আজ ভোরবেলা থেকে ক্রমাগত পূজনীয় লাটু মহারাজের কথা মনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে, চোখ বন্ধ করলেই বারেবারে ওঁর সেই দাঁড়িগোঁফওলা পাঞ্জাবির হাতা গোটানো ছবিটা মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। বিহারের ছাপড়া জেলার কোন গ্রামে কবে জন্ম জানা নেই, বাবা মায়ের নাম কি জানা নেই, রাখতুরাম ছাড়া পূর্বাশ্রমের গোটা নামটা পর্য্যন্ত কেউ জানেন না। অনাথ ছিলেন, অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন, গ্রামে গরু চরাতেন, ছেলেবেলায় কাকার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত শ্রী রামচন্দ্র দত্তের গৃহভৃত্য ছিলেন, কুস্তি লড়তেন আর রামজীর ভক্ত ছিলেন - ব্যাস এটুকুই মাত্র প্রাথমিক পরিচয়। রাখতুরাম থেকে নাম পাল্টে প্রথমে লাল্টু, তারপর ঠাকুরের লেটো, নেটো, স্বামীজীর প্লেটো, সবশেষে সর্বজনপূজ্য শ্রীরামকৃষ্ণপার্ষদ ব্রহ্মজ্ঞানী ঈশ্বরকোটি শ্রীমৎ স্বামী অদ্ভুতানন্দজী মহারাজ।
ঠাকুরের অন্য সমস্ত পার্ষদদের থেকে লাটু মহারাজ একেবারে আলাদা। অন্য সকলের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ গুরু এবং পরবর্তীতে একাধারে ইষ্টও বটে কিন্তু লাটু মহারাজের কাছে প্রথমদিন থেকেই তিনি প্রভু আর লাটু তাঁর দাস। সমস্ত পার্ষদদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে লাটু মহারাজই ঠাকুরের কাছে এসেছিলেন, তাও একরকম প্রায় জোর করেই, আর তারপর থেকে আজীবন ঠাকুরের ভৃত্য হয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অবলম্বন আর তাঁর ছিলনা।
ঠাকুরের কাছে লাটু মহারাজ 'ক' অবধি পড়েছিলেন, উচ্চারণ না করতে পারায় ওখানেই ওঁর অক্ষরজ্ঞানের ইতি হয়। ইংরিজি জানতেন না, ফলে অন্যান্য গুরুভাইদের মতন কান্ট, মিল বা স্পেন্সার পড়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। সংস্কৃতও জানতেন না, ফলে বেদ, উপনিষদ বা অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ এবং সেগুলির ভাষ্য ইত্যাদি পড়ার সুযোগও তাঁর ঘটেনি। অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলেন, স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল, হিন্দি আর বাংলা বুঝতেন, ফলে প্রভু মুখে মুখে যা কিছু শেখাতেন, সেসব তিনি একেবারে আত্মসাৎ করে নিতেন। জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত প্রভুর প্রতিটি শব্দ তাঁর কাছে প্রশ্নাতীত বেদবাক্য ছিল।
অন্যান্য গুরুভাইদের কারো কারো মতন লাটু মহারাজ কিন্তু কোনোদিনই গুরুকে বাজিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি আর গুরুও তাঁকে পর্দানশীন শ্রীশ্রীমায়ের সেবায় নিযুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আহা, গুরু আর শিষ্য, প্রভু আর ভৃত্য, ইষ্ট আর ভক্তের কি মধুর সম্পর্ক! শিষ্যের একপাটি নতুন চটি শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে, গুরু লণ্ঠন হাতে বনে বাদারে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শিষ্য শিবমন্দিরে গভীর ধ্যানে লীন, দরদর করে ঘাম হচ্ছে, গুরু তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছেন আর ঠান্ডা জলের গেলাস নিয়ে বসে আছেন, খাওয়াবেন বলে। আবার শিষ্য রাতে ঘুমোনই না, যাতে গুরুর সেবায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে। গুরু গভীর রাতে ঝাউতলায় যাচ্ছেন বাহ্যি করতে, সঙ্গে লোটা আর লন্ঠন নিয়ে শিষ্য চলেছেন ছায়ার মতন।
আসলে লাটু মহারাজের গোটা স্বত্তা জুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু নেই। অন্যরা যদিও বা কখনো কখনো নিজেদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রেক্ষিতে ঠাকুরের কথাগুলোকে নিয়ে মনে মনে বা নিজেদের মধ্যে সত্যাসত্য বিচার করে থাকেন, লাটু মহারাজের পুরো মানসিক এবং আধ্যাত্মিক গঠনতন্ত্রটিই হলো নির্ভেজাল শ্রীরামকৃষ্ণ-নির্ভর। ওনার মনের মধ্যে গুরু ব্যতীত বাইরের কোনো প্রভাব ছিল না, গুরুকৃপায় ওঁর সমস্ত জ্ঞানই ছিল অন্তঃস্তিত।
তাঁর পক্ষে সংগঠিত সন্ন্যাসীসঙ্ঘের নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব হতো না, প্রকৃতার্থেই উনি ছিলেন মুক্তকচ্ছ ব্রহ্মজ্ঞানী - ভোজনম্ যত্রতত্র, শয়নম্ হট্টমন্দিরে। নিজেকে কম্বলে মুড়ে চুপ করে ঘাটেবাটে পড়ে থাকতেন যাতে তাঁর বিরাট আধ্যাত্মিক শক্তিকে কেউ চট করে বুঝতে না পারেন। তবে মাঝেমাঝে তাঁর অজান্তেই তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেমন একবার নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কাশীতে পশুপতি মহারাজকে গঙ্গার ঘাটে দাঁড় করিয়ে বিশ্বনাথ দর্শন করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর ভুল ভাঙানোর জন্য।
'প্রাচীন সাধুদের কথা' বইতে পূজনীয় স্বামী ধীরেশানন্দজী মহারাজ তাঁর স্মৃতিকথায় পূজনীয় সুধীর মহারাজের (স্বামী শুদ্ধানন্দ) মুখে শোনা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। সুধীর মহারাজের বর্ণনা: “লাটু মহারাজকে নিয়ে এক সভায় এক পণ্ডিতের উপনিষদ্ ব্যাখ্যা শুনতে গিয়েছি। “তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেঞ্জাদিবেষীকাং ধৈর্যেণ’ (কঠ উপনিষদ, ২/৩/১৭)–এর ব্যাখ্যা শুনেই লাটু মহারাজ ঐ সভার মধ্যেই জোরে বলে উঠলেন, "এই সুধীর! পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। আমি অপ্রস্তুত। বলি, "মহারাজ, চুপ চুপ"। আবার ঐরূপ বললেন। আমি বললাম, "মহারাজ, চুপ চুপ"। কিছুক্ষণ পরপর তিনি ঐরূপ বলাতে লােকের বিরক্তিভাজন হওয়ার ভয়ে বললাম, “মহারাজ, চলুন মঠে যাই"। তাঁকে নিয়ে মঠে এলাম। একঘরে থাকি। রাত্রে আমি ঘুমােচ্ছি। তিনি জেগে বসে, ডেকে বলছেন, "এই সুধীর"। আমি উঠলাম। তিনি বললেন, "পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। আমি আবার শুলাম। আবার ঐ ডাক— "এই সুধীর, পণ্ডিত ঠিক বলেছে"। কিছুক্ষণ পরপর এইরূপ চলল। আমার আর সারারাত ঘুম হলাে না। লাটু মহারাজ এমনই তন্ময় হয়েছিলেন ঐ ভাবে! স্বানুভূত বিষয় কিনা! তাই এত উল্লাস!”
[বিঃদ্রঃ: কঠ উপনিষদের মূল শ্লোকটি হলো,
'অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষােহন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।
তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেঞ্জাদিবেষীকাং ধৈর্যেণ।।'
অর্থাৎ অঙ্গুষ্ঠমাত্র পরিমাণস্বরূপ অন্তরাত্মাপুরুষ সর্বজনের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থিত আছেন। মুঞ্জ ঘাস থেকে শিষের ন্যায় তাঁকে স্বীয় শরীর থেকে ধৈর্যের সঙ্গে পৃথক করবে।]
লাটু মহারাজকে সবচেয়ে ভালো চিনতেন তাঁর গুরুভাইয়েরা। তিনি দৈহিকভাবে তাঁদের সঙ্গে থাকুন আর নাই থাকুন, শ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে ওঁদের সকলের মধ্যে ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার কি যে এক অটুট বন্ধন ছিল, বলে বোঝানো যায় না। একদিন স্বামীজীকে লাটু মহারাজ বলছেন, “দেখ ভাই লােরেন, কিশুববাবু টাউন হলে কিমন লিকচার দেয়। তুই ভাই অমন লিকচার দিবি, আর আমি তাের জন্য এক কুঁজো জল লিয়ে বসে থাকব।” আর যখন স্বামীজী আমেরিকায় গিয়ে জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন, তখন সেখান থেকে চিঠিতে লিখছেন, “লেটো ভাই-এর ইচ্ছা এখানে পূরণ করছি। খুব lecture দিচ্ছি।”
স্বামীজী একজায়গায় বলেছেন, "লাটু যেরূপ পারিপার্শিক অবস্থার মধ্য হইতে আসিয়া অল্প দিনের মধ্যে আধ্যাত্মিক জগতে যতটা উন্নতিলাভ করিয়াছে - এতদুভয়ের তুলনা করিয়া দেখিলে সে আমাদের অপেক্ষা অনেক বড়। আমরা সকলেই উচ্চবংশজাত এবং লেখাপড়া শিখিয়া মার্জিত বুদ্ধি লইয়া ঠাকুরের নিকট আসিয়াছিলাম; লাটু কিন্তু সম্পূর্ণ নিরক্ষর।
আমরা ধ্যান-ধারণা ভাল না লাগিলে পড়াশুনা করিয়া মনের সে ভাব দূর করিতে পারিতাম। লাটুর কিন্তু অন্য অবলম্বন ছিল না - তাঁহাকে একটিমাত্র ভাব অবলম্বনেই চলিতে হইয়াছে।
কেবলমাত্র ধ্যান-ধারণা সহায়ে লাটু যে মস্তিষ্ক ঠিক রাখিয়া অতি নিন্ম অবস্থা হইতে উচ্চতম আধ্যাত্মিক সম্পদের অধিকারী হইয়াছে, তাহাতে তাঁহার অন্তর্নিহিত শক্তির ও তাহার প্রতি শ্রীশ্রীঠাকুর-এর অশেষ কৃপার পরিচয় পাই।"
No comments:
Post a Comment