ধারায় বিশ্বাসী নানান স্তরের এবং উপমতধারার রাজনৈতিক দল। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীরা এই সহজ রাস্তাটা কেন অনুসরণ করতে পারলেন না এবং কেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনৈতিক মূল্যবোধের মূলে গিয়ে সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করতে পারলেন না?
৩. Identity politics এর প্রকৃত সংজ্ঞা কি? সে কি কেবল ব্যক্তিস্বত্তার রাজনৈতিক পরিচয়কে নির্দিষ্ট এবং মেরুকৃত করে নাকি সঠিকভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের মাধ্যমে সংকুচিত স্বত্তাকে বৃহত্তর সত্তায় পর্যবসিত করে? সেক্ষেত্রে একটি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে ব্যক্তিস্বত্তার সাথে সম্পৃক্ত করে ব্যক্তির সাথে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মেলবন্ধনের মাধ্যমে শ্রেণীনির্ভর বামপন্থার বিপরীতে যে সার্বিক সাম্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, সে বিষয়ে রাজনৈতিক পদক্ষেপ হয়নি কেন? এটা কি মতাদর্শীদের একটি দল বিশেষের ওপর অতিনির্ভরতার ফল?
৪. দেশের যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে এমন অনেক কিছুই মানুষ সাগ্রহে গ্রহণ করছেন যা গত সাড়ে ছয় দশকে সম্ভব হয়নি। মানুষ আজ নিজের অতীত সম্পর্কে নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে বেশি সচেতন এবং সমাজজীবনে জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের প্রভাব বাড়ছে। একদিকে বামপন্থীয় শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা এবং বামপন্থাশ্রয়ী অনুকরণকামী অন্তর্জাতিকতাবাদ ক্ষয়িষ্ণু, অন্যদিকে সমাজের সব স্তরে দেশীয় আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মনির্ভরতার উত্থান লক্ষণীয়। সামগ্রিকভাবে রাজনীতি এমনদিকে মোড় নিচ্ছে যে তরুণ গগৈ জীবিত থাকাকালীন আসামে যে বদরুদ্দীন আজমলের মতন সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কোনোদিন কংগ্রেস হাত মেলায়নি, আজ তাদেরই সাথে জোট বাঁধতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টেরও, সোজা ওয়াজ মাহফিল থেকে রাজনীতির আঙিনায় উঠে আসা ফুরফুরা শরীফের পীরজাদার সাথে সাম্প্রদায়িক জোট করতে হয়েছে তাঁদের। এই যে অস্তিত্বসংকটে পড়া mainstream রাজনীতির তথাকথিত পন্থনিরপেক্ষ শক্তির পন্থীয় মেরুকরণ, যা ভবিষ্যতে সমাজকে আরো বিভাজিত করবে, তাকে রোখার উপায় কি শুধুমাত্র একদলীয় বা একপন্থীয় ক্ষেত্রবিস্তার নাকি বহুদলের ভেতরে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে সার্বিকভাবে রাজনীতিতে পন্থীয় প্রভাবকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া?
৫. শেষ প্রশ্ন। ভারতের মতন ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্রে রাজনীতিকে কিভাবে ধর্ম আধারিত এবং ধর্মাশ্রয়ী করে তোলা যায় যাতে ভারতের রাজনীতি পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে ওঠে এবং তাকে ব্যবহার করে প্রাচীন ঐতিহ্যে আস্থাবান কিন্তু ভবিষ্যতদর্শী ভারতবর্ষ গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তা নিয়ে চর্চা হওয়া দরকার। ভারতের গোটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি জুড়ে যখন হিন্দুত্বের হওয়া বইবে, বস্তুতঃ সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিন্দু সভ্যতার শিক্ষা, মনন, কৃষ্টি এবং চেতনার পুনঃপ্রকাশ ঘটবে, তখনই তো এই দেশ সত্যিকারের আত্মাবলম্বী হয়ে উঠবে। আজ যাঁরা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জোট করছেন তাঁরা জনসমর্থনের রাস্তা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। কাল যদি তাঁরা বোঝেন যে দেশ বদলে গেছে, তাঁরাই প্রাসঙ্গিকতার তাগিদে হিন্দু সভ্যতার গুনগান গাইতে শুরু করবেন। সেই দিশা মাথায় রেখে ভারতপন্থী আদর্শবাদীদের কি এখন থেকেই একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া জরুরি নয়? উদাহরণস্বরূপ, RSP কেন বামফ্রন্টে থাকবে, ওঁদের উদ্ভব তো অনুশীলন সমিতি থেকে।
No comments:
Post a Comment