আমাদের মতন explorer সংসারীদের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব বারেবারে চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, মাঝেমাঝে সাধুসঙ্গ করো, মাঝেমাঝে নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করো, মনে মনে বিচার করো আর প্রার্থনা করো যাতে তিনি ভক্তি-বিশ্বাস দেন। ঠাকুর বলছেন, "বদ্ধ জীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না। যদি অবসর হয় তাহলে আবোল তাবোল ফালতো গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে। জিজ্ঞাসা করলে বলে আমি চুপ করে থাকতে পারিনা, তাই বেড়া বাঁধছি। হয়তো সময় কাটে না। দেখে তাস খেলতে আরম্ভ করে।" যা যা ঠাকুর করতে বলেছেন সেগুলির প্রত্যেকটির এক একটা উল্টোদিক আছে, যেগুলি বর্জনীয়। অসাধু সঙ্গ ত্যাগ করো, সবসময় কোলাহলের মধ্যে থেকো না, আসক্তি আর বাসনার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেও না আর শুকনো বইপড়া জ্ঞানের পেছনে না দৌড়ে, সীমিত বুদ্ধি দিয়ে Abstarct এবং Impersonal-কে বুঝতে চেষ্টা না করে, ভক্তি এবং বিশ্বাসকে ধরে এগোবার চেষ্টা করো কারণ সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ। আর কি বলছেন? বলছেন খামোখা আড্ডা মেরে, পার্টি করে, হাহা হিহি করে, নাচানাচি করে সময় নষ্ট করো না, যে কাজের জন্য এতগুলো যোনির মধ্যে বিরলতম মানুষের শরীর ও মস্তিষ্ক লাভ করেছ, সময় থাকতে সেই আসল কাজে লেগে পড়ো।
নারদীয় ভক্তিসূত্রে ৪৬ নং সূত্রে নারদমুনি বলছেন 'কস্তরতি কস্তরতি মায়াম? যঃ সঙ্গাংস্ত্যজতি, যো মহানুভবং সেবতে, যো নির্মমো ভবতি।' কস্তরতি মানে কঃ তরতি অর্থাৎ কে পেরিয়ে যায়? Emphasise করার জন্য মুনি দুবার জিজ্ঞেস করছেন, কে পেরিয়ে যায় কে পেরিয়ে যায়? কি অতিক্রম করে? না, মায়া। তারপর উত্তর দিচ্ছেন, যে অসৎ সঙ্গ আর আসক্তি দুটোই ত্যাগ করে, যে মহৎ ব্যক্তির সেবা বা সঙ্গ করে আর সেটা করতে করতে যে নির্মম হতে শেখে বা সোজাকথায় ধীরে ধীরে মোহমুক্ত, মমত্বত্যাগী এবং নিরহঙ্কারী হয়ে ওঠে। ওই একই কথা, যা ঠাকুর বলছেন। যে সঙ্গ তোমায় রিপুর দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা কুসঙ্গ - তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করো। সুসঙ্গ কি? না মহৎব্যক্তির সঙ্গ, সাধুসঙ্গ। ঠাকুর বলতেন, "সাধুকে দিনে দেখবি রাতে দেখবি তবে বিশ্বাস করবি"। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি ।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ।। ৫.৩
অর্থাৎ, তাঁকেই নিত্যসন্ন্যাসী বলে জানবে, যিনি রাগদ্বেষ রহিত, কারণ হে মহাবাহাে, যিনি দ্বন্দ্বমুক্ত, তিনিই সহজে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হন।
এখন সাধুসঙ্গ করলে কি হয়? যত তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তত তাঁদের জীবনবোধ, তাঁদের ধর্মবোধ আর তাঁদের আধ্যাত্মিক শক্তি সংসারী ব্যক্তির ভাবনাচিন্তাকে postively influence করতে শুরু করে। আমাদের নিরিখে সামাজিক প্রতিষ্ঠায়, প্রতিপত্তিতে এবং প্রভাবে যিনি হয়তো কোনো তুলনাতেই আসেন না, যিনি হয়তো কপর্দকশূন্য, হয়তো recluse, তাঁর প্রতি আমি আকৃষ্ট হবো কেন, কেন তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হবো? কারণ তাঁর কাছে সেটা আছে যা আমার পরিচিত বৃত্তের মধ্যে কারো কাছে নেই। ঠাকুর যেমন বলতেন, "যার কাছে গুড়ের নাগরি আছে, সে যদি রােগীকে বলে, 'গুড় খেয়াে না', রােগী তার কথা তত শুনে না।" সাধুর কাছে গুড় নেই, অমৃত আছে, তাই তাঁর কথা শুনবো, সেগুলি নিয়ে ভাববো, সত্যাসত্য বিচার করবো। নারদমুনি বলছেন 'লভ্যতেহপি তৎকৃপয়ৈব' (ভক্তিসূত্র, ৪০) অর্থাৎ ঈশ্বরের কৃপা থাকলেই সাধুসঙ্গ লাভ হয়। সেইজন্যে প্রার্থনা করতে হয়। তারপরের ৪১নং সূত্রতেই বলছেন, 'তস্মিংস্তজ্জনে ভেদাভাবাৎ'। এখানে তস্মিন্ মানে ভগবান, তজ্জনে মানে ভক্ত আর ভেদাভাবাৎ মানে ভেদের অভাব। অর্থাৎ ভগবান ও তাঁর ভক্তের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই বলেই একের অনুগ্রহেই অপরের অনুগ্রহ পাওয়া যায় (পূজ্যপাদ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ কৃত ভাবানুবাদ)। এঁদের সঙ্গ পেলে মনে বিচার উঠতে শুরু করে, 'আমি কে'? ওইখান থেকেই আধ্যাত্মপথে যাত্রার শুরু।
এইবার আসল কথা - ভক্তি। ঠাকুর বলছেন, "একটা পথ দিয়ে ঠিক যেতে পারলে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তখন সব পথের খবর জানতে পারে। যেমন একবার কোন উপায়ে ছাদে উঠতে পারলে, কাঠের সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; পাকা সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; একটা বাঁশ দিয়াও নামা যায়; একটা দড়ি দিয়াও নামা যায়"। ভক্তি যেমন একটা পথ, তেমনি একটি পাথেয়ও বটে। নারদ বলছেন, ভক্তি স্বয়ংই ফলরূপা, স্বয়ং ফলরূপতা ইতি ব্রহ্মকুমারঃ (ভক্তিসূত্র, ৩০)। কেন সাক্ষাৎ ফল না বলে ফলরূপা বলছেন? পরম পূজনীয় ভূতেশানন্দজী বুঝিয়ে দিচ্ছেন, 'যে কোনো কর্মের ফল হচ্ছে উৎপন্ন বস্তু। কিন্তু ভক্তি উৎপন্ন বস্তু নয়, ভক্তি আমাদের অস্তিত্বের, আমাদের স্বত্তারই উপাদান। কর্ম বা সাধন দ্বারা যে বস্তু লাভ করি তা আবার বিনষ্ট হতে বাধ্য। ...কিন্তু যদি কেউ একবার ভক্তি লাভ করেন, সে ভক্তির আর ক্ষয় নেই। এইটি বোঝানোর জন্য ফলরূপা বলা হয়েছে'। ভক্তির মূল element হলো প্রেম বা ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থগন্ধ নেই। যাঁকে ভালোবাসি তাঁকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করতে পারলেও ক্ষতি নেই, তাতে ভালোবাসার টান একটুও কমে না। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, "কোন কামনা-বাসনা রাখতে নাই কামনা-বাসনা থাকলে সকাম ভক্তি বলে! নিষ্কাম ভক্তিকে বলে অহেতুকী ভক্তি। তুমি ভালবাসো আর নাই বাসো, তবু তোমাকে ভালবাসি। এর নাম অহেতুকী।" নারদীয় ভক্তিসূত্র ব্যাখ্যা করে পরম পূজনীয় ভূতেশানন্দজী বলছেন 'ভক্তি শব্দটির মধ্যে সাধন-সাধ্য দুটি ভাবই আছে। ...ভক্তির চরম অবস্থাই ভক্তের পরম সাধ্যবস্তু। ...ভক্তের কিছু ত্যাগ করতে হয়না। ...কারণ তিনি দেখেন অন্যভাবে। তিনি যা কিছু দেখেন সবই তাঁর কাছে ঈশ্বর। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি আমাকে তথা বিশ্বজগৎকে ব্যাপ্ত করে আছেন। তিনি ছাড়া কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নেই।'
মজাটা হলো, যোগ বা জ্ঞানের পথে চললেও অনেক ঠোক্করটোক্কর খেয়ে অবশেষে ঠিক এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয় যে তিনি ছাড়া আর কিছু নেই, সবই ব্রহ্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিজ্ঞানী কেন ভক্তি লয়ে থাকে? এর উত্তর এই যে, ‘আমি’ যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের ‘অহং’ যায় না। অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁক্ড়ি বেরিয়েছে। (সকলের হাস্য)
“জ্ঞানলাভের পরও আবার কোথা থেকে ‘আমি’ এসে পড়ে! স্বপনে বাঘ দেখেছিলে, তারপর জাগলে, তবুও তোমার বুক দুড়দুড় করছে। জীবের আমি লয়েই তো যত যন্ত্রণা। গরু ‘হাম্বা’ (আমি) ‘হাম্বা’ করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। লাঙলে জোড়ে, রোদবৃষ্টি গায়ের উপর দিয়ে যায়, আবার কসাইয়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়, ঢোল হয় — তখন খুব পেটে। (হাস্য)
“তবুও নিস্তার নাই। শেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈয়ার হয়। সেই তাঁতে ধুনুরীর যন্ত্র হয়। তখন আর ‘আমি’ বলে না, তখন বলে ‘তুঁহু’ ‘তুঁহু’ (অর্থাৎ ‘তুমি’, ‘তুমি’)। যখন ‘তুমি’, ‘তুমি’ বলে তখন নিস্তার। হে ঈশ্বর, আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ছেলে, তুমি মা।
“রাম জিজ্ঞাসা করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পুর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।
“সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, পঞ্চম পরিচ্ছেদ, ১৮৮২, ৫ই অগস্ট)