আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা, চৈতন্য মহাপ্রভুর ধরাধামে পুণ্য আবির্ভাব তিথি। আজ সত্য, প্রেম, ক্ষমা, ধৈর্য্য, কৃপা, অনুকম্পা, অনুরাগ, সমর্পণ আর মুক্তিকে উজ্জাপন করার শুভদিন। অন্য এক যুগে আজকের এই তিথিতেই ব্রহ্মরূপী শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ব্রহ্মশক্তি শ্রীমতি রাধারাণী ও জীবরূপী ভক্তকুল গোপিনীদের সাথে নানান দৈবীগুণের প্রতীক হিসেবে নানা রঙের গুলাল নিয়ে হোলি খেলে সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। এই হোলি শব্দটি এসেছে 'হোলিকা' নামের এক দৈত্যকন্যার নাম থেকে। গল্পটা হয়তো সবার জানা, তবুও বারবার শুনতে মন্দ লাগে না।
এ আরো আগের এক যুগের ঘটনা। হোলিকা ছিলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন। একসময় তিনি কঠোর তপস্যা করে এমন একটি চাদর পেয়েছিলেন যেটি পরে থাকলে আগুন আর তাঁকে পোড়াতে পারবে না। হিরণ্যকশিপু নিজেও আবার দীর্ঘদিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে বারবার দেবলোক আক্রমণ করছিলেন। আসলে দেবত্বের ওপর অসুরত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা তো আর আজকের ব্যাপার নয়, এ চিরকালীন। তাই তো 'ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে'। যাইহোক, রাজার নিজের ঘরেই এক মস্ত বড় সমস্যা ছিল - তাঁর নিজের ছেলে প্রহ্লাদ। তিনি শিশু হলে কি হবে, আজন্ম পরম বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, মূর্তিমান বিবেক। যতবার রাজা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন ততবার বিষ্ণুর আশীর্বাদে তা ব্যর্থ হয় আর প্রহ্লাদ বেঁচে যান। শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে হিরণ্যকশিপুর মনে পড়ে হোলিকার বরের কথা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হিরণ্যকশিপু হোলিকার কোলে বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলেন। প্রহ্লাদ ছোট ছেলে, কি আর করবেন? দাউদাউ অগ্নিশিখার মধ্যে চুপচাপ বসে শুধু একমনে ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে যাচ্ছেন। যাঁর ওপর ঈশ্বরের কৃপা আছে, তাঁকে ছোঁবে এমন সাধ্যি যে স্বয়ং অগ্নিদেবেরও নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কি না হতে পারে? ফলে বিষ্ণুর কৃপায় ভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত থেকে গেলেন আর বর পাওয়া স্বত্তেও হোলিকা পুড়ে ছাই।
গতকাল সারা দেশ জুড়ে প্রতীকী হোলিকা দহন করা হয়েছে, যাকে আমরা নেড়াপোড়া বলি। হিংসা, দ্বেষ, লোভ, মদ, মৎসর্য্য, ক্রুরতা, নিচতা ইত্যাদি সমস্ত আসুরিক প্রবৃত্তিকে দমন করে আজকের দিনে নিজেদের মধ্যে দৈবত্বকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই আমরা এই হোলি উৎসব পালন করছি। আমাদের বাংলায় অবশ্য হোলিকে গৌড়ীয়বৈষ্ণবধারা অনুযায়ী দোলযাত্রা বলা হয় কারণ প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রার অনুকরণে এইদিন মন্দির থেকে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে বের করে এনে, আবিরে রাঙিয়ে, দোলায় চড়িয়ে কীর্তন করতে করতে সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে আসার যে প্রথা এখানে চালু হয়েছিল, তার থেকেই লোকের মুখে মুখে হোলি একসময় দোল হয়ে গেছে। মূল কথা হচ্ছে 'every man is potentially divine', স্বামীজীর বাণীর সেই স্পিরিটটাকে হৃদয়ে ধারণ করা আর মনুষ্যত্বের রঙে নিজেদের মনকে রাঙিয়ে নেওয়ার দিন আজ, যাতে চেষ্টা চালিয়ে গেলে আমরা প্রত্যেকেই একদিন না একদিন দেবত্বে উন্নীত হতে পারি।
শুভ দোলযাত্রা।
No comments:
Post a Comment