অদ্বৈত বেদান্ত বড় কঠিন বস্তু, মুখে বলা যত সহজ, যাপনে ধারণ করা তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি কঠিন। মুখে 'আমিই সেই' বললেই তো আর হলো না, গোটা জীবনটা সেই বোধের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে তো - কোটি কোটি বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ক'জনই বা তা অর্জন করতে পেরেছেন? তাই যতক্ষন ভেদাভেদ জ্ঞান থাকবে ততক্ষণ স্বার্থপরতাও থাকবে, এটাই মায়ার জগতের নিয়ম। যদি ভেদাভেদ জ্ঞান একেবারে নির্মূল হয়ে যায়, শুধু শরীরধারণের জন্য যেটুকু 'আমি'র প্রয়োজন কেবল ততটুকুই নামমাত্র অহং পড়ে থাকে, তখন তাঁরা কেউ হয় ত্রৈলঙ্গস্বামী নয় লাহিড়ীমশাই হয়ে যান, তাঁদের ভেতর আর শরীরবোধ বা স্বার্থের লেশমাত্র থাকে না। তবে ক'জন মহাত্মাই বা আর এই আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌঁছতে পারেন, তা তিনি গেরুয়াধারীই হন বা গৃহস্থ? হয়তো অহংবোধ কারো প্রবল, কারো বা দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে খানিকটা স্তিমিত হয়, কারো বা ভগবৎ কৃপায় প্রায় যায় যায়, কিন্তু কিছু না কিছু তো তাও থাকবেই।
পাপকর্ম সরাসরি এই অহংবোধের সঙ্গে যুক্ত। অহং মানে আমি, আমার ইত্যাদি। আমি এত ভালো ভালো কথা বলছি আর ওরা শুনছে না, কি মূর্খ! মনে হঠাৎ এই ধরণের 'আমি পন্ডিত ওরা মূর্খ' ভাবনা কেন এলো? না 'আমি' বোধ প্রবল, তাই। কোন আমি? যে আমিটা আর বছরকয়েক পর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর যার বড়জোর এক-দু প্রজন্ম পর্য্যন্ত দেওয়ালে একখানা ছবি ঝুলবে, তারপর সেটাও টান মেরে ফেলে দেওয়া হবে। আরে, সেসব তো পরের কথা, আমি নিজেই পরের জন্মে এই জন্মের আমিটাকে চিনতে পারবো না, বস্তুটি এতটাই ঠুনকো। এই অহং হলো পুরোপুরি শরীর-নির্ভর, শরীর থাকলে আমি আছি, আমার অহংকার আছে, অন্যদের চেয়ে আমি যে স্বতন্ত্র - সেই বোধ আছে, নীচতা আছে, সুখ ভোগ করার তীব্র বাসনা আছে, অন্যের কাঁধে পা দিয়ে সমাজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তাগিদ আছে, অন্যকে ঠকানো আছে, আস্ফালন আছে, নিন্দামন্দ আছে, অন্যকে দুঃখ দিয়ে নিজের কামনা চরিতার্থ করা আছে - আরো কি কি ধরণের বিষ যে এই 'আমি'র ভেতর ভরা আছে কে জানে বাপু!
এখন বিষয়টা হলো, এই যে এতদিনের গড়ে ওঠা পাপের কর্মফল, সে কি একবার গঙ্গোত্রীতে গিয়ে মা গঙ্গায় ডুব দিলে বা অমরনাথে গিয়ে মহাদেবের নাম করলেই হটাৎ ভোজবাজির মতন হুশ করে উবে যাবে? কখনো হতে পারে নাকি, না হওয়া উচিত? ব্যবসা করতে গিয়ে ভুরি ভুরি মিথ্যে কথা বলে সারা সপ্তাহ ধরে গ্রাহকদের বেশি দামে বাজে জিনিষ গছিয়ে দিলুম আর শনি বা মঙ্গলবার দেখে কালীঘাটে গিয়ে এক চাঙারি প্যাঁরা কিনে মায়ের পুজো দিয়ে সামনের চাতালে বসা কোনো ভিখারির হাতে পঞ্চাশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে ভাবলুম এইতো, ডেবিট ক্রেডিট দুদিক মিলে গেল - এত সোজা? আবার মায়া এমন এক গ্যাঁড়াকল করেছেন যে প্রত্যেকের জীবনে ভালো সময় আর খারাপ সময় চক্রাকারে আসতে আর যেতেই থাকে। ভালো সময় মানে যখন 'আমি' খুশি, তা সে দুনিয়াজাহান জাহান্নামে যাক, আর খারাপ সময় মানে 'আমি' অসুখী, তাতে কার কি উপকার হলো বয়েই গেল। এই দুঃখের সময়ই তো মানুষের দৈবের কথা মনে পড়ে, কারণ সেখানেও স্বার্থ জড়িয়ে আছে - যদি প্রার্থনা করে আবার সুখের সময়টা তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনা যায়! আসলে পাপ করার পর 'আমায় উদ্ধার করো' বলে কেঁদে আর লাভ কি? আমি পাপ করেছি, আমি পাপী, এসব শুনলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব খুব রেগে যেতেন। যদি বোঝোই যে ওগুলো পাপকাজ, তাহলে জেনেশুনে সেসব করতে গেলে কেন বাপু? ঠাকুর বদ্ধজীবের এই কপটতা বা hypocrisy একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তবে ব্যতিক্রম কি আর নেই? না থাকলে গিরিশ ঘোষের পাপ নীলকন্ঠ হয়ে গলায় ধারণ করতে গেলেন কেন। ওটা দৈবলীলা।
আমজনকে কর্মফল ভুগতেই হবে, ওতে কোনো ছাড় নেই। ঠাকুর বলছেন, "কি জানো, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহ ধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।" তবে ঠাকুর তো জীবন্ত ইতিবাচকতা, positivity personified, তাই বলছেন, "সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য — এ-সব আত্মার কোনও অপকার করতে পারে না; তবে দেহাভিমানী লোকদের কষ্ট দিতে পারে। ধোঁয়া দেওয়াল ময়লা করে, আকাশের কিছু করতে পারে না।...‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ এ-কথা বলতে বলতে সে ব্যক্তি বদ্ধই হয়ে যায়। যে কেবল বলে ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ সেই শালাই পড়ে যায়! বরং বলতে হয়, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার পাপ কি, বন্ধন কি!" এই বিষয়ে একদিনের একটি কথোপকথন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ:
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চন্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। — কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে।
“শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুল্লনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল।
“একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না! সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চর্তুভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হল। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।”
মাস্টার — শুধু কারাগার ঘোচা কেন? দেহই তো যত জঞ্জালের গোড়া। দেহটা ঘুচে যাওয়া উচিত ছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহ ধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। (সকলের হাস্য) পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।
মণি — যে বাণটা ছোঁড়া গেল, তার উপর কোনও আয়ত্ত থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেহের সুখ-দুঃখ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান, ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে সে ঐশ্বর্য কখনও যাবার নয়। দেখ না, পাণ্ডবের অত বিপদ! কিন্তু এ-বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। তাদের মতো জ্ঞানী, তাদের মতো ভক্ত কোথায়?"
তবে ঠাকুরের মতন ত্যাগীশ্বর পাওয়া তো আর চট করে সম্ভব নয় কারণ তিনি স্বয়ং পরমব্রহ্ম। কথামৃতে ঠকুরের একটি ঘটনার কথা উল্লেখিত আছে, যা আমাদের সকলকে এই 'আমি'র বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখায়। জীবন থেকে লোভ বাদ দিতে পারলেই মনের ওপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ এসে যায়। আর মন একবার বশে এলে সে অন্তর্মুখী হতে বাধ্য। লক্ষ্মীনারায়ণ নামক একজন মাড়োয়ারী সৎসঙ্গী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন। ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বেদান্তের বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠাকুরের সঙ্গে ধর্মপ্রসঙ্গ করে ও তাঁর বেদান্ত সম্পর্কিত আলোচনা শুনে তিনি বড়ই প্রীত হন। পরিশেষে ঠাকুরের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় বলেন, "আমি দশ হাজার টাকা আপনার সেবার নিমিত্ত দিতে চাই।" ঠাকুর এই কথা শোনবামাত্র, মাথায় দারুণ আঘাত লাগলে যেমন হয়, মূর্ছাগতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি প্রকাশ ক'রে বালকবৎ হয়ে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, "শালা, তুম্ হিঁয়াসে আভি উঠ্ যাও। তুম্ হামকো মায়াকা প্রলোভন দেখাতা হ্যায়?" উক্ত মাড়োয়ারী ভক্ত একটু অপ্রতিভ হয়ে ঠাকুরকে বললেন, "আপ্ আভি থোড়া কাঁচা হ্যায়।" তার উত্তরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, "ক্যায়সা হ্যায়?" মাড়োয়ারী ভক্ত বললেন, "মহাপুরুষ লোগোকোঁ খুব উচ্চ অবস্থা হোনেসে ত্যাজ্য গ্রাহ্য এক সমান বরাবর হো যাতা হ্যায়, কোই কুছ্ দিয়া অথবা লিয়া উসমে উনকা চিত্তমে সন্তোষ বা ক্ষোভ কুছ্ নেহি হোতা।" ঠাকুর ঐ কথা শুনে ঈষৎ হেসে তাকে বোঝাতে লাগলেন, "দেখ, আর্শিতে কিছু অপরিষ্কার দাগ থাকলে যেমন ঠিক ঠিক মুখ দেখা যায় না, তেমনি যার মন নির্মল হয়েছে, সেই নির্মল মনে কামিনী-কাঞ্চন-দাগ পড়া ঠিক নয়।" ভক্ত মাড়োয়ারী বললেন, "বেশ কথা, তবে হৃদয়, যে আপনার সেবা করে, না হয় তার নামে আপনার সেবার জন্য টাকা থাক।" তদুত্তরে ঠাকুর বললেন, "না, তাও হবে না। কারণ, তার কাছে থাকলে যদি কোন সময় আমি বলি যে অমুককে কিছু দাও বা অন্য কোন বিষয়ে আমার খরচ করতে ইচ্ছা হয়, তাতে যদি সে দিতে না চায় তখন মনে সহজেই এই অভিমান আসতে পারে যে, ও টাকা তো তোর নয়, ও আমার জন্য দিয়েছে। এও ভাল নয়।"
এই হলো আসল উপায়। গঙ্গাস্নান আক্ষরিক অর্থে পাপ ধোয়ার জন্য নয়, গোড়ার অজ্ঞান ধুয়ে ফেলার মানসিকতা তৈরি করার জন্য উপযোগী। অমরনাথের কষ্টকর দীর্ঘ চড়াই আর উৎরাই মন থেকে অভিমান মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন। আর দরকার খুব করে প্রার্থনা, নিরন্তর তাঁর কৃপা প্রার্থনা। তাঁর কৃপা হলে কর্মফল ভোগ তো কোন ছাড়, জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকেই স্থায়ী ছুটি পাওয়া যেতে পারে। ঠাকুর তাঁর গোটা মর্তলীলা জুড়ে লোককে ডেকে ডেকে, তাদের প্রার্থনাস্থলে গিয়ে, মায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি পর্য্যন্ত গিয়ে মুক্তির পথই দেখিয়ে গেছেন।
সবাইকে শ্রীরামকৃষ্ণ জয়ন্তীর শুভেচ্ছা।
No comments:
Post a Comment