এক হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি কাটিয়ে উঠে শেষ দখলদারদের দেশ থেকে তাড়ানোর পরেও কিন্তু পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল, অথচ এতদিনের স্বশাসনেও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে আমরা বিশেষ উন্নতি করতে পারিনি, তার জন্য সরকার অবশ্যই দায়ী, আমরাও কিছু কম দায়ী নই। আজ এর মধ্যে চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথম সমস্যাটি হোল আমাদের অন্নদাতাদের আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখে দিয়েছি, ওঁদের দৈন্যদশা থেকে উত্তরনের কোন সার্বিক ব্যাবস্থা হয় আমরা করতে চাইনি অথবা পারিনি। ১৯৬১ সাল থেকে দেশে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের নামে জমিতে বিষ মেশাতে মেশাতে ধীরে ধীরে আমরা তাকে নিষ্ফলা এবং বন্ধ্যা করে তুলেছি। একজোড়া বলদের জায়গা নিয়েছে কেঁচোর বসবাস ধ্বংসকারী বড় দাঁতওলা ট্র্যাক্টর আর সুপরিকল্পিতভাবে যে গোবর আর গোমূত্র বিনাপয়শায় জমির উর্বরতার কারিগর কেঁচোর খাদ্য যোগাতো, আমরা তার যোগান বন্ধ করিয়ে দিয়েছি। কেঁচো নেই, তাই ক্ষেতে পাখি নেই, রেনুর হাওয়াই সফর বাতিল। বাড়ির নিমপাতার তেল, গোমূত্র আর বেসনের ঘোল বানিয়ে খুব কম পয়সার যে জৈবিক কীটনাশক কৃষক ব্যবহার করতেন, তার জায়গায় তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি বিশুদ্ধ বিষ, যার ফলে আর মৌমাছি এবং বন্ধু কীটপতঙ্গ আসে না, পরাগ বিতরণ বন্ধ, কৃষক হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাহলে গত একাত্তর বছরে আমরা ফলন বাড়ানোর নামে কি করলাম? ১। কৃষিকে মুনাফাখোর শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিলাম, ২। কৃষককে ভর্তুকির প্রলোভন দেখিয়ে সরকার নির্ভর করে দিলাম, ৩। কৃষকের গোসম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে যন্ত্র নির্ভর করে দিলাম, ৪। জমিকে বন্ধ্যা করে দিলাম, ৫। কৃষকের স্বনির্ভরতাকে শেষ করে দিয়ে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাঁর জীবনকে জুড়ে দিলাম আর ৫। অন্নদাতাকে বিষ ফলাতে আর বিষ খেতে বাধ্য করলাম। এর নিট ফল হচ্ছে কৃষি আজ আর যথেষ্ট অর্থকরী বৃত্তি নয়। একটা পরিসংখ্যান হয়তো বিষয়টিকে আরও প্রাঞ্জল করবে। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ৩৪০ কেজি চাল হত, এখন পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ মিলিয়ে হয় হেক্টরপ্রতি ৩১৮ কেজি, এত কাণ্ড করার পরেও আখেরে কম। ভুলে যাবেন না ভারতের ৪২৩ মিলিয়ন হেক্টার জমির মধ্যে ১৯০ মিলিয়ন হেক্টার জমি এখনও কৃষিযোগ্য, রাশিয়ার ক্ষেত্রে যেটি ১৭০৮ এর মধ্যে মাত্র ১২৬, আমেরিকার ক্ষেত্রে ৯৩৬ এর মধ্যে ১৭৭ আর চিনের ক্ষেত্রে ৯৬০ এর মধ্যে ১২৪, অর্থাৎ ৮০ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে আমরা এতদিন ছিনিমিনি খেলেছি, এখনো খেলছি। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পরিশুদ্ধ জলের রিসার্ভ ভারতে, রাসায়নিক ও শিল্পবর্জ্যের কল্যানে সেই জলকেও আমরা তিলে তিলে বিষাক্ত করে তুলেছি। প্রকৃতিকে নিয়ে অনেক তো হল পরিক্ষা-নিরিক্ষা, এবার জল, জমি আর জঙ্গলকে আসল মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে পাপমুক্ত ও বিষমুক্ত হলে ক্ষতি কি?
দ্বিতীয় বিষয়টি হোল কাশ্মীর। সরকারের পর সরকার এসেছেন আর গেছেন, কাশ্মীরিদের কাছে ভারত ইন্ডিয়া হয়েই রয়ে গেছে, নিজের দেশ হয়ে উঠতে পারেনি। জওহরলাল নেহরু কি করেছেন, সর্দার প্যাটেলের কি ভুমিকা হতে পারতো, ডঃ শ্যমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বলিদান কেন বিফলে গেল সে সব ঐতিহাসিক তথ্য এবং তর্কের মধ্যে না ঢুকেও, আজকের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে আজ আমরা কাশ্মীরের মানসিকরূপে ভারতভুক্তির জন্য কি করছি, তার উত্তর কি পাবো? কাশ্যপমুনির কথা কি কাশ্মীরের স্কুলে পড়ানো হয়, কালহানার রাজতরঙ্গিনির কথা কতজন কাশ্মীরি জানেন, কর্ণ রাজপুরম থেকে রাজপুরা হয়ে আজকের রাজৌরি, রাজা জম্বু লোচন, সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক, বৌদ্ধ মনিষী অস্বঘোষ, নাগার্জুন ও বসুমিত্র এবং কাশ্মীরি পণ্ডিত কুমারজিব, যিনি চিনে গিয়ে সেখানকার সম্রাটকে সংস্কৃত গ্রন্থ চিনেভাষায় অনুবাদ করতে অনুপ্রানিত করেন, এই সব পূর্বইতিহাস কি স্থানীয় পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে? একজন কাশ্মীরির মূল পরিচয় যে তিনি ভারতীয়, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির তিনিও সমানভাবে ধারক ও বাহক, এই ঐতিহ্যের শিক্ষা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিতে না লাগে সংবিধান সংশোধন, না লাগে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাহলে আমরা এই সাংস্কৃতিক শোধনটি করলাম না কেন? এখন থেকেও যদি শুরু করা যায়, আগামী পনেরো-বিশ বছরে কাশ্মীরে মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।
তৃতীয় বিষয়টি হল সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ ও রাষ্ট্রের একিকরণের ক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগে আমাদের সর্বাঙ্গীণ ব্যর্থতা। আসলে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারনাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন সরকার এবং আমরা নিজেরাও কোথায় যেন আমাদের ভারতীয়ত্বের মূল জায়গাটা খুইয়ে বসেছি। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা কি? সত্যি কি আমরা একটাই ভারত নাকি নানা ভারতের সমষ্টি? একজন কাশ্মীরির সাথে একজন কেরালাবাসীর চেহারা, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, মানসিকতায়, বস্তুত বাহ্যিকরূপে কোনকিছুতেই তো তেমন মিল নেই, ঠিক যেমন একজন মিজোর সাথে একজন গুজরাতির আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর অমিল, তাহলে আমরা এক জাতি হলাম কি করে? আসলে ভারতীয়ত্ব শুধুমাত্র একটি ভৌগলিক অবস্থানের পরিচায়ক নয়, এটি একটি বৃহত্তর জাতীয় চরিত্রের নির্দেশক। ভারতীয়ত্ব আমাদের গোটা রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষেত্রের চিন্তাধারা এবং কর্ম সমুহের সমষ্টি। ভারত যেকটি সিদ্ধান্তের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলি চিরন্তন, যেমন সহিষ্ণুতা, সম্মান, সমন্বয়, স্বাধিকার এবং সংবাদ। এতে ঈশ্বরহীনতার স্থান আছে বৈকি কিন্তু স্থান নেই ধর্মহীনতার। বহুত্ববাদ আর সংস্কার ভারতের প্রকৃতি। আমরা দেখতে পাই মহাভারতের শান্তিপর্বে জাতির বৈশিষ্ট বোঝাতে গিয়ে ভৃগু ভরদ্বাজকে বলছেন ‘ব্রাহ্মনেরা গৌরবর্ণ, ক্ষত্রিয়রা রক্তবর্ণ, বৈশ্যরা পীতবর্ণ আর শূদ্রেরা কৃষ্ণবর্ণ’। উত্তরে ভরদ্বাজ বলছেন, ‘যদি বিভিন্ন বর্ণ বিভিন্ন জাতি নির্দেশ করে তবে বলতে হয় সব জাতিই মিশ্র জাতি।‘ (১৮৮/৬)। তারপরেই বলছেন, ‘আমরা সকলেই কাম, ক্রোধ, ভয়, দুঃখ, উৎকণ্ঠা, ক্ষুধা আর শ্রম এই সবেই প্রভাবিত হই, তা হলে জাতিতে জাতিতে আমাদের প্রভেদ কোথায় ?’ ভারতের এই সর্বংসহা রূপটির সুরভি বহন করে আনে প্রাচীন ভবিষ্যপুরাণের একটি অসাধারণ শ্লোক, যাতে ঋষি বলছেন, ‘যেহেতু চতুর্বর্ণের সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, তাই তারা এক বর্ণের। সমস্ত মানুষের জনক এক, আর একই জনকের সন্তানদের ভিন্ন জাত হতে পারেনা‘ (ব্রাহ্মপর্ব, ৪১, ৪৫)। আবার অথর্ববেদে বর্ণিত মাতৃভূমির বন্দনায় ঋষি বলছেন,
জনং বিভ্রতি বহুধা বিবাচসম, নানা ধর্মানং পৃথিবী যথৌকসম।
সহস্রধারা দ্রবিনস্য মে দুহাম, ধ্রুবেন ধেনুং রন প্রস্ফুরনস্ত।।
অর্থাৎ, ‘বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং বিভিন্ন গুনসমন্বিত মানুষকে একই পরিবারের মত যিনি ধারণ করছেন, নিজ দুগ্ধধারাকে কোন প্রকার প্রতিহত না করে, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে রাখা গোমাতার ন্যায়, যিনি আমাদের ধন সম্পদের সহস্রধারা প্রদান করে চলেছেন, তিনিই আমাদের মাতৃভূমি, অর্থাৎ ভারতমাতা।‘ যেদিন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকে আমরা একই সাংস্কৃতিক একাত্মতা সুত্রে এবং আত্মিক বন্ধনে বাঁধতে পারবো, সেদিন কারো সাহস হবে না ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ বলার। এই কাজটা না আমাদের সরকার করেছেন, না আমরা করেছি, আজ কিন্তু এ কথা ভাববার বিশেষভাবে সময় এসেছে। এতদিন যে সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের প্রাসঙ্গিকতার চর্চা সমষ্টিগত ছিল তা যেদিন সর্বাঙ্গীণ হবে, সেদিন সত্যিই আমাদের জননী জন্মভুমি স্বর্গাদপি গরীয়সী হবেন।
এই পর্বে শেষ আলোচ্য বিষয় হল আমাদের দেশে গনতান্ত্রিক মুল্যবোধ সমাজের সমস্ত স্তরে, সমস্ত ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক ভাবে জনমানসে এখনো দৃঢ় না হওয়া। বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪-২৯৭ সনের মধ্যে নন্দসাম্রাজ্য পতনে চাণক্যের যে ভূমিকা বর্ণিত রয়েছে, তার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদি রাজনৈতিক সংঘর্ষের কাহিনি। এর আগেও বিচ্ছিন্নভাবে ভারত ভুভাগে জনপদ-বিশেষে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু দেশের বৃহত্তর অংশ জুড়ে গনতান্ত্রিক পরম্পরা স্থাপনের সময়কাল ঐ বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যর দৌলতে। ভারতে গনতান্ত্রিক পরম্পরা সুদৃঢ় ছিল সেই জন্যই হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ, বিশ্বের এই চার ধর্মের উৎসভূমি ভারত হওয়া স্বত্তেও পরবর্তীকালে খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম (পারসি ধর্ম), ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম এদেশে অবাধে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দেশের এই গনতান্ত্রিক পরিবেশ এক হাজার বছরের দাসত্বের চাপে সুপ্ত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার ফলস্বরূপ সমাজের সর্বস্তরে আবার তার যে সর্বব্যাপী পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল, তা ঘটেনি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য এবং চরম অপারগতা। আমাদের দেশে জাতপাতের রাজনীতি, গরিব-বিত্তবানের রাজনীতি, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর রাজনীতি, উত্তরভারত-দক্ষিনভারতের রাজনীতি, ইত্যাদি নানান রকমের অরাজক ও নক্কারজনক মতবাদ এই কারণে আজও সমাজের ক্ষতি করতে পারছে কারণ স্বাধীনতার পর আমরা আমাদের সুপ্রাচীন বহুত্ববাদী সর্বংসহা গনতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে প্রতিস্থাপিত করতে পারিনি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষুদ্রস্বার্থে মানুষের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন আর আমরা চুপচাপ তা মুখ বুঝে মেনে নিয়েছি। আপাতকালের সময় জেলখাটা একজন মহাপুরুষ একবার আমায় বলেছিলেন যে রোজ উনি নিজেকে বোঝাতেন, সরকার ওঁর শরীরকে বধ করতে পারেন কিন্তু ওঁর আত্মা অবধ্য, উনি আবার জন্ম নেবেন এবং আবার নিজের গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই লড়বেন। আমাদের নাগরিক অধিকার এবং নাগরিক কর্তব্য দুটোকেই যেদিন আমরা সমান সন্মান করতে শিখব, সেদিন এঁদের সকলের আত্মত্যাগ সফল হবে।
No comments:
Post a Comment